বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, জীবনযাত্রা যত আধুনিক হচ্ছে হার্টের অসুখে আক্রান্তের হার তত বাড়ছে। প্রতিবছর শুধু হার্টের অসুখে বিশ্বজুড়ে মারা যায় প্রায় দেড় কোটি মানুষ, যা উন্নত বিশ্বের মোট মৃত্যুর প্রায় ৪৫ শতাংশ এবং উন্নয়নশীল দেশগুলোর মোট মৃত্যুর প্রায় ২৫ শতাংশ।
বাংলাদেশে প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে উচ্চ রক্তচাপ ১০-২০ শতাংশের, করোনারি বা ইস্কিমিক হৃদরোগ ১০ শতাংশের আছে। এ ছাড়া প্রতি এক হাজারে ১ দশমিক ৩ জনের বাতজ্বরজনিত হৃদরোগ ও প্রতি হাজারে আটজন নবজাতক শিশুর জন্মগত হৃদরোগ রয়েছে।
হৃদরোগ বিভিন্ন রকমের হতে পারে। যেমন- জন্মগত হৃদরোগ, বাতজ্বরজনিত হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপজনিত হৃদরোগ, হৃৎপিণ্ডে স্বল্প রক্ত চলাচলজনিত হৃদরোগ, হৃদপেশির দুর্বলতাজনিত হৃদরোগ। হৃদরোগ সাধারণত মারাত্মক হয় এবং এর চিকিৎসাও ব্যয়বহুল। কিন্তু প্রায় সব রকমের হৃদরোগের প্রতিরোধব্যবস্থা আছে। সময়মতো প্রতিরোধ ব্যবস্থা নিলে এসব রোগের হাত থেকে অনেকটাই রক্ষা পাওয়া সম্ভব। এমনকি কিছু ব্যবস্থা আছে যা গ্রহণ করলে জন্মগত হার্টের অসুখ থেকে অনাগত শিশুও মুক্ত থাকে। এগুলো আমরা অনেকেই জানি না বা গুরুত্ব দিই না।
জন্মগত হৃদরোগ প্রতিরোধের জন্য নিচের বিষয়গুলো মেনে চলা জরুরি।
* গর্ভধারণের পরিকল্পনা করার সময়ই নারীকে এমএমআর ইনজেকশন নিতে হবে। এটি রুবেলা ভাইরাস বা জার্মান মিসেলস রোগ থেকে রক্ষা করতে পারে। মনে রাখা দরকার, রুবেলা আক্রান্ত মায়েদের সন্তানরা প্রায়ই জন্মগত হার্টের অসুখ নিয়ে জন্মগ্রহণ করে।
* গর্ভকালীন বহু মা উচ্চ রক্তচাপ বা ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়। যার যথাযথ চিকিৎসা নেওয়া জরুরি। এমনিতেই যেসব মা উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিস আক্রান্ত তাঁদেরও গর্ভধারণের পরিকল্পনা করা মাত্র ডাক্তারের সঙ্গে রোগ দুটির নিয়ন্ত্রণবিষয়ক পরামর্শ গ্রহণ করতে হবে।
* গর্ভকালীন প্রথম তিন মাস খুব ঝুঁকিপূর্ণ। এ সময় এক্স-রে বা যেকোনো ধরনের তেজস্ক্রিয়তা থেকে দূরে থাকা উচিত। খুব জরুরি প্রয়োজনে এক্স-রে করা যায়, তবে তার আগে অনাগত শিশুর শরীরে যেন কোনোভাবেই এক্স-রে রশ্মি পড়তে না পারে তার যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এজন্য লেড অ্যাপ্রন পরিধান করা একটা উপায়।
* গর্ভবতী মায়েদের ধূমপান ও মদপান সম্পূর্ণ বাদ দিতে হবে। এমনকি যে ঘরে ধূমপান করা হয় সে ঘরেও তার বসবাস না করা উচিত।
