রোমান্টিক উপন্যাস: ছায়া এসে পড়ে পর্ব-৬
রোমান্টিক থ্রিলার ঘরানার বইটি মধ্যবয়সী পুরুষ তৈয়ব আখন্দকে ঘিরে। জীবন সংসারের প্রতি খানিকটা উন্নাসিক কিন্তু বুদ্ধিমান এ মানুষটা পালিয়ে বেড়াতে চায়। কিন্তু আচমকা টাঙন নদী ঘেঁষা গ্রাম পদ্মলতায় এসে সে আটকা পড়ে চাঁদের আলোয় ঝুলতে থাকা একটা লাশ আর লাবনীর জালে। তৈয়ব নিজেকে বের করে আনার চেষ্টা করে। চলতে থাকে জড়িয়ে পড়া ও ছাড়িয়ে আনার মাঝে এক সমঝোতা।
রোমান্টিক প্রেমের গল্প ও একই সঙ্গে থ্রিলার স্বাদের উপন্যাস ছায়া এসে পড়ে । লেখক ধ্রুব নীল
কুরিয়ারে হার্ড কপি পেতে এই পেইজে অর্ডার করুন
ছায়া এসে পড়ে পর্ব -১ এর লিংক
ছায়া এসে পড়ে পর্ব -২ এর লিংক
ছায়া এসে পড়ে পর্ব -৩ এর লিংক
ছায়া এসে পড়ে পর্ব -৪ এর লিংক
ছায়া এসে পড়ে পর্ব -৫ এর লিংক
৬
গ্রাম দেখাটা বিশেষ উপভোগ করতে পারলো না তৈয়ব। শামীমের জোরাজুরি এটা ওটা দেখতে হলো। তৈয়ব যেন বিদেশি পর্যটক। তাকে ঘটা করে গ্রামের রাজহাঁস আর শাপলা শালুক চিনিয়ে ছাড়লো এসআই শামীম।
মিনুকে ছাড়া সুন্দর কিছুই দেখতে ইচ্ছে করে না তৈয়বের। সে থাকলে জানতে চাইতো, ‘বাবা মেয়েটা এতো সুন্দর সুন্দর শাপলা ফুল ছিঁড়ে ফেলছে কেন?’
‘শাপলা একটা তরকারি মা। তরকারি বিক্রি করে মেয়েটা ভাত খাবে। ফুলের জন্য এতো মহব্বত থাকার দরকার নাই।’
‘মহব্বত কী বাবা।’
‘মহব্বত হলো ভালোবাসা। যেমন আমি তোকে অনেক অনেক ভালোবাসিরে মা। আর কাউকে মনে হয় না বাসি।’
বাজারে গেলো দুজন। শামীম সিগারেটের প্যাকেট কিনেছে। আস্ত বেনসনের প্যাকেট বাড়িয়ে দিয়ে বলল, ‘এখন খাওয়ার দরকার নাই। মাগুর মাছের ঝোল দিয়া ভাত খাওয়ার পর ধরাবো। চলেন।’
এসআই শামীম পীড়াপিড়ি শুরু করলো বাসায় যেতে।বাসা মানে ভাড়া বাসা। ঘন ঘন ট্রান্সফারের চাকরি। নিজের বাড়ি অন্য জেলায়।
ঝরনাকে বলে এসেছেদুপুরে তৈয়ব খাবে। দুপুরের খাওয়ার আগে সরিষার তেল আর পেঁয়াজ দিয়ে মুড়ি মাখাও খাবে।
উঠোনে মোটরসাইকেল রাখতেই অস্বাভাবিক বিষয়টা নজরে পড়ে তৈয়বের। আধাঘণ্টা আগেও ঝুম বৃষ্টি হয়েছে। তখন মোটরসাইকেল রেখে রেস্টুরেন্টে চা খেয়েছে দুজন। কিন্তু উঠানে মেলে দেওয়া কাপড় সব ভিজে চুপচুপে। তাড়াহুড়ো করে সেগুলো ঘরে নেওয়ার কথা ঝরনার। সে কি বাসায় নেই? দরজা বাইরে থেকে লাগানো।
‘ঝরনা! ঝরনা! দেখো কারে নিয়া আসছি। তুমি আমার ভাইবো না নতুন বউ আনছি। আমার দোস্ত আসছে। কই তুমি!’
