গৃহপালিত বা পোষা পাখিদের মধ্যে কবুতর অন্যতম। সুপ্রাচীনকাল থেকে সুস্বাদু মাংস, সংবাদ প্রেরণ ও শখের জন্য কবুতর পালন করা হচ্ছে। তাই আমরা আজকে আলোচনা করবো কবুতর পালনের আধুনিক কলাকৌশল নিয়ে।
কবুতর পালনের গুরুত্ব: কবুতর অত্যন্ত নিরীহ ও শান্ত প্রাণী এবং সহজে পোষ মানে। আমাদের দেশের জলবায়ু ও বিস্তীর্ণ শস্যক্ষেত কবুতর পালনের উপযোগী। কবুতর পালনের গুরুত্ব ক্রমান্বয়ে তুলে ধরা হলো-
এক জোড়া কবুতর ১২ মাসে ১৩ জোড়া পর্যন্ত বাচ্চা দেয়
কবুতরের মাংস সুস্বাদু ও বলকারক বলে সদ্য রোগমুক্ত ও প্রসব পরবর্তী ব্যক্তির জন্য উপকারী
কোন মহৎ কাজের শুরুতে ‘শান্তির প্রতিক’ কবুতর ছেড়ে দেয়া হয়
প্রজনন, শরীরবৃত্তিয় ও অন্যান্য অনেক বৈজ্ঞানিক গবেষণা কর্মে কবুতর ব্যবহার করা হয়
স্বল্পখরচ উৎকৃষ্ট মানের মাংস ও আয়ের উৎসরূপে কবুতর পালন লাভজনক উদ্যোগ; কবুতর পালন কার্যক্রম ক্রমেই জনপ্রিয়তা লাভ করছে
বেকার যুবক এবং দুস্থ মহিলাদের কর্মসংস্থানের উপায়
কবুতরের রোগবালাই কম ক্স এরা পোকা মাকড় ধ্বংস করে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে ক্স কবুতর পালন আনন্দদায়ক।
কবুতরের জাত ঃ বাংলাদেশে কবুতরের প্রায় ২০টি বিভিন্ন জাত রয়েছে। উল্লেখযোগ্য জাতগুলো হচ্ছে- গিরিবাজ, রোলার লোটন, জালালি, গোলা ও সিরাজি। বিদেশি জাতগুলো হলো- কিং, ফ্যানটেল (ময়ূরপঙ্খি), জাকোবিন, মুকী, টিপলার, ফ্রিলব্যাক ও গ্যালাতী রোলার। উল্লেখ্য যে, কবুতর পালনে প্রাপ্যতা অনুযায়ী যেকোন জাত ব্যবহার করা যায়। সপ্তাহকাল একত্রে রাখলে এদের মধ্যে ভাব ও মিলন হয় এবং একত্রে জোড় বাঁধে। একটি স্ত্রী কবুতর প্রতিবার দু‘টি করে ডিম দেয়। কবুতরের ডিম ফুটে ছানা বের হতে ১৭-১৮ দিন সময় লাগে। কবুতর সাধারণত ১৬-২০ বছর বেঁচে থাকে।
কবুতরের বাসস্থান: মুক্ত জীবন-যাপনকারী আপোষা কবুতর পুরনো দালানকোঠা, মসজিদ, মন্দির, গির্জা, দরগাহ ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ফাঁক ফোকরে বা সিলিং- এ বাসা করে। পোষা কবুতরের জন্য ঘরের বারান্দায় বা কার্নিশে টিন বা কাঠের বাক্স অথবা মাটির হাঁড়ি বেঁধে রেখে কবুতর পালনের ব্যবস্থা করা যায়। ৮-১০ জোড়া কবুতর পালনের জন্য বারান্দার কোনায়, বহু স্তরবিশিষ্ট মাটির খোপ তৈরি করা যায়।
