class="post-template-default single single-post postid-22728 single-format-standard wp-custom-logo group-blog vl-boxed aa-prefix-matin-">
Shadow

রোমান্টিক উপন্যাস – ফ্যান্টাসি থ্রিলার কৃ (পর্ব-১৩)

রোমান্টিক উপন্যাস – ফ্যান্টাসি থ্রিলার কৃ (পর্ব-১২)

রোমান্টিক উপন্যাস ফ্যান্টাসি থ্রিলার উপন্যাস- কৃ

১৩
এরপর কেটে গেল আরো তিন মাস। প্রথম দুমাস হন্যে হয়ে প্রামাণিক ব্যাটাকে খুঁজেছি। বিন্তিদের কয়েক বাড়ি পরেই নাকি ওর বাড়ি। কিন্তু ব্যাটা তালা মেরে নিরুদ্দেশ। পরিবারে এক মেয়ে ছাড়া আর কেউ নেই নাকি।
গ্রামে আমার কোনো চাকরি নেই যে দিন তারিখের হিসাব রাখতে হবে। মঞ্জু মাসে এক দুবার দেখা করতে আসে। আমার ছবি নিয়ে যায় বিক্রি করতে। আমার হয়ে প্রকাশকের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা, টাকা পয়সার হিসাব সামলায়। রেনুর সঙ্গে তার ভাবের শেষ নেই। ভাবি ভাবি বলে মুখে ফেনা তোলে। শেষের এক মাসে মনে হলো সে চারবার এসেছে। ঘটনা পরিষ্কার হলো শেষ দিন।
‘এখানে থেকে যাব ঠিক করেছি। একটা পুকুরের ব্যাপারে কথা হয়েছে। মারাত্মক সস্তা। এরকম দশটা লিজ নিয়ে নেব ভাবছি। মাছ চাষ করবো। এত লাভ আর কিছুতে নাই।’
‘ভালো বুদ্ধি। তোর পুকুরে আমি বড়শি ফেলে বসে থাকব, আর হরর গল্প লিখবো। আসল ঘটনা বল এবার।’
‘তুই তোর জীবনকাহিনি লেখ। দেখ ভালো চলবে।’
‘বুদ্ধি খারাপ না। সমস্যা হলো আত্মজীবনী আকারে লেখা যাবে না। কেউ এক বর্ণ বিশ্বাস করবে না।’
‘ভাবি সত্যিই উড়তে পারে?’
‘অবশ্যই পারে। উড়তে না পারলে এতদূর আসি কী করে। কিন্তু এখন আর ওড়ে না। মাঝে মাঝে পূর্ণিমা হলে আমাকে নিয়ে গভীর রাতে নদীর ওপর দিয়ে উড়ে বেড়ায়। কিন্তু তুই সে আশা বাদ দে।’
‘আরে দূর। তোদের ওড়ার ভিডিও করে ইউটিউবে দিতে পারলে হতো। কোটি কোটি ভিউ পেতাম। দুই দিনে লাখপতি।’
‘কেউ দেখবে না। সবাই বলবে এটা এডিট করা। হলিউডের সিনেমায় সুপারম্যান সুপারগার্লদের আরো সুন্দর করে উড়তে দেখা যায়। ওরা মানুষদের বাঁচায় উপকার করে। তোর ভাবির ওসব নিয়ে মাথাব্যথা নেই। চোখের সামনে ঝামেলা দেখলে সেটা না দেখার ভান করে।’
‘শোন তোকে আসল ঘটনা বলি। তোদের পাশেই ঝর্নাদের বাড়ি। মেয়ে হিন্দু। তাতে সমস্যা নেই। দুজনে বিয়ে করবো ঠিক করেছি। তবে ঘটনা একটু ঝামেলার দিকে মোড় নিয়েছে। মেয়ে হিন্দু আমি মুসলমান। তাতে সমস্যা নেই মেয়ের বাবার। কিন্তু ওই ব্যাটা এক বিচিত্র শর্ত দিয়েছে।’
‘কী?’
