মামুন সরকার
ভোরবেলা। কুয়াশার চাদর বাড়িঘরকে আবৃত করে রেখেছে। দূরের বাড়িঘর কিংবা রাস্তার বৃক্ষলতাদি দৃষ্টিগোচর হয় না। সবকিছু আবছায়া লাগে। পুরো আকাশেটা যেন কুয়াশার চাদরে ঢাকা। বাতাসে শিউলি ফুলের ঘ্রাণ।
গাঁয়ের এক কিশোরী উঠোনে দাঁড়িয়ে, কাঁখে কলস।
নগ্ন পা’য়ে ছুটে চলে নদীর দিকে। শিশিরভেজা ঘাস কিশোরীর পা ভিজিয়ে দেয়। ঘাসের ডগায় টলমল করে মুক্তোদানার মত।
নদীর ঘাটে কলস ভরে। জলে প্রতিচ্ছবি দেখা যায়। জলে পড়া ছায়ার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসে। সেই হাসি বাতাসে ঢেউয়ে মিলিয়ে যায়।
পেছন থেকে এক কিশোর জানতে চায়, “কুসুম, এত ভোরে একা একা নদীরঘাটে। ভয় করে না।
ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনে তাকাতেই দেখে এক কিশোর
পাশে দাঁড়িয়ে আছে।, হাতে বাঁশের লাঠি। চোখে কৌতূহল।কিশোরী একগাল হেসে জবাব দেয়, ভয় কি জিনিস আমি জানি না। আমি জানি নদীরজল, আঁকাবাঁকা পথঘাট সবই আমার বন্ধু। ওরাই আমার সাহস।
ভোরের সৌন্দর্যের মত তোমার হাসি। কিশোর পাপন ভাবে,“এই হাসিই কি পৃথিবীর সবচেয়ে মূল্যবান রত্ন?”
কিশোরী কুসুমের সারাদিন কাটে মাঠে কাজ করে। ক্ষেতে ধান রোপণ, আগাছা তোলা, গোয়াল সামলানো—সব কাজেই সে কঠুর পরিশ্রমি। ঝাঁঝালো রোদের নোনা ঘামে ভিজে চুল, তারপরও মুখে থাকে আলোর মতো হাসি।
গ্রামের বুড়োরা বলে,“ওর হাসি হাসিতে মনে হয়, ধানের শিষও সোনালি হয়ে ওঠে।”
এক বিকেলে পাপন কাশফুল হাতে কুসুমের মুখোমুখি হয়।
“কুসুম, তুমি হাসলে নদীর ঢেউ সের তুলে।”
কুসুম লাজুক হাসি দিয়ে কাজ চালিয়ে যায়।কোন কথা বলে না। কুসুমের দৌড়ঝাঁপ ধান ক্ষেতের মধ্যে লুকোচুরি, সবকিছুতেই পাপন খুঁজে পায় তার চোখের দীপ্তি।
পথেঘাটে চোখে চোখ পড়লেই অন্যরকম এক অনুভূতি দু’জনের মনকে নাড়া দেয়। দু’জনের মনেই ছায়া ফেলে। যে ছায়ার মধ্যে লুকিয়ে আছে এক গভীর মায়া। আর মায়া মানেই ভালোলাগার বহিঃপ্রকাশ।
কুসুম মনে মনে ভাবে, পাপনের এই দৃষ্টি কি শুধু তার জন্য? সে যখন চোখে চোখ রাখে মনটা নদীর মতো অস্থির লাগে”।
বর্ষার দিনে কর্দমাক্ত মাঠে কুসুম ধান রোপণ করছে।
হঠাৎ পাপন কাছে এসে বলে,কুসুম, কাদার ভেতর তোমাকে দেখে মনে হয় পদ্মফুল ফুটেছে।
কুসুম হাসে। হাসির মধ্যে মায়াবী ঢেউ খেলা করে। কুসুম জবাব দেয়, আমার জীবন তো কাদামাটির মতোই। কাদাতে পদ্মফুল ফুটে কিনা জানি না।
