ধ্রুব নীলের গল্প : ক্লেপটোম্যানিয়া
পিন্টু তালুকদারের মতে চুরি করা পৃথিবীর সবচয়ে সহজ কাজ। ধরা পড়ার অংশটুকু নিয়ে কখনই মাথা ঘামান না তিনি। মিন্টুকে সাহেব বলার কারণ তিনি সবসময় কেতাদুরস্থ চলাফেরা করেন। আংশিক টাক পড়া কাঁচাপাকা চুলে হাত বুলোতে বুলোতে কথাও বলেন বুদ্ধিদীপ্ত। তার সমস্যা একটাই। চুরি না করে থাকতে পারেন না তিনি।
চুরি করাটা মিন্টু সাহেবের অভ্যাস। তিনি এটাকে বদভ্যাস বলতেও রাজি না। বদভ্যাস হলো ধূমপান, মদ্যপান এসব। চুরি করাটা শরীর-স্বাস্থ্যের জন্য যেহেতু ক্ষতিকর নয়… যাক সে আলাপ।
মিন্টু সাহেবের যথেষ্ট টাকাকড়ি আছে। সব কিন্তু চুরি করে পাওয়া নয়। তিনি চাকরি করেন। ঢাকায় ফ্ল্যাট না থাকলেও বেশ ভালো একটা বাসা ভাড়া করে থাকেন। তার স্ত্রী কলেজের প্রভাষক। ছেলে মোবাইলে গেমস খেলে। ছোট মেয়ে ইউটিউবে ভিডিও দেখে। বাইরে থেকে দেখে কে বলবে যে মিন্টু সাহেব মানুষের বাসায় চুরি করে বেড়ান।
মিন্টু সাহেব কখনও ধরা পড়েছেন? পড়েছেন। ধরা পড়া নিয়ে তার মাথা না ঘামানোর কারণ ওটাই। ধরা পড়েন, সহজে ছাড়া পান, আবার চুরি করেন। তবে থানায় যেতে হয়নি কখনও। তার চুরির একটা-দুটা গল্প বললেই বিষয়টা খোলাসা হবে।
চুরি করার প্রতি দুর্নিবার একটা আকর্ষণ অনেকেরই থাকে। মিন্টু সাহেব ইন্টারনেট ঘেঁটে জেনেছেন এটা একটা রোগ। যদিও তিনি নিজেকে রোগী ভাবেন না। রোগের নাম ক্লেপটোম্যানিয়া (চুরির করিবার প্রবল ইচ্ছা)।
মিন্টু সাহেব সোনার গয়না, নগদ টাকা কিংবা দামি কিছু চুরি করেন না। ছোটখাট জিনিস চুরি করেন। রাতের আঁধারে বা দিনেদুপুরে কারো বাড়ি বা ফ্ল্যাট থেকে একটা কিছু নিয়ে সটকে পরাটাই আসল কাজ। কী নিলেন সেটা বড় কথা নয়।
গেলো বর্ষার কথা। মধ্যরাত। ঘন ঘন বজ্রপাত হচ্ছে। মিন্টু সাহেব ছাতা হাতে মোহাম্মদপুরের একটি রাস্তায় দাঁড়িয়ে সেকেন্ড গুনছেন। তার ধারণা যেকোনও সময় তার মাথায় বজ্রপাত পড়বে। রাশিয়ান রুলেট খেলছেন। ১ থেকে ১০০ গুনবেন। এর মধ্যে হলে হবে না হলে নাই। ঝুঁকি নেওয়ার বাতিকও আছে তার। বাজ পড়লো না। হাঁটা দিলেন মিন্টু সাহেব।
খোঁজখবর নিয়েই চুরি করতে যান। আজ করবেন একটা নামিদামি অ্যাপার্টমেন্টের ছয় তলায় থাকা ডা. সিরাজ ও ড. মুনিরার ফ্ল্যাটে। তাদের এক ছেলে এক মেয়ে।
গেটের সামনে গিয়ে ছাতা বন্ধ করে ভালো করে পানি ঝাড়লেন। ঝেড়ে কাশলেন। পরনে ফতুয়া আর সাধারণ প্যান্ট। হাতে একটা মিষ্টির প্যাকেট।
‘সিরাজ, দরজা খোলো।’
‘কার বাসায় যাবেন স্যার?’