‘লোকটা পাগল টাইপের। আশপাশের লোকজন তাই বলল। মানুষের দান খয়রাতে চলে। অবশ্য কালিপ্রসন্ন নামটা শুনলেই কেমন ভণ্ড ভণ্ড মনে হয়।’
আমি চুপ করে গেলাম। মনে একসঙ্গে দুটো চিন্তা। নামটা কোথায় যেন শুনেছি। আর লোকটাকে কেন যেন সুবিধের মনে হলো না। কেবলি মনে হচ্ছে কালিপ্রসন্ন মানে একটা ভয়াবহ বিপদ। মঞ্জুকে সাবধান করে দিতে হবে। কিন্তু কী বলে সাবধান করবো। এখনো লোকটাকে দেখিনি।
মঞ্জু তখনো আমাকে বলল না বিশেষ সেই শর্তের কথা। রাতের খাবার খেয়ে সিগারেট নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। ইশারা পেয়ে আমিও বের হলাম। বের হওয়ার সময় রেনুর সঙ্গে কড়া দৃষ্টি বিনিময় হলো। অভয় দেওয়া হাসি দিলাম। মানে আমি সিগারেট ধরেও দেখবো না।
মঞ্জু আমাকে টেনে নিয়ে গেল নদীর পাড়ে। যমুনার শাখানদী। পানি সামান্য হলো ঠাণ্ডা বাতাসের অভাব নেই। এদিকে শীত পড়তে শুরু করেছে জাঁকিয়ে।
মঞ্জু শীতে কাঁপছে। পরনে একটা ফুলহাতা শার্ট। আমি চাদরমুড়ি দেওয়া।
‘ঘটনা কী?’
‘ঘটনা হলো কালিপ্রসন্ন রাজি। তবে কঠিন শর্ত দিয়েছে। এত কঠিন যে আমি তার মুখের ওপর থুথু ফেলে এসেছি। জাহান্নামে যাক ঝর্না।’
‘ঝর্নার দোষ কী! তার বাবার না হয় মাথা খারাপ।’
‘হারামজাদা আমাকে বলে রেনু ভাবির একটা পুরনো শাড়ি আর এক গাছি চুল দিতে হবে। তা হলে ঝর্নাকে সে নিজ হাতে আমার হাতে তুলে দেবে। কোনো রা করবে না।’
আমার বিস্ময় খানিক পর হাসিতে রূপ নিল। ‘মানলাম তার ইচ্ছেটা অদ্ভুত। কিন্তু এসব দিয়ে কী করবে জানতে চাইলি না?’
মঞ্জু আমার দিকে এমনভাবে তাকাল যেন আমি একটা প্রথম স্তরের বুদ্ধিমত্তা সম্পন্ন উল্লুক। মানুষ হতে যার বহু দেরি।
‘ব্যাটারা এসব কেন নেয় জানিস না? আর সে আমাকে গোপনে ডেকে নিয়ে তার এই ডিমান্ডের কথা বলেছে। কেউ জানে না।’
‘কিন্তু কারণ…।’
‘কারণ সে রেনুভাবির লোভে পড়েছে। ভাবিকে সে কালোজাদু করে কাছে পেতে চায়। বুঝলি? ব্যাটার কোষে কোষে শয়তানি।’
মঞ্জুর হাত থেকে সিগারেট নিয়ে কষে টান দিলাম। বাসায় যাওয়ার সময় লেবু পাতা হাতে ডলে নিতে হবে। চিবুতেও হবে। অবশ্য তাতেও লাভ হবে না। হাতে লেবু পাতার গন্ধ পেলেও রেনু বুঝে যাবে আমি সিগারেট খেয়েছি। তার শাস্তির ধরনগুলোও অদ্ভুত। এই শীতের রাতে সারারাত বাইরে বসিয়ে রাখতে পারে।
‘একটা বুদ্ধি আছে। ব্যাটাকে গাধা বানানো যায়।’
‘আমি সত্যিই হারামজাদার মুখে থুথু মেরে এসেছি। সে জামার হাতা দিয়ে সেটা মুছেছেও। থুথু মারার পরও হারামির মুখে হাসি। বলে আমি কিনা ঠিকই ফিরে আসবো।’
‘হুম। সে জানে ঝর্নাকে তুই অনেক ভালোবাসিস এবং তুই এসব জাদুটোনায় বিশ্বাস করিস না। এ কারণে সে কনফিডেন্ট যে তুই ফিরে যাবি। আমার বুদ্ধিটা শোন।’
‘কোনো বুদ্ধি টুদ্ধির ধার ধারি না। ঝর্না চ্যাপ্টার ক্লোজড।’
‘যে এমন আবদার করে, তাকে এমনি এমনি ছেড়ে দিলেও তো অন্যায়।’
‘ওকে, বল কি বলবি।’
‘তুই ওকে বিন্তির মায়ের চুল আর শাড়ি দিয়ে আয় তাকে। শেষ বয়সে বুড়ির একজন সঙ্গী হলে মন্দ হয় না। হা হা হা।’
‘কিন্তু কিছু হলে… না মানে। যদি ওই বিন্তির মায়ের.. উফ! তুইও আমার মাথা খাবি নাকি!’
