এইচএসসি'র ফল বিপর্যয়, ক্যাডেট কলেজের সাফল্য, শিক্ষক আন্দোলন ও বিবেকের সংকট - Mati News
Friday, December 5

এইচএসসি’র ফল বিপর্যয়, ক্যাডেট কলেজের সাফল্য, শিক্ষক আন্দোলন ও বিবেকের সংকট

লেখক: জেমস আব্দুর রহিম রানা

জ্যেষ্ঠ গণমাধ্যমকর্মী ও কলামিস্ট

দেশের শিক্ষা অঙ্গন আজ এক অভূতপূর্ব সংকটের মুখে। একদিকে উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে ভয়াবহ ফল বিপর্যয়, অন্যদিকে মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষকদের একাংশের অযৌক্তিক আন্দোলন—দুটি ঘটনাই জাতির শিক্ষাব্যবস্থাকে গভীর প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়েছে। আর এই বাস্তবতার বিপরীতে ক্যাডেট কলেজের শতভাগ সাফল্য আমাদের মনে করিয়ে দেয়, দায়িত্ববোধ থাকলে সফলতা অসম্ভব নয়।

যশোর শিক্ষা বোর্ডের অধীনে এ বছর ২০টি কলেজ থেকে একজনও পাস করেনি—এমন নজিরবিহীন ফলাফল আমাদের হতবাক করেছে। এটি কেবল একটি অঞ্চলের সমস্যা নয়; বরং গোটা দেশের শিক্ষাব্যবস্থার গলদ ও অবক্ষয়ের প্রতিফলন। যখন একটি বোর্ডের অধীনে বিশটি কলেজ থেকে একজন শিক্ষার্থীও উত্তীর্ণ হতে পারে না, তখন স্পষ্ট হয় যে ব্যর্থতা শিক্ষার্থীর নয়, বরং আমাদের শিক্ষা প্রশাসন, তদারকি এবং শিক্ষক সমাজের এক বড় অংশের।

এরই মধ্যে মাধ্যমিক পর্যায়ের প্রায় ৯০ ভাগ শিক্ষক নিজ নিজ বাড়ির কাছাকাছি স্কুলে চাকরি করেন। উদ্দেশ্য যেন শিক্ষার্থীদের উন্নয়ন নয়, বরং নিজস্ব স্বাচ্ছন্দ্য ও সামাজিক প্রভাব বজায় রাখা। এর মধ্যে আবার কতিপয় বিবেকবর্জিত শিক্ষক বাড়ি ভাড়া বৃদ্ধি, পদোন্নতি ও নানা সুযোগ-সুবিধার দাবিতে আন্দোলনে নেমেছেন—যে সময়ে দেশের শিক্ষা অঙ্গন চরম সংকটে। দাবি করা অন্যায় নয়, কিন্তু যখন শিক্ষার্থীরা ফলাফল নিয়ে হতাশ, তখন শিক্ষকের এই অযৌক্তিক আন্দোলন নৈতিক দিক থেকেও প্রশ্নবিদ্ধ।

আজ দেশের অসংখ্য বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা দিনের পর দিন শিক্ষকের অপেক্ষায় ক্লাসে বসে থাকে। অনেক শিক্ষক নামমাত্র উপস্থিতি দেখিয়ে বেতন তোলেন; মানসম্মত পাঠদান ও শিক্ষার্থীর ব্যক্তিগত যত্ন যেন বিলুপ্তপ্রায়। অথচ সমাপনী পরীক্ষা সমাগত—এই সময়ে আন্দোলন নয়, প্রয়োজন ছিল শিক্ষার্থীর পাশে দাঁড়ানো ও তাদের শেখার ঘাটতি পূরণে নিবেদিত হওয়া।

অন্যদিকে ক্যাডেট কলেজগুলোর শতভাগ সাফল্য এই অন্ধকারে এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। সেখানে নেই আন্দোলন, নেই অজুহাত। আছে শুধু শৃঙ্খলা, কঠোর তদারকি, নিয়মিত ক্লাস ও দায়িত্বশীল শিক্ষক। ফলে প্রতিটি শিক্ষার্থী সফল হচ্ছে। তাদের সাফল্য প্রমাণ করে—যেখানে জবাবদিহিতা ও আন্তরিকতা আছে, সেখানে ব্যর্থতা আসতে পারে না।

এই বৈপরীত্যই আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় যে সমস্যার মূল শিক্ষার্থীর মধ্যে নয়, বরং শিক্ষকের পেশাগত নৈতিকতা ও প্রশাসনিক দুর্বলতার মধ্যে। দেশের শিক্ষা প্রশাসনকে এখনই কঠোরভাবে সিদ্ধান্ত নিতে হবে—অকার্যকর শিক্ষক ও প্রতিষ্ঠানগুলিকে পর্যবেক্ষণ তালিকায় এনে পুনর্মূল্যায়ন করা, প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক করা এবং কর্মদক্ষতার ভিত্তিতে পুরস্কার বা পদোন্নতি নিশ্চিত করা।

শিক্ষকতা কেবল পেশা নয়, এটি এক মহান দায়িত্ব। কিন্তু যখন শিক্ষক নিজের স্বার্থকে শিক্ষার্থীর ভবিষ্যতের উপরে স্থান দেন, তখন শিক্ষা হারায় তার আসল উদ্দেশ্য—চরিত্র গঠন ও জাতি গঠনের ক্ষমতা। এই অবস্থার অবসান না ঘটালে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম আরও গভীর অন্ধকারে নিমজ্জিত হবে।

উচ্চমাধ্যমিকের ফল বিপর্যয়, মাধ্যমিক শিক্ষকদের স্বার্থনির্ভর আন্দোলন এবং ক্যাডেট কলেজের শতভাগ সাফল্য—এই তিনটি চিত্র আমাদের একই বার্তা দেয়: শিক্ষা ব্যবস্থার সংস্কার এখন বিলম্বিত হলে জাতির ভবিষ্যৎ ঝুঁকির মুখে পড়বে। কারণ উচ্চমাধ্যমিকে ভয়াবহ ফল বিপর্যয়ের পাশাপাশি মাধ্যমিক শিক্ষকদের অযৌক্তিক আন্দোলন আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার নৈতিক দুরবস্থাকে উন্মোচন করেছে। পাশাপাশি ক্যাডেট কলেজের সাফল্য দেখিয়ে দিয়েছে— দায়িত্ববোধ থাকলে ব্যর্থতা শব্দটি থাকে না। অত‌এব,

শিক্ষক যদি নিজের বিবেক হারান, তবে ছাত্র শুধু পরীক্ষায় নয়, জীবনের প্রতিযোগিতাতেও ব্যর্থ হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *