class="post-template-default single single-post postid-10492 single-format-standard wp-custom-logo group-blog vl-boxed aa-prefix-matin-">
Shadow

গোয়েন্দা গল্প : আশ্চর্য ডিস্ক

গোয়েন্দা গল্পঘাড় ফিরিয়ে তাকাতে দেখি, নীল যুদ্ধপোশাক পরা কাঠামোটি মঞ্চ থেকে নেমে পড়েছে। এখন হেঁটে আসছে আমাদের দিকে! আবার ঘুরে দৌড় দিতে যাব, দেখলাম আমাদের পথ আগলে দাঁড়িয়েছে লাল যুদ্ধপোশাক পরা মূর্তি। তারপর কালো আর হলুদ মূর্তিও মঞ্চ থেকে নেমে এসে ঘিরে ফেলল আমাদের। শুধু কি তা-ই, চারপাশ থেকে এগিয়ে আসছে ইঁদুরবাহিনী। একটা ইঁদুর আমার জুতোর ওপর ওঠার চেষ্টা করছে

কম্পিউটারে সাপ-লুডু খেলছি আর মাঝেমধ্যে ঘড়ির ওপর চোখ বুলাচ্ছি। অতুল বোধ হয় ভুলে গেছে আনকোরা নতুন একটা গেইম নিয়ে এখানে তার আসার কথা। কিংবা বরাবরের মতো, খামাখা দেরি করছে সে। ভাবছি ফোন করব, এই সময় মায়ের গলা শুনতে পেলাম, ‘শোভন, অতুল এসেছে।’ এক সেকেন্ড পর ঝড়ের বেগে আমার শোয়ার ঘরে ঢুকে পড়ল সে, শরীরে মোচড় খাওয়ার মতো ঢেউ তুলে পিঠ থেকে ব্যাকপ্যাকটা নামাল।
‘এটা এখুনি একবার চালিয়ে দেখ’, বলে প্যাক থেকে একটা প্যাকেজ বের করল।
‘অন্ধকার জগতের প্রভু’, প্রচ্ছদের লেখাটা পড়লাম আমি। ‘এটার কথা আগে কখনো শুনিনি।’
‘শুনিনি আমিও। তবে শান্তিনগর চৌরাস্তার মুখে ওই ছোট্ট পরিচ্ছন্ন দোকানটার মালিক আমাকে বললেন, এর চেয়ে অবাক করা গেইম পৃথিবীর আর কোথাও নেই। বাজারে ছাড়ার আগে পরীক্ষা করিয়ে নিচ্ছেন, তাই আমাকে বিনা পয়সায় দিলেন। আয়, চালিয়ে দেখি!’
অতুল আমার সঙ্গে ক্লাস সেভেনে পড়ে। আমাদের স্কুলে যারা কম্পিউটার নিয়ে বিস্তর পাগলামি করে, ওদের তালিকায় তার নামটাই সম্ভবত এক নম্বরে থাকবে। কেউ যদি দুনিয়ার সবচেয়ে বিস্ময়কর কম্পিউটার গেইম খুঁজে পায়, তো সে-ই পাবে।
ডিস্কটা আমি আমার সিডিরম ড্রাইভে ঢুকিয়ে ইনস্টল হওয়ার জন্য অপেক্ষা করছি। কিন্তু তার বদলে কম্পিউটারের পর্দা সম্পূর্ণ কালো হয়ে গেল। তারপর ধীরে ধীরে একটা মুখ ফুটে উঠল সেখানে। মুখটা সরু, ম্লান আর আশ্চর্য, কোথাও একটা চুল নেই, এমনকি ভ্রু পর্যন্ত কামানো। যেভাবে সরাসরি তাকিয়ে আছে, অনুভব করলাম, আমার হাতের লোম দাঁড়িয়ে যাচ্ছে।
‘আমি অন্ধকার জগতের প্রভু’, মুখটা বলল, ‘চ্যালেঞ্জ করছি, সাহস থাকে তো আমার দুনিয়ায় ঢোকো। সবুজ ঢালে ক্লিক করো, সঙ্গে সঙ্গে একটা আশ্চর্য অভিযানে নিয়ে যাওয়া হবে তোমাকে। তবে, সাবধান কিন্তু; বেরিয়ে আসার পথ মাত্র একটাই। তুমি কি গোপন রহস্যটা আবিষ্কার করতে চাওয়ার মতো যথেষ্ট স্মার্ট?’ এরপর মুখটা হাসতে শুরু করল, সেই হাসি শুনতে শুনতে টের পেলাম, আমার ঘাড়ের চুল খাড়া হয়ে যাচ্ছে। অতুলকে আমি অন্য কোনো গেইম খেলার কথা বলতে যাব, হঠাৎ ঢাল আকৃতির সবুজ আইকনে ক্লিক করে বসল সে।
পরক্ষণে আমার ঘরে বাজ পড়ল। অন্য কোনোভাবে এটা ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়। আকস্মিক একটা আলোর ঝলক আমাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিল। কোথায় ফেলল, বললে দুনিয়ার কেউ বিশ্বাস করবে না। এরপর যেটা দেখতে পেলাম, তা হলো : আমি আর অতুল গরম, স্যাঁতসেঁতে একটা পাথুরে কামরার ভেতর হামাগুড়ি দিচ্ছি। চারদিকে মশাল জ্বলতে দেখছি, ওগুলোর লালচে আলোয় দেয়ালে আঁকা ছবিগুলো উজ্জ্বল হয়ে আছে।
‘মিসরীয় হাইরাগ্লিফিক!’ বললাম আমি। ‘কিন্তু কোনটা ঠিক? আমরা কি সত্যি সত্যি একটা পিরামিডের ভেতর রয়েছি? নাকি স্বপ্ন দেখছি?’
