থ্রিলার রহস্যজট : পরিচয়
লিখেছেন ধ্রুব নীল
দেয়ালে স্ট্যাচুর মতো ঝুলতে থাকা পেটমোটা টিকটিকিটা দেখে যুবকের মনে হলো তার নাম আরশাদ নয়, অন্য কিছু। কিন্তু আরশাদ নামটা মাথায় আসলো কেন বুঝতে পারছে না। ভোঁতা একটা ব্যথা মাথায় ছড়িয়ে আছে। সাদা বিছানায় সে একা। বিছানাটা এত সরু যে আর কারোর থাকাও সম্ভব না।
বিছানা ছেড়ে উঠে বসতে গিয়ে বুঝতে পারলো এটা হাসপাতাল। তা না হলে শরীর এত দুর্বল লাগবে কেন? মুখভর্তি দাঁড়ি। এত বড় দাঁড়ি তার কখনই থাকে না। তার মানে সে এখানে অনেকদিন ধরে, শুয়ে ছিল? নাকি ঘুমিয়ে ছিল? আজ কত তারিখ। হড়বড় করে অনেকগুলো প্রশ্ন ভিড় করলো।
হন্তদন্ত হয়ে রুমে ঢুকলো নার্স। দুলতে থাকা জানালার কপাট লাগিয়ে দিল। যুবকের সঙ্গে চোখাচোখি হতেই হাসলো।
‘আজ কত তারিখ সিস্টার?’
‘জুলাইয়ের সাত।’
তারপর যেভাবে এক ঝলক বাতাসের মতো ছুটে এসেছিল, সেভাবেই আবার হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে গেল মেয়েটা।
ঘণ্টাখানেক শুয়ে কাটালো। ঘুম ভাঙলো একটা গুঞ্জনে। তার রুমের দিকেই আসছে। নার্সের পাশে পান খাওয়া মোটাসোটা মহিলাটাকে দেখেই হাসিতে ভরে উঠলো যুবকের মুখ। পরিচিত ঠেকলেও নামটা মনে পড়লো না।
‘ওরে মিঠুরে.. ‘ বলেই ছুটে এলেন মহিলা। মিঠু! ছোটবেলায় এই নাম ধরে তাকে কত ডাকতো মা! কিন্তু এই মহিলা কে? এ তো তার মা নয়!
‘আম্মা কোথায়?’
‘তুই আমাকে চিনতে পারস নাই? আমি তোর জেবু খালা। আর তোর কী হইসে?’
‘আম্মা কই?’
‘ওমাগো! মিঠুরে তোর কী হইসেরে! তোর মা তো মরসে সেই ছসাত বৎসর হইল। দুই হাজার আটে।’
মিঠু চমকে উঠলো না। তার মনে হলো হয়তো অনেক দিন আগে মারা গেছে বলেই তার এখন আর শোক উথলে উঠছে না। বাবার মৃত্যুর কথা মনে আছে। সে একেবারে শৈশবের কথা।
জেবু খালা অনেকক্ষণ গল্প করলেন। ধীরে ধীরে সব খুলে বললেন। মাস্টার্স পাশ করার পর মিঠুর একটা চাকরি হয়। অফিস কোথায় জেবু খালা জানেন না। এ ছাড়া মিঠুর সঙ্গে তার পছন্দের মেয়ে জবার বিয়ের বন্দোবস্তও করে রেখেছেন। জবা! মিঠু অনেক ভেবেও কোনও চেহারা কল্পনা করতে পারলো না। একটা সময় জেবু খালার সময় ফুরিয়ে এলো। মিঠুকে খাবার আর ওষুধ খাইয়ে চলে গেলেন। যাওয়ার সময় হাতে একটা চিঠি আর কিছু টাকা গুঁজে দিয়ে গেলেন। সহসা ঘোর কাটলো না মিঠুর।
এরপর কে আসবে? অপেক্ষায় আছে মিঠু। নিজেকে আয়নায় দেখছে বার বার। এরইমধ্যে জেবু খালা কাকে দিয়ে যেন নতুন একসেট পোশাকও এনে দিয়েছে। জিন্স আর টিশার্ট। নিজের চেহারাটাকে অনেক বেশি বুড়িয়ে যাওয়া মনে হলো। যদিও জেবু খালার মতে তার বয়স ছত্রিশ কি সাইত্রিশ। অনার্সের সেকেন্ড কি থার্ড ইয়ারের কথা ভাসা ভাসা মনে আছে। আর মনে পড়ছে জবার কথা। কেমন ছিল দেখতে?
