রোমান্টিক উপন্যাস: ছায়া এসে পড়ে পর্ব- ১০
রোমান্টিক থ্রিলার ঘরানার বইটি মধ্যবয়সী পুরুষ তৈয়ব আখন্দকে ঘিরে। জীবন সংসারের প্রতি খানিকটা উন্নাসিক কিন্তু বুদ্ধিমান এ মানুষটা পালিয়ে বেড়াতে চায়। কিন্তু আচমকা টাঙন নদী ঘেঁষা গ্রাম পদ্মলতায় এসে সে আটকা পড়ে চাঁদের আলোয় ঝুলতে থাকা একটা লাশ আর লাবনীর জালে। তৈয়ব নিজেকে বের করে আনার চেষ্টা করে। চলতে থাকে জড়িয়ে পড়া ও ছাড়িয়ে আনার মাঝে এক সমঝোতা।
রোমান্টিক প্রেমের গল্প ও একই সঙ্গে থ্রিলার স্বাদের উপন্যাস ছায়া এসে পড়ে । লেখক ধ্রুব নীল
কুরিয়ারে হার্ড কপি পেতে এই পেইজে অর্ডার করুন
ছায়া এসে পড়ে পর্ব -১ এর লিংক
ছায়া এসে পড়ে পর্ব -২ এর লিংক
ছায়া এসে পড়ে পর্ব -৩ এর লিংক
ছায়া এসে পড়ে পর্ব -৪ এর লিংক
ছায়া এসে পড়ে পর্ব -৫ এর লিংক
ছায়া এসে পড়ে পর্ব -৬ এর লিংক
ছায়া এসে পড়ে পর্ব -৭ এর লিংক
ছায়া এসে পড়ে পর্ব -৮ ও ৯ এর লিংক
১০
রেবেকার সঙ্গে প্রথম দেখা হয়েছিল ভার্সিটির সেকেন্ড ইয়ারে। তৈয়ব ঢোলাঢালা শার্ট পরে ঘোরে। চোখে চশমা না থাকায় তাকে খুব একটা পড়ুয়াও মনে হয় না। কলাভবনের সামনের কোথাও বসে বসে আঁকিবুকি করতো আর ছেলেমেয়েদের দেখতো। কার বাড়িতে মা-বাবার ঝগড়া হচ্ছে, কে গোপনে নেশা করে, কে তার প্রেমিকার সঙ্গে ধোকাবাজি করছে এসব বের করা ছিল তার রুটিন। কাউকে কিছু বলতো না।
‘এক্সকিউজ মি, আপনি আমার দিকে তাকিয়ে আছেন কেন?’
রেবেকার প্রথম কথা ছিল এটা।
তৈয়ব থতমত খেয়ে যায়। তারপর মিনমিন করে বলে, আমি সবার দিকেই তাকিয়ে থাকি। বদভ্যাস। কে কী করে দেখি।
‘আমি কী কী করেছি বলেন তো?’
‘আপনি বান্ধবীদের সঙ্গে কথা বললেও আপনার মন পড়েছিল সম্ভবত আপনার মায়ের কাছে। বাবা অনেক ধনী। তবে মন্ত্রী মিনিস্টার না। আপনার মায়ের সঙ্গে উনার ঝগড়া হয়। তবে সেটা অন্য কারণে। আপনার মা মনে হয় খুব অসুস্থ। অসুস্থ মানুষ কারণে অকারণে চেঁচামেচি করে।আবার আপনি যার সঙ্গে প্রেম করছেন সে জানে আপনি ধনীর দুলালি। তার ধান্ধা হলো টাকা।’
‘স্টপ! গেট আউট।’
‘আমি গেট আউট হবো কেন? এটা সরকারি এলাকা। আমার কথা ভালো না লাগলে আপনি ভাগেন।’
তৈয়ব আসল কথা বলেনি এখনও। মাথা নিচু করে হিজিবিজি আঁকছে।
‘আপনার চোখের নিচের কালশিটে দাগটা অ্যালকোহলিক প্যাচ। অনেক দিন ধরেই মদ খাচ্ছেন। এক ফাঁকে আপনার ডায়াল লিস্ট চোখে পড়েছিল। শুধু ডি আর অক্ষর দুটি চোখে পড়েছিল। আমরা সাধারণত ডাক্তারদের নাম্বার সেভ করার আগে এ অক্ষর দুটি দিই। আপনার দুই হাতে সানবার্নের দাগ। মোটরসাইকেলে অনেকক্ষণ বসে থাকলে যেমনটা হয়। দূরে কোথাও গিয়েছিলেন। মানে বয়ফ্রেন্ড আছে। ডায়াল লিস্টে বয়ফ্রেন্ডের মিসড কল অনেকগুলো। মানে আপনি তার কল ধরতে চান না। তবে বেশিরভাগই অনুমাননির্ভর। আপনার পরিবারের কেউ কি মারাত্মক কোনও রোগে আক্রান্ত?’