আমার আবার খটকা লাগল। এত ঘন ঘন খটকা লাগার মানে হলে স্মৃতিশক্তি নষ্ট হওয়ার পথে।
‘ওই কালিপ্রসন্ন ব্যাটার পুরো নাম জানিস?’
‘কী যেন প্রামাণিক।’
‘হুমমম..’
মঞ্জুকে ঘটনা জানানোর সময় এসেছে। লজ্জার মাথা খেয়ে সব খুলেই বলতে হলো। শোনার পর ঝিম মেরে বসে থেকে আরেকটা সিগারেট ধরাল। তারপর লম্বা করে দম নিল। বড় লেকচার দেওয়ার প্রস্তুতি।
‘প্লায়ার্স দিয়ে একটা একটা করে দাঁত তুললে কেমন হয়? এটা নাকি সবচেয়ে যন্ত্রণার শাস্তি। আমার মাথায় অবশ্য আরো ভয়াবহ সব আইডিয়া আছে। রিমান্ডের চেয়েও ভয়াবহ। যেমন ধর একটা একটা করে আঙুলে কেরোসিন তেল ব্রাশ করতে হবে। বার বি কিউতে যেভাবে তেল লাগায়। তারপর…।’
‘আপাতত তোকে কিছু করতে হবে না। প্রতিশোধ তো নেবই। তার আগে রহস্যটা জানা দরকার। ওর কাছে একটা কিছু আছে। বই বা নোটবুক টাইপ কিছু। ওতে কিছু সঙ্কেত.. মানে ধর ইয়ে মন্ত্র লেখা আছে। ওটা বাগাতে হবে। ওর জন্য আগের প্ল্যানটাই ভালো। আমাকে সে চেনে। তাই তুই যাবি। শাড়ি আর চুল নিয়ে। আসার সময় চুরি করে ওই নোটবইটা নিয়ে আসবি। আমি লাল রঙের বইটা ওর হাতে দেখেছি।’
‘মনে কর কাজ হয়ে গেছে।’

কাজ হলো না। মঞ্জু ভদ্রলোকের মতো শাড়ি আর চুল দিয়ে এসেছে। নোটবইয়ের ধারেকাছেও যেতে পারেনি। বিন্তির মায়ের শাড়িটা আমিই চুরি করে তাকে দিয়েছি আর চুল নিয়েছি একটা চিরুনি থেকে। করুক তন্ত্রমন্ত্র। এসবে বিশ্বাস করি না। আসলেই করি না? এত কিছু ঘটার পরও?