পাপন আচমকা কুসুমের হাত ধরে বলে, কাদামাটির মানুষই আসল মানুষ। তোমার প্রতিটা হাসিই পদ্মফুল।
কুসুম লাজে মাথা নিচু করে রাখে। পাপনের হাতের স্পর্শ বিদ্যুৎ চমকানোর মত কুসুমের মনে শিহরণের ঢেউ খেলে।
চাঁদের আলোয় পুকুরপাড়ে বসে তারা স্বপ্ন আঁকে।কুসুম বলে,যদি আমাদের ঘর হয়, উঠোনে একটা বকুলগাছ থাকবে।
আর সেই বকুলের হাসি সুবাস ছড়াবে সারা ঘরে। আমার কাছে তুমিই একটা বকুল গাছ। তোমার ঠোঁটের মোহনীয় হাসিই হবে আলোর প্রদীপ। তোমার ভারোবাসার আলোতেই হবে আমার পথ চলা।
পৌষের উৎসব। মাটির মাঠে কিশোরেরা নাচে, কিশোরীরা গান গায়।
পুকুরঘাটে কুসুম বসে আছে। পরনে সাদা লালপেড়ে শাড়ি। হাতে রঙবেরঙের কাঁচের চুড়ি। জলের ঢেউ তার প্রতিবিম্ব। চোখে কিশোরের ছবি, হৃদয়ে প্রেম।
পাপন এসে পাশে বসে। হাতে একগাদা কাশফুল। কাশফুলের শুভ্র হাসি যেন কুসুমের ফোঁটে। সায়েম কাশফুল হাতে দিয়ে বলে,এই ফুলের মতোই তোমার হাসি। তোমার হাসিতে আমি বিমোহিত হই। হারিয়ে যাই তোমার মাঝে। তুমি কী তা বুঝতে পারো কুসুম?
কুসুম লাজে শাড়ির আঁচলে মুখ ঢাকে। কিছু বলে না। কাশফুর হাতে নিয়ে দৌড়ে দৌড়ে ছুটে বাড়ির দিকে। কুসুমের প্রশংসা গাঁয়ের সবার মুখে। এমন পরিশ্রমী ঘরগুছানো মেয়ে পাঁচ গাঁয়ে বিরল।
কুসুমের মা অসুস্থ। ঝড়বৃষ্টি, গরু, ক্ষেতের কাজ সামলে মায়ের সেবাযত্মে কঠিন এক জীবন। এক সাঁঝরাতে পাপন বলে, শুনেছি তোমার মায়ের অসুখটা বেড়েছে।,তুমি একা মাঠের কাজ, মায়ের সেবাযত্ন কি ভাবে সামলাচ্ছ।
কুসুম হাসিমাখা ঠোঁটে জবাব দেয়, আমরা কাদামাটির নিয়ে কাজ করি। অসুখবিসুখ আমাদের তেমন ঘায়েল করতে পারে না। সবকিছুকে মেনে নেয়াই আমাদের সংগ্রাম। রুজিরোজগার ছাড়া চুলোতে হাড়ি উঠে না।
কুসুমের কথা শুনে নীরবে নিচু করে সবকিছু বোঝে নেয় পাপন। পকেট থেকে কিছু টাকা কুসুমের হাতে গুঁজে দিয়ে বলে, আমি তোমার বন্ধু। টাকা কয়টা রাখো। মায়ের চিকিৎসায় কাজে লাগবে।
কুসুম হাত সরিয়ে নিয়ে বলে, না পাপন, আমি তোমার টাকা নিতে পারব না। আমরা দীনদরিদ্র মানুষ। ঋণের টাকা পরিশোধ করতে পারব না। আমাদের থাকার ভিটে ছাড়া কোন জমিজিরাত নেই যে —