দম নিতে থামল তৈয়ব। রেবেকার চোখের আবহাওয়া বদলে যেতে লাগল দ্রুত। প্রথমে প্রচণ্ড রাগ, রাগ থেকে ক্ষোভ, ক্ষোভ থেকে হতাশা। সবচেয়ে একরাশ বিষন্নতা। সে কিছু না বলে ধপ করে বসে পড়লো তৈয়বের পাশে। বসেই একটা সিগারেট ধরালো। তৈয়ব ধরে নিলো তাদের প্রেম হয়ে গেছে।
‘তুমি কাল থেকে এই শার্ট পরবে না। এই শার্ট পরা দেখলে আমি গুন্ডা দিয়ে তোমার শার্ট খুলে সবার সামনে জ্বালিয়ে দিব।’
‘জি আচ্ছা।’
‘ভালো, জি জি করবে। আপনি আপনি করে বলবে আমাকে। তুমি করে বললে তোমার নামে ইভটিজিংয়ের মামলা দেব। জামিন পাবে না কয়েক মাস।’
‘জি আচ্ছা।’
দীর্ঘ সময় কেটে গেলে ভার্সিটির মেয়েরা দুম করে ছোট ফুপু টাইপের হয়ে যায়। রেবেকাও হয়েছে। তবে চেহারার আবেদন কমেনি। ওসি বারবার জি আপা জি আপা করছে। এমনটা করার কারণও আছে। তার টেবিলে একটা ব্রিফকেস রাখা। কয় লাখ টাকা আছে কে জানে।
‘ঘটনা হেডকোয়ার্টার পর্যন্ত চলে গেছে তো। এ কারণ ধরে নিয়ে আসতে হয়েছিল। এমনিতে কিছু করি নাই। চার্জশিট তো অনেক দেরি।’
‘কেন করেননি। হাজতে এনেছেন মারধর হবে না? মারতে ইচ্ছে করলে মেরে আসুন। আমি অপেক্ষা করছি।’
‘হে হে। আপা বেশ রসিক।মজার কথা বলেন। কী খাবেন বলেন?’
‘ভদকা খাওয়াতে পারবেন?’
‘আপা, গ্রাম দেশ। দামি জিনিস কই পাই। তবে দাঁড়ান, আমি বোতল পাঠানোর ব্যবস্থা করছি।’
‘মামলা কি হয়েছে? সে তো খুন খারাবি করার মতো লোক না।’
‘কেউই আপা খুন খারাবি করার মতো লোক থাকে না আপা। পরিস্থিতি, সবই পরিস্থিতি। তা আপার পছন্দের কোনও ব্র্যান্ড আনাতে হবে?’
‘একটা হলেই হলো। যে পুলিশের স্ত্রী মার্ডার হয়েছে, তাকে কি রেপ করা হয়েছে?’
‘আপনি দেখি সব খবর রাখেন। জি রেপ করা হয়েছে বলে সুরতহালে মনে করা হচ্ছে।’
‘তা হলে এটা তৈয়বের কাজ না। সে আর যাই করুক, এসব করবে না। প্রমাণ আছে কিছু? নাকি শুধু সন্দেহ করছেন?’
‘আপা উনার বেনসন সিগারেটের প্যাকেট পাওয়া গেছে স্পটে। ভেতরে আঠারোটা শলাকা।’
‘ও তো সিগারেটই খায় না। দুনিয়ার লোক এর পক্ষে সাক্ষী দেবে। একটা সিগারেটের প্যাকেট দিয়ে খুনের মামলা সাজাচ্ছেন? কোর্টে হাজিরা দেবে কে? আপনি নাকি ওই এসআই?’