উঠানের পাশে পাতিল উপুড় হয়ে পড়ে আছে। আশপাশে ছড়ানো ছিটানো মাগুর মাছ। বেঁচে নেই ওগুলো।
শামীম পুলিশ। সন্দেহবাতিক মন। দ্রুত ঘরের দরজা খুলে ঢুকেই থমকে গেলো। হোলস্টারে হাত দিয়ে দেখলো রিভলবার থানায় রেখে এসেছে। সবসময় সঙ্গে রাখে না। ধপ করে বসে পড়লো একটা বড় টুলে।
তৈয়বের মাথায় চিন্তার ট্রেন। চৌকাঠে লালচে ছোপ দেখে ভেতরের দৃশ্যটা কল্পনা করে নিয়েছে অনেকটা।
দ্বিতীয় দফায় ভয়াবহ দৃশ্যটা হজম করতে হলো তৈয়বকে। মাটির মেঝেতে পড়ে থাকা ঝরনার নগ্ন শরীর পুরোপুরি ফ্যাকাসে। গলা কেটে ফেলায় শরীরের সব রক্ত বের হয়ে গেছে। মাটির মেঝে শুষে নিয়ে বেশ খানিকটা।
শামীম বিড় বিড় করে কী যেন বলছে। কয়েকবার তৈয়বের নাম উচ্চারণ করতে শুনলো। তৈয়বের মনে হলো একটা কাপড় এনে ঝরনার লাশটা ঢেকে দেওয়া উচিৎ। কিন্তু সেটা করতে পারছে না। তার নিজের শরীরও অবশ লাগছে। আরও একবার ঠিক করলো, জীবনেও মিনুকে নিয়ে গ্রামে আসবে না।
লাশটাকে না ঢাকার আরেকটা কারণ আছে। তৈয়বের চোখ গোয়েন্দাগিরি শুরু করেছে। গলার কাটা দাগ দেখলো খুঁটিয়ে। হাতের কবজি, নখের ডগা, একপাশে থেবড়ে যাওয়া তরকারির পাতিল ইত্যাদি।
শামীম চুল আঁকড়ে থুতনিতে মাথা ঠেকিয়ে বসে আছে। আশপাশের কোনও বাড়িতে সাড়াশব্দ নেই। কেউ কিছু টের পায়নি। তারমানে চিৎকার করারও সুযোগ পায়নি ঝরনা। খুনটা হয়েছে দ্রুত ও নিঃশব্দে। এরপর দরজার বাইরে থেকে লাগিয়ে চলে গেছে খুনি।
লাশ দেখে তৈয়ব বুঝল খুনের আগে ধর্ষণ করা হয়নি ঝরনাকে, মেয়েটাকে নগ্ন করা হয়েছে খুন করার পর।কারণ শাড়িটা জট পাকিয়েপাশে পড়ে আছে। রক্তে জবজব করছে ওটা। খুনি বোঝাতে চেয়েছে কেউ একজন ধর্ষণ করে তারপর খুন করেছে। কাঁচা হাতের কাজ।
খুন করা হয়েছে বিছানার ওপর। তারপর লাশটাকে নামিয়ে রাখা হয়েছে মাটির মেঝেতে। শরীরের অন্য কোথাও ক্ষত নেই, জোরাজুরির চিহ্নও নেই। মেঝের অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে সব রক্ত শুষে নিয়েছে।
রক্তের একটা ছোপ ছোপ ভাব থাকার কথা, সেটাও তেমন নেই। রক্ত গড়িয়েছে অনেক দূর। মানুষের গলা কাটার পর রক্ত কোন সারফেসে কতদূর গড়াবে? এটা জানা নেই তৈয়বের। এক্সপেরিমেন্ট করে দেখতে পারলে ভালো হতো।
‘তৈয়ব ভাই, আপনি কি একটু ওসি সাহেবের সঙ্গে কথা বলবেন? এই নেন মোবাইল।’
শামীমের চেহারা কঠোর হয়েছে। ভালো লক্ষণ। শোক সামলে নেওয়ার প্রসেসিং শুরু হয়েছে। হাতে তুলে নিয়েছে সাদা রুমাল। আলামত পরীক্ষা করার জন্য ফরেনসিকের লোকেরা যেটা ব্যবহার করে।
ওসিকে ঘটনা বলল তৈয়ব। ফোর্স পাঠানো হয়েছে। লাশ নেওয়া হবে ময়নাতদন্তের জন্য।
তৈয়ব আরেকটা বিষয় এড়াতে পারছে না। গতরাতের ঘটনা। লোকমানকে এসআই শামীমের কথা বলেছিল সে। ওই লোক ঘটায়নি তো কাজটা? সে ঝরনাকে কেন করবে খুন?
