Thursday, March 28
Shadow

হরর গল্প : তার ভেজা চুল

হরর গল্পহরর গল্প : তার ভেজা চুল। লিখেছেন সজল সরকার।

মাথার ওপর যে সিলিং ফ্যানটা ঘুরছিল তার গতি হঠাৎই কেমন জানি একটু কমে গেল। ওপরে তাকাতেই চোখ ছানাবড়া হলো আবিরের। ফ্যানের তিনটি পাখায় ঝুলে আছে মেয়েদের লম্বা ভেজা চুল। মনে হচ্ছে যেন তিন পাখার ওপরেই বসানো রয়েছে তিনটি মেয়ের কাটা মাথা, আর তাদের চুলগুলো ঝুলছে পাখার নিচে। ফ্যান তখন কিছুটা ধীর গতিতে ঘুরছে, সঙ্গে সঙ্গে চুলগুলোও দুলছে। দলা পাকানো চুল থেকে দু’একটা ফোটা করে পানি ঝরছে অবিরত। রাতের অন্ধকারে লিফ্টে ওঠার পর যে আবছা ছায়ায় কিছু একটা দেখেছিল তা-ই এখন পর্যন্ত মাথা যাচ্ছে না আবিরের। এখন আবার সিলিং ফ্যানের এই দৃশ্য। ভেতরটা দুমরে মুচরে আসছে, ভয়ে বুকটা কেঁপে উঠার সমানতালেই মাথাটাও চক্কর দিচ্ছে এবার। দুই দিনের মধ্যেই এ্যাসাইনমেন্ট দিতে হবে, ল্যাপটপের দিকে তাকাতে পারছে না এখন। সারাদিন ক্লাস করতেও ভাল লাগেনি। গত কয়েকদিন ধরেই ঘুম হচ্ছে না। মাথাটা ঝিমঝিম করে নিয়মিত। চোখ বন্ধ হয়ে আসছে ঘুমে কিন্তু ঘুমাতে গেলেই আৎকে উঠছে অদৃশ্য কারো চিৎকারে। গুমট একটা অবস্থার মধ্যে দিন যাচ্ছে আবিরের। কাউকে কিছু বলতেও পারছে না। কাউকে বলেই বা কি হবে? এই সেদিনই তো কাছের বন্ধু রঞ্জুকে নিয়ে রাতে ঘুমিয়েছিল। রঞ্জু দেদারছে নাক ডেকে ঘুমালেও আবির দেখছিল তার পাশেই শুয়ে থাকা ভেজা চুলের এক মেয়ে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছে। আবির চুলে হাত দিতেই কালচে দাঁত বের করে হাসি দিল মেয়েটা, ভয়ে চিৎকার করে উঠতেই পাশ থেকে রঞ্জু বললঃ ‘কী হলো রে? দুঃস্বপ্ন দেখেছিস?’

হরর গল্প

আবিরঃ না, না, স্বপ্ন না! সত্যি। দেখ দেখ, কেমন কালো দাঁত বের করে হাসছে মেয়েটা!

রঞ্জুঃ তোর সামনে আমিই তো। কার কথা বলছিস?

আবির মনে মনে ভাবল কারো কাছে বলে লাভ নেই। কেউ বিশ্বাসও করবে না। খুব কাছের বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে থেকেও যদি সে না বুঝতে পারে তাহলে আর কাউকে বলে লাভ নেই। মনোবিজ্ঞানীর সঙ্গেও দেখা করেছিল আবির। হিতে বিপরীত হয়েছে। মনোবিজ্ঞানীর দেওয়া ওষুধ খাওয়ার আগে শুধু রাতে ঘুমাতে গেলে দুঃস্বপ্ন দেখতো কিন্তু এখন সমসময় চোখের সামনে উল্টাপাল্টা দৃশ্য দেখে।