‘না আপা, বিষয়টা দেখছি। মামলাই তো হয় নাই। এমনিতে একটু টুকটাক কথাবার্তা বলার জন্য।’
‘সিগারেটের প্যাকেটের ফিঙ্গারপ্রিন্টের রেজাল্ট পেয়েছেন? রেজাল্ট আসার আগে কী করে নিশ্চিত হলেন যে ওটা তার? আর খুন করার পর এতগুলো সিগারেট ফেলে যাবে কেন? ওর পকেটে নাই একটা টাকা। তারউপর আবার দামি সিগারেট।’
এসআই শামীম এক কোনে চুপচাপ শুনছিল। ইনিয়ে বিনিয়ে বলল, ‘আসলে ওই দিন আমার সঙ্গেই ছিলেন তৈয়ব ভাই। উনার কাছে প্যাকেটটা..।’
ওসি কটমট করে তাকাতেই চুপসে গেলো শামীম। রেবেকার আর কিছু বলতে ইচ্ছে করছে না। থানায় বসে ভেবেছিল সিগারেট ধরাবে না। এখন আর উপায় নেই। লাইটার এগিয়ে দিল কনস্টেবল হাদি।
রবিউল ঠিক যে মুহূর্তে পেপারওয়েট দিয়ে বাড়ি দেবে, তখুনি রেবেকা ঢুকেছিল থানায়। বাড়িটা দিতে গিয়ে খানিকটা ধন্ধে পড়ে গিয়েছিল। গায়ের জোরে বসাতে পারেনি। মাঝারি মানের হয়েছে। তৈয়বের মাথা ফুলে আলু। তবে জ্ঞান হারায়নি, রক্তও বের হয়নি।
তৈয়বকে মারার পরই বুঝলো বিরাট ভুল হয়েছে। পীর দরবেশের গায়ে হাত দেওয়া বলে কথা। কনস্টেবলদের হাতে একদফা মার খেয়েছে। এসআই শামীমও মেরেছে।
রবিউল নিজেই এখন মেঝেতে শোয়া। মুখে যন্ত্রণার আহ উহু নেই। তাকিয়ে আছে সিলিংয়ের দিকে।
এই হাজতটা পছন্দ হয়েছে তৈয়বের। টয়লেট আছে, সিলিং ফ্যান আছে। রীতিমতো ফাইভ স্টার হাজত।
‘রবিউল তুমি উঠে বসো। তোমাকেও ছাড়ানো যায় কিনা দেখি।’
রবিউল জবাব দিল না।
তৈয়ব এখনও কোনায় বসে আছে। হাজতের মধ্যে লুকিয়ে থাকবে কেন? কারণ সে ভয় পাচ্ছে, মিনু না আবার দেখে ফেলে। একটু পর বুঝতে পারলো রেবেকা একাই এসেছে। থানায় মারধর গালিগালাজ কমন ঘটনা। এসব মিনুকে দেখাতে চায় না ও।
বাড়িতে ঢুকতেই শরবানু আর মিনুর খিলখিল হাসি শুনে মনে হলো তৈয়ব এতোদিন একটা দুঃস্বপ্নের ভেতর ছিল। লাবনী বলেও কেউ নেই। সব তার নিছক কল্পনা।
মিজান আলীর দুলতে থাকা লাশটাকে অবশ্য কল্পনা ভাবতে পারছে না। ঝরনা মৃতদেহটাও একটু পর পর মাথার ভেতর কথা বলতে শুরু করেছে, ‘ভাইজান, আমার কী গতি করলেন? আমারে ভুলে গেলে চলবে? ওই বদমাইশটা তেলতেলাইয়া ঘুইরা বেড়াইবো?’
কল্পনায় ঝরনার কথার উত্তরও দিচ্ছে তৈয়ব।
‘আমি কী করবো? হাতে প্রমাণ টমান নাই। উল্টা আমার বিরুদ্ধে কেইস করে পারলে। দেখি কী করতে পারি।’
‘আপনি যা করতে পারেন সেটাই করবেন। আপনি আমার ধর্মের ভাই। আমি আপনার আশায় আছি।’
কী যন্ত্রণা!
