বগুড়ার উডবার্ন গণগ্রন্থাগারে কাচের বাক্সে বন্দি তিনটি পাণ্ডুলিপি আজও রহস্য হয়েই রয়েছে। তিনশ বছর হয়ে গেলেও করা যায়নি পাণ্ডুলিপির পাঠোদ্ধার। এসব পাণ্ডুলিপির কথা শোনার পর বহু দফা এসেছেন গবেষকরা; নেড়েচেড়ে দেখে আবার আসবেন জানিয়ে ফিরে গেছেন। কিন্তু কেউ আর ফিরে আসেননি। ফলে কাচের বাক্সেই বন্দি হয়ে আছে পাণ্ডুলিপিগুলো।
সরেজমিন দেখা যায়, ধূসর বর্ণের কাগজের পাশগুলো অনেকটা পোকায় কাটা। তাতেই শোভা পাচ্ছে হাতের লেখা। লেখার ভাষা প্রাকৃত, পালি না সংস্কৃত—সেটিও নিশ্চিত করা যায়নি। যদিও ওই তিন পাণ্ডুলিপির মাথায় বাংলায় লেখা রয়েছে পৃথক তিনটি নাম। সেই নামগুলো হলো—পদ্মাপুরাণ, গোবিন্দ কথামৃত ও হিরণ্যকশিপুর। কাগজের ধরন দেখে গ্রন্থাগার সংশ্লিষ্টদের ধারণা, এসব তুলট কাগজ। সে হিসেবে ন্যূনতম তিনশ বছরের প্রাচীন এসব পাণ্ডুলিপি।
উডবার্ন গণগ্রন্থাগারের সহকারী গ্রন্থাগারিক আমির হোসেন জানান, ১৪ ইঞ্চি দৈর্ঘ্য ও ৩ ইঞ্চি প্রস্থের পদ্মপুরাণে রয়েছে ৮০০ পৃষ্ঠা। গোবিন্দ কথামৃত ১ হাজার পৃষ্ঠার এবং হিরণ্যকশিপুর গ্রন্থটি ৭০০ পৃষ্ঠার। বিভিন্ন সময়ে গ্রন্থাগারে এসব প্রাচীন গ্রন্থ দেখতে আসা গবেষকদের কাছে তারা জেনেছেন, পদ্মাপুরাণ দেবী মনসার প্রশংসা করে লেখা। গোবিন্দ কথামৃত লেখা প্রাচীন পুন্ড্রনগরীর অন্যতম রাজা গৌড় গোবিন্দের গুণকীর্তন করে আর ভারতের মেদিনীপুর জেলার হিরন্যকাশিপুরের গুণ বর্ণনা হয়েছে হিরন্যকাশিপুর গ্রন্থে। উপমহাদেশের আর কোথাও এসব পুঁথির অস্তিত্বের কথা এখন পর্যন্ত জানা যায়নি বলে গবেষকরা তাদের জানিয়েছেন।
আমির হোসেন বলেন, গবেষকদের জন্য এই প্রাচীন গ্রন্থগুলো নিঃসন্দেহে মূল্যবান। এসবের পাঠোদ্ধার করা সম্ভব হলে রচনার সময়কাল ছাড়াও এ অঞ্চলের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া যাবে।
কীভাবে প্রাচীন এ গ্রন্থগুলো এলো, সরকারি এই গণগ্রন্থাগারে জানতে চাইলে সহকারী এ গ্রন্থাগারিক বলেন, ২০১২ সালের আগ পর্যন্ত সরকারি গণগ্রন্থাগার আর উডবার্ন পাবলিক লাইব্রেরি পৃথকভাবে পরিচালিত হতো। উডবার্ন পাবলিক লাইব্রেরি দেশের প্রাচীন গ্রন্থাগারগুলোর মধ্যে অন্যতম। ১৮৫৪ সালে এই পাবলিক লাইব্রেরির গোড়াপত্তন হয়। পরে ১৯০৮ সালে জেলা কালেক্টর জে এন গুপ্ত তদানীন্তন বাংলার লেফটেন্যান্ট গভর্নর স্যার জন উডবার্নের নামানুসারে এই লাইব্রেরির নাম রাখেন উডবার্ন পাবলিক লাইব্রেরি। বগুড়ার নবাব সৈয়দ আবদুস সোবহান চৌধুরী ওই লাইব্রেরির জন্য একটি ভবন তৈরি করে দেন। বগুড়া এডওয়ার্ড পৌর পার্কের উত্তর-পূর্ব পাশের সেই ভবনেই চলত লাইব্রেরির কার্যক্রম। সেটি ২০১২ সালে সরকারি গণগ্রন্থাগারের সঙ্গে একীভূত করা হলে দুর্লভ এই গ্রন্থ তাদের হাতে আসে।
আমির হোসেন জানান, উডবার্ন পাবলিক লাইব্রেরিতে কর্মরত ছিলেন বর্তমানে তার দপ্তরের অনিয়মিত কর্মচারী রেজওয়ানুল আলম রিপন। তার কাছে জেনেছেন, ১৯৯৭ সালে টাঙ্গাইল থেকে পদ্ম নামের এক ব্যক্তি উডবার্ন পাবলিক লাইব্রেরিতে ওই তিনটি গ্রন্থ দিয়ে যান। রিপনের মাধ্যমে পদ্ম নামের ওই ব্যক্তির ঠিকানা সংগ্রহ করে তিনি যোগাযোগ করে জানতে পারেন, বংশপরম্পরায় গ্রন্থ তিনটি তার (পদ্মর) হাতে আসে। পরে তিনি তা লাইব্রেরিতে দান করেন।
এ সহকারী গ্রন্থাগারিক আরও জানান, শুধু যে এ তিনটি প্রাচীন পাণ্ডুলিপি এ লাইব্রেরিতে আছে, তা নয়। এখানে অনেক দুর্লভ বই রয়েছে। জনবল সংকটের কারণে উডবার্ন লাইব্রেরি থেকে পাওয়া ৮ হাজার বই নিয়ে তেমন কাজ করা সম্ভব হয়নি। সেটি করা গেলে আরও দুর্লভ ও দুষ্প্রাপ্যধ বইয়ের সন্ধান মিলতে পারে।