মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সাবেক সহযোগী অধ্যাপক ডা. মো. জিল্লুর রহমান খানের পরামর্শ : ভালো থাকুক মানসিক স্বাস্থ্য
মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা আসলে মস্তিষ্ক বা ব্রেনের সমস্যা। দেশে তুলনামূলকভাবে মানসিক রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। তবে এই রোগে চিকিৎসার অগ্রগতি সন্তোষজনক এবং সময়মতো চিকিৎসা নিলে সুস্থ থাকা যায়। লিখেছেন জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সাবেক সহযোগী অধ্যাপক ডা. মো. জিল্লুর রহমান খান
১৯৪৮ সালে দেওয়া বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সংজ্ঞা অনুযায়ী, স্বাস্থ্যের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ মানসিক স্বাস্থ্য। শারীরিক ও মানসিক উভয়ভাবে নীরোগ থেকে জীবন উপভোগ করা ও সাধ্য অনুযায়ী ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজে কিছু করতে পারার সক্ষমতাই মানসিক স্বাস্থ্য। কারো হয়তো মানসিক রোগ নেই। তার মানে এটা বলা যাবে না যে তার কোনো মানসিক সমস্যা নেই। তবে মানসিক স্বাস্থ্যহানি ও মানসিক রোগ এক বিষয় নয়; বরং এটি মানসিক রোগের একটি কারণ।
মানসিক রোগী কারা
কোনো ব্যক্তির মধ্যে যখন সুনির্দিষ্ট কিছু মানসিক ও শারীরিক লক্ষণ নির্দিষ্ট সময় ধরে থাকে এবং তখন ওই ব্যক্তির আচরণ, চিন্তাভাবনা ও আবেগ-অনুভূতির পরিবর্তন হয় এবং এ কারণে তার ব্যক্তিগত, পারিবারিক, পেশাগত ও সামাজিক জীবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তখন তাকে মানসিক রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি বা মানসিক রোগী বলা হয়। একে জটিল (সাইকোটিক ডিসঅর্ডার) ও মৃদু মানসিক রোগ (নিউরোটিক ডিসঅর্ডার)—এ দুই ভাগে ভাগ করা হয়।
জটিল মানসিক রোগীর লক্ষণ
❏ অস্বাভাবিক আচরণ ও কথাবার্তা।
❏ অতিরিক্ত রাগ, ভাঙচুরের প্রবণতা
❏ সন্দেহপ্রবণতা দেখা দেওয়া।
❏ গায়েবি কথা বা আওয়াজ শোনা।
❏ একা একা হাসা ও কথা বলা।
❏ খাবার ও পানিতে কিছু মেশানোর সন্দেহ।
❏ ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতার অভাব ইত্যাদি।
সাধারণত সিজোফ্রেনিয়া, ম্যানিয়া, প্রসবোত্তর মানসিক রোগ ইত্যাদি জটিল মানসিক রোগীর মধ্যে পড়ে।
মৃদু মানসিক রোগীর লক্ষণ
❏ বিষণ্নতা, উদ্বেগ, অবসেশন বা সূচিবায়ু রোগ।
❏ টেনশন, অস্থিরতা, বিষণ্নতা, হতাশা, নার্ভাসনেস।
❏ মন খারাপ, কাজে অনীহা, ভয়, আতঙ্ক।
❏ খিটখিটে মেজাজ।
❏ বারবার একই চিন্তা ও কাজ করা, বারবার দুঃস্বপ্ন দেখা।
❏ যৌন দুর্বলতা, শারীরিক ক্লান্তি।
❏ খুঁতখুঁতে স্বভাব ও শুচিবাই।
❏ মৃত্যুভীতি।
❏ দাম্পত্য কলহ ও অশান্তি।
মানসিক রোগের শারীরিক লক্ষণ
❏ দীর্ঘমেয়াদি মাথা ব্যথা, ঘাড়, বুকসহ শরীরের বিভিন্ন স্থানে ব্যথা ও জ্বালাপোড়া।
❏ মাথা ঘোরা, বুক ধড়ফড়, হাত-পা ঝিনঝিন।
❏ খাবারে অরুচি।
❏ হঠাৎ শ্বাসকষ্ট, খিঁচুনি, কথা বন্ধ, অবশ লাগা।
❏ ঘুমের সমস্যা।
শিশু-কিশোরদের মানসিক রোগের লক্ষণ
❏ বিছানায় প্রস্রাব করা
❏ অতিচঞ্চলতা
❏ অবাধ্যতা
❏ স্কুলভীতি, পরীক্ষাভীতি, স্কুল পালানো, পড়াশোনায় অমনোযোগী
❏ ভুলে যাওয়া, ফলাফল খারাপ
❏ অসামাজিক আচরণ
❏ মাদকাসক্তি
❏ সহিংসতা ও ভাঙচুর
❏ আত্মহত্যার চেষ্টা, নিজের শরীরে আঘাত
প্রবীণদের মানসিক রোগের লক্ষণ
❏ বিষণ্নতা, উদ্বেগ, অস্থিরতা
❏ স্মরণশক্তি কম, স্মৃতিভ্রম (ডিমেনশিয়া) ইত্যাদি।
কারণ
অন্যান্য অসংক্রামক রোগের মতো বিভিন্ন কারণে মানসিক রোগ বা মানসিক স্বাস্থ্যহানি হতে পারে। এর মধ্যে কিছু কারণ হলো—
❏ জেনেটিক বা বংশগত। অর্থাৎ বংশে কারো থাকলে হতে পারে।