জেবু খালার চিঠিটা খুলল মিঠু। কোনও সম্বোধন নেই।
‘বাবা মিঠু, তোমার স্মৃতিশক্তি নষ্ট হয়েছে এটা সবাই জানে। তুমি গত মাসেও এইভাবে ঘুম থেকে উঠে কাউকে চিনতে পারো নাই। তোমাকে হাসপাতালে রাখা নিরাপদ না। কিন্তু আমি অসহায়। তোমার কাছে সম্ভবত অনেক টাকা আছে। আর তাই তোমার কিছু শত্রুও আছে। গত কয়েকদিন যাবৎ তোমার খোঁজখবর করতে আমাদের বাসায় কিছু লোকজন এসেছে। আমার ঘরে তল্লাশি করেছে। তুমি সাবধানে থাকবা। কাউকে বিশ্বাস করবা না। তোমার গ্রামের একটা ঠিকানা আমি চিঠির শেষে লিখিয়া দিয়েছি। তুমি সেইখানে চলে যেও। বহু কষ্টে তোমার এক বন্ধুর কাছ থেকে তোমার সন্ধান পেয়ে দেখা করতে আসছি আমি। কিন্তু এখন আর সম্ভবপর হবে না। ইতি তোমার জেবু খালা।”
চিঠিটা পড়া শেষ হতেই বিদ্যুৎ খেলে গেল মিঠুর মাথায়। জলদি কিছু করা চাই। চিঠিটা হাতের মুঠোয় দলা পাকিয়ে নিল। এরপর ছুড়ে ফেলল ওয়েস্ট বাস্কেটে।
আধ ঘণ্টা পর। কেবিনে ঢুকলো এক সাক্ষাৎ রূপবতী। কড়া মেকাপ দেওয়া তরুণী নির্বিকারচিত্তে এগিয়ে এসে মিঠুর কপালে চুমু দিল। এরপর পাশে বসে হাত ধরলো আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে।
‘ইটস অলরাইট আরশাদ। তুমি আমাকে চিনতে পারছো না তা বুঝতে পারছি। তবে তোমাকে কিছু বিষয় জানানোর সময় হয়েছে।’
চুপ করে শুনছে মিঠু কিংবা আরশাদ নামের যুবক।
‘তুমি বাংলাদেশের একটি গোয়েন্দা সংস্থার আন্ডারকাভার এজেন্ট। সিকিউরিটির জন্য এখনই তোমাকে নামটা বলতে পারছি না। আমার নাম জবা। তোমার গার্লফ্রেন্ড হলেও আপাতত ছদ্মবেশেই আছি। আমরা আশঙ্কা করছি তোমার পরিচয় ফাঁস হয়ে গেছে। এখানে তুমি আর নিরাপদ নও। আজই তোমাকে নিয়ে যাওয়া হবে।’
কেঁপে উঠলো মিঠুর চোখ। তবে ভড়কে গেল না। জবা নামের মেয়েটার চোখের ভাষা পড়ার চেষ্টা করছে। পারছে না। খুব সরল আবার শীতল। তবে তাড়াহুড়ো করেনি। থেমে থেমেই কথাগুলো বলেছে।
‘তোমার কাছে এজেন্সির ইম্পরটেন্ট একটা ফাইল আছে। ফাইলটা কোথায় রেখেছো কেউ জানি না। একসিডেন্ট করার আগে তুমি একটা কোড বলতে গিয়ে বলনি। তার আগেই তোমার গাড়ি উল্টে যায়।’
‘হুমম।’
একসিডেন্টের দৃশ্যটা একটুও কল্পনা করতে পারলো না যুবক। এমনকি কোনও কোডও না।
‘তুমি কি সত্যিই কিছু মনে করতে পারছো না আরশাদ?’
