class="post-template-default single single-post postid-47469 single-format-standard wp-custom-logo group-blog vl-boxed aa-prefix-matin-">
Shadow

ধ্রুব নীলের অতিপ্রাকৃত সায়েন্স ফিকশন : যে কারণে ঘোর বর্ষা দেখতে নেই

 

ধ্রুব নীলের অতিপ্রাকৃত সায়েন্স ফিকশন ঘোর বরষাবর্ষা খুব বেশি হলে তাকে ঘোর বর্ষা বলে। এর কারণ, অধিক বর্ষায় এক ধরনের ঘোর লাগে। তবে সত্য কথাটা হলো এই ঘোর সবার লাগে না। আমার লাগার কথা ছিল কিনা জানি না, তবে ১৯৯০ সালের ওই ঘটনায় আমি একবার ভীষণ এক বর্ষা-ঘোরে পড়ে গিয়েছিলাম। মাসটা ছিল আষাঢ়।

দুলার হাটে আমি আগে কখনো যাইনি। আমার এক বন্ধু আরিফের বাড়ি ওই গ্রামে। আরিফ আমাদের এলাকায় থাকতো তার বাবার চাকরির কারণে। ছুটি পেলে বাড়ি যেত। দুর্গম পাহাড়-পর্বত বা সমুদ্র নয়, অচেনা ছিমছাম গ্রামই আমাকে বেশি টানতো। তাই নতুন গ্রাম দেখার লোভে আরিফের সঙ্গে যেতে একবার রাজি হয়ে যাই। বাড়িতে ম্যানেজ করতে কষ্ট হলেও আমার জেদের কাছে হার মানে সবাই। যে সময়ের কথা বলছি, তখন মোবাইল-টেলিফোন ছিল না। ছিল শুধু ফিল্মের ক্যামেরা। আমি তখন কলেজে। আমার একটা ক্যামেরা ছিল। ওটা ছিল যাবতীয় অ্যাডভেঞ্চারের একমাত্র সঙ্গী। পকেটে অবশ্য একটা নোটবুক আর কলম রাখার বাতিকও ছিল। দুলার হাটের সবচেয়ে ভেতরে অজপাড়া গাঁ যাকে বলে সেখানেই ছিল আরিফদের গ্রাম। গ্রামের নামটা ঠিক মনে পড়ছে না। সম্ভবত চানমোহন বা এরকম একটা কিছু হবে। ধরি নামটা চানমোহনই।

চানমোহনে পৌঁছার পর থেকেই ঝিরিঝিরি বৃষ্টি। উপক‚লীয় গ্রাম। নি¤œচাপ আর সতর্ক সঙ্কেতের মাস। বৃষ্টি তো হবেই। আরিফের বাড়ির লোকজন বিশেষ করে রেজু চাচা আমাকে বারবার সতর্ক করে দিতে লাগলেন আমি যেন ভুলেও বৃষ্টি বাদলার সময় নদীর কাছে না যাই। তার ধারণা নদীর কাছে গেলেই আমি সাঁতার কাটতে চাইব এবং ডুবে যাব। নদী বলতে ওটা সমুদ্রেরই অংশ। বড় বড় ঢেউ। তবে সত্যি বলতে কি ঢেউ বাবদ আগ্রহ ছিল না। আমি এসেছিলাম গ্রামের বর্ষা উপভোগ করতে। অপেক্ষায় ছিলাম কখন নামবে সেই ঘোর বর্ষা।

এসেছি দুদিন হলো। এই দুদিনে ছাতা হাতে গ্রামটা চষে বেড়িয়েছি। ছোটখাট গ্রাম। সুপারি গাছ, নারকেল গাছ আর বনজুঁইয়ের ঝোপগুলো মুখস্থ হয়ে গেল। সীমানার ওপারে শূন্য সৈকত। আরেকপাশে চিকন জঙ্গলে ছাওয়া রাস্তা চলে গেছে হাটের দিকে। বর্ষা না আসতেই ঘোরে পড়ে গেলাম। গ্রামটার একটা আলাদা গন্ধও পেতে শুরু করেছি। কেমন যেন মেটে মেটে গন্ধ। বাড়িতে চিঠি পাঠিয়ে দিয়েছি, ফিরতে দেরি হবে।

