ওয়েস্টার্ন উপন্যাস নিয়ে স্মৃতিচারণমূলক লেখাটি লিখেছেন ইশতিয়াক হাসান
শীতের মিষ্টি সকালে, জানালা গলে এক ফালি রোদ এসে পড়ছে আমার চোখে-মুখে, হাতের খোলা বইটায়। আরামদায়ক এই পরিবেশে নানার বাড়ির বারান্দা লাগোয়া সাত ফুট বাই ছয় ফুট ছোট্ট রুমে শুয়ে থাকা আমি গন্ডি পেরিয়ে হারিয়ে গিয়েছি অন্য এক জগতে। দীর্ঘ-আকাশছোঁয়া পাহাড়সারি, ধূ ধূ মরুভূমি, সীমান্ত শহরের ধূলি-ধূসরিত রাস্তা, সেল্যুনে গ্লাসের টুংটাং, হঠাৎ মাথায় হ্যাট চাপানো রুক্ষ চেহারার কাউবয়ের খিস্তি-খাউর, আচমকা দুই পিস্তলবাজের গোলাগুলি কিংবা ঘোড়ায় টানা ওয়াগনের শহরপ্রবেশ যেখানকার পরিচিত চিত্র।
সত্যি সময়টা ছিল ওয়েস্টার্ন এ বুদ হয়ে থাকার। সেবাই আশ্চর্য এই স্বাদ আস্বাদনের সুযোগ করে দিয়েছে আমাকে, আমাদের। ঠিক কোন ওয়েস্টার্নের মাধ্যমে বুনো পশ্চিমের ওই জগতে পদার্পন তা আর মনে নেই, তবে সম্ভবত ক্লাস ফাইভে পড়ি তখন। নানার বাড়ির বইয়ের আলমারির গল্প আগের এক লেখায় বলেছি, ওখানকার কোনো একটি বই দিয়ে শুরুটা সন্দেহ নেই। কারণ আমাদের বাসায় আব্বুর সংগ্রহশালায় কোনো ওয়েস্টার্ন ছিল না।
তবে ওয়েস্টার্নের প্রতি সত্যিকারের টানটা মনে হয় ক্লাস সিক্সে পড়ার সময়। তখন ব্রাক্ষণবাড়িয়ায় থাকি। গলির মধ্যে সোলায়মানীয়া লাইব্রেরিতে ঢু মারতাম ওয়েস্টার্নের খোঁজে। ওই লাইব্রেরি নিয়ে বিস্তারিত বলব তিন গোয়েন্দা নিয়ে কোনো লেখায়। ওখান থেকে কেনা বইয়ের মধ্যে এপিঠওপিঠ আর রাইডারের নাম এখনো মনে আছে।
এদিকে আমাদের বাসার কাছেই ছিল নোমান ভাইদের বাসা। ওয়েস্টার্ন, হেনরি রাইডার হ্যাগার্ডসহ নানান সেবার বইয়ে ভরপুর ছিল তাদের বিশাল দুটো ট্রাঙ্ক। তবে কথা হলো নোমান ভাই বই দিতে বেজায় ঘুরাতেন। আমি তাই কখনো কখনো তিনি বাড়িতে না থাকা অবস্থায় যেতাম। গেট ঠেলে, হালকা উঠোন পেরিয়ে তার বাকি তিন ভাই-বোন জ্বিলানী ভাই কিংবা কল্যানী বা ভিক্টোরিয়া আপার যে কোনো একজনকে পেলেই কেল্লাফতে। আধো অন্ধকার ওই কামরাটায় নিয়ে যেতেন, যেখানে চাবি দিয়ে তালা খুললেই ঘর ভরে যেত বইয়ের অদ্ভুত সুবাসে, নাক ভরে ওটা টেনে নিয়ে পছন্দের বইয়ের খোঁজে পারলে ট্রাঙ্কের মধ্যে সেধিয়ে যেতাম।
এই নোমান ভাই ও ওয়েস্টার্ন নিয়ে আছে আরেক দুঃখস্মৃতি। তখন ঢাকা আসা হতো প্রায়ই। ফিরবার পথে রেলওয়ে বুক স্টল ক্যামলেট বা সৃজনী থেকে দুই-চারটা বই কেনা চাই। সৌভাগ্যক্রমে একবার পেয়ে গেলাম বাথান-১। হুয়ান কার্টেয স্যাবাডিয়ার বাথান সেবার সেরা ওয়েস্টার্নগুলোর একটি। কাজেই ওই এক খন্ডই কিনে নিলাম। তো ব্রাক্ষণবাড়িয়া ফিরতে ভিক্টোরিয়া বা কল্যাণী আপা মারফত বাথান-২ পেয়েও পড়লাম। তারপর নোমান ভাই একদিন উল্টো আমার কাছে বাথান-১ চাইলেন, বললেন তারটা হাতের নাগালে নেই, পড়ার তৃষ্ণা পেয়েছে বড়। দিলাম, ওই বই আর কোনোকালে ফেরত পাই নি, পরে জানতে পারি নোমান ভাইয়ের সংগ্রহশালায় বাথান-১ ছিল না!