অতুল গলা ফাটিয়ে চিৎকার করছে, আমার প্রশ্ন শুনতে পেল না। কী দেখে চেঁচাচ্ছে বোঝার জন্য ঘাড় ফেরালাম। একদিকে দেয়ালে ঠেস দিয়ে রাখা হয়েছে একটা মমি কেস, ভেতরে নিশ্চয়ই কয়েক হাজার বছরের পুরনো লাশ সংরক্ষিত আছে, দেখলাম সেটার ঢাকনি ক্যাঁচ ক্যাঁচ শব্দ তুলে অলসভঙ্গিতে খুলে যাচ্ছে।
ঢাকনি পুরোপুরি খুলে যাওয়ার পর ভেতরে দেখলাম হাড়ভর্তি কোঁচকানো একটা চামড়ার থলি শুয়ে আছে।
চামড়ার থলিটা মাথা তুলে আমাদের দিকে তাকাল! প্রথমে আমরা পরস্পরের দিকে ছিটকে পড়লাম, তারপর দিক বদলে একটা প্যাসেজের দিকে ছুটলাম, ইচ্ছেÑকামরা থেকে বেরিয়ে যাব। পেছনে পায়ের আওয়াজ পেলাম…সর্বনাশ, মমিটা আমাদের ধাওয়া করছে!
দৌড়াচ্ছি, দৌড়াচ্ছি, হঠাৎ দেখি প্যাসেজটা সামনে দুই ভাগ হয়ে গেছে। ‘কোন দিকে?’ জিজ্ঞেস করলাম আমি। সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করল ডান প্যাসেজ ধরে ছুটে আসা একটা খয়েরি ইঁদুর।
‘ইইই, ও মা রে, মা রে, ছুঁচো!’ অতুলের গলায় কান্নার চেয়ে চিৎকার বেশি।
‘আমি তো শুধু ইঁদুর দেখছি’, বললাম তাকে। ‘ইঁদুরও কম অপছন্দ করি না। চলো, বাঁ দিকে যাই।’
কতক্ষণ ছুটছি বলতে পারব না, মনে হলো ১০ মাইল পেরিয়ে এসেছি। তারপর হঠাৎ করে প্যাসেজটা বিরাট একটা কাঠের দরজার সামনে শেষ হয়ে গেল। ‘এটাই বেরোনোর পথ’, হাঁপাতে হাঁপাতে বলল অতুল, তবে আমার ধারণা স্রেফ আন্দাজ করছে সে।
দরজার কপাট ফাঁক করতে দুজনের সবটুকু শক্তি কাজে লাগাতে হলো। চৌকাঠের ওপারে কাঠের তৈরি প্রকাণ্ড কামরা, যেমনটি প্রাচীন দুর্গে দেখা যায়। প্রতিটি দেয়ালের সামনে একটা করে মঞ্চ, প্রতিটি মঞ্চে যুদ্ধপোশাক পরা একটা করে বিশালদেহী মূর্তি দাঁড়িয়ে আছেÑঢাল, তলোয়ার আর বর্মসহ। অদ্ভুত ব্যাপার হলো, প্রত্যেকের রং আলাদা : নীল, লাল, হলুদ আর কালো। কামরার উল্টোদিকে আরেকটা দরজা। এক সেকেন্ড পর দেখা গেল, এই কামরাতেও ইঁদুর আছে।
‘কী ঘটেছে, বুঝতে পারছিস তো?’ জিজ্ঞেস করল অতুল। উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করলাম না। কী ঘটেছে আমি জানি। শুনতে যতই পাগলের প্রলাপ বলে মনে হোক, বিচিত্র কোনো কৌশল খাটিয়ে খেলাটার মধ্যে টেনে নেওয়া হয়েছে আমাদের দুজনকে! ‘ওটাই হয়তো বেরোনোর রাস্তা’, বললাম আমি, তারপর দ্বিতীয় দরজার দিকে এগোলাম আমরা, কিন্তু ঝনঝন ধাতব আওয়াজ শুনে থমকে দাঁড়াতে হলো।
ঘাড় ফিরিয়ে তাকাতে দেখি, নীল যুদ্ধপোশাক পরা কাঠামোটি মঞ্চ থেকে নেমে পড়েছে, এখন হেঁটে আসছে আমাদের দিকে! আবার ঘুরে দৌড় দিতে যাব, দেখলাম আমাদের পথ আগলে দাঁড়িয়েছে লাল যুদ্ধপোশাক পরা মূর্তি। তারপর কালো আর হলুদ মূর্তিও মঞ্চ থেকে নেমে এসে ঘিরে ফেলল আমাদের। শুধু কি তা-ই, চারপাশ থেকে এগিয়ে আসছে ইঁদুরবাহিনী। একটা ইঁদুর আমার জুতোর ওপর ওঠার চেষ্টা করছে।