* গর্ভকালীন বহু ওষুধ সেবন করা যায় না। অনেক ওষুধ অনাগত সন্তানের শারীরিক ত্রুটি তৈরি করে। তাই ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া কোনো ওষুধ সেবন করা যাবে না। এমনকি গাছগাছড়া বা এ ধরনের ওষুধও।
* মা-বাবার জেনেটিক কিছু ত্রুটির জন্য বাচ্চা জন্মগত হার্টের সমস্যা নিয়ে জন্মাতে পারে। বহু ক্ষেত্রে শিশু গর্ভে থাকাকালীনই তা নির্ণয় করে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া যায়।
অল্প বয়সে হার্টের অসুখে আক্রান্ত হওয়ার বড় কারণ রিউম্যাটিক ফিভার বা বাতজ্বর, যা প্রতিরোধ করা খুবই সহজ এবং কম খরচসাপেক্ষ। সাধারণত বাতজ্বর হয় গলাব্যথা সৃষ্টিকারী জীবাণু স্ট্রেপটোকক্কাস হিমোলাইটিকাসের জন্য। যদি ছোট শিশুদের গলাব্যথার চিকিৎসা যথাসময়ে অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োগে করা যায়, তাহলে বাতজ্বর প্রতিরেধ করা যায়। আবার বাতজ্বর হওয়ার পরও দ্রুত চিকিৎসা গ্রহণ করলে বাতজ্বরজনিত হার্টের কিছু অসুখ প্রতিরোধ করা যায়।
হৃৎপিণ্ডে স্বল্প রক্ত চলাচলজনিত কারণে যে ধরনের সমস্যা হয় সেটা খুবই মারাত্মক আকার ধারণ করতে পারে, যাকে সাধারণ ভাষায় হার্ট অ্যাটক বলা হয়। এ রোগে হার্টের রক্তনালিতে চর্বি জমে তা আংশিক বা পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যেতে পারে। হার্টের অংশবিশেষে রক্ত চলাচল ব্যাহত হতে পারে।
বংশগত কারণে এ ধরনের অসুখে বহু মানুষ আক্রান্ত হয়, যা আগে থেকে প্রতিরোধ করতে হলে খাদ্য গ্রহণ ও জীবনযাপনে সতর্ক হতে হবে। সাধারণভাবে হার্টের অসুখ এড়াতে নিচের পরামর্শগুলো মেনে চলা ভালো।
* শরীরের স্বাভাবিক ওজন বজায় রাখা। উচ্চতা, বয়স ও লিঙ্গভেদে যার জন্য আদর্শ যে ওজন তা ঠিক রাখতে হবে। বিশেষ করে যাদের ওজন আদর্শ ওজনের বেশি তাদের তা কমিয়ে গ্রহণযোগ্য পর্যায়ে আনতে হবে।
* থলথলে শরীর নয়, শরীর হতে হবে সুঠাম ও মেদহীন। এজন্য শারীরিক পরিশ্রম করতে হবে।
* ভুঁড়ি ও তলপেটের চর্বির আধিক্য হৃদরোগের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ (যেকোনো পরিস্থিতিতে পুরুষের কোমরের মাপ ৩৭ ইঞ্চির কম ও মহিলাদের ক্ষেত্রে ৩২ ইঞ্চির কম হওয়া উচিত)।
* বিএমআই (ওজন যত কিলোগ্রাম হবে, তাকে উচ্চতা যত মিটার তার বর্গ দিয়ে ভাগ করে) দেখতে হবে তা যেন ২৫-এর নিচে থাকে। এটা যত বেশি হবে, তত বেশি হবে হৃদরোগের ঝুঁকি। নিজে এটা বের করতে না পারলে ডাক্তারের সাহায্য নিন।
* ওজন যা-ই হোক, বেশি ক্যালরিসমৃদ্ধ খাদ্য বর্জন করতে হবে। বহু ক্ষেত্রে দেখা যায়, ওজন স্বাভাবিক আছে কিন্তু অতিরিক্ত ক্যালরি গ্রহণের ফলে লোকটি হার্টের অসুখে আক্রান্ত হচ্ছে।
