ধ্রুব নীল
মকবুল সাহেব ভুলোমনা। তার কাছে সব সময়ই হলো প্রেজেন্ট পারফেক্ট টেন্স। এইমাত্র একটা কিছু করলে সেটা খানিকক্ষণ মনে থাকে। রাত সাড়ে এগারোটায় স্ত্রী-কন্যার সঙ্গে ঝগড়া করে বাসা ছেড়ে ব্যাগ হতে বের হয়ে গেছেন। কী নিয়ে ঝগড়া সেটা মনে পড়ছে না।
রাস্তায় নামতেই পেয়ে গেলেন রিকশা। রিকশাওয়ালাই ডাক দিল।
‘যাবেন?’
রিকশাওয়ালার ডাক শুনে মনে হলো তার যাওয়া উচিত। যাওয়ার জন্যই তো বের হয়েছেন।
মকবুল সাহেব ধরে নিয়েছেন তিনি জানেন কোথায় চলেছেন। পরে কোনো এক সময় মনে পড়লেই হলো।
রিকশা থামলো একটা বস্তির মতোন জায়গায়।
‘নামেন।’
মকবুল সাহেব নামলেন। দুই যুবক পথ আটকালো। দেখতে ফিটফাট। কোম্পানির সেলসে চাকরি করলে যেমন সুটেড বুটেড থাকে।
‘আংকেল ব্যাগটা দিন, আর মানিব্যাগটা।’
ধ্রুব নীলের গল্প “তোমার অসীমে”
মকবুল সাহেব ঘাবড়ালেন না। রিকশাভাড়া দিতে গেলেন। রিকশাওয়ালা বলল, লাগবে না স্যার। মকবুল সাহেব তার মানিব্যাগ ও কাঁধের ব্যাগ যুবকদের দিকে বাড়িয়ে দিলেন।
‘কী আছে ভিতরে? জামা কাপড়?’
‘জানি না।’
‘মানে?’
‘আমি ভুলে গেছি। সঙ্গে অবশ্য মোবাইলও নেই।’
‘টাকা আছে মোটে পাঁচশ। এই টেকা নিয়া এত রাইতে কই যান।’
‘বাসা থেকে বের হয়ে গেছি তো। একটু ঝগড়াঝাঁটি হয়েছে।’
‘ঠিক আছে। এবার বাসায় যান। আমরাও বাসায় যাই। আমাদের আবার মনে রাইখেন না। আপনে আলাভোলা মানুষ। তাই আর ছুরি চাক্কু বের করলাম না।’
‘ঠিক আছে তোমরা যাও। অনেক রাত হয়েছে। এত রাতে বাইরে থাকা ঠিক না।’
‘হে হে হে। আংকেল তো ভালো কমেডি করেন।’
‘হা হা হা। মজার কথা বললে তো। চা খাবে?’
‘ফাইজলামি করেন?’
‘চা না খেলে আমি যাই। অবশ্য চায়ের বিল দিব কী করে। আমার টাকা তো…। হে হে।’
‘এই নেন, একশ নেন। রিকশা নিয়া বাসায় যান।’
মকবুল সাহেব টাকাটা নিতে কিছুটা দ্বিধা করলেন। তার মনে হলো, অন্যের টাকা নেওয়া ঠিক হচ্ছে না। তার এও মনে হলো, শারমিনের সঙ্গে ঝগড়া করে হুট করে বের হওয়া ঠিক হয়নি। সে টেনশন করবে। তারচেয়ে বেশি টেনশন করবে তার মেয়ে রেনু। রেনুর মাস্টার্স শেষ। সেও ইঞ্জিনিয়ার। মেধাবী মেয়ে। চাকরিও পেয়ে গেছে নাকি একটা। চাকরিটা কি আজকেই পেল? মকবুল সাহেবের মনে হলো তার এখুনি বাসায় চলে যাওয়া উচিত। কিন্তু ঠিকানা মনে পড়ছে না। রিকশাওয়ালাও চলে গেছে। থাকলে সে চিনতো।
মকবুল সাহেব উল্টোদিকে হাঁটতে শুরু করলেন। পথে কিছু একটা দেখে যদি কিছু মনে পড়ে এই ভেবে। শহরটা তার সবসময়ই অচেনা লাগে। শারমিনের সঙ্গে এই শহরে তার কত স্মৃতি। ভুলোমনা হলেও অনেকগুলো ঘটনা মনে আছে। বিয়ের আগে লুকিয়ে নিউ স্টার কফি হাউসে দেখা করতেন। সেটা যে কোথায়। অবশ্য কফি হাউসে গিয়ে তো আর শারমিনকে পাবেন না। শারমিন আছে এখন বাসায়। ভাত-তরকারি নিয়ে বসে আছে মনে হয়।
‘এই যে রিকশাওয়ালা ভাই, যাবেন?’
‘কই?’
‘জানি না। আমার আবার কিছু মনে থাকে না।’
‘ও আইচ্ছা। উঠেন, উঠলে মনে পড়বো।’
মকবুল সাহেব বসলেন আরাম করে। ব্যাগ না থাকায় নির্ভার লাগছে।
রাত বারোটা ছাড়িয়েছে। তরতরিয়ে চলছে রিকশা। মূলত রিকশাওয়ালা যাচ্ছে তার গ্যারেজের দিকে। ভাবছে, গ্যারেজের আশপাশে পাগল লোকটাকে নামিয়ে দেবে। কিছু টাকা পেলে মন্দ কী।
এই গলি সেই গলি আর কয়েকটা বাড়ি দেখলেন মকবুল। অদ্ভুত ব্যাপার ঘটছে। যত আশপাশ দেখছেন ততই তার স্মৃতিগুলো যেন খসে খসে পড়ছে কোনো এক অদৃশ্য দেয়াল থেকে। সব স্মৃতিই অবশ্য শারমিনকে ঘিরে। প্রেমের দিনগুলো নিয়ে। ভার্সিটিতে পড়ার সময় শারমিনের এক খালাত বোনের সামনে ধরা পড়েছিলেন। সেকি লজ্জা। মেয়েটা তাকে দেখেই বলল, আরে দুলাভাই! মকবুলের তখন চোখে পানি আসার দশা।
শারমিনদের বাড়ি এই পথেই মনে হয়। বিয়ের পর কোথায় যেন প্রথমে উঠলেন? সম্ভবত হরিদাস লেনের একটা চিলেকোঠায়। ভালো বেতনের চাকরি করতেন দুজনই। তবে শারমিন একেবারেই উচ্চভিলাষি ছিল না। সে ছিল তার উল্টো। অল্পতেই বেশি খুশি। একবার একটা সোনার চেন কিনে দিয়েছিলেন মকবুল সাহেব। শারমিনের সেকি রাগ। পরে সেটা বদলে কিনে দিতে হলো একটা রুপার নুপুর। সঙ্গে একটা ফুলের তোড়াও ছিল। সেই গ্ল্যাডিওলাসের গন্ধ এখনো মাঝে মাঝে পান মকবুল।
আরে ওই বাড়িটাই তো? বাড়িটা থেকে গ্ল্যাডিওলাসের গন্ধ আসছে কেন? মকবুল সাহেবের মন বলছে এবার তার স্মৃতি প্রতারণা করেনি। জানালায় কার যেন চিন্তিত মুখ দেখা গেল এক ঝলক। ওরা কি তাকে খুঁজতে বের হয়ে গেছে? এত রাতে অবশ্য বের হবে না। বড়জোর থানায় কথা বলবে বা মাইকিং টাইকিং করবে। আশপাশে মাইকিং শোনা যাচ্ছে না যদিও। যদি মাইকিং হতো, তবে কী বলবে মাইকওয়ালা? শারমিনের সেন্স অব হিউমার অসাধারণ। আগে সারাক্ষণ হাসাতো। মকবুল সাহেবের মনে হলো শারমিনের লেখা মাইকিংয়ের ঘোষণাটা হবে এমন- ‘মকবুল তুমি করিয়াছো বড় ভুল। বাড়িতে ফিরে আসো এখুনি। তা না হলে মস্তকে থাকিবে না চুল। জনাব মকবুল সাহেব, আমি মাইকওয়ালা বলছি, কথাগুলো ভাবি সিরিয়াসলি বলেছেন, আপনি আমার কথা শুনতে পেলে আমার দিকেই ছুটে আসুন। কারণ আমি জানি আপনি বাসা খুঁজে পাবেন না। আর কোনো কঠোর হৃদয়ের মানুষ যদি আত্মভোলা মকবুল ভাইকে দেখে থাকেন, তবে তাকে চ্যাংদোলা করে বাসায় নিয়ে আসুন। উপযুক্ত সম্মানি দেওয়া হবে।’
‘হো হো হো।’
মকবুল সাহেবের হাসিতে রিকশাওয়ালা বিশেষ পাত্তা দিল না। একটা গলিতে ঢুকতেই মকবুল সাহেব চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘আরে এখানে একটা বড় কাঠগোলাপ ছিল। ওটা নাকি? তাই তো! হতেই পারে। দাঁড়ান তো।’
রিকশাওয়ালা দাঁড়াল। মকবুল সাহেব নামলেন না। তিনি জোর করে মনে করার চেষ্টা করছেন কিছু। জোর করে মনে করার চেষ্টা করলেই সব ভজগট পেকে যায়। এত বছর যে বাড়িতে যাওয়া আসা করেছেন, সেটা এত অচেনাই লাগছে কেন? আবার মনে হচ্ছে এটাই তো সেই বাড়ি। কিন্তু গেট বরাবর নারিকেল গাছটা কেটে ফেলল কেন? আতা গাছটাই বা কোথায়?
‘নামবেন স্যার?’