কবুতরের বাসস্থান নির্বাচনের বিবেচ্য বিষয়:
উঁচু, সমতল ও শুস্ক জায়গা
খোঁপ ঘরের উঁচু স্থানে স্থাপন করতে হবে। যাতে শিয়াল, কুকুর, বেজি, ইঁদুর, ইত্যাদির হাত থেকে কবুতরকে নিরাপদ রাখা যায়
ঘর/খোঁপ সহজে পরিষ্কার ও জীবানুমুক্ত করার সুবিধা সম্পন্ন স্থানে স্থাপন করতে হবে
ঘরে যাতে পর্যান্ত সূর্যালোক পবেশ ও বায়ু চলাচল করার সুযোগ পায়
একজোড়া কবুতরের জন্য খোঁপের দৈর্ঘ্য, প্রস্থ ও উচ্চতা হবে যথাক্রমে ৪৫, ৩০ ও ৩০ সে.মি. (১৮, ১২, ও ১২ ইঞ্চি)।
কবুতরের খাদ্য: কবুতরের সুষম খাবারে শর্করা, চর্বি, আমিষ, খনিজ ও বিভিন্ন ভিটামিন উপাদান থাকা প্রয়োজন। এরূপ মিশ্রিত সুষম খাদ্যে ১৫-১৬ % ক্রুড প্রোটিন থাকবে। প্রতি কেজি খাদ্যে বিপাকীয় শক্তি ২৫০০-২৬০০ ক্যালোরি থাকা বাঞ্চনীয়। তাছাড়া বিশুদ্ধ পানি যথেষ্ট পরিমাণে সরবরাহ করতে হবে। সাধারণত একটি কবুতর দৈনিক তার দেহের ওজনের দশ ভাগের একভাগ পরিমান খাবার খায়। এ হিসাবে বিভিন্ন বয়সে কতবুতর দৈনিক ২০-৯০ গ্রাম খাবার খায়।
কবুতর সাধারণত ধান, গম, মশারি, খেসারি, মটর, ভূট্টা, সরিষা, বিভিন্ন কলাই ইত্যাদি দানা শস্য খেয়ে থাকে। মাঠপর্যায়ে কবুতর ছাড়ার আগে প্রতিদিন গম, কলাই ও সরিষার মিশ্রণের খাবার তৈরি করে দৈনিক ২০ গ্রাম হারে খাওয়ালে উৎপাদন ভালো হয়।
কবুতর ছানার দ্রুতবৃদ্ধি, হাড় শক্ত ও পুষ্টি প্রাপ্তির জন্য এবং পূর্ণবয়স্ক কবুতরের ও ডিমের খোসাশক্ত হওয়ার জন্য ঝিনুকের খোসা, চূন, চুনাপাথর, শক্ত কাঠ কয়লা চূর্ণ, হাড়ের গুঁড়া, লবণ এসব একত্রে মিশিয়ে গ্রিট মিকচার তৈরি করে খাওয়ানো প্রয়োজন। এছাড়া প্রতিদিন কিছু কাঁচা শাকসবজি কবুতরকে খেতে দিতে হবে।
সারণি: কবুতরের জন্য বিভিন্ন দানাদার খাদ্য মিশ্রণ:
ক্রমিক নং ।খাদ্য উপাদান । মিশ্রণের শতকরা হার (%)
০১. ভূট্টা ভাঙ্গা ৩৫ গ্রাম
০২. গম ভাঙ্গা ২০ গ্রাম
০৩. সরিষা দানা ১৫ গ্রাম
০৪. ছোলা ভাঙ্গা ২০ গ্রাম
০৫. সয়াবিন মিল ০৫ গ্রাম
০৬. চালের কূঁড়া ০৪.৫ গ্রাম
০৭. লবণ ০.৫ গ্রাম
মোট = ১০০.০০ গ্রাম
কবুতরের রোগ ব্যবস্থাপনা: আর্থিক ভাবে লাভবান হওয়ার জন্য স্বাস্থ্যসম্মত খামার ব্যবস্থাপনা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অধিকাংশ রোগই খাবার ব্যবস্থাপনার সাথে সম্পৃক্ত। স্বাস্থ্যসম্মত খামার ব্যবস্থাপনার মৌলিক বিষয়গুলো হচ্ছে-
