ল্যাবএইড হাসপাতালের অর্থোপেডিক বিভাগের প্রধান ডা. এম আমজাদ হোসেনের পরামর্শ : কাঁধের জয়েন্টে ব্যথা বা ফ্রোজেন শোল্ডার এ করণীয়
ঘুমাতে গেলে বা একপাশ হয়ে শুতে গেলে বাঁ কাঁধে প্রচণ্ড ব্যথা হয়। ঘুমানোর শত চেষ্টা করেও অনেকে তা পারে না। প্রথম দিকে ব্যথা অল্প হলেও তা ক্রমান্বয়ে বাড়ে। বিশেষ করে কোনো জিনিস হাতে ওঠাতে গেলে বা কাঁধ ঘুরিয়ে পিঠ চুলকাতে গেলে ব্যথা অনুভূত হয় বেশি। এ ধরনের ব্যথাই ফ্রোজেন শোল্ডার। ফ্রোজেন শোল্ডার কাঁধের এমন একটা রোগ, যাতে ব্যথার মাত্রা আস্তে আস্তে বাড়তে থাকে এবং একসময় তা অসহনীয় হয়ে পড়ে। কাঁধের নড়াচড়াও অসম্ভব হয়ে পড়তে পারে। সাধারণত মধ্যবয়সীদের এই রোগ বেশি দেখা যায়।
কারণ
বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এর তেমন কোনো কারণ জানা যায়নি। তবে ডায়াবেটিস, হাইপারলিপিডেমিয়া বা শরীরে অতিরিক্ত মেদ, হাইপার থাইরয়েড, হৃদরোগ ও প্যারালাইসিস রোগীদের মধ্যে ফ্রোজেন শোল্ডারের প্রকোপ বেশি। কাঁধের অস্থিসন্ধির পর্দার ভেতরে ও বাইরের দিকে দুটি আবরণ থাকে। এই দুই আবরণের মাঝে কিছুটা ফাঁকা জায়গা থাকে, যেখানে এক ধরনের তরল পিচ্ছিল পদার্থ থাকে, যা কাঁধের মসৃণ নড়াচড়ার জন্য জরুরি। এই রোগ হলে ওই দুই পর্দার মাঝখানের স্থান ও পিচ্ছিল পদার্থগুলো কমে যায়। এতে কাঁধের নড়াচড়া সহজভাবে করা যায় না। ফলে প্রচুর ব্যথার সৃষ্টি করে, যা দিন দিন বাড়তে থাকে ও অসহনীয় হয়ে পড়ে।
পরীক্ষা-নিরীক্ষা
পরীক্ষা করলে দেখা যায়, রোগীর কাঁধের নড়াচড়া, বিশেষ করে হাত ওপরের দিকে উঠানো এবং হাত ঘুরিয়ে পিঠ চুলকানো প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। কখনো কাঁধ কিছুটা শুকিয়ে যাওয়ার মতো মনে হতে পারে। এটা হয় ব্যথার কারণে দীর্ঘদিন আক্রান্ত কাঁধ ব্যবহার না করলে। কাঁধের এক্স-রে করলে তা প্রায় স্বাভাবিক পাওয়া যায়। কোনো কোনো রোগীর ক্ষেত্রে সেখানে আগে আঘাত ছিল বলে জানা যায়, তবে সেটি খুব গুরুত্বপূর্ণ নয়। কিছু রোগীর ক্ষেত্রে হাত ঝিঁঝি করা, শক্তি কম পাওয়া, এমনকি পাশাপাশি হাত একদম উঠাতে না পারার মতো লক্ষণ দেখলে খুব সতর্কতার সঙ্গে পরীক্ষা করা উচিত যে রোগটি ফ্রোজেন শোল্ডার কি না। স্নায়ুরোগজনিত কোনো সমস্যা, নাকি অতীতের আঘাতের ফলে রোটেটর কাফ ছিঁড়ে যাওয়াজনিত কোনো সমস্যা। সে ক্ষেত্রে চিকিৎসার ধরনও ভিন্ন হবে।
ব্যায়াম