‘দরজা খোলো আগে, তারপর বলি। পানির ঝাপটায় ভিজলে সমস্যা। ঠান্ডা সহজে যাবে না।’
দারোয়ানের নামও সিরাজ। এসব তথ্য আগে থেকে জেনে নেন মিন্টু। গেট খোলা হলো।
‘আপনি যাবেন কই?’
সরু চোখে সিকিউরিটি গার্ডের পোশাক পরা পেশীবহুল সিরাজের দিকে তাকালেন মিন্টু।
‘আমি চোর। ডা. সিরাজের বাসায় চুরি করতে এসেছি। তোমার কোনো সমস্যা আছে?’
হেসে দিল দারোয়ান। মিন্টু বুঝলেন, মিশন সাকসেসফুল।
‘স্যার লিফটের পাঁচ দিয়েন। ছয় তলা।’
খানিকটা এগিয়ে আবার দাঁড়ালেন মিন্টু। শকুনে চোখে লিফটের গায়ে তাকালেন। ডাক দিলেন দারোয়ানকে। ইশারায় দেখিয়ে বললেন, ‘কেউ পানের পিক ফেলছে মনে হয়। এরপর যে ফেলবে আমার পক্ষ থেকে একটা তাকে বিশ টাকা দিবা। ঠিক আছে? পাপের বদলে পুরস্কার। সে জীবনেও আর এ কাজ করবে না।’
‘জি স্যার। এখুনি মুছতেসি।’
মিন্টু সাহেবের মিষ্টির প্যাকেটে মিষ্টিই আছে। তবে অনেক আগে কেনা। এই প্যাকেট নিয়ে তিনি অনেক বাসাতেই গিয়েছেন। চুরির সরঞ্জাম হিসেবে কেনা। এখন আর খাওয়ার মতো অবস্থায় নেই।
গভীর রাতে বাড়ির লোকজনের ঘুম ভাঙিয়ে চুরি করার ভেতর একটা অ্যাডভেঞ্চার আছে। রাত মানেই আলো-আঁধারি ব্যাপার। সময়টা বেশ উপভোগ করেন মিন্টু।
লিফট উঠতে উঠতে চকিতে তার আগের একটা স্মৃতি মনে পড়ে গেলো। বয়স তখন চল্লিশের ঘরে।
দরজার লক খোলা এক মিনিটের কাজ। পকেটভর্তি চাবি থাকে। চাবি খুঁজতেও সময় লাগে না।
ফ্ল্যাটে ঢুকেই আগে রান্নাঘরের চুলার চাবি ঘুরিয়ে দিলেন। গ্যাস বের হওয়ার জন্য অপেক্ষা করলেন বেশ কিছুক্ষণ। বাড়িতে স্বামী-স্ত্রী, বৃদ্ধ বাবা আর এক কাজের মেয়ে। মাস্টারবেডে নক করলেন মিন্টু।
‘কে! কে!’