‘আপনারে ছাইড়া দিলো কেন?’ কথাটা কল্পনায় নয়। বলল লাবনী। পুরনো একটা শাড়ি পরে সামনে দাঁড়িয়ে আছে।
রেবেকাকে দেখে তুমি থেকে আপনিতে চলে গেলো লাবনী? হতে পারে। ঝামেলা বাড়ানোর মতো মেয়ে সে না।
রেবেকা পাশেই ছিল। চাপা গলায় বলল, ‘তুমি কে? লাবনী? তৈয়বের সঙ্গে থাকো? সমস্যা নেই। আপনি করে বলতে হবে না। চাইলে ওর গলায় ঝুলে পড়তে পারো। আমি কিছু মনে করবো না। আর আমি বেশিক্ষণ থাকবোও না। এরপর আর তোমার চিন্তা নাই। ড্রাইভারকে তো প্রত্যেক রাত গাড়িতে ঘুমাতে বলতে পারি না।’
লাবনীর মুখ কঠোর হয়ে গেলো। দপ করে জ্বলে উঠলেও আবার টলোমলো। তৈয়ব কড়া জবাব দেবে কিনা এমন আশা সে করছে না। তৈয়ব কড়া কথা বলতে পারে না। এটা দুজনই জানে।
‘লাবনী তুমি কি চা খাওয়াতে পারবে? আর রেবেকা, তোমার আজ যাওয়ার দরকার নেই। মিনু এসেছে। ওকে একটু গ্রাম দেখাই। ড্রাইভার থাকবে রবিউলের সঙ্গে। ড্রাইভার যদি বলে রবিউল সারারাত দাঁড়িয়ে থাকবে।’
‘ও তো সেই লোক, যে তোমার অফিসের পিয়ন। তুমি না বললে ও ভাড়াটে খুনি। দেখে তো মনে হয় ছিঁচকে চোর।’
এমন সময় রবিউল ঢুকলো। হাতের বাজারের ব্যাগ দেখে পরিষ্কার বোঝা যায় ভেতরে মদের বোতল। স্বয়ং ওসি পাঠিয়েছে। রবিউল ব্যাগ রেখে বাইরে গিয়ে দাঁড়াল। ক্ষমা শুধু মহত্মের লক্ষণ নয়, মানুষকে চাইলে ক্ষমার শেকল দিয়ে বজ্র আঁটুনিতেও ফেলা যায়।
বোতল চলে আসায় রেবেকারও সুর বদলে গেলো। সে মদের গ্লাস হাতে এখন আশপাশে ঘুরে বেড়াবে। লোকজনকে দেখিয়ে সিগারেট ধরাবে। এমনভাবে নিমগাছের দিকে তাকিয়ে থাকবে, যেন চেরিগাছ দেখে আনন্দে অভিভূত।
তৈয়বের ভেতরও এক ধরনের হোমড়াচোমড়া ভাব চলে এসেছে। নিজেকে মনে হচ্ছে গ্রামের উজির। রেবেকার টাকার আঁচ তার গায়েও লাগছে। এমনিতে তৈয়বের মাথাভর্তি বুদ্ধি। বুদ্ধি থাকলে নিজেকে হোমড়াচোমড়া মনে হয় না কেন?
লাবনী চা বসিয়েছে। চায়ের পানিতে টুপটাপ দুই ফোঁটা চোখের পানিও পড়েছে। কান্নার কারণ মিনু। মিনুকে কোলে নিয়ে এর মধ্যে জামরুল গাছ থেকে জামরুলও পেড়ে দিয়েছে। মিনু তার কোলে থাকতে চাচ্ছে না। লাবনী জোর করে ধরে রেখেছে।
একবার তার মনে হলো তৈয়বকে বিয়ে করলে মিনুকে নিয়েই থাকতে পারবে। আবার মনে হলো এই মেয়ের অনেক বুদ্ধি।এর মা সে জীবনেও হতে পারবে না। মা মা-ই। সে মদ খাক আর বিড়ি খাক। লাবনীর ইচ্ছে করলো শব্দ করে কাঁদতে। তৈয়ব আবার উঠোনে রাখা নীল গাড়িটায় চড়ে শহরে চলে যাবে না তো?
তৈয়বের মধ্যে একটা পালানোর স্বভাব আছে। ঢাকায় থাকতে তার এই স্বভাবের সঙ্গী ছিল মিনু। মিনুকে নিয়ে এখানে ওখানে চলে যেতো। রেবেকাকে বলে যেত ফিরতে দেরি হবে। রেবেকা তখন তার বয়ফ্রেন্ডকে সময় দিতে পারতো। তার আপত্তি ছিল না তাতে।
‘বাবা, তোমাকে পুলিশ ধরে নিয়েছিল? তোমাকে কি জেলে থাকতে হবে?’