আমার কাক্সিক্ষত ঘোরবর্ষা এলো দুদিন পরেই। এর মাঝে গল্প হওয়ার মতো কোনো ঘটনা ঘটেনি। তাই ওসব বাদ রাখলাম। তার আগে বলে রাখি গ্রামে আমার এক অন্যরকম কিশোরের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল। বয়স নয় দশ হবে। ছেলেটার চোখ বড় বড়। কথা বলে না। আমি আগ বাড়িয়ে টুকটাক কথাবার্তা বলেছিলাম। কারণ তাকে দেখে আমার মনে হয়েছিল সে এ গ্রহের বাসিন্দা নয়। নির্ঘাৎ এলিয়েন। চুপচাপ মাঠে দাঁড়িয়ে আকাশ দেখে। বিড় বিড় করে। আমি প্রথম দেখেই উচ্ছ¡সিত হয়ে মনে মনে ভাবি, আরে! আমার মতো! ছেলেটার নামও জানি না। তবে এ গল্পে সে একটা গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র। মূল গল্পে আসা যাক।

আমি আরিফদের বাড়ির উঠোনে। দূরে টুকটাক বজ্রপাত হচ্ছিল। পরে সেটাও থেমে গেছে। শুরু হলো ভারি বৃষ্টি। সামনের কিছুই দেখা যায় না এমন বৃষ্টি। আমি স্ট্যাচুর মতো দাঁড়িয়ে রইলাম। বৃষ্টি দেখে মনে হলো কয়েকটা পরতের মতো পড়ছে। পাতলা চাদরের মতো। একটা সময় আমি কিছুই দেখতে পাচ্ছিলাম না। একটা সাদা ঝিরঝির ছবি কেবল। মনে হলো বৃষ্টিটা বুঝি আমায় গিলে খেয়ে ফেলেছে। ভয় ভয় লাগলো। আরিফদের বাড়ি কোন দিকে ঠাহর হলো না। পা বাড়ালাম। চোখে বৃষ্টির ছাট বাড়ি খাচ্ছে। আমি অন্ধের মতো এগোচ্ছি। হাঁটতে হাঁটতে বুঝলাম ভুল পথে চলে এসেছি। ভাসা ভাসা দুয়েকটা গাছ দেখতে পাচ্ছি। তবে গাছগুলো অপরিচিত। উঠোন পেরিয়ে একটা দুটো বাড়ির পর একটা সুপারি গাছের রাস্তা থাকার কথা। সেখানে একটা খালের মতো। তার দুপাশে আবার বেতের ঝোপ। আশ্চর্য! এ গাছ তো দেখিনি আগে। ধীরে ধীরে আরো দৃশ্য পরিষ্কার হতে লাগলো। জাঁকিয়ে বসলো ভয়টা। আমি কোথায়! এ তো চানমোহন না! যে পথ ধরে হেঁটে এসেছি সেটাও অচেনা। পাশে এটা কার বাড়ি?

আমার হাতের ছাতাটাই কেবল আমার চেনা। বাকি সবই অচেনা। একজন মানুষের দেখা পেলে হয় এখন। ওই তো। কে যেন মাথায় কলাপাতা ধরে দৌড়ে আসছে। এক মধ্যবয়সী কৃষক। আগলে দাঁড়ালাম তার পথ।

‘আমি কোথায়! এ গ্রামের নাম কী!’

‘ও মিয়াভাই, আষাইড়া গেরামে আপনে নতুন?’

‘কী বললেন! এ কেমন নাম।’

‘ও বুঝছি আপনে নতুন।’

 

আশপাশের বাড়ির ছেলেমেয়ে এরা। বাড়ির ভেতর থেকে এক প্রবীণ ও এক নারী বেরিয়ে এলেন। আমাকে বসার জন্য একটা পুরনো ভাঙাচোরা চেয়ারও দিলেন। যেন আমার অপেক্ষাতেই ছিলেন তারা।

 

‘দাঁড়ান দাঁড়ান। আমার কথা শেষ হয়নি। আরিফদের বাড়িটা কোন দিকে। আমি চানমোহনে যাব।’

‘চানমোহন! এইডা আবার কেমুন নাম! হেহে।’

‘এটা কোথায়? আজ কত তারিখ? আমি কোথায়?’

