Monday, December 23
Shadow

পিজির ডাক্তার মোশাররফ হোসেনের পরামর্শ ওষুধে যক্ষা ভালো হয়

যক্ষা ভালো

ওষুধে যক্ষা ভালো হয়

যক্ষ্মা রোগের চিকিৎসা নিয়ে জনমনে অনেক ভ্রান্তি রয়েছে। কিন্তু সঠিক তথ্য হলো, যথাযথ চিকিৎসা নিলে পুরোপুরি যক্ষা ভালো হয়। লিখেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের বক্ষব্যাধি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. এ কে এম মোশাররফ হোসেন

যক্ষ্মা বা টিবি একটি প্রাচীন রোগ। মাইকোব্যাকটেরিয়াম টিউবারকুলোসিস নামের জীবাণুর সংক্রমণে এটি হয়ে থাকে। এটি অত্যন্ত ছোঁয়াচে রোগ। ২০১৪ সালের জরিপ মতে, বিশ্বে প্রতিবছর ৯৬ লাখ লোক সক্রিয় যক্ষ্মা রোগে আক্রান্ত হয়, যাদের মধ্যে ১৫ লাখই মারা যায়। বাংলাদেশে প্রতিবছর গড়ে তিন লাখ লোক যক্ষ্মায় আক্রান্ত হয়, এর মধ্যে ৭০ হাজার মারা যায়। নতুন রোগীদের ২.২ শতাংশ ও পুরনো রোগীদের ১৫ শতাংশ পাওয়া যায় মাল্টিড্রাগ রেসিস্ট্যান্ট (এমডিআর) বা ওষুধ প্রতিরোধী যক্ষ্মারোগী।

 

যক্ষ্মার উৎপত্তি

জীবাণু : বেঁচে থাকার জন্য প্রচুর অক্সিজেন লাগে বলে যক্ষ্মা রোগের জীবাণুর আদর্শ স্থান হলো ফুসফুস। এই জীবাণু ১৫-২০ ঘণ্টায় দ্বিগুণ হয়। শুষ্ক অবস্থায় এই জীবাণু কয়েক সপ্তাহ বেঁচে থাকতে পারে। ফুসফুসের জীবাণু ধ্বংসকারী কোষ ম্যাক্রোফেজ এই জীবাণু ধ্বংস করতে পারে না।

সংক্রমণ : যক্ষ্মারোগীর কাশি, হাঁচি, কথা বলা, থুথু ইত্যাদিতে যক্ষ্মার জীবাণু বায়ুমণ্ডলে ক্ষুদ্র কণা হয়ে প্রবেশ করে। এই কণা আকারে ১-৫ মাইক্রোমিটার হয়ে থাকে, যেগুলো ১০ ফুট দূরত্ব পর্যন্ত বাতাসে ছড়াতে পারে। একবার কাশি দিলে প্রায় ১০ হাজার জীবাণু বাতাসে আসে। পরীক্ষা করে রোগী যদি স্মেয়ার পজিটিভ হয়, তবে এই জীবাণুর সংক্রমণ সবচেয়ে বেশি হয়। এরপর নিঃশ্বাসের মাধ্যমে নিকটবর্তী অন্যের ফুসফুসে ঢুকে গিয়ে সংক্রমণ ঘটায়। রোগ নির্ণয়ের আগেই একজন যক্ষ্মারোগী কমপক্ষে ১৫-২০ জন সুস্থ মানুষকে সংক্রমিত করে থাকে। গরুর কাঁচা দুধ খেলেও যক্ষ্মার জীবাণু অন্ত্রে সংক্রমণ করতে পারে।

এ ছাড়া ডায়াবেটিস, কিডনি বিকল, বংশগত কারণ, কেমোথেরাপি প্রয়োগ, লিম্ফোমা, ধূমপান, বেশি বয়স, দীর্ঘদিন স্টেরয়েড সেবন, রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস রোগীদের ইনফ্লিক্সিম্যাব ব্যবহারসহ নানা কারণে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে গিয়ে ৫-১০ ভাগ ক্ষেত্রে যক্ষ্মা হতে পারে। ৯০ শতাংশ সংক্রমণের ক্ষেত্রে কোনো উপসর্গ থাকে না এবং জীবাণু সুপ্তাবস্থায় থাকে। পরবর্তী সময়ে এদের ৫-১০ শতাংশ যক্ষ্মায় আক্রান্ত হয়, যাকে পোস্ট প্রাইমারি বা রি-অ্যাক্টিভেশন টিবি বলে।

 

প্রকারভেদ

ফুসফুসীয় যক্ষ্মা : ৮০ শতাংশ রোগীর ক্ষেত্রে যক্ষ্মা আক্রান্ত হয় ফুসফুসে। ফলে যক্ষ্মা রোগের লক্ষণ ফুসফুসে বেশি প্রকাশ পায়। এ ছাড়া দেহের যেকোনো অঙ্গেও যক্ষ্মা হতে পারে। এমনকি অগ্ন্যাশয়, থাইরয়েড, মাংসপেশি ও হৃদযন্ত্রের পেশিতেও কখনো কখনো যক্ষ্মা হয়।