‘দরজা খোলেন। গ্যাস লিক করেছে।’
রাতে হুট করে ঘুম ভাঙলে এমনিতেই আতঙ্কে থাকে সবাই। ভদ্রলোক বাকিদেরও তুললেন। আতঙ্কে বৃদ্ধ বাবাব বারবার কলেমা পড়তে শুরু করে দিয়েছেন।
‘ভয় নেই খালু, এখনও তো আগুন লাগে নাই। তবে একবার লাগলে সবাই কাবাব হয়ে যাবেন। খবরদার কেউ বাতি জ্বালাবেন না। মোবাইল ফোনও দূরে রাখুন।’
মিন্টু সাহেবের কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করলো সবাই।
‘চারতলা থেকে এসেছি। গ্যাসের গন্ধ পেয়ে মনে হলো এ বাসা থেকেই আসছে। সবাই ধীরেসুস্থে সিঁড়ি দিয়ে নামেন। শব্দ যেন না হয়। আমি ব্যবস্থা নিচ্ছি।’
কেউ জানতেও চাইল না মিন্টু কী করে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকলেন।
চুরি করার মতো অনেক কিছু ছিল। বেশি কিছু নেননি। একটা পুরনো ঘড়ি কিছু শার্ট-প্যান্ট। স্ত্রী রেহানার জন্য ভাঁজ করা দুটো শাড়ি। যাওয়ার আগে চুলা অফ করলেন। সব জানালা খুলে দিলেন। এমনকি পরিবারটির সঙ্গে দেখাও করলেন। সবাই সেকি খুশি। পারলে মিন্টুকে মাথায় তুলে
স্লোগান দেয়। আরো দুই ফ্লাটের মানুষও মিন্টু সাহেবের প্রশংসা করলো। কেউ জানতে চাইল না তিনি কোন ফ্ল্যাটের বাসিন্দা। ওই সময় আরও একটা ঘটনা ঘটলো। ফ্লাটের লোকজন খুশিতে একটা পিকনিক করার ঘোষণাও দিল।
মিন্টু সাহেবের ধারণা তার স্ত্রী তার এই অভ্যাসের কথা জানেন। রেহানা হয়তো জানেন যে এটা একটা রোগ- ক্লেপটোম্যানিয়া। তাই চুপ থাকেন। রোগের ওপর কথা নাই।
ঘরে শোরগোল শোনা যাচ্ছে। ইদানীং শহরের লোকজন রাত একটাতেও ঘুমায় না।
‘বদভ্যাসটা যে কবে যাবে’।
এ কারণে চুরি করার জন্য মিন্টু সাহেবকে রাত জাগতে হয়। হাঁটাহাঁটির কথা বলে বের হন বাসা থেকে। তবে রাত জাগাটা ভালো হচ্ছে না শরীরের জন্য।
কলিং চাপ দিলেন। দিতেই থাকলেন। ভেতরের লোকজন বিরক্ত হবে। মনে মনে ‘আনকালচারড’ গালিও দেবে। তবে এর সুবিধা হলো, চোর-ডাকাত ভাববে না। কি-হোলে চোখ না রেখেই দরজা খুলল হাফপ্যান্ট পরা এক টিনএজার ছেলে।
‘কাকে চান আংকেল?’
‘আমি তোমার বাবার দুঃসম্পর্কের ভাই। সেই সূত্রে তোমার চাচা হই।’
‘আমার কোনও চাচা টাচা নেই।’
‘কথা সত্য। আমি বানিয়ে বলেছি। হে হে।’
‘আপনার হাতে কী? মিষ্টি?’
‘না, এটা একটা ছোটখাট বোমা। ঘরে বানানো। যেকোনও সময় ফেটে যেতে পারে। এর নাম দিতে পারো মিষ্টি বোমা।’
ছেলেটা দরজা খোলা রেখেই দৌড়ে ভেতরে গেলো। খানিক পর ছুটে এলেন ডা. সিরাজ ও ড. মুনিরা।
‘কে ভাই আপনি? কী চান?’
‘আমি চোর। চুরি করতে এসেছি।’
ড. মুনিরা বললেন, ‘দারোয়ান ঢুকতে দিল কী করে! ও আল্লাহ! কী হবে এখন!’
‘ঘাবড়ানোর কারণ নেই ড. মুনিরা। আমি ডেঞ্জারাস লোক না। আমি নিতান্তই ছোটখাট চোর। এই যে মিষ্টির প্যাকেট। এর ভেতর একটা ছোটখাট বোমা আছে। এক সময় কেমিস্ট্রির স্টুডেন্ট ছিলাম। বোমা বানানো আমার জন্য হাতের মোয়া। যদিও আমি মোয়া বানাতে পারি না।’
‘কী চান আপনি? কী চান আপনি!’
‘তেমন কিছু না। চুরি করতে পারলে ভালো লাগতো। কিন্তু আপনারা জেগে আছেন। সবার সামনে চুরি করলে সেটা চুরি হবে না। হবে ডাকাতি। আমি ডাকাত না। ভেতরে আসি?’