❏ শারীরিক বা জৈবিক কারণ যেমন—মস্তিষ্কের গঠন ও নিউরোকেমিক্যালের তারতম্য। যেকোনো শারীরিক রোগ, যেমন উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ, হরমোনজনিত, স্নায়বিক ও অন্যান্য রোগ থাকলে মানসিক সমস্যা বাড়ার আশঙ্কা বেশি থাকে।
❏ পারিবারিক পরিবেশ (সহিংসতা, নির্যাতন, দ্বন্দ্ব, অশান্তি)।
❏ ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব
❏ মানসিক গঠনে সমস্যা
❏ চাপ মোকাবেলার দক্ষতার অভাব ইত্যাদি।
এ ছাড়া শহুরে জীবনযাত্রা, অতিমাত্রায় ইন্টারনেটের ব্যবহারে মানসিক চাপজনিত রোগ, মাদকাসক্তি ও আচরণগত সমস্যা, অপরাধপ্রবণতা অন্যতম কারণ।
চিকিৎসা
মানসিক রোগ চিকিৎসার বর্তমান অগ্রগতি এককথায় বিস্ময়কর। উন্নত দেশে মানসিক রোগ চিকিৎসায় ব্যবহৃত ওষুধের ৯৯ শতাংশ এ দেশে তৈরি হয়, যা মনোচিকিৎসকরা সাফল্যের সঙ্গে প্রয়োগ করছেন। তাই—
❏ কারো কোনো ধরনের মানসিক সমস্যা দেখা দিলে রেজিস্টার্ড চিকিৎসক ও মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ ও সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে হবে।
❏ ওষুধ ও সাইকোথেরাপি—এ দুয়ের সমন্বয়ে মানসিক রোগের আধুনিক চিকিৎসা দেশেই রয়েছে।
❏ ইলেকট্রকনভালসিভ থেরাপিও (ঊঈঞ) বেশ কার্যকর। অনেকে এটাকে শকথেরাপি বলে অহেতুক ভীতির সৃষ্টি করে। অথচ বৈজ্ঞানিক গবেষণায় এর কার্যকারিতা, মানবদেহে সহনীয় ও নিরাপদ ব্যবহারের সফল প্রমাণ পাওয়া গেছে।
কিছু ভ্রান্ত ধারণা
বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো আমাদের দেশেও মানসিক রোগ এবং এর চিকিৎসার ব্যাপারে বেশ কিছু ভ্রান্ত ধারণা ও নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি প্রচলিত আছে। অথচ এসবের কোনো ভিত্তি নেই এবং আধুনিক চিকিৎসা গ্রহণের পথে সবচেয়ে বড় বাধা এই নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি। যেমন—
❏ কারো অস্বাভাবিক আচরণ মানে তাকে জিনে বা ভূতে ধরেছে বা জাদুটোনা করা হয়েছে। অথচ এটা একটা ভ্রান্ত ধারণা।
❏ মানসিক রোগী মানেই তিনি পাগল। এটা মারাত্মক ভুল ধারণা।
❏ অনেকে বেশ চুপচাপ থাকেন এবং সচরাচর কারো ক্ষতি করেন না বলে সাধারণত তাদের চিকিৎসা করানো হয় না। এটা কিন্তু মোটেও ঠিক নয়। এসব লোকের সমস্যা নিউরোবিক, যার ভালো চিকিৎসা রয়েছে।
❏ মানসিক রোগী কখনো ভালো হয় না—এটাও একটা ভুল ধারণা। বরং প্রাথমিকভাবে রোগ শনাক্ত করে চিকিৎসা নিলে বেশির ভাগ রোগীই পরিপূর্ণ সুস্থ হয়।
❏ অনেকে মনে করেন, মানসিক রোগের ওষুধ দীর্ঘদিন খেতে হয় এবং তা ব্রেনের ক্ষতি করে। বিষয়টা আসলে তা নয়। অন্যান্য রোগের মতো সব ওষুধেরই সাইড ইফেক্ট থাকে। তাই বলে ওষুধকে দায়ী করে তা বাদ দেওয়া যাবে না।
❏ মানসিক রোগ চিকিৎসায় ব্যবহৃত ওষুধগুলো শুধু ঘুমের আসক্তি তৈরি করে। প্রকৃত সমস্যার সমাধান করতে পারে না। এটি ভুল ধারণা, যার বিজ্ঞানভিত্তিক প্রমাণ নেই।
❏ মানসিক রোগীকে হাসপাতালে বেঁধে রেখে চিকিৎসা দেওয়া হয় না। এটা বরং আধুনিক চিকিৎসানীতির পরিপন্থী। বর্তমানে কমিউনিটিভিত্তিক আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতিই সবচেয়ে কার্যকর। তবে বিশেষ প্রয়োজনে নির্দিষ্ট মেয়াদে হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়ে এরপর নিজ পরিবার ও সমাজে ফিরে সাধারণ নাগরিকের মতো বসবাস করতে পারেন এবং ওই এলাকায় অবস্থিত চিকিৎসাকেন্দ্র থেকেই চিকিৎসা নিতে পারেন। মানসিক স্বাস্থ্য
https://www.youtube.com/watch?v=AoO_iZhlnGs&fbclid=IwAR3YHQ3alDWe7F8HJuHn_RQG0g5HYZ6qBWBydooV2_lgdFpB8WJ1sAFD14s