‘বাবা, যুদ্ধ এখন শেষ।’ দরজায় দাঁড়ানো কাজলের এ কথায় উমেদ আলী অবাক হয়ে তাকালেন। নাতি সকালের চোখেও বিরক্তি। বৌমা কাজলের এমন বেরসিক কথায় উমেদ আলী ভেতরে ভেতরে আহত হলেও মুখে হাসিটা ঝুলিয়ে রাখেন।
‘বাবা, ওকে এখন ছাড়ুন। ও ঘুমুতে যাবে। কাল ওর স্কুল আছে। সকাল সকাল উঠতে হবে।’
কাজল একনাগাড়ে বলে গেল। তার কথায় মাধুর্য নেই। চেহারায় কাঠিন্য আছে। উমেদ আলী এবার নাতির দিকে তাকিয়ে হাসলেন।
‘ও তাই তো! আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম। যুদ্ধের গল্পের বাকিটা আরেক দিন শোনাব। এখন তুমি ঘুমুতে যাও।’ উমেদ আলী সকালের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন।
‘দাদু ভাই, প্রতিদিন এত সকাল সকাল আমার ঘুম থেকে উঠতে ইচ্ছে করে না।’ গাল ফুলিয়ে বলল সকাল।
‘সে কী কথা! ওই যে কবিতায় পড়েছ না—আমরা যদি না জাগি মা কেমনে সকাল হবে?’
‘কিন্তু দাদু ভাই, যেদিন আমার স্কুল বন্ধ থাকে না সেদিন তো আমি সকালে উঠি না। তাই বলে কি আমি ওঠার আগে সকাল হয় না?’
উমেদ আলী এবার বেকায়দায় পড়ে যান। শ্বশুর আর ছেলের আদিখ্যেতায় দরজায় দাঁড়ানো কাজলের বিরক্তি চরমে ওঠে। কিন্তু মুখ ফুটে কিছু বলে না। হাজার হোক শ্বশুর তো। কিন্তু ছেলেটা যে দাদুর লাই পেয়ে কথার পিঠে কথা বলতে শিখে গেছে! উমেদ আলী এখন কী করে কবিতার চরণটার মানে এত অল্প বয়সী নাতিকে বোঝাবেন! তবুও উমেদ আলীকে একটা কিছু বলতে হবে।
‘এ বাসায় সবার আগে আমি ঘুম থেকে উঠি। তারপর ওঠে তোমার আম্মু-আব্বু। কিন্তু কোনো আওয়াজ হয় না। আর তুমি ঘুম থেকে ওঠার পর বাসায় হৈ-চৈ পড়ে যায়। তার মানে হচ্ছে, তোমরা মানে শিশুরা না জাগলে সকাল হয় না।’
সকাল উমেদ আলীর যুক্তিতে খুশি হয়ে ঘুমুতে যেতে উঠে দাঁড়ায়। দাদুকে ‘গুড বাই’ বলে সে নিজে ঘরের দিকে গেল। কাজলও দরজা থেকে সরে গেল। উমেদ আলী আর সকাল যুদ্ধের গল্পের কোথায় যেন ছিল। মাঝপথে কাজল এসে থামিয়ে দেয়।
সপ্তাহের সাত দিনই মায়েরা সকাল থেকে রাত অব্দি সন্তানকে পড়াশোনা ও এক্সট্রা কারিক্যুলামসহ যাবতীয় যুদ্ধে ঠেলে দেন। সেখানে উমেদ আলী কী করে তার নাতি সকালকে মুক্তিযুদ্ধের গল্পটা শুনিয়ে শেষ করবেন! তার বড় ছেলে শরীফ সারা দিন ব্যবসা নিয়ে ব্যস্ত থাকে। বৌমা কাজল অফিস আর সকালের পড়াশোনা তদারকিতে ব্যস্ত। স্কুল শিক্ষক, প্রাইভেট টিউটর, গানের শিক্ষক ও হুজুরের কাছেই সকালের সময় কাটে। রাতে নাতির সঙ্গে উমেদ আলীর একটু গল্প করার সুযোগও কমে যাচ্ছে। ছোট ছেলে আকরাম এখনো চাকরি-বাকরি করে না। আজকাল তার চলাফেরা উমেদ আলীর কাছে কেমন যেন সন্দেহজনক ঠেকে। সেদিকে শরীফ আর বৌমা কাজলের নজর দেওয়ার সময় নেই। উমেদ আলী বিছনায় শুয়ে এপাশ-ওপাশ করেন।
আকরাম রাত ২টায় বাসার বেল চাপে। উমেদ আলী ওঠে গিয়ে দরজা খোলেন। একি! আকরামের মাথায় ব্যান্ডেজ। উমেদ আলী আতঙ্কে শিউরে ওঠেন। তিনি শরীফ আর বৌমাকে ডাকতে গেলে আকরাম বাধা দেয়।
‘তেমন কিছু না। তুমি গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ো তো।’
আকরাম ফ্রিজ থেকে খাবার বের করে নিজেই গরম করে খেতে বসে। উমেদ আলী তার সামনের চেয়ারে বসে ছেলের খাওয়া দেখছেন।
‘কোথায়, কীভাবে কী হলো?’