শামীম ছেলেটার জন্য মায়ার সাগরে হাবুডুবু খাচ্ছে তৈয়ব। স্পষ্ট বুঝতে পারছে গতরাতের স্মৃতিটাই ঘুরে ফিরে ভাবছে ছেলেটা। তার জীবনটা আপাতত গতরাতের মায়াবী স্মৃতিতে আটকে আছে।
এর মাঝে লাশের আশপাশটা ভালো করে দেখে নিল তৈয়ব। তার অনেকটা ফটোগ্রাফিক মেমোরি। চোখ দিয়ে ছবি তুলে নিলো যতোটা সম্ভব।
আচমকা তৈয়বের হাত শক্ত করে চেপে ধরলো শামীম।
‘তৈয়ব ভাই, আমি জানি আপনি বের করতে পারবেন কে এই কাম করসে। আপনার কাছে অনুরোধ, আপনি আমারে বলবেন আগে। কেউ যেন কিছু না জানে।ওরে আগে আমি ধরবো, পরে যা হবার হবে।’
‘কেউ কিছু জানবে না। তুমি আমার সঙ্গে আসো। বাইরে আসো। সিগারেট খাই।’
মানুষ বিশেষ বিশেষ সময়ে আপনি থেকে তুমিতে নেমে আসে। শামীমের এখন বিশেষ সময় যাচ্ছে।
লাশটাকে প্যাকেটে মোড়ানো হলো। খবর পেয়ে উঠোন ভরে যেতে শুরু করলো লোকে। তৈয়ব তাদের সবার মুখ চেয়ে চেয়ে দেখলো। এর মধ্যে মধ্যবয়সী এক লোককে কয়েকবার চোখ মুছতেও দেখলো। গ্রামের মানুষগুলো মায়ার বাঁধনে জড়ায় দ্রুত। শহরে এক ফ্ল্যাটে কেউ মরলে পাশের ফ্ল্যাটের কেউ টেরও পায় না।
রোমান্টিক উপন্যাস
তিনদিন পরের কথা। এ তিনদিনে বিশেষ কোনও ঘটনা ঘটেনি। লাবনী এসেছিল দুয়েকদিন। যথারীতি রাত কাটিয়ে সকালে চলে গিয়েছিল ভোরের আলো ফোটার আগেই।
তাকে নিয়ে কেন যেন এ মুহূর্তে মাথা ঘামাচ্ছে না তৈয়ব।
দ্বিতীয় রাতে শামীম এসেছিল। রাতে তৈয়বের বাসাতেই ঘুমিয়েছে। তার বাসায় নাকি ঝরনাকে ঘুর ঘুর করতে দেখেছে ও। তৈয়ব ভেবে পাচ্ছে না, যে স্ত্রীকে এতো ভালোবাসতো, সে ভূত হয়ে ফিরে এলে তো ভালোই। ভয় পাওয়ার জায়গায় খুশি হওয়ার কথা। শামীম ভয় পাচ্ছে কেন? ঝরনা তাকে মেরে ফেলবে এই ভয়ে? ঝরনা একা একা অশরীরি হয়ে থাকতে ভালো লাগছে না?
তৃতীয় রাত শামীম এলো না। তৈয়ব আখন্দের মনে কু-ডাক দিচ্ছে। ঝড়বাদলা নেই। আকাশে ঝকঝকে তারা।
‘ঘুমাইসো?’
‘লাবনী?’
‘জি না, আমি পেত্নি। সুন্দরী পেত্নি।’
‘তুমি সুন্দরী কে বলল। নাক বোঁচা। ডান পাশের গাল বাম পাশের চেয়ে সামান্য দেবে থাকে।’
তেড়ে এসে তৈয়বের চুল ধরে ঝাঁকি দিল লাবনী। আছড়ে পড়লো গায়ের ওপর। লাবনীর অভিনয়টা ভালোই উপভোগ করলো তৈয়ব।
‘আজকে তোমারবন্ধু আসে নাই?’