আরেকটা স্মৃতি বেশ মনে পড়ছে। তখন রোযা। ক্লাস সেভেনে পড়ি সম্ভবত। ক্লান্তির কথা বলে, পড়ালেখায় বেশ ছাড়া পাওয়া যেত। নিজের সংগ্রহের ওয়েস্টার্নগুলো পড়া শেষ, নোমান ভাইদের ভান্ডার থেকে কোনো কারনে বই আনা যাচ্ছিল না। দাতিয়ারায় আমাদের বাসা থেকে মিনিট পনেরো হাঁটলেই আলাল ভাইদের বাসা। দুপুরের কড়া রোদে রোযা রেখে হেঁটে চলে যেতাম সেখানে। আলাল ভাইয়ের কাছে কিছু ওয়েস্টার্ন ছিল। একটা বই নিয়ে বাসায় এসে খিদা খিদা পেটে হারিয়ে যেতাম বহু আগের সেই বুনো আমেরিকায়! কী যে অদ্ভুত আনন্দময় ছিল ওই সময়ে ওয়েস্টার্ন পড়া। ওই দফায় পড়া বইগুলোর মধ্যে একটি ছিল মুক্তপুরুষ, যদ্দুর মনে পড়ছে।
ওয়েস্টার্নের এতো ভক্ত কেন হয়ে গেলাম? অনেকবারই নিজেকে জিজ্ঞেস করেছি। উত্তর যেটা পেয়েছি ওই বালক-কিশোর বয়সে ভিন্ন এক পরিবেশ, জায়গায় মধ্যে নিজেকে আবিষ্কার, কাহিনির নায়কদের অদ্ভুত সাহসিকতা, আউটলদের পিস্তলবাজি, কাউবয়দের ঘোড়ার পিঠে সওয়ার হয়ে আশ্চর্য জীবন, বিশাল সব রেঞ্চ, বুনো প্রকৃতি, মার্শাল-শেরিফ, পদে পদে উত্তেজনা সেই সঙ্গে রোমান্টিকতা সব মিলিয়ে কুপোকাত হয়েছি। অবশ্য এই আধ-বুড়ো বয়সে এখনো ওয়েস্টার্ন আমাকে টানে আগেরই মতো।
সবচেয়ে বেশি ওয়েস্টার্ন সংগ্রহ করেছি, এসএসসি পাশের পর ঢাকা সিটি কলেজে ভর্তি হওয়ার পর। নতুন নীলক্ষেত চেনা এই আমি সংঘাত, রূপান্তর, ভাগ্যচক্র, রত্নগিরি, পাতকীসহ কত বই কিনেছি সেখান থেকে। অবশ্য নতুন বইও যোগ হয়েছে তখন বিভিন্ন দোকান থেকে আমার সংগ্রহে। এই সুযোগে বাথানের দুটো খন্ডই বইয়ের আলমারিতে নিয়ে আসতে পারলাম। নানার সংগ্রহের বুনো পশ্চিম ও ওয়েস্টার্ন ভলিউম ১ নিজের করে নিয়েছি। নানা ঢাকা এসে হেঁটে হেঁটে সেবায় গিয়ে যেসব বই কিনেছেন তার একটি এই ভলিউমটা।
ওয়েস্টার্নে কোন চরিত্র প্রিয় এটা বলতে গেলে বেশ ধন্দে পড়তে হয়! কোনটা ফেলে কোনটা বলব বুনো পশ্চিমের টম প্রেস্টন, ফেরার হ্যারি কার্টার, আলেয়ার পিছের এরফান জসাপ(এরফানকে নিয়ে বেশ কয়েকটা বই লেখা হয় পরে তবে আমার মনে জায়গা করে নেয় ওই আলেয়ার পিছেই), বাথান-ছায়াশত্রুর সাবাডিয়া, ভাগ্যচক্রের ড্যান, রূপান্তরের গর্ডন ফেবলস, ওরিন-অ্যানজেল-নোয়েল ওসমান, রক বেননসহ আরো কত প্রিয় নায়ক আমার অন্তরে এখনো জীবিত!
বুনো পশ্চিমের টম প্রেস্টনের সেই সহকারী মাস্টাং উইলিয়ামস কিংবা এপিঠওপিঠের খারাপ মানুষের মুখোশ পড়ে থাকা ভালো মানুষ ফোবিয়ানের কথা কীভাবে ভুলি! প্রিয় নায়িকা চরিত্রের অভাব নেই। রাকা ওয়েস্ট,বেলিন্দা, নোরা, ড্রুসিলা….
বিশ্বাস করবেন ওয়েস্টার্ন পড়ে কেঁদেছিও অনেক! ওই যে বুনো পশ্চিমে ল্যারি ওব্রায়েন টম প্রেস্টনের গুলি খেয়ে যখন বলেছিল, টম তুমি সত্যি শিখেছ, ছোট্ট শিশুর মতো ভেউ ভেউ করে কেঁদেছি। এখনও আবার পড়তে গেলে চোখের জল লুকাতে হয়! কিংবা আমার প্রিয় বাস্তবের চরিত্র বিলি দ্য কিডের পেট গ্যারেটের হাতে মারা পড়ার খবর যখন কোনো একটা ওয়েস্টার্ন বইয়েই পড়েছি (সম্ভবত ভাগ্যচক্র, পরে অবশ্য রুদ্র সীমান্তসহ আরো কোনো কোনো বইয়েও ছিল তথ্যটা) হু হু করে উঠেছে বুকটা। তেমনি ফেরায় রিগার মলিনা, সহযাত্রীতে কুপারের হাতে হেনরির মৃত্যুও কষ্ট দিয়েছে।
আমার মার্কিন মুল্লুকে একবার ঢু মারার সাধের কারণও, ওয়েস্টার্ন বইয়ে পড়া পশ্চিমের সেই টেক্সাস, টেনিসি, অ্যারিজোনা, নিউ মেক্সিকো, কলোরাডোর মতো জায়গাগুলোয় ঢু মারা! কিংবা মিসিসিপি-মিসৌরি নদীর লঞ্চে চড়া আর বুনো পশ্চিমের আদলের সেই ঘোষ্ট টাউন কিংবা ইন্ডিয়ান বসতিগুলো দেখা! অবশ্য আমার আমেরিকাপ্রবাসী বোন নির্ঝর ও কাজিন নাহিদ ভাইয়া লেখাটা পড়ে থাকলে, ওদের দেখার চিন্তা বাদ দিয়ে ওয়েস্টার্ন বইয়ের ফাঁদে পশ্চিমে আসতে চাওয়ায় একটু মন কিংবা মেজাজ খারাপ করতে পারে!
যখন আমি নিজে সেবাতে বই রূপান্তর করা শুরু করি, তখন ওয়েস্টার্ন লেখার ইচ্ছাটা চেপে রাখি জোর করে, এই ভয়ে লেখাটা যদি নিজেরই ভালো না লাগে? তা ছাড়া মনের মতো কাহিনি এখন আর মিলবে কীভাবে? তেমনি আমি ওয়েস্টার্ন সিনেমাও খুব একটা দেখি না, পাছে বই পড়ে বুনো পশ্চিমকে যতোটা সুন্দরভাবে আবিষ্কার করেছি মুভি দেখে ততটা না করে মেজাজ খিঁচড়ে যায়!
পুরনো হেভিওয়েট ওয়েস্টার্ন লেখকদের মধ্য কাজী মাহবুব হোসেন ছিলেন আমার এক নম্বর পছন্দ। তবে দুর্ভাগ্য আমার সেবায় হানা দেওয়া শুরুর আগেই প্রিয় এরফান, টম প্রেস্টনদের জনক পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন। আরেক প্রিয় লেখক শওকত ভাইয়ের সঙ্গে অবশ্য পরিচয় হয়, রওশন জামিলের নাম্বারটা যোগাড় করেছিলাম! জানি না মাঝখানে দেশে আসা ওসমান পরিবার-সাবাডিয়ার কারিগর আবার আমেরিকায় পাড়ি জমিয়েছেন কিনা! পরের দিকের নামী ওয়েস্টার্ন লেখক মায়মুর ভাই, নঈম ভাই, আরমান ভাইয়ের সঙ্গেও আলাপ এমনকী অন্তরঙ্গতাও হয়েছে!
সত্যি আশ্চর্য এক জগতে আমাদের নিয়ে গিয়েছে সেবার ওয়েস্টার্ন। বুনো পশ্চিম, ভাগ্যচক্র, ফেরা, আলেয়ার পিছে, নীল নকশা, মার্সোনারি, রাইডার, প্রহরীর মতো বইগুলো পাঁচ-ছয়বার করে পড়েছি। সেবার পুরনো প্রায় সব এবং নতুন বেশিরভাগ ওয়েস্টার্ন আছে সংগ্রহে, সযতনে। এই লেখাটা লিখতে গিয়েও মনের চোখে ভেসে উঠছে রেড ইন্ডিয়ানদের গুপ্ত হামলা, সুন্দরী কোনো রেঞ্চ মালিককন্যার ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে ছুটে চলা কিংবা পশ্চিমের এক অখ্যাত রাস্তায় মুখোমুখি দুই পিস্তলবাজের ছবি। আজকের লেখাটায় ইতি টানতে হচ্ছে এখনই, কারণ অনেক দিন হয়ে গেল ওয়েস্টার্ন পড়া হচ্ছে না, মার্সোনারি নাকি ভাগ্যচক্র নিয়ে বসব টস করতে হবে যে!