‘ওই সাত রাস্তার পেছনের গলির অন্ধকারে কয়েকটা লোক আমার ওপর হামলা করেছে।’
‘কিন্তু এ সময় তুই ওখানটায় গেলি কেন? আর লোকগুলোই বা কেন তোর ওপর হামলা করল?’
উমেদ আলীর অস্থিরতা যাচ্ছে না। কিন্তু আকরমের কথাবার্তা স্বাভাবিক। আয়েশ করে খাবার খাচ্ছে।
‘কেন হামলা করল সেটা তো বলতে পারব না। তবে চিন্তা করো না। থানায় জিডি করা হয়েছে। কাল দু-একটা পেপারেও খবরটা ছাপা হবে।’
‘এত কিছু ঘটে গেল! কিন্তু শরীফ, বৌমা কিংবা আমাকে জানানোর একটু প্রয়োজনবোধ করলি না?’
‘ভাবলাম, তোমাদের চিন্তায় ফেলে লাভ কী!’
উমেদ আলী চেয়ার ছেড়ে পায়চারি করতে থাকেন। আকরাম খাওয়া শেষ করে নিজের ঘরের দিকে চলে গেল। তার শরীরে যেন এত বড় আঘাতের তেমন প্রভাব নেই। তাই ছেলেকে অচেনা লাগছে উমেদ আলীর। এত রাতে বাসার কলিংবেল বাজা, আকরামের সঙ্গে তার আতঙ্ক জড়ানো কথাবার্তা, খাবারের প্লেটের শব্দ—এসবের কিছুই যেন বড় ছেলে শরীফ ও বৌমা কাজল শুনতে পায়নি। উমেদ আলীর ঘুম আসে না। কখনো পায়চারি আবার কখনো বিছানায় আধশোয়া অবস্থায় তিনি রাত কাটান।
সকালে উমেদ আলী নাতি সকালকে স্কুলে পৌঁছে দিতে বের হলেন। বৌমাকে বলেকয়ে মাঝেমধ্যে তিনি এ দায়িত্বটা নেন। বড় ছেলে ও বৌমার ব্যস্ততা, নাতি সকালের পড়াশোনার যুদ্ধ আর ছোট ছেলের ভবঘুরেপনায় সরকারি চাকরি থেকে অবসর নেওয়া উমেদ আলী আজকাল একা বোধ করেন। সকালকে স্কুলে পৌঁছে দিয়ে উমেদ আলী একটা বইয়ের দোকানে ঢুকলেন। কাজল সকালের জন্য একটা বই কিনতে বলেছে। বইয়ের নাম ‘একের ভেতর তিন’। তৃতীয় শ্রেণির বই। কিন্তু বইটি হাতে নিয়ে উমেদ আলী আকাশ থেকে পড়লেন। এ তো গাইড বই! বইটা সকালের সব পাঠ্যপুস্তকের প্রশ্নের উত্তরের সংকলন। তৃতীয় শ্রেণির বাচ্চাদেরও গাইড বই পড়ানো হচ্ছে! দোকানের মালিকের কাছে উমেদ আলী জানতে পারলেন যে, এখন স্কুল থেকেও গাইড বই কিনতে বলা হচ্ছে। কারণ, স্কুলের শিক্ষকরা এসব বই লিখছেন। পরীক্ষাতেও এসব বই থেকে প্রশ্ন করা হচ্ছে। উমেদ আলী ভাবেন, যদি তাই হয়, তবে স্কুলে শিক্ষকের কী দরকার। নাতি সকালের জন্য উমেদ আলীর বইটি কিনতে ইচ্ছে করছে না। তার পরও তাকে বইটা কিনতে হবে। কারণ বৌমা বলেছে। তিনি বইয়ের দোকান থেকে বের হয়ে একটা চায়ের দোকানে বসলেন।