মনে হয় এখন করি। তবে যাই হোক, ব্যাটা কিছু করার আগেই খতম হয়ে যাবে। ওকে মেরে ফেলার একটা নিখুঁত প্ল্যান আমার করা হয়ে গেছে। অবশ্য অত নিখুঁত হওয়ার কিছু নেই। খুন করে লাশ কোথাও ফেলে রাখলেও সমস্যা নেই। প্রামাণিককে নিয়ে গ্রামের কেউ মাথা ঘামায় বলে মনে হলো না। পুলিশে খবরই দেবে না কেউ।
মঞ্জুর কথা হলো, প্রামাণিককে তার প্রথমে ধরে আছাড় মারতে ইচ্ছে করেছিল। পরে কেন যেন সে ভয় পেয়ে যায়। অদ্ভুত ক্ষমতা আছে লোকটার। পান খায় না। তারপরও মনে হয় মুখে পান নিয়ে সারাক্ষণ চিবুচ্ছে আর বড় বড় চোখ করে বাচ্চাদের মতো হাসছে। তার চোখের দিকে তাকানো যায় না। জিনিসগুলো বাড়িয়ে দিতেই চওড়া করে হাসি দেয়। এরপর ঝর্নাকে ডেকে এনে বলল, ‘যা মা, তুই এর লগে যা। তোর মঙ্গল হইবো। যা, এক্ষণ যা। ওর লগে ঢাহা শহর চইলা যা। আমার একজনের লগে বোঝাপড়া বাকি।’
আমি জানি সে রেনুর কথা বলছে। মঞ্জু ভেবেছে আমার কথা বলেছে। সে আমাকে ছেড়ে যাবেই না। আমি এটা ওটা বুঝিয়ে তাকে ঢাকা পাঠিয়ে দিয়েছি। ও থাকলে বরং আমার পরিকল্পনায় ঝামেলা বড় হবে।
পরিকল্পনা ফাইনাল হওয়ার পর থেকে আমি রেনুকে কিছুটা এড়িয়ে চলতে শুরু করি। ক্ষত সেরে উঠলেও মাঝে মাঝে পিঠে ব্যথা ওঠে। আমাকে তখন তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে হয়। এমনভাবে বললাম যেন কাজটা করতে আমি বাধ্য। আসলে কিন্তু..। সে যাক, বলছিলাম প্রামাণিকের সেই ডায়রি আর তাকে খুন করার কথা।

রোমান্টিক উপন্যাস ফ্যান্টাসি থ্রিলার উপন্যাস- কৃ
ক্যালেন্ডারে চোখ রাখলাম। তিন জানুয়ারি বিকেল। গ্রাম পেরিয়ে শহরের একমাত্র সিনেমা হল থেকে তিন ও চার তারিখের একটা বাংলা সিনেমার দুটি টিকিট কাটলাম। রেনুকে বলে এসেছি বাজার করতে যাচ্ছি।
এসব আমার সাজানো প্ল্যান। যদিও এসবের দরকার ছিল না, তবু বিষয়টায় মজা পাচ্ছি। সিরিয়াল কিলাররা যে মজাটা রোজ রোজ পায়।
তিন তারিখ রাত হলো। খুন করবো চার তারিখ ভোরের দিকে। সকাল আটটা নয়টা হলে ভালো হয়। ওই সময় কেউ কাউকে পরিকল্পনামাফিক খুন করবে এটা কল্পনাও করবে না। এরপর যদি পুলিশি ঝামেলায় পড়ি তা হলে চার তারিখের সিনেমার টিকিট দেখাব। মোবাইল ট্র্যাক করেও কিছু পাবে না। ওটা পুরোপুরি বন্ধ থাকবে। হুট করে বাংলা সিনেমা কেন দেখতে গেলাম, সেটার ব্যাখ্যাও তৈরি। বলবো বাংলা সিনেমা যেসব কারণে দুর্দশা থেকে বের হয়ে আসতে পারছে না সেটার ওপর একটা লেখা লিখছি। আমি পত্রিকায় লিখি। আর বইটই লিখি। তারপরের ঝামেলা তারপর দেখা যাবে।
এর মাঝে রেনু আমার মনের কথা পড়েনি। পড়লে দারুণ হইচই শুরু করতো। আমি খুন টুন করি এটা সে চায় না। আবার মনের কথা জেনে ফেলাটাও তার পছন্দ না। যাক, বাঁচা গেল।
আমি আমার মোবাইল ফোনটা আছাড় দিলাম। গ্লাস ভাঙল ভালো মতোই। এরপর রেনুকে বললাম, তুমি কি শহরের দিকে যাবে? ফোনের গ্লাস বদলাতে হবে। আমার আবার একটা লেখা লিখতে হবে আর্জেন্ট।
‘ঠিকাছে যাচ্ছি। আমি পারলে একটু বিথিকেও দেখে আসবো।’
‘ওহ, ঠিকাছে। তাড়াতাড়ি আসো।’
‘তুমি আবার প্রামাণিকের সঙ্গে বাড়াবাড়ি করো না। ও যে ফিরেছে সেটা আমি জানি। সময় মতো ওকে আমিই দেখবো। সময়টা হোক।’
রেনু সব জেনে গেল নাকি? মনে হলো না। জেনে গেলে যাক। আমি আমার প্ল্যানে অটল। বিনা রণে নাহি দেব সূচাগ্র মেদিনি।
খুন করার অস্ত্রের অভাব নেই। রেনুর চুলের কাঁটা থেকে শুরু করে আমার শেভ করার রেজর। বিন্তিদের রান্নাঘরে চিকন বটিও আছে দুটো। ধার আছে বেশ।
চোরের মতো নয়, প্রামাণিকের আধপাকা বাড়িটার কাছে এগিয়ে গেলাম প্রেমিকের মতো। নির্বিকার চিত্তে। আমার মাথাও আশ্চর্যরকমের ঠাণ্ডা। বারবার একটা কথা উঁকি দিচ্ছে, রেনু আছে, তো কোনো ভয় নেই। সুযোগ পেলে জন্তুটা রেনুর ওপর আবারো হামলা করবে। তার আগে পৃথিবীর প্রাণীজগৎ থেকে তার নামটা কেটে দেওয়া দরকার।
দরজায় টোকা দিলাম। দরজা খুলে দিল শুকনা গোছের এক লোক। কাজ টাজ করে বোধহয়। হতাশ হলাম। প্ল্যানে ফাটল। চেহারা দেখে ফেলল আরেকজন।
‘গুরুজি বাড়ি আছেন?’