‘আপনে আষাইড়া গেরামে আছেন। আমি গেলাম। দেরি হইয়া যাইতেসে। সময় বেশি নাই হাতে।’

‘আপনার এত তাড়া কীসের?’

‘মিয়াভাই আপনে আটকা পড়সেন। তয় ডরাইয়েন না। গেরামে আসছেন। ঘুরেন ফিরেন। গেরস্থ বাড়িত গিয়া জিরান। এরপর সময় হইলে যাইবেন।’

লোকটা আর দাঁড়াল না। হনহন করে চলে গেল। আমি যতটা অবাক হয়েছিলাম, ততটাই রয়ে গেলাম। মনের তাগিদে ফের হাঁটতে শুরু করে দিলাম। হাঁটতে হাঁটতে যাকে বলে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে গেলাম। চানমোহনের চেয়েও মনে হলো সুন্দর এ গ্রাম। কোথায় এক বিন্দু কৃত্রিমতা চোখে পড়ল না। মাটির গন্ধ এখানে আরো কড়া। বৃষ্টিতে আলের ওপর দুয়েকটা কই আর টাকি মাছ লাফাতে দেখলাম। হাতের ছাতাটাই এখন বেমানান।

ঝিরঝির বৃষ্টিটা থামতেই ঝলমলিয়ে উঠল রোদ। ছাতা বন্ধ করে বসে পড়লাম একটা গাছের নিচে। টেনশন কাজ করছে, তবে সেটা আমাকে ভাবাচ্ছে না। হয়ত গ্রামটা একেবারে আমার স্বপ্নের গ্রামের মতো বলেই। নাকি আমি স্বপ্ন দেখছি! নাহ, সে সুযোগ নেই। পথ ভুলই হয়েছে।

এর মাঝে খিদে পেয়েছিল। গাছ থেকে পেয়ারা পেড়ে খেয়েছি। কেউ কিছু বলেনি। সবজি ক্ষেতে দুয়েকজন গৃহিনী আর শিশু-কিশোরকে চোখে পড়ল। তারা কেউ আমার ডাকে সাড়া দেয়নি, কথাও বলেনি। অবাক হয়ে দেখলো খানিকক্ষণ, তারপর আবার যার যার কাজে মন দিল।

‘আরে! ওই তো! ওই ছেলেটা! যাকে আমি এলিয়েন ভেবেছিলাম। এ্যাই, এদিকে আসো!’

‘ও বাই আপনেও আসছেন?’

‘মানে কী! আমিও এসেছি মানে।’

‘আষাইড়া গেরামে আপনেও আসছেন? আমিও এই গেরামে থাকি।’

‘ঘটনা কী বলতো?’

‘হেহেহে।’

‘হাসছো কেন? আজব তো! দাঁড়াও তোমার একটা ছবি তুলি।’

পকেটেই ছিল ক্যামেরা। কিন্তু ছবি তোলার আগেই ছেলেটা দৌড়ে চলে গেল। আমি তাকে কয়েকবার ডাকাডাকি করে ক্ষান্ত দিলাম। এবার ভাবলাম, অনেক হলো। এবার কারো বাড়িতে গিয়ে উঠতে হবে। জিজ্ঞেস করতে হবে সব।

 

প্রথমে একটা বাড়ির উঠোনে ঢুকতেই আমাকে ঘিরে ধরলো একদল শিশু। আশপাশের বাড়ির ছেলেমেয়ে এরা। বাড়ির ভেতর থেকে এক প্রবীণ ও এক নারী বেরিয়ে এলেন। আমাকে বসার জন্য একটা পুরনো ভাঙাচোরা চেয়ারও দিলেন। যেন আমার অপেক্ষাতেই ছিলেন তারা।