‘দোস্ত, আমার মামাত ভাই কাস্টমসে ঢুকছে। মাল আর মাল।’ পাশের টেবিলে বসে যে দুটো ছেলে শিঙাড়া খাচ্ছিল তাদের একজন কথাটা বলল। কথাটা শুনে উমেদ আলীর চা ছলকে পড়ল। এত কম বয়সী ছেলেরা কত স্বাচ্ছন্দ্যে অনৈতিক বিষয়ে কথা বলছে। তিনি চায়ের বিল দিয়ে সকালের জন্য কেনা বইটি নিয়ে পথে নামলেন। গাইড বই আর চায়ের দোকানের ছেলেটির কথাসহ আরও অনেক কিছু তার মাথায় ঘুরপাক খায়। একাত্তরের যুদ্ধক্ষেত্রে সহযোদ্ধা চন্দনের কথা তার মনে পড়ে যায়।
‘আমরা জীবিত অবস্থায় ফিরি না ফিরি, স্বাধীন দেশ হবে মানুষ আর ন্যায্যতার।’ চন্দন পরম মমতায় তার অস্ত্রটা গালে স্পর্শ করিয়ে কথাটা বলেছিল। তখন অস্ত্রের চেয়ে তাদের কাছে আপন আর কেউ ছিল না। ঠিক পরের অপারেশনে চন্দন শহীদ হয়েছিল। হাঁটতে হাঁটতে উমেদ আলী সিদ্ধান্ত নেন যে, তিনি ‘একের ভেতর সব’ শিরোনামে একটা বই লিখবেন। এক মানে হচ্ছে মানুষ। একজন মানুষ হলেই বাকি সব পাওয়া যাবে। যুদ্ধক্ষেত্রের যে গল্পটা নাতি সকালকে শুনিয়ে শেষ করতে পারেননি সেটাও এ বইয়ে থাকবে। বই বিষয়ক ভাবনার ব্যস্ততায় উমেদ আলীর একাকিত্ব কেটে যায়। বাসায় নিজের ঘরের দরজা আটকে বেশিরভাগ সময় কাগজ কলমের সঙ্গে কাটান। কোনো কিছু সহজভাবে লেখার চেয়ে কঠিন করে লেখা কঠিন। কিন্তু তাকে সবকিছু সহজ করে লিখতে হবে। যাতে স্কুলের বাচ্চারাও বইটি পড়তে পারে, বুঝতে পারে। এক সময় কঠিন কাজটি শেষ হলেও, বইটি ছাপতে গিয়ে বিপত্তি দেখা দিল। প্রকাশক টাকা ছাড়া তার মত অর্বাচিন লেখকের বই ছাপতে রাজি হলেন না। উমেদ আলী পেনশনের টাকা দুই ছেলেকে ভাগ করে দিয়েছিলেন। আর মুক্তিযোদ্ধার ভাতা ব্যাংকে জমছিল। সেই জমানো টাকা দিয়েই তিনি ‘একের ভেতর সব’ বইটি ছাপালেন। কিন্তু বই যে চলে না। বইমেলাতেও সারা মাসে দুজন পরিচিত চক্ষুলজ্জায় দুই কপি কিনেছিলেন। একদিন সব বই ভ্যানগাড়িতে উঠিয়ে উমেদ আলী বাসায় ফিরলেন। বৌমা কাজল নিচু স্বরে বলেছিল, বাবার যে কী কাণ্ড!