‘ওর বউটাকে কেউ খুন করেছে। আর আমার মনে হয় সে নিজেওসুইসাইড করবে। গ্রামে মড়ক লেগেছে বুঝলা। গুনীন লাগবে।’
‘ঘোড়ার ডিম সুইসাইড করবে। দুদিন যাক। আরেকটা বিয়ে করবে। তিন দিন পর কেইসও ডিসমিস। কিন্তু খুন করলো কে? অবশ্য মেয়ে তো পুলিশের বউ। খেপা থাকতে পারে অনেকে।’
লাবনীর মন খানিকটা বিষণ্ন হলেও প্রকাশ করতে চাইলো না। কিন্তু সেও জানে, তৈয়বের কাছে লুকানো যায় না। তার কাছে লুকানোর দরকারও বোধ করে না ও। তার কাছে তৈয়ব হলো পানির মানুষ। সারাক্ষণ টলটল করে।
‘আমি মরলে তুমি সুইসাইড করবা?’
‘নাহ। সুইসাইড করবো কেন? মরে গেলে তো তোমার স্মৃতিও শেষ। মানুষের আসল বস্তু হলো স্মৃতি। তুমি মরলে তোমার স্মৃতি বয়ে বেড়াবো আমি। দরকার হয় স্মৃতি রাখার জন্য একটা বস্তা কিনবো।’
‘তারমানে মরবা না?’
লাবনী অভিমান করলে করুক। এখন সে অভিমানের ভান করলেও সেটাকে সত্য মনে হবে। ঝরনার ঘটনায় তার কেন যেন খারাপ লাগছে না। উল্টো সমাধান করার মতো একটা রহস্য পেয়ে ভালোই লাগছে। মনে হচ্ছে গ্রামে এমন দুচারটা ট্র্যাজেডি ঘটলে ক্ষতি কী।
লাবনীর শরীরের আঁচ এসে লাগছে গায়ে। শরীরে আঁচে একটা কিছু আছে। তাতেই আচমকা একটা ক্লু মিলে গেলো। চট করে উঠে বসলো তৈয়ব। শামীমের সঙ্গে কয়েকদিন সিগারেট খেয়ে হালকা নেশা হয়ে গেছে। এখন নিজেই প্যাকেট কেনা শুরু করেছে। সিগারেট ধরালো। লোকমানের টাকায় সস্তা দেখে একটা ফোনও কিনেছে।
রোমান্টিক উপন্যাস
ফোন করলো এসআই শামীমকে।
‘ভালো টাইমে ফোন করসেন তৈয়ব ভাই। আপনার কাছ থেকে বিদায় নেওয়ার দরকার ছিল। দড়ি কিনে আনছি। দোকানদারকে বলসি, গরু বাঁধার দড়ি দেন। কারণ আমি তো একটা গরু। পুলিশ হইয়াও নিজের পরিবারকে বাঁচাইতে পারি নাই। কথা ঠিক না?’
‘ফাঁস নেবে ভালো কথা, তার আগে শোনো। ক্লু পেয়েছি। খুনিকে বের করা দুই মিনিটের কাজ। তুমি আজ রাতে আর ফাঁস নিও না। মোটরসাইকেল নিয়ে সকালে আসো। ফাঁস নেওয়ার জন্য আরও রাত পড়ে আছে।’
লাইন কেটে দিল তৈয়ব। থাকুক একটু সাসপেন্স।
লাবনী বলল, ‘এখন আসতে বললে না কেন? মতলবটা কী? বাসায় যুবতী মেয়ে আছে এ জন্য?’
‘রাতটা তাকে টাইম দিলাম। টাইম হইল শোকের মলম। তার মলম দরকার।’
‘সত্যিই ধরে ফেলসো খুনি? তুমি অবশ্য বিরাট গোয়েন্দা।’
‘হুম। আধাআধি ধরেছি। পুরাটা না। খুন করার টাইমটেবিলটা ধরতে পেরেছি। খুনি ধরা সময়ের ব্যাপার।’
‘তোমার লগে আবার জিন-পরী নাই তো?’
‘আছে তো। মাঝে মাঝে কানের কাছে ফিসফিস করে বলে যায়।’
‘কী বলে?’