* মদপান, সাদা-জর্দা, তামাক, ধূমপান করা যাবে না। এমনকি ধূমপান ছাড়ার ১০ বছর পর পর্যন্ত হার্টের অসুখে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থেকে যায়।
* অতিরিক্ত চা-কফি, ফাস্ট ফুড, টিনজাত ও শুকনো খাবার, কোমলপানীয় সবার জন্যই ক্ষতির কারণ।
* মহিলাদের জন্মনিয়ন্ত্রণ বড়ি, কায়িক পরিশ্রম কম করাও হৃদরোগের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ বলে বিবেচনা করা হয়।
* অনিদ্রা, টেনশন, ভয়, ক্রোধ, শোক, হতাশা, রাগ, প্রতিশোধপ্রবণতা, হিংসা-বিদ্বেষ, অশান্তি, উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় বা চেঁচামেচি (চিৎকার), অস্থিরতা, ক্ষমা করতে না পারা- এসব মানসিক চাপে হার্টের ভীষণ ক্ষতি হয়। দিনের পর দিন এ ধরনের পরিস্থিতিতে থাকলে হার্টের অসুখ হওয়ার ঝুঁকি বহুগুণ বেড়ে যায়।
* উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিস থাকলে তা অবশ্যই নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। এ জন্য সপ্তাহে এক দিন রক্তচাপ পরীক্ষা, মাসে একবার রক্তের সুগার পরিমাপ করা, তিন মাস পর পর লিপিড প্রোফাইল টেস্ট করে রক্তে চর্বির মাত্রা দেখা, ছয় মাস পর পর ইসিজি ও বছরে একবার করে ইটিটি করে হার্টের অবস্থা দেখা দরকার।
* লিপিড প্রোফাইলে চর্বির মাত্রা বেশি থাকলে চিকিৎসকের পরামর্শে নিয়মিত ওষুধ সেবন করতে হবে।
* যাঁদের বয়স চল্লিশের ওপরে তাঁরা অবশ্যই সুষম খাদ্য খাবেন, প্রাণিজ চর্বি (গরু, খাসি, হাঁস, বড় চিংড়ি, ডিমের কুসুম, কলিজা, মগজ, চামড়া, চর্বির টুকরো, ঘি, ডালডা, পনির ইত্যাদি) খাবেন না, তবে উদ্ভিজ্জ তেল (সয়াবিন, সূর্যমুখী, সরিষার তেল) ও সামুদ্রিক মাছ খাবেন। বাদাম হার্টের জন্য ভালো। প্রতি সপ্তাহে পাঁচ দিন ৩০ গ্রাম করে (ভেতরের লাল আবরণসহ) খেলে রক্তের ভালো কোলেস্টেরল (এইচডিএল) বাড়ে। বাদামের ভেষজ প্রোটিন, ফলিক এসিড, পটাসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, ফ্লাভোনয়েড, সেলিনিয়াম ও ভিটামিন-ই হৃদরোগ প্রতিরোধ করতে পারে বলে বহু গবেষণায় প্রমাণ পাওয়া গেছে।
* প্রতিদিন ৩০ মিনিট মুক্ত বাতাসে ব্যায়াম বা দ্রুত হাঁটতে হবে। খেলাধুলা, সাঁতার কাটা, সাইকেল চালানো, বাগান করা এবং অল্প দুরত্বে হাঁটাচলা করা হার্টের জন্য ভালো।
* মাদকাসক্তি হৃদরোগের কারণ। তাই কোনো ধরনের মাদকে আসক্ত হওয়া যাবে না।
* প্রচুর ফলমূল, শাকসবজি, তরকারি, আদা, মেথি, করলা, রসুন, টক ফল খাবেন। লবণ ও চিনি কম খান, টক দই খাবেন।
* দাম্পত্য সুখী সম্পর্ক, সামাজিক সুস্থ সম্পর্ক, ধর্মকর্ম, ধ্যানও হৃদরোগ প্রতিরোধ সহায়ক বলে বহু গবেষণায় দেখা গেছে।