পাপন বুঝতে পারে কুসুম কি বলতে চাচ্ছে। গাঁয়ের মানুষ ঋণ নিয়ে তা পরিশোধ করতে না পারলে মহজনরা আবাদি জমি দখল করে নেয়। পাপন তো আর মহাজন না। সে কুসুমের বন্ধু। পাপন কুসুমের কথা শেষ করতে না দিয়ে বলে, কুসুম কোন আমি মহাজন না৷ আমি তোমার বন্ধু। বিপদে তোমার পাশে দাঁড়াতে পারলে নিজেকে ধন্য মনে করব। আমি তোমাকে কোন ঋণ দিচ্ছি না। বন্ধু হয়ে বন্ধুকে সহযোগিতা করছি। তুমি টাকাটা না নিলে খুব কষ্ট পাবো। আর এই টাকা তোমাকে পরিশোধ করতে হবে না। তোমার মা তো আমারও মা। চিকিৎসায় তিনি সুস্থ হয়ে যে দোয়া করবেন, তাতেই আমার জীবন আলোকিত হবে। আমরা সুখি হব এটাই আমার চাওয়া।
কুসুম যেভাবে কিছু বলে না। নীরবে চোখের জল আড়াল করে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে। এই মুহূর্তে এমন কিছু টাকা তার খুব দরকার ছিল। যা পাপনে হাত থেকে পেয়েছে।
ধীরে দের মধ্যে সম্পর্ক গাঢ় হতে থাকে। পাপনের মা বাবাও বিষয়টা জেনে যায়। পাপনের পরিবারর বেশির ভাগ আত্মীয়-স্বজন শহরে বাস করে। পাপনও শহরের আলো বাতাসে বড় হয়। বাবা-মা চান, শহরের কোন মেয়ে পাপনের বউ হয়ে আসুক।
বাবা এক সকারে পাপনকে বলেন, পাপন, তুমি শহরে লেখাপড়া করছো। একটা রুচিবোধ থাকা দরকার। একটা দিন-দরিদ্র মেয়েকে তুমি পছন্দ করবে, ভাবতেই আমার গা কেমন গিনগিন করছে। গ্রামের মানুষ তোমাকে নিয়ে কানা গুসা করছে। আমার মান-সম্মান আর থাকলো না।
পাপন কথার জবাব দেয়, যদিও আমি শহরে লেখা পড়ে করেছি কিন্তু আমার শিকড় কিন্তু গ্রামে। তোমার অনেক টাকা পয়সা আছে। তাই বলে মানুষকে ছোট করে দেখার কোন অবকাশ নেই। আর টাকা দিয়ে সম্মান কেনা যায় না। সম্মান আসে মানবতা আর শিষ্টাচার থেকে। গ্রামের দরিদ্ররাও মানুষ। হয়তো তাদের জমিজিরাত নেই। কিস্তু সরল একটা মন আছে। যে মনে কোন পাপ নেই। আছে ডালভাত খেয়ে বেঁচে থাকার সংগ্রাম।
পাপনের কোন নীতি কথাই বাবা আমলে নেন না। সাফ জানিয়ে দেন, আত্মীয়-স্বজন মিলে যে মেয়ে পছন্দ করেছে তাকেই বিয়ে করতে হবে।প্রভাবশালী বাবার সাথে পেড়ে ইঠে না পাপন। অবশেষে খবর আসে, পাপনের বিয়ে শহরের ধনী মেয়ের সঙ্গে ঠিক হয়েছে।
সেই সাঁঝরাতে কুসুম নদীর ঘাটে একা বসে থাকে। পাশে খালি কলস। চোখে কষ্টের জল। আকাশের তারাগুলোও মিটমিট জ্বলছে। বাতাসে একটা বনফুলের ঘ্রাণ ভেসে আসে। কুসুম মনে মনে ভাবে,
“প্রেম কি কেবল ধনীদের জন্য? আমার ঘামের গন্ধে, মাটির টানে কি সৌন্দর্য নেই?”