‘আমার মায়ের কথা তোমার মনে আছে? তোমাকে কি আমি মায়ের কাছে নিয়ে গিয়েছিলাম।’ আচমকা প্রশ্ন ছুড়ে দেয় মিঠু।
দম নিল মেয়েটা। তারপর বলতে শুরু করলো।
‘ওহ ইটস সো স্যাড। আন্টি মারা যাওয়ার পর তুমি অনেক ভেঙে পড়েছিলে। কিন্তু তোমার সেসব কিছুই মনে নেই। আমি মনে করিয়েও দিতে চাই না। গোয়েন্দা সংস্থায় যেদিন জয়েন করলে, তার তিন দিন পরেই তো আন্টির সঙ্গে আমার দেখা। আমাকে তো সেদিনই উনি বৌমা ডেকেছিলেন।’
‘হুম। কীসের যেন কোডের কথা বললে?’
‘একটা লকাপের সম্ভবত। তুমি ওটা কোথাও লিখে রাখোনি? তোমার গাড়ি তন্ন তন্ন করে খুঁজেও পাইনি।’
‘কিন্তু.. আমি কি সত্যি… আচ্ছা আমি তোমাদের এজেন্সিতে কতদিন ধরে কাজ করছি?’
‘২০০৯ এর আগস্ট থেকে। আর তুমি আমাদের সবচেয়ে তুখোড় গোয়েন্দা। তোমাকে আন্ডারকাভারে একটা গ্রুপের কাছে পাঠিয়েছিলাম। ওরা বাইরের একটা সংস্থার হয়ে কাজ করে।’
‘হুম। কিন্তু আমি কী করে নিশ্চিত হবো যে আমি তোমাদের লোক।’
‘তোমার পক্ষে এটা নিশ্চিত হওয়া সম্ভব নয়। আমাদের পক্ষেও কঠিন। কারণ তোমার সমস্ত রেকর্ড মুছে ফেলা হয়েছে। যাই হোক.. মনে পড়লে এই নাম্বারে কল দেবে। আমি উঠি। তোমাকে হয়তো আরও কিছু দিন থাকতে হবে।’
জবা চলে গেল ঘণ্টাখানেক হলো। মিঠু ভাবলো আরশাদ নামটা সম্ভবত জবার এজেন্সিই তাকে দিয়েছে। জবা নামটাও বানানো মনে হচ্ছে। জবা নামে আসলে কি তার কোনো প্রেমিকা ছিল? নাকি এই মেয়েটাই অবচেতনে তার পুরনো প্রেমিকা হয়ে গেছে। দলা পাকিয়ে ফেলে দেওয়া কাগজটা নিয়ে ঠিকানাটা মুখস্ত করে নিল মিঠু। এরপর ছিড়ে কুচি কুচি করে টয়লেটে ফ্লাশ করে দিল। অনেকটা তার স্মৃতির মতোই। কেন যেন আর কিছুই মনে করার ইচ্ছা হলো না মিঠুর।
রাত দশটা। দরজায় মৃদু পায়ের শব্দ শুনেই সচকিত হলো। টেকো মাথার মধ্যবয়সী এক লোক। এদিক ওদিক তাকিয়ে শেষে ঢুকেই পড়লো।
‘কি ভাই.. এবার আপনি বলবেন..।’
‘শশশশ…’
মিঠুকে চুপ করিয়ে দিয়ে লোকটা বেডের নিচে হাত দিল। একটা ছোট্ট যন্ত্র বের করে মিঠুকে ইশারায় বোঝালো, লিসেনিং ডিভাইস রেখে কেউ তার ওপর নজর রাখছে। যন্ত্রটা নষ্ট করে হাত ঝাড়তে ঝাড়তে এগিয়ে এলো লোকটা। যেন একগাদা ময়লা ঘেঁটে এসেছে এইমাত্র।
‘শোনো বালক, আমি ইন্টেলিজেন্সের একজন অফিসার। তুমি ইতিমধ্যে দারুন কনফিউজড এটা সত্য। আপাতত তোমার পরিচয়ের চেয়েও বড় সত্যটা হলো সেই কোড। যার ভেতর লুকিয়ে আছে একটা লকাপের ঠিকানা।’
লোকটার মুখের কথা কেড়ে নিল মিঠু। ‘এবং সেই ঠিকানায় গেলে একটা বাক্সে লুকানো আছে একটা ফাইল। এবং তাতে..।’
‘ওহ না.. ওটা ঠিক ফাইল নয়। একটা মেমোরি কার্ড বলতে পারো। এজেন্সির অনেক বড় বড় কর্মকর্তার কিছু কেলেঙ্কারিয়াস ব্যাপার আছে সেখানে। বুঝতেই পারছো সেটা খারাপ লোকের হাতে পড়লে পরিস্থিতি কতটা ভয়াবহ হবে। জিনিসটা আসলে আমাদের দুই পক্ষেরই দরকার। ভালো মন্দ দুজনেই এর পেছনে ছুটছে। শেষ পর্যন্ত কী করে যেন ওটা তোমার হাতেই চলে আসে। আর অমনি বেমক্কা গাড়ি উল্টে পড়লে খাদে। তারপর আর তোমার হুঁশ নেই। যাও একটু আসে, তাও চিনতে পার না কাউকেই। তবে মজার বিষয়টা হলো, আমরা ভালো পক্ষ এবং খারাপ পক্ষ; দুই দলই চাই তুমি বহাল তবিয়তে থাকো এবং কোডটা মনে কোরো। বাই দ্য ওয়ে কিছু মনে করতে পেরেছো খোকা?’