‘ইয়ে মানে। আমি আরিফদের বাসা।’

‘আসমা, এরে গুড় আর মুড়ি দে।’

এক কিশোরীর দিকে তাকিয়ে বললেন গৃহিনী। কিশোরী দৌড়ে ভেতরে গেল গুড়-মুড়ির ব্যবস্থা করতে। প্রবীণ লোকটার গায়ে চকচকে শার্ট। মাফলার ঠিক করে আমার সামনে এসে দাঁড়াল। হাল্কা কাশি দিল। যেন ভয়াবহ কিছু বলতে চায়।

‘শোনো বাবা। তুমি এই গেরামে নতুন। তবে তোমারে দেইখা মনে হয় তুমি ভয় পাও নাই।’

‘এই গ্রামে যারা নতুন আসে, তারা সবাই ভয় পায়?’

‘হ, এইটা একটা আষাইড়া গেরাম।’

‘এই আষাড়ে গ্রাম জিনিসটা কী?’

লোকটা চুপ করে রইল। সম্ভবত একটা ভাল সংজ্ঞা সাজাচ্ছে।

‘এই গ্রাম শুধু আষাঢ় মাসে থাকে।’

লোকটা বেশ গুছিয়ে শুদ্ধ ভাষায় কথা বলছে। হতে পারে এই একই কথা তিনি হয়তো আরো অনেককেই শুনিয়েছেন। তাই এমন শোনাচ্ছে।

‘তুমি ছোট মানুষ। আর তোমার সাহসও মেলা। তোমারে আমরার পছন্দ হয়েছে।’

এমন সময় গুড়-মুড়ি হাজির। কোনো রকম খিদে চাপা দিতে হবে। তাই আর না করলাম না। দুদ্দাড় গিলতে শুরু করলাম আর লোকটার কথা শোনার চেষ্টা করলাম।

‘আরিফদের বাসা কোথায় বলতে পারবেন? তার চাচার নাম রেজু।’

সবাই চুপ। দুয়েকজনের ফিসফিস কানে আসলে আমার নিজের মুড়ি চাবানোর শব্দে সেটা বুঝতে পারলাম না। এরপর যখন আমার মুড়ি আর গুড় খাওয়া শেষ হলো তখন হুট করে আমার খেয়াল হলো ছাতাটা আমার সঙ্গে নেই। সম্ভবত রোদ ওঠার পর কোনো গাছতলাতেই রেখে এসেছি। আমি উঠে দাঁড়ালাম।

রাত হওয়া পর্যন্ত আমি এক নাগাড়ে হেঁটেছি। দুপুরে আর খাওয়া হয়নি কারো বাড়িতে। এতক্ষণ হেঁটে আমি নিশ্চিত হয়েছি যে আমি সত্যিই চানমোহনে নেই এবং এ গ্রামটা একটা গোলকধাঁধার মতো

‘জ্বি আপনাদের ধন্যবাদ। আমি যাই।’

‘ঠিকাছে যাও।’

‘দুপুরে খাইতে আইসো।’ মৃদুস্বরে বললেন ওই গৃহিনী। আমার খুব ইচ্ছে হলো দুপুরে এ বাড়িতে এসে ডাটা শাক দিয়ে ছোট মাছের চচ্চড়ি খেয়ে যেতে। কিন্তু আগে আমাকে চানমোহন খুঁজে বের করতে হবে।

পথে কারো সঙ্গে বিশেষ কথা হলো না। তবে এক বুড়ো কৃষক মাথায় শাকের আঁটি নিয়ে আমার সামনে দাঁড়িয়ে একগাল হাসলেন।

‘তুমি কুন গ্রামের ছাওয়াল?’

‘আমি চানমোহনের ছাওয়াল। আপনি?’

‘আষাইড়া গেরামে ঘুরতাসো? ভাল কইরা দেখো।’

‘কী গ্রাম বললেন? এটা কোথায়? কোন জেলায়?’