‘কী করব এখন?’ কেঁদে ফেলল অতুল। ‘অন্ধকারের প্রভু বললেনÑবেরোনোর মাত্র একটাই পথ আছে, সেটা আমাদের খুঁজে বের করতে হবে।’
মাথার ওপর তলোয়ার তুলে আরো কাছে চলে আসছে প্রাচীন যোদ্ধারা। ইঁদুরটা এখন আমার ট্রাউজারের পা ধরে ওপরদিকে ওঠার চেষ্টা করছে। ‘ধুর মিয়া!’ পা ঝাড়া দিয়ে চেঁচিয়ে উঠলাম। তবে ঠিক তখনই আমার মাথায় একটা বুদ্ধি খুলল। ‘না’, অতুলকে বললাম, ‘ওটা সত্যি সত্যি বেরোনোর রাস্তা হতে পারে না, বড় বেশি সহজ লাগছে।’
‘তাতে কী?’ ভয়ে কুঁকড়ে যাচ্ছে অতুল। ‘এটাই একমাত্র পথ, কাজেই চেষ্টা করে দেখতে হবে।’
‘ঠিক আছে।’ নিচু হলাম আমি, নিজেকে বাধ্য করলাম ইঁদুরটাকে তুলে নিতে। আমার হাতে মোচড় খাচ্ছে ওটা, চিঁচিঁ শব্দ করছে, একবার তো একটুর জন্য ফেলেই দিচ্ছিলাম। ‘সবুজ মানে যাও, তাহলে লাল মানে নিশ্চয়ই থাম।’ লাল যোদ্ধার দিকে ফিরলাম আমি, হাতে ধরা ইঁদুরটাকে তার বর্ম পর্যন্ত তুলে ধরলাম, তারপর জিভ আর টাকরা সহযোগে ক্লিক করে একটা আওয়াজ করলাম। পরমুহূর্তে আবার বাজ পড়ল, বিদ্যুতের চোখ ধাঁধানো একটা ঝলক ধাক্কা দিল। তারপর যখন চোখ মেললাম, দেখি আমার কামরায় ফিরে এসেছি দুজন!
‘কী রে, ভাই’, হাঁপাচ্ছে অতুল, ‘কী করেছিলি তুই?’
‘এর গোপন দিকটাকে তুই একটা বাজে কৌতুক বলতে পারিস। খেলাটা আমরা শুরু করেছিলাম ঢাল আকৃতির সবুজ আইকনে মাউস ক্লিক করে, তাই না? ওই একই নিয়মে খেলা থেকে বেরোনোও যায়।’
‘তুই লাল বর্মের ওপর একটা মাউস ক্লিক করেছিস’, গুঙিয়ে উঠে বলল অতুল।
‘দুঃখিত, এই ডিস্ক ডাস্টবিনে ফেলে দেব’, বললাম আমি, আমার সিডিরম ড্রাইভ খুললাম। কি আশ্চর্য, ডিস্কটা ওখানে নেই!
পরদিন ঠিক করলাম, ছোট্ট দোকানটায় যাব আমরা, অতুল যেখান থেকে ডিস্কটা পেয়েছিল। কিন্তু শান্তিনগর চৌরাস্তার মুখে পৌঁছে অতুলের মাথা ঘুরে গেল, কারণ দোকানটা ওখানে নেই। তার বদলে ছোট্ট একটা ফাঁকা জায়গা পড়ে আছে। ‘কিন্তু, খোদার কসম বলছি, ঠিক এখানেই ছিল দোকানটা!’ অতুলকে হতভম্ব দেখাচ্ছে।
‘আরে, ওটা কী?’ বললাম আমি, হাত তুলে মাটিতে পড়ে থাকা একটা খাম দেখালাম। কাছে গিয়ে দেখি, ওটার ওপর অতুল আর আমার নাম লেখা। হাত কাঁপছে, খামটা তুলে খুললাম, এক টুকরো কাগজ বের করে দেখি কিছু লেখা রয়েছে। পড়লাম।
‘তোমরা জিতেছ, কাজেই আমাকে এখন ফিরে গিয়ে খেলাটাকে আরো চ্যালেঞ্জিং বানাতে হবে। কোনো একদিন হয়তো আবার আমরা খেলব।’ সই করা হয়েছেÑঅন্ধকার জগতের প্রভু।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Please disable your adblocker or whitelist this site!