সঠিকভাবে সেড তৈরি করতে হবে ক্স কবুতর উঠানোর পূর্বে সব যন্ত্রপাতি জীবানুমুক্ত করতে হবে
রোগমুক্ত খামার থেকে সুস্থ সবল কবুতর সংগ্রহ করতে হবে ক্স জীবানুমুক্ত খাবার ও বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ করতে হবে
খামারে অযাচিত মানুষের যাতায়ত নিয়ন্ত্রণ করতে হবে, শেড ও খোঁপ নিয়মিত পরিষ্কার করতে হবে
অসুস্থ কবুতর তড়িৎ আলাদা করে ফেলতে হবে।
কবুতরের কয়েকটি রোগ ও তার প্রতিকার:
ক্র: নং রোগের নাম রোগের লক্ষণ রোগের প্রতিকার
০১ বসন্ত পালকহীন স্থানে ফোস্কা দেখা যায়। চোখের পাতা ও চোখ ফুলে যায়। খাওয়ার অসুবিধা হয়। শরীর দুর্বল হয়ে যায়। না খেয়ে অবশেষে কবুতর মারা যায়। এ রোগ দেখা দিলে আক্রান্ত স্থান ডেটল দিয়ে পরিষ্কার করতে হবে। অথবা পটাশ দিয়ে ধুয়ে দিতে হবে। Renamycin Powder ১ গ্রাম সামান্য গরম ভাতের সাথে মিশিয়ে ২০-২৫ টি কবুতরকে খাওয়ানো যায়। Renamycin oinment আক্রান্ত স্থানে লাগলে ক্ষত দ্রুত শুকিয়ে যায় ৪ সপ্তাহ বয়সে পিজিয়ন পক্স ভ্যাকসিন বুকের বা পায়ের পালক তুলে ছিদ্রযুক্ত সূচের সাহায্যে এ টিকা দিতে হয়।
২. কলেরা সবুজ বা হলুদ ডায়রিয়া দেখা দেয়, শরীরের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পায়, শ্বাসকষ্ট, অরুচি, পানি পিপাসা বৃদ্ধি পায়। ট্যারামাইসিন ক্যাপসুল, কসুমিন প্লাস ক্যাপসুলের ভেতরের ঔষধ ৮ ভাগ করে দিনে ৩ বার পর পর ২-৩ দিন খাওয়াতে হবে। রেনাকুইন বা সুলটিক্স যে কোন একটি মুখে ব্যবহার করতে হবে।
৩. রক্ত আমাশয় বা ককসি ডিওসিস রক্ত মিশ্রিত মল, ক্ষুদামন্দা, পালক ফ্যাকাসে দেখায়, পালক ঝুলে পড়ে। ইএসবি-৩ অথবা এমবাজিন ১ লিটার পানিতে ২-৫ গ্রাম মিশিয়ে পর পর ৩ দিন খাওয়াতে হবে।
৪. রানীক্ষেত/ নিউক্যাসল সবুজ ডায়রিয়া বা টুথ পিকের মতো পায়খানা, হা করে শ্বাস-প্রশ্বাস গ্রহণ করে। পাখা ও পায়ে প্যারালাইসিস দেখা দেয়। মাথা ঘোরাসহ মাথায় কাঁপনি দেখা দেয়। সিপ্রোফ্লক্স/ সিপ্রো-১০/ রেনাফক্স ইত্যাদির যেকোন একটি ব্যবহার করতে হবে। রানীক্ষেত রোগের ভ্যাকসিন কবুতরের রানের মাংসে ১ মিলি করে প্রয়োগ করতে হবে প্রতি ৪ মাস অন্তর অন্তর।