ভ্যাবাচেকা খাওয়া লোকগুলো কিছু বললো না। পেছন থেকে বিরক্ত চোখে তাকাল একটা তরুণী। সেজেগুজে আছে সে। সামনে আসার প্রয়োজন বোধ করছে না। চুরি হলে হোক, সে তার মতো থাকবে, এমন একটা ভাব নিয়ে আছে।
ওই তরুণীই এগিয়ে এলো। কী যেন ভাবল। তারপর বললো, ‘আসুন ভেতরে আসুন। সোফায় বসুন। চা দিচ্ছি। ভাত খাবেন?’
মিন্টু সাহেব মনে মনে চাইলেন তার মেয়েও বড় হয়ে এমন বুদ্ধিমান হোক। এই মেয়ে মনে করছে তিনি মানসিক রোগী।
‘ভাত খেয়ে এসেছি। চায়ের সঙ্গে কেক দিলে ভালো। কেকের গন্ধ পাচ্ছি। কারো জন্মদিন নাকি?’
‘আমার জন্মদিন।’
‘শুভ জন্মদিন মামনী। তা কত হলো তোমার?’
‘বাইশ পার হলো। তেইশে পা দিলাম। আপনারও একটা মেয়ে আছে তাই না? বয়স মনে হয় সাত-আট।’
‘একদম ঠিক ধরেছো। তুমি খুব বুদ্ধিমান। কী করে বুঝলে?’
‘আপনি যেভাবে মামনী বলেছেন, সেটা শুনে। আর আপনার বয়স দেখে মেয়ের বয়স অনুমান করেছি। সহজ অংক। তবে আপনি কেন এসেছেন সেটা বুঝতে পারছি না।’
মিন্টু সাহেব বহুদিন বুদ্ধিমান মানুষ দেখেননি। রেবেকা সম্ভবত বুদ্ধিমান। তবে প্রমাণ পাননি। এই মেয়ে প্রমাণ করে দিয়েছে। তিনি বেশ মুগ্ধ হয়েছেন।
‘আমি সত্যিই চুরি করতে এসেছি মামনী। কিন্তু এখন আর তা সম্ভব নয়।’
‘কারণ আমরা সবাই আপনাকে ধরে ফেলেছি?’
‘অনেকটা তাই। চুরি করতে হবে নীরবে নিভৃতে। কাকপক্ষীও টের পাবে না। কারণ এটা একটা বিদ্যা। গুপ্তবিদ্যা। আমরা যেটাকে চুরি বলে জানি, সেটা কিন্তু চুরি না। আসল চুরি হলো একটা বিশেষ জ্ঞান। এটা সবাই রপ্ত করতে পারে না। আমার ধারণা আমি পেরেছি।’
‘তা বুঝলাম। তবে প্যাকেটটা বয়ে বেড়াতে হবে না। বাসি মিষ্টির গন্ধে আমার বমি আসছে। ওটা ফেলে দিন।’
‘ঠিক বলেছো। পলিথিন দিয়ে ভালো করে মুড়ে ময়লার ঝুড়িতে রাখো। গন্ধ ছড়াবে না। তুমি আসলেই বুদ্ধিমান।’
‘গন্ধ পাওয়ার সঙ্গে বুদ্ধির সম্পর্ক নেই। আমি পলিথিন আনছি। আপনার মিষ্টি আপনি মুড়ে নিন।’
‘তোমার নাম কী মামনী?’