আমি এমন ভাব করলাম যেন নামটা আমি প্রথম শুনেছি। কিন্তু তাতে কাজ হলো না। লোকটা হাসিমুখেই আবার চলে গেল।

রাত হওয়া পর্যন্ত আমি এক নাগাড়ে হেঁটেছি। দুপুরে আর খাওয়া হয়নি কারো বাড়িতে। এতক্ষণ হেঁটে আমি নিশ্চিত হয়েছি যে আমি সত্যিই চানমোহনে নেই এবং এ গ্রামটা একটা গোলকধাঁধার মতো। একদিক দিয়ে সোজা হাঁটতে হাঁটতে আবার সেদিকেই এসে হাজির হচ্ছি। গ্রামটার শেষেই আবার গ্রামটার শুরু। অসহায় বোধ করতে লাগলাম। অবচেতন মন খুঁজতে লাগল সেই বালককে। কিন্তু তার আর দেখা মিলল না। শেষে উপায় না দেখে আবার সেই বাড়িতে গিয়ে হাজির হলাম। কিছু বলতে হলো না। ওরা মনে হয় আমার অপেক্ষাতেই ছিল।

‘যারা আষাঢ়ে গ্রামে আসে, তারা আপনাদের বাড়িতেই আসে?’

ওরা সম্ভবত আমার প্রশ্নটা বুঝতে পারেনি। তাই উত্তর পেলাম না। আমি খেতে শুরু করলাম। এত স্বাদের ভাত আর তরকারি আমি জীবনেও খাইনি। আষাড়ে গ্রামটা আসলেই মন্দ না।

‘আমরা এই গেরামে আছি ধরো বাপ-দাদার আমল থেইকা। আমরা কেউ কোথাও যাই নাই।’

গৃহিনী বললেন, ‘তুমি থাইকা যাও।’ খেতে খেতে বললাম, ‘তাই তো মনে হচ্ছে। যাওয়ার রাস্তা তো পাচ্ছি না।’

দুজনে চুপ। আমাদের সঙ্গে দুটো মেয়ে শিশুও খাচ্ছিল। তারা নিজেরা নিজেরা কী নিয়ে যেন হাসছে। একজন আমার ক্যামেরার দিকে তাকাচ্ছে বারবার। হাত ধুয়েই তাই দেরি না করে ওর একটা ছবি তুলে ফেললাম এবং কথা দিলাম ছবিটা ওয়াশ করে তাকে একটা কপি দেব।

আমার ঘুমানোর ব্যবস্থা করা হলো। সামনের ঘরের একটা চৌকি। তাতে শীতল পাটি পাতা। একটা ধোয়া কাঁথাও পেলাম। আরামে চোখ বুঁজে আসতে চাইল একবার। আবার দুশ্চিন্তায় কেটে যেতে লাগল ঘুম। এমন সময় জানালা দিয়ে উঁকি দিল মস্ত একটা চাঁদ। যাক, আষাড়ে গ্রামে তাহলে চাঁদও আছে।

এরপর কয়েকটা দিন যথারীতি কোনো গল্প ঘটল না। ঘটনাগুলো রুটিনমাফিক। এর মধ্যে শুধু দুবার ওই রহস্য বালকের দেখা পেয়েছি। সে মহা উৎসাহে নিজের মতো খেলায় মত্ত ছিল। আমার কথার জবাবই দেয়নি। চানমোহনের কথা বললেই দৌড়ে পালায়। যেন নামটা শুনতেই চায় না ও। আমার টেনশন দুশ্চিন্তা এসবের কথা আর নাই বা বললাম। শুধু ভয় হতে লাগলো আষাঢ়ে গ্রামের বাকিদের মতো না আবার আমিও সব মানিয়ে নিতে শুরু করি।

আমার আপাতত ঠিকানা হয়ে গেল সুরুজ আলির ঘর। যার বাড়িতে আমি প্রথম চিড়া-মুড়ি খেয়েছিলাম। তার স্ত্রী রাবেয়া খাতুনকে আমি চাচি ডাকা শুরু করে দিলাম। তাদের ছোট দুই কন্যা আমাকে ভাই বানিয়ে ফেলল। আমার মনে হতে লাগল আমি আসলেই এ গ্রামেরই বাসিন্দা এবং এটাই আমার পরিবার। চানমোহনকে মনে হতে লাগল একটা কাল্পনিক গ্রাম।