ভোরবেলা। কুয়াশার চাদর বাড়িঘরকে আবৃত করে রেখেছে। দূরের বাড়িঘর কিংবা রাস্তার বৃক্ষলতাদি দৃষ্টিগোচর হয় না। সবকিছু আবছায়া লাগে। পুরো আকাশেটা যেন কুয়াশার চাদরে ঢাকা। বাতাসে শিউলি ফুলের ঘ্রাণ।
গাঁয়ের এক কিশোরী উঠোনে দাঁড়িয়ে, কাঁখে কলস।
নগ্ন পা’য়ে ছুটে চলে নদীর দিকে। শিশিরভেজা ঘাস কিশোরীর পা ভিজিয়ে দেয়। ঘাসের ডগায় টলমল করে মুক্তোদানার মত।
নদীর ঘাটে কলস ভরে। জলে প্রতিচ্ছবি দেখা যায়। জলে পড়া ছায়ার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসে। সেই হাসি বাতাসে ঢেউয়ে মিলিয়ে যায়।
পেছন থেকে এক কিশোর জানতে চায়, “কুসুম, এত ভোরে একা একা নদীরঘাটে। ভয় করে না।
ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনে তাকাতেই দেখে এক কিশোর
পাশে দাঁড়িয়ে আছে।, হাতে বাঁশের লাঠি। চোখে কৌতূহল।কিশোরী একগাল হেসে জবাব দেয়, ভয় কি জিনিস আমি জানি না। আমি জানি নদীরজল, আঁকাবাঁকা পথঘাট সবই আমার বন্ধু। ওরাই আমার সাহস।
ভোরের সৌন্দর্যের মত তোমার হাসি। কিশোর পাপন ভাবে,“এই হাসিই কি পৃথিবীর সবচেয়ে মূল্যবান রত্ন?”
অধ্যায় ২ : খেতের খেলা
কিশোরী কুসুমের সারাদিন কাটে মাঠে কাজ করে। ক্ষেতে ধান রোপণ, আগাছা তোলা, গোয়াল সামলানো—সব কাজেই সে কঠুর পরিশ্রমি। ঝাঁঝালো রোদের নোনা ঘামে ভিজে চুল, তারপরও মুখে থাকে আলোর মতো হাসি।
গ্রামের বুড়োরা বলে,“ওর হাসি হাসিতে মনে হয়, ধানের শিষও সোনালি হয়ে ওঠে।”
এক বিকেলে পাপন কাশফুল হাতে কুসুমের মুখোমুখি হয়।
“কুসুম, তুমি হাসলে নদীর ঢেউ সের তুলে।”
কুসুম লাজুক হাসি দিয়ে কাজ চালিয়ে যায়।কোন কথা বলে না। কুসুমের দৌড়ঝাঁপ ধান ক্ষেতের মধ্যে লুকোচুরি, সবকিছুতেই পাপন খুঁজে পায় তার চোখের দীপ্তি।
পথেঘাটে চোখে চোখ পড়লেই অন্যরকম এক অনুভূতি দু’জনের মনকে নাড়া দেয়। দু’জনের মনেই ছায়া ফেলে। যে ছায়ার মধ্যে লুকিয়ে আছে এক গভীর মায়া। আর মায়া মানেই ভালোলাগার বহিঃপ্রকাশ।
কুসুম মনে মনে ভাবে, পাপনের এই দৃষ্টি কি শুধু তার জন্য? সে যখন চোখে চোখ রাখে মনটা নদীর মতো অস্থির লাগে”।
বর্ষার দিনে কর্দমাক্ত মাঠে কুসুম ধান রোপণ করছে।
হঠাৎ পাপন কাছে এসে বলে,কুসুম, কাদার ভেতর তোমাকে দেখে মনে হয় পদ্মফুল ফুটেছে।
কুসুম হাসে। হাসির মধ্যে মায়াবী ঢেউ খেলা করে। কুসুম জবাব দেয়, আমার জীবন তো কাদামাটির মতোই। কাদাতে পদ্মফুল ফুটে কিনা জানি না।
পাপন আচমকা কুসুমের হাত ধরে বলে, কাদামাটির মানুষই আসল মানুষ। তোমার প্রতিটা হাসিই পদ্মফুল।