‘তারা বিশেষ কিছু বলে না। জীবনানন্দে কবিতা বলে। আবার আকাশে অন্ধকার ঘন হয়ে উঠেছে…।’
কার আকাশে কীসের অন্ধকার, জানতে চাইলো না লাবনী।
তৈয়বের চোখ খোলা। খোলা চোখে এখন মাথার ভেতর আগের তোলা ছবিগুলো দেখছে। একইসঙ্গে মুখে কথা চালিয়ে যাচ্ছে। এটাও তার একটা গুণ।
‘লোকমান তোমারে মনে হয় না মারবে। তুমি কি তার সঙ্গে সংসার চালাবে ঠিক করেছো? আমাকে বিয়ে করবে না? প্ল্যান কী তোমার লাবনী?’
‘আমার কোনো প্ল্যান ট্যান নাই। লোকমান সাহেবের ধারণা আমি তার সম্পত্তির লোভ করি। তবে তার কাছে মাফ চেয়ে নিয়েছি। এখন তারে ছেড়ে যাব না। সে আমার স্বামী। তোমার লগে যা হবার গোপনে হবে। তুমি আমার গোপন প্রেমিক। কোনও আপত্তি আছে?’
কথাটা শোনার পর তৈয়বের ইচ্ছে হলো ঝট করে লাবনীকে নিয়ে আকাশে উড়াল দেয়। বাস্তবে পারলো না। আপাতত আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরলো। এই মেয়ের জন্য চোখ বুঁজে দুচারটে খুন সে-ও করে ফেলতে পারে এখন।
‘সম্পত্তি পেলে ভালোই হবে, কী বলো। এক কাজ করা যাক, আমরালোকমানকেও মেরে ফেলি। এরপর পালিয়ে যাই।কী দারুণ অ্যাডভেঞ্চার।’
‘ধরা পড়বা না?’
তৈয়ব আবার হাসলো। চেষ্টা করলো হাসির মধ্যে শয়তানি ভাবটা আনার। ঠিকমতো হলো না। লোকমানের মতো লোককে মারা দুই মিনিটের কাজ। কিন্তু দুই মিনিটের কাজে মজা নেই। লোকমানকে মারতে হবে ভিন্ন কায়দায়। তৈয়বের মাথায় আবার গিজগিজ করতে শুরু করলো প্ল্যান।
‘একটু দাঁড়াও। ওষুধটা খেয়ে আসি। ওষুধ না পেলে দেখা যাবে আজ রাতেই ঘটনা ঘটে যাবে।’
‘ঘটনা মানে? আমার জন্য তুমি লোকমানরে সত্যি সত্যি মারতে পারবা?’
লাবনীর কথার মধ্যে আবেদনটা তৈয়বের কান এড়ালো না। লোকমানকে সরিয়ে দিলে মেয়েটার লাভ কী? আসলেই সম্পত্তি চায়? নাকি অন্যকিছু।
‘তুমি ধরা পড়লে তোমার মেয়ের কী হবে? আমার নিজের তো পোলা-মাইয়া কিছু হইল না।’
বিষন্ন হতেই ঢিল পড়লো লাবনীর বাঁধনে।
‘আমার মেয়ে ভালোই থাকবে। মেয়ের মায়ের টাকার অভাব নাই। টাকায় সুখ কেনা যায়। বস্তা বস্তা সুখ কেনা যায়।’
‘আমারে কিনতে পারবা টেকা দিয়া?’