ইউনিভার্সিটির সেকেন্ড ইয়ারে আবির। মা-বাবার একমাত্র সন্তান হওয়ায় খুব আদর যতেœ বড় হয়েছে সে। গ্রামের বাড়ি টাঙ্গাইলে। ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হওয়ার আগে কখনও বাড়ির বাইরে একদিনের বেশি থাকেনি। সেই একদিনও থেকেছে মামার বাড়িতে তাও আবার মায়ের সঙ্গে। বাবা ব্যাংকে চাকুরী করায় একেবারেই সময় পান না। ছুটি নিয়ে কোথাও ঘুরতে যাওয়া হয়নি পরিবারের সঙ্গে। দেশ-বিদেশ ঘুরে বেড়ানোর অনেক শখ আবিরের। গ্রামের বাড়িতে থাকতে ক্যালেন্ডার বা ওয়ালমেটের দৃশ্য দেখে সেই জায়গায় যাওয়ার খুব শখ হত তার। বিশেষ করে সিনেমায় বিদেশি কোন প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখলে তো সেখানে যাওয়ার ইচ্ছায় গায়ের লোম দাড়িয়ে যেত।

ভার্সিটিতে ভর্তি হওয়ার পর ইন্দিরা রোডের এক পুরান বাসার ছাঁদঘরে ঠাঁই হয়েছে আবিরের। পড়াশোনার পোকা আবির প্রথম কয়েক সেমিষ্টারে রেজাল্টও ভাল করেছে। শান্ত চেহারার ছেলেটার প্রেমে পড়েছে অনেকেই। তবে বছর খানেক হলো দুই সেমিষ্টার জুনিয়র অহনার কাছে ধরা দিয়েছে আবির। মেয়েটি খুব ভালবাসতো আবিরকে। কিন্তু দুই মাস আগে বান্দরবান বেড়াতে গিয়ে পাহাড় থেকে পড়ে অকাল মৃত্যু হয় মেয়েটার। তারপর থেকেই আবিরের এই অবস্থা।

হরর গল্প

ভার্সিটিতে অন্যান্য বন্ধু-বান্ধবীর সঙ্গে আড্ডা দেওয়ার সময় এখন আশ্চর্যজনক সব ঘটনা ঘটছে। রোববার সকালে ক্লাসের ফাঁকে যখন সেতু ও মামুনের সঙ্গে বসে আলাপ করছিল তখন কানের কাছে একটা মাছি এসে সেই যে ভনভন করা শুরু করল তা কোনভাবেই যাচ্ছে না। মাছিটাও যেনতেন মাছি নয়, মোটাগাটা ভিন্ন ধরণের মাছি এটি। মাথার ওপরেই ভনভন শব্দ করতে করতে চুলে বাড়ি খেয়ে যাচ্ছে। আবিরের মনে আবারও ভয় ঢুকলো। কয়েকবার হাত দিয়ে তাড়ানোর পরও যায়নি মাছিটা। উল্টা আরো বেশি করে চুলে বাড়ি খাচ্ছে বলেই মনে হলো। সহ্য করতে না পেরে ক্লাস বাদ দিয়ে বাসায় চলে আসে আবির। বাসায় ফিরে গোসল দিয়ে যেই না বিছানায় শুতে যাবে তখন আবারও চমকে উঠলো সে। বিছানার ওপর রাখা কাঁথাটা সরাতেই মেয়েদের দলা পাকানো ভেজা চুল হাতে জড়িয়ে গেল। চিৎকার দিয়ে বাইরে বের হতেই জ্ঞান হারিয়ে ফেলে আবির। যখন জ্ঞান ফেরে তখন সে নিজেকে আবিষ্কার করে বাথরুমের শাওয়ারের নিচে। টিপটিপ করে পানি পড়ছিল মাথায়। পাশে বালতিটাও এমনভাবে রাখা যে আবিরের গায়ে পানি লাগেনি, শুধু মাথাটায় ভেজা। নিজেকে সামলে নিয়ে আশেপাশে কাউকে খুঁজলো সে কারন বাথরুমে এভাবে শাওয়ারের নিচে মাথায় পানি দেওয়ার জন্য নিশ্চয় কেউ এসেছিল। কিন্তু চারিদিকে কাউকেই দেখতে পেল না। মাথা মুছে যখন রুমে ঢুকল তখন দেখল ঘরের দরজা ভেতর থেকেই বন্ধ। তাহলে অজ্ঞান অবস্থায় তাকে বাথরুমে নিয়ে মাথায় পানি দেওয়ার ব্যবস্থা করল কে? ভয়ে ভয়ে বিছানায় গিয়ে কাঁথা সরিয়ে দেখল দলা পাঁকানো ওই চুল আর নেই। নিজের হালুসিনেসন ভেবেই শুয়ে পড়ল তখন।