আষাঢ়ে গ্রামের নিয়মকানুন অদ্ভুত। গ্রামের সীমানা সবাই এড়িয়ে চলে। কেন এড়িয়ে চলে সেটা আমি প্রথম দিনেই টের পেয়েছি। সে কথা অবশ্য কাউকে বলিনি। আরেকটা নিয়ম হলো ঝড়বৃষ্টিতে কেউ ঘর ছেড়ে বের হয় না। কারণটা আমি আঁচ করতে পেরেছিলাম কিছুটা। তবে সত্যি বলতে কি আমারও মনে হলো, ঝড় বৃষ্টিতে আষাঢ়ে গ্রামে বের না হওয়াই ভাল। এই তো বেশ আছি আমি। কচু শাক, লাল শাকের ঝোল, পুকুরে মাছ ধরা, গাছ লাগানো, সবজি গাছের তলার আগাছা পরিষ্কার, লাউগাছের গোড়ায় শুকনো গোবর দেওয়া; এসব তো আমারই কাজ। আমার মনেই পড়লো না, আমি স্কুলে ঠিক কী পড়েছি বা আদৌ আমি স্কুলে যেতাম কিনা।

সম্ভবত দশ কি পনের দিনের মাথায় আমি সত্যিই বিশ্বাস করতে শুরু করলাম, আমার একটা অসুখ হয়েছিল। আমি উল্টোপাল্টা আচরণ করেছি এবং আমার বাবা সুরুজ আলি ও মা রাবেয়াকে আমি নাকি কিছুদিন চাচা-চাচি ডেকেছি। এ নিয়ে সবাই হাসাহাসিও করেছে।

শুধু একটা চাবি ছিল, যে চাবিটা আমাকে জানিয়ে দেয়, কোথাও না কোথাও একটা তালা আছে। যেটা আমাকে খুলতে হবে। চাবিটা হলো সেই বালক। যার বয়স নয় কি দশ। ছেলেটার মুখে হাসি লেগেই থাকে। আমাকে দেখলে তার হাসির ধরন বদলে যায়। একবার ঠিক করলাম ছেলেটাকে যে করেই হোক পাকড়াও করতে হবে। জানতে হবে রহস্যটা কী।

সন্ধ্যায় গল্প বলার আসর হবে, এমন ঘোষণা দিতেই ফাঁদে পা দিল ছেলেটা। ছোটদের আগেই জানিয়ে রেখেছিলাম, ছেলেটা যেন পালাতে না পারে। ফাঁদে আটকা পড়েছে বুঝতে পেরে মিইয়ে গেল ছেলেটা। মিনমিন করে বলল, আপনে চইলা যান। আপনে চইলা যান। আমি বললাম, ‘ধুর বেটা। আমি যামু না। তুই আমারে ক, তুই এমুন করস ক্যান।

‘আমি যামু না। আপনে যান।’

‘আমি কই যামু।’

‘চানমোহনে যান।’

নামটা শুনেই কেমন যেন লাগল। খুব পরিচিত একটা নাম। পরিচিত সুপারি গাছের সারি, তাল গাছ আর বনজুঁই। বনজুঁই অবশ্য এ গ্রামেও আছে। গন্ধ খুব ঝাঁঝাল হয়। চানমোহন নামটা শুনলে ঠিক সে রকমই একটা ঝাঁঝাল গন্ধ নাকে ঠেকে। সেই গন্ধ অনেকক্ষণ নাকেই লেগে থাকে। ছেলেটা এবার আর দৌড়ে পালাল না। চুপচাপ কেটে পড়ল। আমি এটা সেটা ভাবতে ভাবতে খাওয়া শেষে শুয়ে পড়লাম।

জানালা দিয়ে আসা চাঁদটা বারবার মেঘের আড়ালে ঢেকে যাচ্ছে। আশপাশে গুঞ্জন। ‘তুফান আইতাসে, আষাইড়ড়া তুফান আইতাসে।’