‘আমার নাম বিবি জুলেখা। কেক নিয়ে আসছি। কেক খেয়ে বিদেয় হবেন।’
‘ঠিক আছে মামনী, তাই হবে।’
মিন্টু সাহেবের সামনে এই মেয়ের ভবিষ্যত ঝকঝক করে ভেসে উঠলো। বিরাট কোনো কোম্পানির ম্যানেজার হবে নির্ঘাৎ। মিন্টু সাহেব অবশ্য চান না তার মেয়ে বড় হয়ে তার মতো চোর হোক। অবশ্য হলেও ক্ষতি নেই। তার চুরি সাধারণ চুরি না। এটা গুপ্তবিদ্যা। মহান সব লোকেরা নিয়মিত এই বিদ্যার চর্চা করেন।
চা এলো। কেকও এলো বিরাট সাইজের। তার সামনে চেয়ারে বসে পা দোলাচ্ছে ছেলেটা। সে মনে হয় ক্লাস নাইন-টেনে। তার ভয় কেটে গেছে। সে বলেছে, সে কখনও চোর দেখেনি। বসে বসে আড়চোখে চোর দেখছে আর মোবাইলে গেম খেলছে।
রাত দেড়টা। চা খেয়ে ঘুম কিছুটা কেটেছে মিন্টুর। চুরি না করতে পারায় খুঁতখুঁত করছে মন।
‘এই নিন পলিথিন।’ মিন্টু সাহেব পলিথিন নিলেন। তবে সঙ্গে সঙ্গে প্যাকেটটা ভরেননি। পলিথিন হাতে নিয়ে মচমচ শব্দ করছেন।
‘আমার এখুনি উঠতে ইচ্ছে করছে না। চা টা অসাধারণ হয়েছে। যদি আরেক কাপ খাওয়াতে।’
‘ভুল বলেননি। আমারও খেতে ইচ্ছে করছে। বসুন।’
ডা. সিরাজ এখনও বিশেষ কথাবার্তা বলেননি। তার মেয়ে সবাইকে নিশ্চয়ই বলেছে যে লোকটা মানসিক রোগী। মানে মানে কেটে পড়লেই ভালো।
ড. মুনিরা বারবার ফোন নাড়াচাড়া করছেন। কিন্তু কাকে কল করবেন বুঝতে পারছেন না। এর মাঝে দুবার ফেসবুকও চেক করলেন। লোকটার ছবিসহ একটা স্ট্যাটাস দেওয়া দরকার ভাবলেন। তা না হলে মহা অনর্থ ঘটে যাবে।
বাড়ির কাজকর্ম করার একটা মেয়ে আছে। সে তার কাজে ব্যস্ত। বাড়ির সব চুরি হয়ে গেলেও তার কিছু যায় আসে না।
চা নিয়ে এলো তরুণী। তার মা সঙ্গে এক প্লেট বিস্কিটও ধরিয়ে দিল।
ড. মুনিরার দিকে হাসিমুখে বললেন মিন্টু, ‘চা টা খেয়েই চলে যাব। এরপর আর জীবনেও আসবো না। আমি এক বাড়িতে দুবার চুরি করতে যাই না।’
‘কিন্তু আপনি তো কিছু চুরি করেননি। আরেকবার তো আসতেই পারেন।’
হাসলেন মিন্টু। দ্বিতীয়বারের চা-টা প্রথমবারের চেয়েও ভালো হয়েছে। তৃপ্তি করে চুমুক দিচ্ছেন। যথাসম্ভব চেষ্টা করছেন যেন শব্দ না হয়।
‘মামনী তুমি বিরাট জ্ঞানী। আমার মেয়ে যেন বড় হয়ে তোমার মতো হয়।’
‘আপনার মেয়ে আরও বড় জ্ঞানী হবে। আমার মনে হয় চুরির ব্যাপারটা বংশগত। আপনার বাবাও কি..।’ কথাটা বলা ঠিক হয়নি ভেবে আটকে গেল তরুণী।
‘আমি জানতাম তুমি ধরে ফেলবা! হা হা হা।’ এবার উচ্ছ্বাসের বাঁধ ভেঙেছে মিন্টু সাহেবের।
‘আমার বাবা ছিল একেবারে টমাস আলভা এডিসন লেভেলের মানুষ। এডিসন সাহেবও বিস্তর চুরি করেছেন। তবে আমার বাবা বিজ্ঞানী নন। তিনি গ্রামে অতি নগণ্য জীবন যাপন করতেন। বিচিত্র সব জিনিস চুরি করতেন। কোনো মৃত্যুপথযাত্রীর এক গাছি চুল, কারো পুরনো ছবি, কোনো বাচ্চার জন্য কেনা প্রথম জুতো জোড়া। লোকের কাছে এগুলোর দাম নাই, আবার ধরো এগুলোই সবচেয়ে দামি।’
‘আপনার বাবা স্মৃতি চুরি করতেন। ব্যাপারটা দারুণ। আমি পরিচালক হলে তাকে নিয়ে সিনেমা বানাতাম। তা আপনি কী চুরি করেন?’