অনেক ক্লান্তির পর বিছানায় গা এলাতেই গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হলো আবির। দুপুরের পর থেকে একেক ঘটনায় উদ্বিগ্ন হয়ে খাওয়া দাওয়াও হয়নি তার। সন্ধ্যা গড়িয়ে এখন রাত কিন্তু সেদিকে খেয়াল নেই। হঠাৎ হালকা বাতাসের ঝিরঝির শব্দে ঘুুমটা ভাঙতেই আবিরের চোখ পড়ল দরজার ওপরের ভ্যান্টিলেটরের দিকে। খাঁজকাটা ভ্যান্টিলেটরের ফাঁক দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে ভেজা লম্বা চুল। কী বিভৎস দৃশ্যরে বাবা! আবির আর নিতে পারছে না। স্বপ্ন ভেবে নিজেকে স্বান্তনা দিতে চাচ্ছিল সে সময় কিন্তু চোখে হাত দিতেই টের পেল এটা স্বপ্ন নয়, সত্যি। আলো জ্বালাতেই গড়িয়ে পড়া চুল উধাও, শুধু ভ্যান্টিলেটরের ওপাশ থেকে দুটি লাল চোখ দেখা গেল, চোখ দুটি তীক্ষèভাবে আবিরের দিকে তাকিয়ে আছে। চোখ দিয়ে জল পড়ছে অবিরত। দরজা খুলতেই মনে হলো কেউ চাপা কান্না নিয়ে দ্রæত চলে গেল। কয়েকদিনের ভয়ে আবির এখন অনেকটা পাথরের মত শক্ত। দ্রæত কান্নার পিছু নিলো। সিড়ি দিয়ে নামতে নামতে নিচ পর্যন্ত এলো কিন্তু কাউকে আবিষ্কার করতে পারল না। বাসার মেইন গেইটে এসে দেখলো কাপড় পেচানো কেউ একজন বসে আস্তে আস্তে গান গাচ্ছে। কে?- জিঙ্গেস করতেই মাথা থেকে কাপড় নামিয়ে দায়োয়ান বললঃ জি ভাই, এত রাতে আপনি এখানে?

-দারোয়ান চাচা, আপনি এভাবে কাপরে ঢেকে গান গাচ্ছেন কেন?

-না ভাইজান, গান গাই না তো, মোবাইলে গান হুনতাছিলাম। বাসা পাহারা দিতে দিতে চোখে ঘুম পায়, তাই মোবাইলে গান হুনি। আপনাগো ডিস্টাব হইবো মনে কইরা কাপড়চোপর দিয়ে ঢাইকা হুনতাছিলাম। আপনি বাইরে যাইবেন?

-না।

-তাইলে নিচে নামছেন ক্যা? কিছু লাগব?

-না। একটু আগে কি কেউ ছাদে আমার ঘরের দিকে গেছিল?

– না তো ভাইজান। ব্যাবাকেই তো ঘুমায়। চোর-টোর আইলো নি আবার?