মেয়েকে বাড়িতে রেখে গিয়েছিল রেবেকা। তাকে এ খবর কে দিল? শরবানু চাচী দিতে পারে। নাকি লাবনী? তার তো এখন ঈর্ষায় জ্বলার কথা। ঈর্ষায় জ্বলা লাবনীকে দেখতে খুব ইচ্ছে করছে তার।
‘বিরাট কাহিনিরে মা। এই গ্রামে বিশাল অ্যাডভেঞ্চার হয়ে গেছে। বাবাকে এখন চোর ধরতে হবে। দুটো চোর। চোর ধরার আগে থানার হাজত ঘুরে দেখে এসেছি। হাজত জিনিসটা বেশ ভালো। উন্নত হয়েছে। চোর ধরে ধরে সেখানে ঢোকাবো।’
‘আমিও চোর ধরবো বাবা। মাকে বলে দাও মা যেন বিদেশ না যায়।’
মিনুর কথা শুনে থমকে গেলো তৈয়ব। সচরাচর তার মাথায় রক্ত চড়ে না। এখন মনে হয় কিঞ্চিৎ চড়েছে।
প্রিপেয়ার ফর দ্য ওয়ার্স্ট বলে একটা কথা আছে। মুখে বললেও আসলে কেউ এটা মানতে চায় না। তৈয়বের এখন ওই অবস্থা। ঝরনার খুনি, মিরাজ আলীর ঝুলে পড়া, লাবনী, লোকমানসব মিলে মিশে ভর্তা মাখানি হয়ে আছে। এই ভর্তার জাল থেকে নিজেকে আলগোছে বের করে আনতে হবে। লাবনী হলো জালের মাঝে থাকা স্ত্রী মাকড়শা। যে তার পুরুষ মাকড়শাটাকে খাওয়ার জন্য মুখিয়ে আছে।
‘চল মা, আলিমের দোকানে আলু পুরি খাবো। চায়ে ভিজিয়ে খাবো। ঝাল পুরি গরম চায়ে ভিজিয়ে খেলে মুখে ভয়াবহ জ্বালা করে। তুই অবশ্য খেতে পারবি না। এই ঝাল সেই ঝাল না। জিহ্বা পোড়া ঝাল।’
‘ও মাই গড! জিব পুড়ে যাবে! তুমি কি আগুন খাবে?’
‘আগুনও খাওয়া যায়। একটু লবণ লবণ টেস্ট। ছোট থাকতে খেতাম। এখন খাই না।’
‘তুমি কি ড্রাগন?’
আলুপুরি খেতে খেতেই রেবেকার ফোন। সে চলে যাবে।
‘জলদি আসো। এখানে আর থাকছি না। পড়শু ফ্লাইট।’
‘এসেছো কটা দিন থাকো?’
‘কেন? একসঙ্গে দুজনকে নিয়ে বিছানায় যেতে চাও?’
‘মন্দ হতো না।’
‘আমার সঙ্গে এখন ফাতরামির সম্পর্ক নেই তোমার। যা করেছি মনে করো মিনুর জন্য। ও যেন বড় হয়ে মাকে অপরাধী না ভাবে।’
‘এখন যে চলে যাবে, সেটার জন্য ভাববে না?’
‘কিছু করার নেই। মেয়ে টানপড়েনের মধ্যে বড় হবে। মন শক্ত হবে। সামনের যে দিনকাল। শক্ত মনের মেয়ে হতে হবে।চিন্তা করো না। ভিডিও কলে মাঝে মাঝে কথা বলিয়ে দেবো। বড় হলে বেড়াতেও আসবে। এখন মেয়েকে নিয়ে বাড়ি আসো। তোমার লাবনী তোমার জন্য মুরগি আর পুটি মাছের চচ্চড়ি রান্না করে রেখেছে। ভালো কথা। মেয়েটা নাকি বিবাহিতা?’
‘ঠিক শুনেছো। আলুপুরিটা শেষ হোক, আসছি। মিনুর জন্য ঠাণ্ডা করে দিতে হচ্ছে। ও গরম খেতে পারছে না।’
লাইন কেটে দিল তৈয়ব। মনের একটা অংশ বলছে, ভালোই তো, আপদ বিদেয় হবে, এরপর আবার নিজের মতো করে অ্যাডভেঞ্চার করা যাবে। দুয়েকটা খুন তো করাই যায় এখন। বিড়বিড় করে বলল, ধরা যাক দুয়েকটা ইঁদুর এবার।
‘ইঁদুর কেন ধরবে বাবা?’