‘জ্বি। উনি বিশ্রাম নিচ্ছেন। আপনাকে ভেতরে যেতে বলেছেন।’
‘আমি এসেছি উনি জানলেন কী করে?’
‘উনি আগেই সব বুঝতে পারেন।’
‘ও, তা হলে তো উনার জানার কথা যে উনার সময় শেষ।’
কঠিন অথচ তরল একটা হাসি হাসলাম। লোকটা আমার হাসির তোয়াক্কা না করে সরে গেল। আমি ভেতরে ঢুকলাম। অস্ত্র হিসেবে আমার হাতে যেটা আছে সেটা অতি সাধারণ বস্তু। দেখে কেউ সন্দেহ করবে না। পকেটে রাখা।
একটা কক্ষের দরজা ধাক্কা দিতেই খুলে গেল। পেটমোটা প্রামাণিক শুয়ে আছে। হাঁপাচ্ছে দরদর করে। আমাকে দেখে চোখ বড় বড় হয়ে গেল। মুখের পরিচিত হাসিটা উধাও।
‘পারলাম না। পারলাম না তরে বাঁচাইতে ওই ডাকিনির হাত থেইকা।’
‘কী করে বাঁচাবে শুনি। ডাকিনিকে আমি ভালোবাসি। ডাকিনিও আমাকে ভালোবাসে। আমার জন্য জীবন দিতে তৈরি।’
‘সব মিথ্যা! সব! ও তোকে মিথ্যা দেখাইতাসেরে!’
‘আর তুই আমাকে সত্য দেখাবি?’
ভারটা নেমে গেল। খুনির চরিত্রে ফিরে এলাম। ধীরেসুস্থে কাজটা সারব ঠিক করেছি। ছুরির ঘাই, কিংবা বটি দিয়ে মাথা ফেলে দেওয়াটা শাস্তি হিসেবে নগণ্য।
‘তোর নোটবইটা কোথায়।’
‘ওইটা পুড়ায়া ফালাইসি। কেউ পাইব না আমার ক্ষমতা। আমার ক্ষমতা আমার লগে যাইব, অঙ্গার হইব।’
‘হায় হায়। এখন তোর কোনো ক্ষমতা নাই তা হলে? মারামারি করতে হবে না তোর সঙ্গে?’
‘আমার বিদ্যা মানুষের ওপর খাটে না। নইলে তোরে এখনি হিয়াল বানাইয়া দিতাম।’
‘ও শুধু রেনুর মতো ডাকিনির ওপর খাটে?’
‘রেনু কিডা? ও হইলো কৃ।’
‘কী?’