ফুসফুসবহির্ভূত যক্ষ্মা : যদি ফুসফুসে যক্ষ্মার কোনো অস্তিত্ব না থাকে তবে অন্য অঙ্গ যেমন—প্লুুরা, লিম্ফনোড, হাড় ইত্যাদিতে যক্ষ্মা হয়ে থাকে। একত্রে তাদের ফুসফুসবহির্ভূত যক্ষ্মা বলে, যা অবশ্য ছোঁয়াচে নয়।

আবার রোগীর কাশিতে যক্ষ্মার জীবাণুর উপস্থিতির ওপর যক্ষ্মারোগীদের দুই ভাগে ভাগ করা হয়।

স্মেয়ার পজিটিভ : যদি রোগীর শ্লেষ্মার দুটি নমুনার অন্তত একটিতে যক্ষ্মার জীবাণু পাওয়া যায়, সে ক্ষেত্রে রোগ ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা বেশি থাকে।

স্মেয়ার নেগেটিভ : যদি রোগীর শ্লেষ্মার দুটি নমুনায়ই যক্ষ্মার জীবাণু পাওয়া না যায়, সে ক্ষেত্রে জীবাণু ছড়ানোর আশঙ্কা কম থাকে।

 

উপসর্গ

এক-তৃতীয়াংশ রোগীর যক্ষ্মার লক্ষণ প্রকাশ পায় প্রাথমিক যক্ষ্মায়। বেশির ভাগ রোগীরই কোনো লক্ষণ থাকে না। যক্ষ্মার সাধারণ লক্ষণগুলো হলো—

♦ ঘুসঘুসে জ্বর হয়, যা সন্ধ্যায় আসে আবার মাঝরাতে ঘাম দিয়ে ছাড়ে।

♦ বুকের মাঝখানে, বুকের পাশে, কখনো পিঠের মাঝখানে ব্যথা হয়।

♦ খাবার গিলতে কষ্ট হয়।

♦ সাধারণত শুষ্ক কাশি হয়। কখনো হলুদ শ্লেষ্মা বা রক্তমিশ্রিত হয় বা কাশির সঙ্গে রক্ত যায়।

♦ ফুসফুসের সংক্রমণ, ফুসফুসের বাইরের পর্দায় পানি, পুঁজ বা বাতাস জমা হয়ে শ্বাসকষ্ট হয়ে থাকে।

♦ শরীর অতিদুর্বল হয়।

♦ দেহের ওজন কমে যায়।

 

এ ছাড়া প্রগ্রেসিভ প্রাইমারি যক্ষ্মার কিছু ক্ষেত্রে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম থাকার কারণে দেহের নানা অঙ্গে যক্ষ্মার জীবাণু ছড়িয়ে পড়ে এবং নিম্নোক্ত রোগের উৎপত্তি ঘটাতে পারে। যেমন—

মেনিনজাইটিস : মস্তিষ্কের পর্দায় যক্ষ্মার জীবাণুর সংক্রমণ হয়। রোগী অজ্ঞান হয়ে পড়ে, মাথা ব্যথা হয়, বমি হয়।

গ্রীবা বা ঘাড়ে লসিকাগ্রন্থির প্রদাহ : গ্রীবা বা ঘাড়ের লিম্ফনোডে যক্ষ্মার জীবাণু সংক্রমিত হয়। গ্রীবার গ্রন্থি ফুলে যায়। দেহের অন্য জায়গায়ও গ্রন্থি ফুলতে পারে।

পেরিকার্ডাইটিস : হার্টের বাইরের পর্দায় যক্ষ্মার জীবাণু সংক্রমণ করে। এতে বুকে ব্যথা হয়। হার্টের চারদিকের পর্দায় পানি জমে হার্টের কাজে বিঘ্ন ঘটায়।

মিলিয়ারি টিবি : যক্ষ্মা জীবাণু রক্তবাহিত হয়ে দেহের বিভিন্ন অঙ্গে ক্ষুদ্র মিলেট দানার মতো ক্ষত তৈরি করে।

পুনঃসক্রিয়করণ যক্ষ্মা : সুপ্ত যক্ষ্মারোগীর ১০ শতাংশ জীবনের যেকোনো সময় দেহের বিভিন্ন অঙ্গে যেমন—ফুসফুস, হাড়, কিডনি ইত্যাদিতে যক্ষ্মার জীবাণুর সংক্রমণ ঘটায়। এ ক্ষেত্রে অনেক বিলম্বে রোগের লক্ষণ প্রকাশ পায়।

 