আবির যা বুঝার বুঝে গেল। আস্তে করে দারোয়ানকে বললঃ না, না। বিড়াল-টিড়াল কিছু একটা হবে হয়ত।

বুকের মধ্যে পাথর নিয়ে উপরে নিজের ঘরের দিকে গেল আবির। একটা চাপা যন্ত্রণা নিয়ে কতক্ষণ থাকা যায়। ততক্ষণে শরীরটা একেবারেই ছেড়ে দিয়েছে। আবারও ঘুমে চোখ বন্ধ হয়ে আসছে। বিছানায় শুয়ে পড়ার সময় হঠাৎ লক্ষ্য করল তার বিছানা ভরা দলা পাকানো ভেজা চুল। আবছা আলোয় বিছানার যেখানেই হাত দেয় সেখানেই লম্বা লম্বা চুল। আবিরের আত্মচিৎকারে বিল্ডিংয়ের সবাই জেগে উঠল।

হাসপাতালের বেডে যখন আবিরের জ্ঞান ফিরল তখন সে আশেপাশে বন্ধু-বান্ধব ও আত্মীয়-স্বজনদের দেখতে পেল। সবাই শঙ্কা নিয়ে তাকিয়ে আছে তার দিকে।

আবিরের মা কাঁদো কাঁদো গলায় জিঙ্গেস করলঃ ‘অহনা কে বাবা?’ ‘তুই কিসের জন্য দায়ী নয় বাবা?’ ‘অচেতন অবস্থায় শুধু পাহারে যেতে চাচ্ছিলি কেন বাবা?’

আবির কান্না চেপে রাখতে পারল না। ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদতে লাগল। বন্ধুরা স্বান্তনা দিয়ে কিছুটা শান্ত করার পর আবির চারিদিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকালো। বিড়বিড় করে বলল ‘আমাকে বলতেই হবে।’ সবাইকে কাছে ডেকে আবির বললঃ ‘আমি একটা ঘটনা সবার কাছে গোপন করেছি। অহনা আমাকে খুব ভালবাসতো, খুবই। আমি এবং ও বেড়াতে খুব পছন্দ করতাম। আমরা কাউকে না জানিয়ে বান্দরবান বেড়াতে গিয়েছিলাম। সন্ধ্যার সময় পাহাড়ের কিনার দিয়ে হাঁটতে গিয়ে অহনা পা পিছলে যায়। আমি হাত বাড়িয়ে দিয়েও লাভ হয়নি। শুধু ওর কয়েকটা চুলই আমার হাতে আটকে ছিল কিন্তু পাহাড়ের নিচে পড়ে যায়। অনেক উঁচু পাহাড়, নিচে পড়লে বেঁচে থাকার কোন সম্ভবনাই নেই। খুব ভয় পেয়েছিলাম আমি। যেহেতু আমরা কাউকে বলে যাইনি, তাই ভয়ে আর কাউকে বিষয়টি জানাইনি আমি।’

আবিরের কথামত সেই পাহাড়ের নিচে স্থানীয় প্রশাসন তল্লাসি চালায়। কয়েকশ ফুট পাহারের নিচে খুবই গহীন জঙ্গল। জঙ্গলের ভেতর দিয়ে একটি ঝর্ণা বয়ে গেছে। ঝর্ণা যে পাথরে বাঁধা খেয়ে গতি পরিবর্তন করেছে সেই বাঁকেই আরেকটা পাথরের ধারে অহনার লাশ মিলল অবশেষে। কয়েকদিন পড়ে থাকাতে চেহারা চেনা যাচ্ছে না তেমন। অহনার লম্বা চুল ঝর্ণার পানিতে ভেজা। মাথাটা একদিক ঘুরাতেই সামনের পাটির কালো হয়ে যাওয়া দাঁতগুলো চোখে পড়ল।

অহনার বাড়ির লোকজন সেই নিথর দেহটা নিয়ে এসে চিরনিদ্রায় শায়িত করল। আবিরের আর পড়াশোনা করা হয়নি। ছেলেটা ঘরে চুপচাপ একাই বসে থাকে এখন, কথা বলে না তেমন কারো সাথে!

হরর গল্প

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Please disable your adblocker or whitelist this site!

error: Content is protected !!