কালিপ্রসন্ন প্রামাণিকের পেটে কিছু একটা হয়েছে। সে পেট ধরে আছে আর যন্ত্রণায় কোঁ কোঁ করছে।
‘আমারে ডাক্তারের কাছে নিয়া চলরে। ও হারু! হারু! শোন, তুষার, তোরে বাঁচানোর শেষ চেষ্টা করবার পারি আমি।’
‘পেটে কী হয়েছে? গ্যাস? নাকি এপেনডিসাইটিস। কোনো সমস্যা নেই। একটু পর যাবতীয় যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাবি।’
‘আরে আমার কিসুই হইব না। আমি চক্রে আটকা পড়ছি। কৃর চক্র খুব খারাপ। খুব খারাপ।’
‘আমি চক্রে আটকা থাকতে চাই। দুনিয়া একটা চক্রে আটকা পড়ে আছে। এটাকে বলে সিমেট্রি। আরো কঠিন নাম আছে, পয়েনকেয়ার গ্র“প। সহজ করে বলি। হাতে অনেক সময়। তোকে আস্তে ধীরে মারবে। ধর পৃথিবীর সব ঘড়ি থামিয়ে দেওয়া হলো। সব ঘোরাঘুরিও বন্ধ। চাঁদ সূর্য সব স্থির। ঠিক এ অবস্থায় অনন্তকাল থাকলেও, পরে আবার যখন সব চালু হবে, তখন মনে হবে সময় একটুও আগায়নি। বুঝতে পারলি কিছু? ঘিলুতে ঢুকেছে?
‘কৃ তোরে খাইবো। ওরা খুব খারাপ।’
‘মানুষের চেয়ে বেশি খারাপ বলে তো মনে হয় না। আর নামটা কী? কিরি? নাকি ক্রিকেটের ক্রি?’
‘তুই যা! ভাগ! ভাগ! নইলে তোরে মাইরালামু! ভাগ! আমার মন্ত্রে হাত দিবি না! খবরদার। তোরে বাণ মাইরা..।’ কথাটা শেষ করার আগেই আমি গ্লাভস পরা হাতে প্রামাণিকের দুই উরুর ফাঁকে স্পর্শকাতর জায়গায় চেপে ধরলাম। কুঁই কুঁই করে উঠল কালিপ্রসন্ন প্রামাণিক। মুখে কথা বের হচ্ছে না। দুহাত জোড় করে ছেড়ে দেওয়ার অনুরোধ করছে। আমি উদাস হয়ে জানালার দিকে তাকালাম। একটা নীল কাঠঠোকরা সুপারি গাছ নিয়ে দ্বিধায় পড়ে গেছে। ঠোকর দেবে আবার দেবে না এমন করছে। কালিপ্রসন্ন একটা কিছু বলার চেষ্টা করলো। চাপটা বাড়ালাম। কথা ফুটলো না ওর মুখে। আমি হাই তুললাম। কালিপ্রসন্নের চোখ ফেটে বেরিয়ে আসবে যেন। তারপর দ্রুত পাগলের মতো হাতের ইশারায় দেখালো একটা সেলফ। ওতেই আছে তা হলে।
ছাড়া পেতেই বড় করে দম নিয়ে আটকে রাখল লোকটা। আপাতত পেট ব্যথার চেয়েও বড় ব্যথা নিয়ে ব্যস্ত সে।
সেলফটা ভালো করে ঘাঁটতেই গোপন চেম্বারটা পেলাম। একপাশে পড়ে আছে বিন্তির মায়ের শাড়ি আর চুল। ওগুলো ব্যবহারের সুযোগ পায়নি ব্যাটা। তার আগেই অসুখে কাত। চেম্বারের ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো লাল রঙের মন্ত্র লেখা নোটবই। পরিষ্কার হাতের লেখা। বাংলা উচ্চারণসহ আছে।
নোটবই পরে পড়া যাবে। প্রামাণিকের খাটের কাছে এগিয়ে গেলাম। একটা প্রেসক্রিপশনের মতো কাগজ পড়ে আছে। তাতে পাকস্থলীতে ইনফেকশনসহ আরো কী কী যেন লেখা। লিভার কিডনিতেও সমস্যা। টেবিলে অনেকগুলো ওষুধ। এর মধ্যে দুটো অ্যান্টিবায়োটিকও আছে। অ্যান্টিবায়োটিকগুলো সব পাতা থেকে খুলে মগে রাখা পানিতে গুলিয়ে নিলাম। তারপর পানিটা কালিপ্রসন্নের পেটের ওপর ঢাললাম। চোখ বড় বড় করে দেখলো। কিছু বলল না। ওকে খুন করার জন্য নিয়ে এসেছিলাম সাইকেলের ব্রেকের তার। পেছন থেকে গলায় পেঁচিয়ে হ্যাঁচকা টান দেওয়ার প্ল্যান ছিল। ওটার আর দরকার হবে না। তারচেয়ে কঠিন মৃত্যু অপেক্ষা করছে তার জন্য। ধুঁকে ধুঁকে মরুক হারামজাদা।
চলে যাওয়ার সময় শুকনো মতোন লোকটাকে ডাকলাম। শীতল গলায় বললাম, তুমি হারু? থানা থেকে লোক আসবে একটু পর। গুরুজি যেন পালাতে না পারে খেয়াল রাখবে। গ্রাম কোথায় তোমার?