পরীক্ষা-নিরীক্ষা

যক্ষ্মা হলেও অনেক সময় তেমন কোনো লক্ষণ প্রকাশ পায় না। তবে ঘুসঘুসে জ্বর, ওজন হ্রাস ইত্যাদি কারণে সন্দেহ হলে চিকিৎসকের পরামর্শে কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখা উচিত। এ রকম কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা হলো—বুকের এক্স-রে, শ্লেষ্মা পরীক্ষা, শ্লেষ্মার কালচার ও সেনসিটিভিটি, Xpert MTB/RIF, মানটো পরীক্ষা, ব্রংকোসকপি, সিটি স্ক্যান চালিত এফএনএ, AFB Stain বা কালচার, এডিনোসাইন ডিএমাইনেজ (এডিএ), সেরোলজিক্যাল টেস্ট ইত্যাদি।

 

চিকিৎসা

একসময় বলা হতো, ‘যক্ষ্মা হলে রক্ষা নাই।’ তবে এখন বলা হচ্ছে, ‘যক্ষ্মা ভালো হয়।’ পর্যাপ্ত চিকিৎসায় প্রায় সব রোগী নিরাময় লাভ করে। চিকিৎসা না নিলে বরং ২৫ ভাগ রোগী মারা যায়। এমডিআর যক্ষ্মায় ও এইডস আক্রান্ত যক্ষ্মারোগীর মৃত্যুহার বেশি। যক্ষ্মা রোগের জন্য প্রচলিত নানা চিকিৎসা রয়েছে। যেমন—

নতুন রোগীর চিকিৎসা : নতুন রোগীদের রিফামপিসিন, আইসোনায়াজিড, পাইরাজিনামাইড ও ইথামবিউটামল—এই চারটি ওষুধ দিয়ে চিকিৎসা করা হয়। চিকিৎসার মেয়াদ সাধারণত ছয় মাস।

পুরনো রোগীর চিকিৎসা : ওপরের চারটি ওষুধের সঙ্গে ইনজেকশন স্ট্রেপটোমাইসিন যোগ করে মোট আট মাস চিকিৎসা দেওয়া হয়।

মাল্টিড্রাগ প্রতিরোধী (এমডিআর) যক্ষ্মা : এ ক্ষেত্রে যক্ষ্মার চিকিৎসা ১৮-২৪ মাস করা হয়। ইনজেকশন ও খাবারের ওষুধ মিলিয়ে প্রায় ছয়-সাতটি ওষুধ বিভিন্ন মেয়াদে প্রায় দুই বছর রোগীকে দেওয়া যায়।

 

পরামর্শ ও সতর্কতা

♦ রোগীকে যথাযথ পুষ্টিকর খাবার দিতে হবে।

♦ শ্লেষ্মায় জীবাণুবাহী যক্ষ্মার ক্ষেত্রে রোগীকে অন্তত দুই সপ্তাহ আলাদা রাখতে হবে।

♦ রোগীর শ্লেষ্মা যেখানে-সেখানে ফেলা যাবে না।

♦ মুখে সব সময় মাস্ক ব্যবহার করা উচিত।

♦ চিকিৎসা চলাকালীন রোগীকে নিয়মিত ফলোআপে রাখতে হবে। সাধারণত চিকিৎসার দুই থেকে চার সপ্তাহের মধ্যে জ্বর কমে যায়, খাবারে রুচি আসে, ওজন বাড়তে থাকে। এ ধরনের উন্নতি দিয়ে বোঝা যায়, রোগীর চিকিৎসা সঠিক হচ্ছে।

♦ যক্ষ্মার ওষুধে কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দিলে যেমন : জন্ডিস, চোখে ঝাপসা দেখা, মাথা ঘোরা, পায়ে শিরশির করা ও অবশতা হলে তাৎক্ষণিক চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।

 

যক্ষ্মা প্রতিরোধে করণীয়

♦ প্রতিটি শিশুকে সময়মতো বিসিজি টিকা দেওয়া উচিত। কেননা এই টিকা শিশুকে যক্ষ্মার সংক্রমণ থেকে ২০ থেকে ৬০ শতাংশ রক্ষা করতে পারে। এমনকি কোনো কারণে যক্ষ্মা সংক্রমিত হলেও যক্ষ্মা থেকে প্রতিরোধ করে। পাশাপাশি শরীরে যক্ষ্মার জীবাণুর বিস্তার রোধ করে।

♦ কোনো যক্ষ্মারোগী (বিশেষত স্মেয়ার পজিটিভ) শনাক্ত হওয়ার আগে আরো ১৫-২০ জনকে সংক্রমিত করে থাকে। তাই এর বিস্তার রোধে রোগীকে দ্রুত চিকিৎসার আওতায় আনা উচিত। শুধু তা-ই নয়, যক্ষ্মারোগীর সংস্পর্শে যারা থাকবে বা যারা পরিচর্যা করবে, তাদেরও সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।

♦ মা যক্ষ্মারোগী হলে অবশ্যই শিশুকে যক্ষ্মা প্রতিরোধী চিকিৎসা দিতে হবে।

https://www.youtube.com/watch?v=AoO_iZhlnGs&fbclid=IwAR1xQ9rZ8YctNyfCH6_uW9xjOWrrA3O7ymIjLiGAM5eBtM0WoaGk1o4ju9g

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Please disable your adblocker or whitelist this site!