তৈয়ব জবাব দিল না। সিগারেট ধরিয়ছিল। ওটা ফেলে শুয়ে পড়েছে লাবনীর কোলে মাথা রেখে।
‘লাবনী, তুমি কি আমাকে মেরে ফেলতে চাও কখনও? তোমার মধ্যে সিরিয়াল কিলার একটা ভাব আছে। সিরিয়াল কিলাররা তাদের প্রিয়জনদের কেন যেন আগে মেরে ফেলতে চায়। আপনজন মানেই পিছুটান। তাদের পিছুটান ভালো লাগে না।’
‘তুমি আমারেডরাও? তুমি না বীরপুরুষ? মাঝরাইতে লাশ দেখতে বাইর হও।’
‘আমি ভীতুর ডিম। ভয়ে নিজের মেয়েকেও দেখতে যেতে পারবো না। বউ ইশারা করলে পরদিন আমি জেলহাজতে। নারী নির্যাতন কেস খুব ডেঞ্জারাস। শার্লক হোমসকেও ছয় মাস জেল খাটতে হবে।’
‘আমি কিছু চাই না। আমি চাই তোমার লগে এখন শুইয়া থাকতে। আরও একটা জিনিস চাই। কইতে পারুম না। বুইঝা লও মাঝি।’
তৈয়বের মাথায ঝরনার মার্ডার কেইস। চিন্তার সুতো বারবার কেটে যাচ্ছে লাবনীর কথায়। তবে সে বিরক্ত হচ্ছে না। ঘোর লাগা অবস্থায় আছে। কিছুক্ষণ আগে দুতিনটা ওষুধ খেয়ে নিয়েছে। আকাশে অন্ধকার ঘন হচ্ছে আরও, জীবনানন্দের মতো এই অন্ধকার দেখতে অনেকটা আলোর ভাইয়ের মতো। মনের আলো-আঁধারিটা খুব উপভোগ করে তৈয়ব। সে নিজেও মাঝে মাঝে এমন আলো-অন্ধকার তৈরি করে।
‘তুমি যা ভাবসো তা না। আমার চাওয়াটা শুনলে হাসবা।’
‘বলো। একটু হাসি। অনেক দিন হাসি না।’
‘টাঙন নদীর কূলে একটা নৌকায় আমি আর তুমি.. নৌকা গেল মাঝনদীতে। ঢেউয়ে দুলতাসে। এ কাইত ওই কাইত। ভিতরে আমরাও দুলতাসি। মাইঝনদীতে আমগোরে লোকমান মিয়া পাইবো কই! খিক খিক।’
লাবনীর বর্ণনার ঢঙেচিন্তার সুতো সব ঘ্যাচাং করে কেটে গেল। সত্যি সত্যি নিজেকে মাঝি মনে হলো তৈয়বের। নৌকা দোলার আগেই কিছু কাজ করে রাখতে হবে।
মনে মনে দ্রুত নোটখাতা খুললো। মনে মনে নোট নেওয়ার অদ্ভুত ক্ষমতা আছে তার। তাতে ঝরনার ফ্যাকাসে শরীরটা এঁকে রাখলো মাঝ বরাবর। নিচে সূত্রগুলো গুছিয়ে লিখে দিলো ঝটপট।
সূত্র-১:লাশের গলার কাটা দাগ বেশ মিহি আর এক পোঁচে কাটা। ছুরি, বটি বা ধানকাটার কাচি দিয়ে কাটা হয়নি। অন্যকিছু দিয়ে কাটা হয়েছে। ধারালো সার্জিক্যাল ব্লেড টাইপ। খুনি আধুনিক, স্মার্ট ও খুন খারাবির বিষয়ে জ্ঞান রাখে।
সূত্র-২: খুন যে করেছে সে ঝরনার পরিচিত। ঝরনা সম্ভবত খাটে চোখ বুঁজে শুয়েছিল। খুনি ঘরে ঢোকার পরও। এরপর ঝরনার দুই হাত চেপে রেখেছিল খুনি। ছটফট করতে পারেনি মেয়েটা। যে কারণে বিছানা আর শাড়ি রক্তে মাখামাখি হলেও ভাঁজ করা চাদর এলোমেলো হয়নি।
সূত্র: ঝরনার শরীর সামান্য ছুঁয়ে দেখেছিল তৈয়ব। লাশের শরীরের তাপমাত্রা বোঝার জন্য। বেশ ঠাণ্ডা মনে হয়েছে তার। লাশ এত ঠাণ্ডা হবে? রুম টেম্পারেচারের চেয়েও কম তো হওয়ার কথা নয়।
সূত্র লেখা শেষ। এবার লাবনীকে জড়িয়ে ধরে মাঝনদীতে নৌকার দুলুনি উপভোগ করার পালা। ঝড়ও উঠেছে। বাড়ি খাচ্ছে কপাট। নৌকাও দুলছে ভীষণ। একবার তলিয়ে যাচ্ছে, আবার ভেসে উঠছে।
ছায়া এসে পড়ে পর্ব -৭ এর লিংক
রোমান্টিক উপন্যাস