আরেকদিন উমেদ আলী স্কুল থেকে সকালকে নিয়ে বাসায় ফিরে দেখেন বসার ঘরে শরীফ, কাজল আর আকরাম খোশ মেজাজে গল্প করছে। উমেদ আলী অবাকই হলেন। কারণ, এ সময় তাদের বাসায় থাকার কথা নয়। উমেদ আলী জানতে পারলেন যে, আগামীকাল আকরাম একটি দূতাবাসের সহায়তায় বিদেশ চলে যাবে। কাজের বিষয়টি আপাতত গোপন রেখে বাবাকে দোয়া করতে বলল। উমেদ আলীর মনে পড়ল—সাত রাস্তার পেছনের গলিতে আকরামের ওপর হামলা, থানায় জিডি আর ফকিরাপুলের দুটি পত্রিকায় এ ঘটনা নিয়ে ছাপা হওয়া সংবাদের কথা। তিনি বোঝে গেলেন যে, এসব দিয়ে আকরাম বিদেশি দূতাবাসকে সন্তুষ্ট করেছে যে, দেশে সে নিরাপত্তাহীনতায় আছে। উমেদ আলী ওঠে গিয়ে নিজের ঘরের দরজা এঁটে দিলেন। কাজল আর শরীফের মনে হলো, আকরাম চলে যাবে বলে বাবার মন খারাপ হয়েছে। সন্ধ্যার পর উমেদ আলী একবার বের হয়েছিলেন। পরদিন সকালে কাজল কলিংবেল শুনে দরজা খুলে দেখে পুলিশ দাঁড়িয়ে আছে। শরীফ, কাজল আর সকাল ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। আকরাম নিজের ঘরে লুকিয়ে আছে। পুলিশ তাকেই নিয়ে যেতে এসেছে। আর এর নেপথ্যে আছেন বাবা উমেদ আলী। ব্যাপারটা দুই ছেলে আর বৌমা কাজল বুঝে গেল।
‘তোমার বাবা খুব মহান।’ কাজল তার স্বামী শরীফকে বলল।
পুলিশ আকরামকে নিয়ে বের হচ্ছিল। আকরাম পেছন ফিরে বাবার দিকে তাকাল। আর বলল, ‘বাবা, তুমি নিজের সন্তানের সুন্দর ভবিষ্যৎটা এভাবে ধ্বংস কইরা দিতে পারলা?’
‘যে দেশের জন্য যুদ্ধ করেছি, তার মুখে কালিমা লেপন করে আমি তোমাকে বিদেশ যেতে দিতে পারি না।’
পুলিশ অফিসার টুপি খুলে উমেদ আলীকে স্যালুট জানালেন। আর রাগে ফুঁসছে দুই ছেলে আর কাজল।
উমেদ আলী আকরামকে বললেন, ‘শোন, নিজের তো যোগ্যতা নেই। তুমি অবশ্যই বিদেশ যাবে। আমি পাঠাব। তার আগে প্রায়শ্চিত্ত করে এসো।’
পুলিশ আকরামকে নিয়ে গেল। উমেদ আলী ঘরে পায়চারি করছেন। আর ভাবছেন, আরেকটা যুদ্ধ তার নিজের ঘর থেকে শুরু করতে হবে। শরীফ আর কাজল উমেদ আলীর এমন চেহারা কখনো দেখেনি।
‘তোমার শাশুড়ির ধারণা ছিল যে, সে আমার আগে মারা যাবে। হয়েছেও তাই। আর মরার আগে সে আমার নামে ফ্ল্যাটটা লিখে দিয়ে গেছে।’ উমেদ আলী বৌমা কাজলকে বললেন।
উমেদ আলী ফেলনা নন সেটা বোঝাতেই যে কথাগুলো বলেছেন সেটা শরীফ আর কাজল বুঝতে পারল।
‘আজ থেকে সকাল আমার কাছে প্রতিদিন এক ঘণ্টা গল্প শুনবে। যুদ্ধের গল্প, মানুষের গল্প।’ উমেদ আলী বললেন।
‘জ্বি বাবা।’ কাজল নতস্বরে সায় দিল। আর আনন্দে সকালের চোখ ঝলমল করে উঠল।
‘আমার লেখা বইটি আমি পথে, বাসে আর ট্রেনে ফেরি করে বিক্রি করব। কেউ না কিনলে পড়ে শোনাব। এতে তোমাদের আত্মসম্মানে লাগলে আমার কিছু করার নেই।’
কাজল এবার উচ্ছ্বাসের সঙ্গে বলল, ‘বাবা, আমাদের আত্মসম্মানে লাগবে কেন? এ তো খুব ভালো কাজ।’ তার উচ্ছ্বাস দেখে শরীফ আর সকাল মুচকি হাসল।
উমেদ আলী বললেন, ‘তোমরা মায়েরা যারা সন্তানকে যুদ্ধে অবতীর্ণ করে স্কুলের সামনে জটলা বেঁধে গল্প করো, সেখানেও আমি বই পড়ে শোনাতে যাব।’
কাজল মাথা নেড়ে সায় দিল। উমেদ আলী নিজের ঘরে ঢুকে দরজা আটকে দিলেন। শরীফ, কাজল, এমনকি সকালও বুঝতে পারল যে, তিনি এখন আকরামের জন্য কাঁদবেন।