‘জ্বি আজ্ঞে, আ আ আমি একটা ওষুধের জন্য এসেছিলাম। স্যার আমাকে মাফ করা যায় না। আমি আবার কী বিপদে..।’
‘ভাগো তা হলে।’
লোকটা এক সেকেন্ডও দাঁড়াল না। ছুট লাগাল একদিকে।
এতক্ষণ ফুরফুরে মেজাজে ছিলাম। বাসায় পা রাখতেই আতঙ্কে জমে গেলাম। ফুরফুরে মেজাজ ফুরুৎ করে উড়ে গেল। উঠানে অগ্নিমূর্তি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে রেনু। চোখ দিয়ে যেন ঠিকরে আগুন বের হচ্ছে। এই সেরেছে, প্রামাণিকের কথাই তো ঠিক! সত্যি সত্যি ডাকিনির মতো লাগছে রেনুকে।
‘ইয়ে মানে..’ ঝিম ঝিম করে উঠল মাথাটা। সব পড়ে ফেলল রেনু।
এরপর যা ঘটল তার জন্য মনে মনে আমি তৈরি ছিলাম হয়তো। কিন্তু বিন্তি বা তার মা ছিল না। রেনু এগিয়ে এসে ধড়াম করে চড় বসিয়ে দিল আমার বাম গালে। চড় জিনিসটা একটু কোমল ঘরানার শাস্তি মনে হলেও আমার কাছে মোটেও কোমল মনে হলো না। থুথু ফেলে দেখলাম রক্ত বের হচ্ছে কিনা। রেনু বোধহয় দ্বিতীয় আরেকটা মারার চিন্তা করছিল। তার আগেই অজুহাত হিসেবে লাল নোটবইটা তার দিকে বাড়িয়ে ধরলাম। ভ্রƒ বেঁকে গেল রেনুর। চোখের আগুন কমলো না অবশ্য।
‘এটা আনতেই গিয়েছিলাম।’
‘মিথ্যে বললে এরপর এক লাথিতে নদীতে ফেলবো। গ্রামের সবাই হাজার বছর এই দৃশ্য মনে রাখবে। মারবো লাথি?’
‘আচ্ছ বাবা! খুন তো করিনি। আমার এত সাহস নেই। সঙ্গে ছুরি কাঁচি কিছু আছে! চেক করে দেখো, কিছু নাই! বড়জোর একটু মারতাম ওই বেটাকে। হাত-পা একটা কিছু ভেঙে আসতাম। এখন দেখি সে এমনিতেই মরে মরে অবস্থা।’
‘কী বলো!’
রেনুকে মনে হলো দারুণ দুঃসংবাদ শুনেছে। এক হাতে নোটবই, অন্যহাতে আমাকে আঁকড়ে রীতিমতো উড়ে উড়ে দৌড়াতে শুরু করলো। কিছু চিন্তা করারও সুযোগ পেলাম না। তার আগেই আবার প্রামাণিকের বাসা।
লোকটার হাঁপানি আরো বেড়েছে।
‘আইছস তাইলে! হে হে। আমারে ছাড়া তোর গতি নাই বুঝলি! তখন তরে মুক্তি দিতে চাইলাম। তুমি মুক্তি হইলি না। মানুষের লগে প্রেমের শখ তোর। মানুষটারে ছাড়লি না। আমিও ছাড়ূম না তরে। আমার নাম.. খুক খুকক।’
কাশতে কাশতে আর নামই বলতে পারল না। আমি আলতো করে রেনুর হাত থেকে নোটবইটা নিলাম। চোখে প্রশ্ন নিয়ে তাকালাম। এরপর আমাকে ইশারায় বাইরে আসতে বলল রেনু। প্রামাণিকের বাড়ির উঠোনে দাঁড়ালাম। রেনু কিছুক্ষণ ভেবে নিয়ে বলতে শুরু করল।
‘শোনো, তোমাকে অনেক কিছু জানানো হয়নি। কারণ তুমি বুঝবে না সব। আমি জানি একটা বড় গোলমাল হয়েছে আমাদের। কী হয়েছে তা জানি না। তবে আমার ভাসা ভাসা অনেক স্মৃতি আছে। মানে..।’
খেই হারিয়ে ফেলছিল রেনু। খেই ধরিয়ে দিলাম।
‘মানে, সেই স্মৃতিতে আমার নাম তুষার?’