আমি শিহরণ বোধ করলাম। এই প্রথম এই গ্রামে ঝড় দেখবো। তাও এমন পূর্ণিমার রাতে। অবশ্য চাঁদটা এখন কমই ধরা দিচ্ছে।

শুরু হলো ঝমঝম বৃষ্টি। যেমনটা সবাই বলছিল ওইরকম তুফান না হলেও বৃষ্টির সঙ্গে বাতাস আছে বেশ। আমি কাঁথামুড়ি দিয়ে শুয়ে আছি। জানালা বন্ধ করা দরকার। বৃষ্টির ছাঁট পায়ের দিকটা ভিজিয়ে দিচ্ছে। জানালা খানিকটা ফাঁকাই রাখলাম। কাঁথা সরিয়ে উঠে দাঁড়ালাম। ফাঁক দিয়ে চোখ রাখলাম। বাতাসে পানির ছিটায় চোখ খোলা রাখা দায়। এর মাঝে একবার শুধু বাড়ির পেছনের পুকুরে চাঁদের আলোর ঝিলিক দেখতে পেলাম। এরপর বাড়তে লাগল বৃষ্টির দাপট। পুরো গ্রাম ঘুমিয়ে পড়েছে বোধহয়। আমি গুটি পায়ে উঠে দাঁড়ালাম। গোটা বৃষ্টিটাকে মনে হলো একটা প্রাণী। আমাকে ডাকছে ঝমঝমিয়ে। দরজার আড়ালে রাখা লম্বা কালো মজবুত গড়নের ছাতাটা তুলে নিলাম। দরজা খুলে নামলাম উঠোনে। একেই বুঝি বলে ঘোর বর্ষা। পানির সঙ্গে পানির আঘাতে দেখা দিচ্ছে ধোঁয়াশা। ধীরে ধীরে হারিয়ে গেল পুকুরটা, পুকুরপাড়ের বেতগাছ, হোগলা পাতা, বাসক। সবার শেষে বৈঁচি গাছটাও ভুতুড়ে অবয়বের মতো ধীরে ধীরে নাই হয়ে গেল।

বৃষ্টি কতক্ষণ ধরে চলেছে জানি না। থামতেই ভোরের আলো ফুটে উঠল আকাশে। জানালা দিয়ে দেখলাম আমাদের সরকারি কোয়ার্টারের চার নম্বর বিল্ডিংয়ের হাফেজ আংকেল জোর কদমে মসজিদের দিকে যাচ্ছেন। তারমানে ফজরের আযান হয়েছে একটু আগে। বৃষ্টিতে চারপাশ দারুণ সতেজ। এমন শুদ্ধ বাতাস আর হয় না। গেটের তালা খুলে বের হয়ে এলাম। সরকারি আবাসিক এলাকা হওয়ায় চারপাশ বেশ ছিমছাম। গাছপালা থাকলেও বনজঙ্গল কিংবা কাদামাটির সোঁদা গন্ধ নেই। পুকুরপাড়ে একটা বনজুঁই গাছ বেড়ে উঠেছে নিজে নিজে। গাছটাকে আমার খুব আপন মনে হয়। ওটার দিকে তাকিয়ে আমার মনে হলো, ঠিক এ গাছটাই আমি আগে কোথাও কোনো এক সময় দেখেছি। আরিফ নামের কোনো এক বন্ধুর গ্রামে বা অন্যকোনো গ্রামে সম্ভবত। কিন্তু এ নামে তো আমার কোনো বন্ধু নেই। কে জানে! ঘোর বর্ষার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে আমরা তো কত গল্পই বানিয়ে ফেলি।

 

ধ্রুব নীলের বই কিনতে এখানে ক্লিক করুন

রক্তবন্দি
রক্তবন্দি
ছায়া এসে পড়ে
ছায়া এসে পড়ে
সায়েন্স ফিকশন ২০২১ রক্তদ্বীপ
সায়েন্স ফিকশন ২০২১ রক্তদ্বীপ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Please disable your adblocker or whitelist this site!