‘নাহ। মনে হয় না। যেখানে যাচ্ছিলে যাও।’
মকবুল সাহেবের দিশেহারা লাগছে। আজই ঝগড়া করে বের হয়েছেন। তবু তার মনে হচ্ছে শারমিনের সঙ্গে অনন্তকাল কথা হয় না। বিয়ের কয়েক মাস পর একবার ঝগড়া করে বের হয়ে গিয়েছিলেন। সেদিন প্রথম জীবনে সিগারেটে টান দেন। তিন নম্বর টান দিতেই শারমিন হাজির। সেদিন কী দুর্ভাগ্য তার। রাত বাজে এগারোটা। অথচ বাজারের পাশের রাস্তায় লোকজন ভর্তি। সবার সামনেই সিনেমাটিক কায়দায় ঘুষি মেরে বসলো শারমিন। ঘুষির ধাক্কায় জ্বলন্ত সিগারেট উড়ে গিয়ে পড়ল এক মধ্যবয়সী নারীর গায়ে। সে আবার কী যেন গালি দিয়ে বসলো মকবুলকে। শারমিন মারতে গেল তাকেও। কোনোমতে স্ত্রীকে ঠেকান মকবুল। ওই সময় ক্যামেরাওয়ালা মোবাইল ছিল না। তা না হলে ঘটনা সারা দুনিয়ায় রটে যেত। পরে অবশ্য সেরাতেই তারা দুজন মিলে নিউ স্টার কফি হাউসে গিয়ে তেঁতুল দিয়ে গুড়ের চা খেয়েছিলেন।
‘স্যার আর যামু না। নামেন।’
মকবুল নামলেন। এগিয়ে গেলেন পাশের আরেকটা বাড়ির দিকে। থমকে দাঁড়ালেন। জোরে শ্বাস নিতেই পরিচিত গন্ধ পেলেন। সব গন্ধের নাম হয় না। মকবুল সাহেব ভুলোমনা বলে তার কাছে এ গন্ধের নাম আছে। এটা হলো নিজের বাড়ির আশপাশের গন্ধ।
গন্ধের কারণেই আচমকা সব মনে পড়তে শুরু করেছে। যত মনে পড়ছে, ততই মকবুল সাহেবের চোখমুখ কঠোর হচ্ছে। তিনি এখন জানেন, খানিকটা হাঁটলেই একটা ড্রেন। ওটা পার হওয়ার সময় একটা বাড়ির দেয়াল। দেয়াল ঘেঁষে দুটো নয়নতারা গাছ দেখা যাবে, যেগুলোর কেউ যত্ন নেয় না। শারমিন দেখলে নির্ঘাৎ প্রতিদিন পানি দিত। ওই নয়নতারা পার হলেই তার বাসা। তিনতলা একটা বাড়ির নিচতলায় ভাড়া থাকেন মকবুল সাহেব।
বাড়ির ভেতর অন্ধকার। নক করতেই দরজা খুলে দিলেন রাবেয়া। রাবেয়ার পেছনে রেনু। রেনুর চোখ ফোলা। বাবার প্রতি ভালোবাসার শেষ নেই রেনুর। বাবা যখনই রাগ করে বের হয়ে যায় তখনই তার কান্না শুরু।
অন্যদিকে বিশেষ কোনো কারণ ছাড়া ভুলোমনা স্বামীর এমন হুটহাট বের হয়ে যাওয়াটা রাবেয়ার সয়ে গেছে। তিনি কী করে যেন বুঝে যান যে লোকটা আবার পথ চিনে ফিরে আসবে। মকবুলের প্রতি তার প্রগাঢ় মমতা।
কিছুই হয়নি এমন ভাব করে রাবেয়া বললেন, ‘টেবিলে ভাত-তরকারি আছে। খাওয়া হলে তেঁতুল আর গুড়ের চা করে দিচ্ছি।’ জামা-কাপড়সহ ব্যাগটা কোথাও ফেলে এসেছে কিনা সেটা জিজ্ঞেস করতে গিয়েও করলেন না তিনি। আত্মভোলা স্বামী ফিরে এসেছে এতেই খুশি।
তেঁতুল-গুড়ের চায়ের কথা শুনেই মকবুল সাহেবের হুড়মুড় করে একগাদা স্মৃতি মনে পড়ে গেল। শারমিনের সঙ্গে তার কোনোকালে বিয়ে হয়নি। বিয়ের পরের স্মৃতিগুলো সব বানানো স্মৃতি। শারমিন সম্ভবত অন্য কাউকে বিয়ে করে বিদেশ টিদেশ চলে গেছে। দেশে থাকলেও তিনি কিছু জানেন না। এত দিন আগের কথা মনে থাকার প্রশ্নই আসে না।
বেসিনে হাত-মুখ ধুয়ে রেনুর দিকে বোকার মতো কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন মকবুল সাহেব। এরপর বসে পড়লেন ভাত খেতে।