জবাব দিলেন না মিন্টু। এ প্রশ্নের উত্তর দিতে তার খানিকটা লজ্জাবোধ হয়। তরুণী দ্বিতীয়বার জানতে চাইল না।
‘আমার নাম ইরিনা। রাগ করে বিবি জুলেখা বলেছিলাম। রাগটা অবশ্য আপনার ওপর করিনি। করেছি আমার বয়ফ্রেন্ডের ওপর।’
‘রাগটা কেন করেছো জানতে পারি?’
‘সে আজ সারাদিন আমার সঙ্গে ঠিকমতো কথাও বলেনি। সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার জন্য কোনোমতে হ্যাপি বার্থডে বলেছে। তারপর তার কোন এক দুঃসম্পর্কের মামার সঙ্গে ঢাকায় ঘুরে বেড়িয়েছে। মামাকে নিয়ে চিড়িয়াখানা, জাদুঘর এসব ঘুরিয়ে দেখিয়েছে।’
‘বাহ, খুব ভালো ছেলে। খুব ভালো। তবে রাগ করাটাও যৌক্তিক। রাগ পুশে রাখা ঠিক না। ভোর পাঁচটায় ফোন করে তার ঘুম ভাঙাবে। এটা হলো তার শাস্তি। অবশ্য তাকে দোষ দেওয়াটাও উচিৎ নয়। তুমি যেমন তার কাছে গুরুত্বপূর্ণ, এমন মানুষ তো আরও অনেকেই থাকতে পারে। আমার ছোট মেয়ে আবার আমাকে ছাড়া থাকতেই পারে না। হে হে।’
‘আপনি কী করে বুঝলেন আমি ভোর পাঁচটায় উঠবো।’
‘তোমার চোখ দেখেই বোঝা যায়। তুমি নিয়মিত রাত জাগার মেয়ে না। তা ছাড়া তোমার টেবিলের অ্যালার্ম ঘড়িতে হলুদ কাঁটাটা পাঁচের ঘরে দেখেছি।’
‘আপনার তো বিশাল পাওয়ার। আপনার তো চোর না হয়ে পুলিশ হওয়া উচিৎ ছিল!’
‘হা হা হা।’
অনেকক্ষণ প্রাণখুলে হাসলেন মিন্টু। হাসি থামলে ইরিনা জানতে চাইল, ‘এত রাতে বাসায় যাবেন। পথে ঝামেলা হবে না? রাতটা থেকে যাবেন?’
‘না, আমি তো চোর। রাতে চলাফেরার অভ্যাস। কোনোদিন কোনো ঝামেলা হয়নি।’
‘কোনোদিন হয়নি। আজ তো হতে পারে।’
‘হলে হবে। ঝামেলা থেকে চুরি করে কেটে পড়বো।’
‘আপনি একটা অদ্ভুত মানুষ। আমাদের জীবনে এমন অদ্ভুত মানুষ আসে না।’
‘আমরা সবাই অদ্ভুত মা। আমাদের সবার ক্ষমতা অনেক। আমরা সেটা জানি না। আমরা আমাদের নিেেজর ক্ষমতাটা চুরি করতে শিখিনি।’
‘আপনি দেখি দার্শনিকও।’
‘বললাম না, চুরি একটা মহান গুপ্তবিদ্যা। মহান বিদ্যার পেছনে কিছু দর্শন থাকবেই।’
‘চুরিটাকে বার বার এত মহান বলার কিছু নাই। চুরি মানে চুরি।’
মিন্টু সাহেব আবার হাসলেন। এ হাসির অর্থ হলো, ‘বুঝলি না রে মা টাইপ’ একটা কিছু।
‘আমি উঠি। ছোট মেয়েটা আবার রাতে মাঝে মাঝে জেগে উঠলে আমাকে খোঁজে।’
মিন্টুকে বিদায় জানাতে এগিয়ে এলেন সিরাজ ও মুনিরা দম্পতি। কাজের মেয়েটাও এলো। সে মিন মিন করে বলল, ‘এতো রাইতে…।’