‘না, তবে মনে হচ্ছে মনে করতে পারলেও সেটা বলা ঠিক হবে না।’
‘হুম। বুদ্ধিমান ছেলে। যাই হোক, আমরা তাদের ওপর নজর রাখছি। আপাতত ভয় নেই। কিন্তু তথ্য না দিতে পারলে ওরা তোমাকে বাঁচিয়ে রাখবে না।’
‘আপনারা বাঁচিয়ে রাখবেন তো?’
টেকো লোকটা কিছু না বলে মিটিমিটি হাসলো। তারপর চলে যেতে দরজার দিকে পা বাড়ালো। আচমকা ঘুরে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলো, ডাক্তার বলেছে আর দুই সপ্তাহের মধ্যে তোমার একটা কিছু হবে। হয় মনে পড়বে না হয় সব ভুলে যাবে। দুই সপ্তাহ পর, মানে ঠিক ৬ আগস্ট তারিখে তুমি আমাদের কাছে হয়ে যাবে অপ্রয়োজনীয়। ডাক্তার এই তারিখটাই বলেছে বৎস। এজেন্সি তোমাকে বাঁচিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করবে কিন্তু তোমার মতো একটা ফ্রিল্যান্সারের জন্য কেউ কাভার নষ্ট করবে না। মানে তোমার পাশে ধরে নাও কেউ নেই। এক্স গ্রুপ তোমাকে মেরে ফেলবে কনফার্ম। আমার সাজেশন? বাঁচতে চাইলে নিজেই নিজেকে সামলাও।’
লোকটা চলে গেল। মিঠুর কাছে আবার সব তালগোল পাকিয়ে যেতে লাগলো। টেকো মাথার লোকটাকে তার কেন যেন বিশ্বাস করতে মন চাইল। কারণ জবা নামের মেয়েটাকে কিছুতেই বিশ্বাস করা যায় না।
খানিক পর ইনজেকশনের ট্রে হাতে ঢুকলো নার্স। মুখে কৃত্রিম হাসিটা মুছে যায়নি। ইনজেকশনে ঘুম পাড়ানি মাসিপিসি বসে আছে নির্ঘাৎ। নার্সকেও বিশ্বাস না করার যথেষ্ট কারণ আছে। কাছে আসতেই খপ করে ডান হাতে ইনজেকশনটা নিল মিঠু। বাম হাতে নার্সের গলা পেঁচিয়ে ধরলো। এরপর সূঁচটা ঢুকিয়ে দিল তরুণীর ঘাড়ের কাছে। মুহূর্তে লুটিয়ে পড়লো মেয়েটা। সন্দেহই ঠিক প্রমাণ হলো। এখন জবা ও তার গ্যাং হাজির হওয়ার আগেই পালাতে হবে। ঠিকানাটা তার মুখস্তই আছে।
মিঠু কেন জবা ও নার্সকে বিশ্বাস করতে পারলো না?
[লেখাটি ভালো লাগলে আমাদের লেখকদের জন্য নামমাত্র সম্মানি পাঠাতে পারেন নগদ-এ নম্বর 01407-885500]
রহস্যজটের উত্তর: জবার কথা মতো ২০০৯ সালে এজেন্সিতে জয়েন করেছে মিঠু এবং এর পর সে তার মায়ের সঙ্গে জবার পরিচয় করিয়ে দেয়। কিন্তু মিঠুর মা মারা যান ২০০৮ সালেই।