কুসুম লাজে মাথা নিচু করে রাখে। পাপনের হাতের স্পর্শ বিদ্যুৎ চমকানোর মত কুসুমের মনে শিহরণের ঢেউ খেলে।
চাঁদের আলোয় পুকুরপাড়ে বসে তারা স্বপ্ন আঁকে।কুসুম বলে,যদি আমাদের ঘর হয়, উঠোনে একটা বকুলগাছ থাকবে।
আর সেই বকুলের হাসি সুবাস ছড়াবে সারা ঘরে। আমার কাছে তুমিই একটা বকুল গাছ। তোমার ঠোঁটের মোহনীয় হাসিই হবে আলোর প্রদীপ। তোমার ভারোবাসার আলোতেই হবে আমার পথ চলা।
পৌষের উৎসব। মাটির মাঠে কিশোরেরা নাচে, কিশোরীরা গান গায়।
পুকুরঘাটে কুসুম বসে আছে। পরনে সাদা লালপেড়ে শাড়ি। হাতে রঙবেরঙের কাঁচের চুড়ি। জলের ঢেউ তার প্রতিবিম্ব। চোখে কিশোরের ছবি, হৃদয়ে প্রেম।
পাপন এসে পাশে বসে। হাতে একগাদা কাশফুল। কাশফুলের শুভ্র হাসি যেন কুসুমের ফোঁটে। সায়েম কাশফুল হাতে দিয়ে বলে,এই ফুলের মতোই তোমার হাসি। তোমার হাসিতে আমি বিমোহিত হই। হারিয়ে যাই তোমার মাঝে। তুমি কী তা বুঝতে পারো কুসুম?
কুসুম লাজে শাড়ির আঁচলে মুখ ঢাকে। কিছু বলে না। কাশফুর হাতে নিয়ে দৌড়ে দৌড়ে ছুটে বাড়ির দিকে। কুসুমের প্রশংসা গাঁয়ের সবার মুখে। এমন পরিশ্রমী ঘরগুছানো মেয়ে পাঁচ গাঁয়ে বিরল।
কুসুমের মা অসুস্থ। ঝড়বৃষ্টি, গরু, ক্ষেতের কাজ সামলে মায়ের সেবাযত্মে কঠিন এক জীবন। এক সাঁঝরাতে পাপন বলে, শুনেছি তোমার মায়ের অসুখটা বেড়েছে।,তুমি একা মাঠের কাজ, মায়ের সেবাযত্ন কি ভাবে সামলাচ্ছ।
কুসুম হাসিমাখা ঠোঁটে জবাব দেয়, আমরা কাদামাটির নিয়ে কাজ করি। অসুখবিসুখ আমাদের তেমন ঘায়েল করতে পারে না। সবকিছুকে মেনে নেয়াই আমাদের সংগ্রাম। রুজিরোজগার ছাড়া চুলোতে হাড়ি উঠে না।
কুসুমের কথা শুনে নীরবে নিচু করে সবকিছু বোঝে নেয় পাপন। পকেট থেকে কিছু টাকা কুসুমের হাতে গুঁজে দিয়ে বলে, আমি তোমার বন্ধু। টাকা কয়টা রাখো। মায়ের চিকিৎসায় কাজে লাগবে।
কুসুম হাত সরিয়ে নিয়ে বলে, না পাপন, আমি তোমার টাকা নিতে পারব না। আমরা দীনদরিদ্র মানুষ। ঋণের টাকা পরিশোধ করতে পারব না। আমাদের থাকার ভিটে ছাড়া কোন জমিজিরাত নেই যে —
পাপন বুঝতে পারে কুসুম কি বলতে চাচ্ছে। গাঁয়ের মানুষ ঋণ নিয়ে তা পরিশোধ করতে না পারলে মহজনরা আবাদি জমি দখল করে নেয়। পাপন তো আর মহাজন না। সে কুসুমের বন্ধু। পাপন কুসুমের কথা শেষ করতে না দিয়ে বলে, কুসুম কোন আমি মহাজন না৷ আমি তোমার বন্ধু। বিপদে তোমার পাশে দাঁড়াতে পারলে নিজেকে ধন্য মনে করব। আমি তোমাকে কোন ঋণ দিচ্ছি না। বন্ধু হয়ে বন্ধুকে সহযোগিতা করছি। তুমি টাকাটা না নিলে খুব কষ্ট পাবো। আর এই টাকা তোমাকে পরিশোধ করতে হবে না। তোমার মা তো আমারও মা। চিকিৎসায় তিনি সুস্থ হয়ে যে দোয়া করবেন, তাতেই আমার জীবন আলোকিত হবে। আমরা সুখি হব এটাই আমার চাওয়া।