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ফ্রোজেন শোল্ডার ভালো হতে থাকে। কিছুটা সময় লাগলেও কোনো রকম অপারেশন ছাড়াই সঠিক ও বিশেষ কিছু ব্যায়ামের মাধ্যমে এই রোগ ভালো হয়ে যায়। জয়েন্টের ক্যাপসুল ও পেশিগুলো জমে যায় বলে যত বেশি নাড়ানো হবে, তত বেশি উপকার পাওয়া যাবে। এ জন্য ২৪ ঘণ্টার মধে ১৪ ঘণ্টাই নাড়াচাড়ার মধ্যে থেকে বাকি সময় ঘুমানো উচিত। কিছু ব্যায়াম রয়েছে, যা ঘরেই করা যায়। এগুলো রোগীকে দেখিয়ে দিলে বেশ কাজ হয়। কিছু ব্যায়াম হলো—
পেন্ডুলাম এক্সারসাইজ : এটি করার নিয়ম হলো, সামনের দিকে একটু ঝুঁকে হাত যতটা ঘোরাতে পারা যায়, সামনে-পেছনে করে ততটাই ঘোরাতে হবে। ঘড়ির কাঁটা যেদিকে ঘোরে, প্রথমে সেদিকে দশবার হাত ঘোরাতে হবে। এরপর ঠিক এর বিপরীত দিকে হাত ঘোরাতে হবে আরো দশবার। এভাবে দিনে দুইবার করে ব্যায়ামটি করতে হবে।
ওয়েট এক্সারসাইজ : পেন্ডুলাম এক্সারসাইজ করার দুই সপ্তাহ পর ওয়েট বিয়ারিং এক্সারসাইজ করা যেতে পারে। হাতে কিছুটা ওজন নিয়ে হাত ঘোরানোর এই ব্যায়াম শুরু করতে হয়। পেন্ডুলাম এক্সারসাইজের নিয়মেই করতে হবে এই ব্যায়াম। ঘড়ির কাঁটার দিকে দশবার এবং তার বিপরীত দিকে দশবার করে হাত ঘুরিয়ে করতে হবে। দিনে দুইবার করা যায় এই ব্যায়াম।
ওয়াল ক্লাইম্বিং এক্সারসাইজ : ওয়াল ক্লাইম্বিং এক্সারসাইজ ফ্রোজেন শোল্ডারের জন্য বেশ উপযোগী। একটি দেয়াল ধরে দেয়ালটি বরাবর ঠিক যতটা হাত ওঠানো যায়, ততটা উচ্চতায় হাত ওঠাতে হবে রোগীকে। ধীরে ধীরে অধিক উচ্চতায় হাত ওঠাতে চেষ্টা করতে হবে।
চিকিৎসা
ব্যথা কমানোর জন্য হালকা কিছু ব্যথানাশক দেওয়া যেতে পারে। ব্যায়াম বা ব্যথানাশকে কাজ না হলে কাঁধের অস্থিসন্ধিতে এক ধরনের স্টেরয়েড ইনজেকশন দিলে ভালো ফল পাওয়া যায়। অনেক রোগী এটি নিতে উদগ্রীব হলেও অবশ্যই একজন অর্থোপেডিক চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে দিতে হবে। এটি দেওয়ার মতো প্রয়োজনীয় দক্ষতা না থাকলে হিতে বিপরীত হতে পারে। এমনকি হাত অবশ হয়ে যেতে পারে বা শুকিয়ে যেতে পারে। একজন অর্থোপেডিক সার্জনই এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য ব্যক্তি। তবে ইনজেকশন দিলেও ব্যায়ামের কোনো বিকল্প নেই, যা সব সময় চালিয়ে যেতে হয়। তাই ফ্রোজেন শোল্ডার নামক অর্ধপঙ্গুত্ব নিয়ে বসবাস নয়, বরং উপযুক্ত চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ থাকুন।
লেখক : বিভাগীয় প্রধান ও চিফ কনসালট্যান্ট, অর্থোপেডিক ও অর্থোপ্লাস্টি সেন্টার, ল্যাবএইড স্পেশালাইজড হাসপাতাল