ডা. সিরাজের কথা কেড়ে নিলেন তার স্ত্রী।
‘আরে ঢাকার জন্য এটা কোনো রাতই না। উনি যেতে চাচ্ছেন চলে যান। এই নিন এক শ টাকা। রিকশা ভাড়া।’
‘ধন্যবাদ। টাকা লাগবে না। আমার কাছে এটিএম কার্ড আছে। একাউন্টে অনেক টাকা। জন্মদিনের বাড়িতে খালি হাতে এসেছি। এজন্য খারাপ লাগছে। মামনী বিবি জুলেখা, এই নাও। এটা রাখো। নিজের পছন্দমতো একটা কিছু কিনে নিও।’
মিন্টু সাহেবের মাথায় ইরিনার নামটা জুলেখা হিসেবেই গেঁথে গেছে। ইরিনাও কিছু বলল না। হাত বাড়িয়ে হাজার টাকার নোট দুটো নিল। তার জামায় পকেট নেই। হাতেই ধরে রাখলো নোট দুটো। বলল, ‘ধন্যবাদ।’
লিফটে ওঠেননি মিন্টু। সিঁড়ি দিয়ে নামছেন। ধীরে ধীরে পা ফেলছেন। তার কেমন যেন মন খারাপ লাগছে।
সিরাজ ও মুনিরা দম্পতি বেলা করে ওঠেন। ভোরে ওঠে ইরিনা। আজ অ্যালার্ম ছাড়াই ঘুম ভেঙেছে তার। চায়ের মগ হাতে বারান্দায় দাঁড়িয়ে ভোরের হাওয়া মাখছে গায়ে। ভাবছে, গতরাতের চোর আংকেল আসলে কী চুরি করেন? তার বাবা চুরি করতেন মানুষের অমূল্য স্মৃতি। ওই আংকেল কি মমতা চুরি করেন? তা না হলে লোকটার প্রতি এত টান লাগছে কেন ইরিনার? নাকি তিনি মানুষের জীবন থেকে একঘেয়েমি চুরি করেন। কারণ সে তার মাকে গতরাতে কম করে হলেও এক শ বার ফোন করতে দেখেছে। বাবাও খুব উত্তেজিত ছিল। দুজনেই সারারাত জেগে ছিল। ইরিনা তার মা-বাবাকে এত খুশি হতে দেখেনি বহুদিন।
ফোন করলো বয়ফ্রেন্ডকে। খানিকটা হাই-হ্যালো করে রেখে দিল। উপযুক্ত শাস্তি হয়েছে। মনে মনে হাসল খানিকক্ষণ।
ড্রয়িং রুমে ঢুকতেই নাক কুঁচকে গেলো ইরিনার। গতরাতের মিষ্টির প্যাকেটটা সোফার নিচে রাখা। কিন্তু ইরিনার স্পষ্ট মনে আছে ওই আংকেল পলিথিনে মোড়ানো বাসি মিষ্টির প্যাকেট নিয়ে বের হয়েছেন। তারমানে তার কাছে একইরকম দুটো প্যাকেট ছিল? জাদুকররা যেমন একটা বাকশের ভেতর ভাঁজ করে দুটো বাকশো লুকিয়ে রাখে? আশপাশে ভালো করে তাকালো ইরিনা। কোনো পার্থক্য চোখে পড়লো না। কিন্তু সে নিশ্চিত একটা কিছু চুরি হয়েছে গতরাতে।
খুব ভোরে মিন্টু সাহেবের কন্যা টুনটুনির ঘুম ভাঙলো টুং টাং শব্দে। চোখ ডলতে ডলতে উঠে বসলো বিছানায়। এরপর চেঁচিয়ে পুরো বাসা মাথায় তুললো, ‘অ্যালার্ম ঘড়ি! অ্যালার্ম ঘড়ি! বাবা অ্যালার্ম ঘড়ি এনেছে!’