কুসুম যেভাবে কিছু বলে না। নীরবে চোখের জল আড়াল করে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে। এই মুহূর্তে এমন কিছু টাকা তার খুব দরকার ছিল। যা পাপনে হাত থেকে পেয়েছে।
ধীরে ধীরে তাদের মধ্যে সম্পর্ক গাঢ় হতে থাকে। পাপনের মা বাবাও বিষয়টা জেনে যায়। পাপনের পরিবারর বেশির ভাগ আত্মীয়-স্বজন শহরে বাস করে। পাপনও শহরের আলো বাতাসে বড় হয়েছে। বাবা-মা চান, শহরের কোন মেয়ে পাপনের বউ হয়ে আসুক।
বাবা এক সকালে পাপনকে বলেন, পাপন, তুমি শহরে লেখাপড়া করছো। একটা রুচিবোধ থাকা দরকার। একটা দিন-দরিদ্র মেয়েকে তুমি পছন্দ করবে, ভাবতেই আমার গা কেমন গিনগিন করছে। গ্রামের মানুষ তোমাকে নিয়ে কানা গুসা করছে। আমার মান-সম্মান আর থাকলো না।
পাপন কথার জবাব দেয়, যদিও আমি শহরে লেখা পড়ে করেছি কিন্তু আমার শিকড় কিন্তু গ্রামে। তোমার অনেক টাকা পয়সা আছে। তাই বলে মানুষকে ছোট করে দেখার কোন অবকাশ নেই। আর টাকা দিয়ে সম্মান কেনা যায় না। সম্মান আসে মানবতা আর শিষ্টাচার থেকে। গ্রামের দরিদ্ররাও মানুষ। হয়তো তাদের জমিজিরাত নেই। কিস্তু সরল একটা মন আছে। যে মনে কোন পাপ নেই। আছে ডালভাত খেয়ে বেঁচে থাকার সংগ্রাম।
পাপনের কোন নীতি কথাই বাবা আমলে নেন না। সাফ জানিয়ে দেন, আত্মীয়-স্বজন মিলে যে মেয়ে পছন্দ করেছে তাকেই বিয়ে করতে হবে।প্রভাবশালী বাবার সাথে পেড়ে ইঠে না পাপন। অবশেষে খবর আসে, পাপনের বিয়ে শহরের ধনী মেয়ের সঙ্গে ঠিক হয়েছে।
সেই সাঁঝরাতে কুসুম নদীর ঘাটে একা। হাতে খালি কলস, চোখেকষ্টের জল। আকাশের তারাগুলোও কেমন ম্রিয়মাণ।
প্রেম কি কেবল জমি–জিরাতের হিসেব বোঝে? মাটির টানে ঘামের গন্ধের কি কোনো সৌন্দর্য নেই?
দূরে বিয়ের সানাই বাজে। গ্রামের আকাশ ভরে ওঠে আতশবাজির আলোয়। আর কুসুমের বুকের ভেতর নিভে যায় সব স্বপ্ন।
কুসুমের জীবন থেকে প্রেম হারিয়ে যায়, কিন্তু সংগ্রাম হারায় না। ভোরবেলা সে আবার কলস নিয়ে নদীর ঘাটে যায়। নদীর স্রোতে শ্যাওলা সাথে ভেসে যায় মনের ব্যথা, টিকে থাকে সংগ্রাম।
সংগ্রাম মানুষকে রুটি দেয়,
কিন্তু প্রেম না থাকলে জীবন অসম্পূর্ণ।
পল্লীবালার আক্ষেপই বলে দেয়—
সবচেয়ে নির্মল ভালোবাসাও অনেক সময় দুনিয়ার চোখে গরিব হয়ে পড়ে।
টঙ্গী কলেজ গেট, গাজীপুর।


