‘ইঁদুরের লেজ ধরে ঝুলিয়ে রাখবো। মজা দেখবো।’
‘ও মাগো। আমি পারবো না।’
‘তোকেও পারতে হবে। তা না হলে বড় হয়ে গবেষণা করবি কী করে। এখনকার গবেষণা মানে তো ইঁদুর ধরাধরির কাজ।’
তৈয়বের মনের আরেক অংশ বলছে, মিনুকে নিয়ে পালিয়ে অন্য কোনও গ্রামে গেলে কেমন হয়? সে লজিং মাস্টার হিসেবে থাকবে কারো বাড়িতে। তার মেয়ে পড়বে গ্রামের কোনও স্কুলে। অত্যন্ত দুর্বল চিন্তা। তৈয়ব বুঝতে পারলো কোনও কারণে তার মাথা স্বাভাবিক হয়ে যাচ্ছে। অনেক সহজ জিনিসও চোখ এড়িয়ে যাচ্ছে। সবার আগে যেটা চোখ এড়িয়েছে সেটা হলো আরিফের সঙ্গে রেবেকার ছাড়াছাড়িটা। রেবেকার আঙুলে আংটি নেই, আংটির দাগও নেই। বাংলাদেশের রোমান্সে এসব আংটির আদিখ্যেতা নেই যদিও।
ভালোই হলো। মিনুর সঙ্গে দেখা করতে ঝামেলা হবে না। কিন্তু মিনুকে নিয়ে রেবেকা একা একা বিদেশ যাবে কেন? দেশে তো তার অভাব নেই। চিন্তাগুলো বার বার ফসকে যাচ্ছে। চিন্তায় মরচে জমে গেছে। ডিটারজেন্ট দিয়ে ঘষতে হবে।
‘ডিটারজেন্ট কী বাবা?’
‘এটা হলো আঠারোটা কার্বন, ২৯টা হাইড্রোজেন, একটা সোডিয়াম.. বাদ দে এখন। আলু পুরি বেশি খাস নে। বাসায় মজার তরকারি রান্না হচ্ছে। লাবনী রান্না করেছে।’
‘লাবনী কে বাবা? তোমার বউ?’
নিজেকে চোরের মতো মনে হলো তৈয়বের। মেয়ের কাছে একেবারে বজ্রআঁটুনিতে ধরা খেয়েছে। কী বলবে সেটা বানাতে একটু বেশিই সময় নিচ্ছে।
‘নারে মা। লাবনী হলো লাবনী। সে কারও কেউ না। সবাইকে কিছু না কিছু হতে হয় না।’
‘আমি কি তোমার সঙ্গে গ্রামে থাকতে পারবো বাবা?’
‘নাহ। তোর মা তোকে ছাড়া থাকতে পারবে না। তুইও পারবি না। তবে এই গ্রামে অনেক মুড়ি আছে। আজ বিকেলে তোকে মুড়িবাড়ি নিয়ে যাব। নিজের চোখে দেখবি কীভাবে মুড়ি বানায়।’
আনন্দ ঝিকমিক করে উঠলো মিনুর চোখ। এটার ঝিকমিকানি দেখার জন্যই বসে থাকে তৈয়ব।
‘চল। আমরা ভটভটিতে চড়ে যাব।’
‘ভটভটি কী?’
‘ভটভটি হলো গ্রামের ব্যালিস্টিক মিসাইল লাগানো রকেট ইঞ্জিন। ইঞ্জিনে একটি সমস্যা আছে। এ কারণে আস্তে চলে। তবে শব্দ করে রকেটের মতো।’
ভটভটি ভর্তি লোকজন। মিনু বসেছে সবার মাঝে। যা দেখছে তাতেই আনন্দিত। প্রশ্নের পর প্রশ্ন। তৈয়ব তাকিয়ে আছে তার চোখের দিকে। শিশুদের ভেতরটা মোটেও খোলা বই না। এরা যে কখন কী ভাবে আর কী থেকে কী বলে, কেউ আঁচ করতে পারবে না। তৈয়ব মুগ্ধ হয়ে তার মিনুর ভটভটি যাত্রা দেখছে।