অবাক হলো রেনু। হাসলাম। বললাম তার বিড়বিড় করে বলার ঘটনাটা।
‘তোমার আর আমার বাস্তবতা এটা নয়। হয়তো অন্য জগতে তুমি অন্যকিছু। আমি অন্যকিছু।’
‘তুমি কৃ?’
‘তুমি জানলে..।’
ইশারা করলাম কালিপ্রসন্নর দিকে। খুব করে মনে করার চেষ্টা করছে রেনু। আমি একটু রবীন্দ্রনাথ কপচে দিতে চাইলাম মওকা বুঝে, ন্যায় অন্যায় জানিনে, জানিনে..’ তৃতীয়বার জানিনে বলার আগেই নোটবুকের একটা পৃষ্ঠায় চোখ আটকে গেল।
‘আচ্ছা, তোমার মতো আরো অনেকেই আছে মনে হচ্ছে।’
‘তুমি দেখি মহাপণ্ডিত! এত কিছু জানো কী করে!’
‘লেখকদের ছোটখাট শার্লক হোমস হতে হয়। কিন্তু বেশিরভাগ লেখকই সেটা জানে না। তারচেয়েও বড় কথা, শার্লক হোমস চরিত্রটা একজন লেখকের লেখা।’
‘ঘটনা বলো।’
‘কৃ ডাকিবার মন্ত্র…।’ এই বলে থামলাম। তারপর যে শব্দগুলো সেগুলোর উচ্চারণের জন্য কিছুক্ষণের প্র্যাকটিস লাগবে। আমি নোটবইটা ঝপ করে বন্ধ করে বললাম, ‘আচ্ছা, এত চিন্তার কী আছে। যেভাবে চলছে চলুক সব। ওই ব্যাটা কদিন পর এমনিতেই শেষ। তারপর তো..।’
‘কিন্তু আমি জেনেশুনে একটা মিথ্যার মধ্যে তোমাকে আটকে রাখতে পারি না।’
‘কিন্তু অ্যালিস যদি তার ওয়ান্ডারল্যান্ডেই থাকতে চায় আজীবন?’
‘কে?’
‘ওহ… অ্যালিস ইন ওয়াল্ডারল্যান্ড পড়োনি! নোটবই নিয়ে গবেষণা পরে হবে। আগে বাসায় চলো। ওর সঙ্গে কাজ নেই। ব্যাটা উল্টোপাল্টা বকবে এখন।’
রেনু নাছোড়বান্দা। কালিপ্রসন্ন প্রামাণিকের চুলের মুঠি চেপে ঝাঁকাঝাঁকি করল কিছুক্ষণ। একটুও প্রতিবাদ করলো না লোকটা। মায়া লাগার কথা। কিন্তু লাগছে না। কারণ কালিপ্রসন্ন প্রামাণিকের বিদঘুটে হাসি। রেনু যেন একটা পুতুল। তার সামনে হম্বিতম্বি করছে কেবল। তারপর খুব ধীরে ধীরে ফ্যাঁসফ্যাঁসে গলায় বলল, ‘তোরে তো ফাঁসাইয়া দিয়া গেলাম এইখানে। তুই কখনো তোর জাতির কাছে ফিরা যাইতে পারবি না। ছেলেটা তো আগেই তোর প্রেমে মইজা গেসে। কিন্তু আমি আমার জগতে ফিরা যাইতাসি। আমার জগতে আমিই রাজা। হা হা হা।’
একেবারে সিনেমার ভিলেনদের মতো করে হেসে উঠল লোকটা। মন চাইল মঞ্জুকে ডেকে এনে প্লায়ার্স দিয়ে একটা একটা করে দাঁত তোলাই।
রেনুকে অনেকটা জোর করে নিয়ে আসলাম। অবশ্য আমরা যখন চৌকাঠ পার হবো তখন কালিপ্রসন্ন যা বলল তাতে আমি আবার নতুন করে দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলাম।
‘যাহ যাহ! আমি মইরা গেলে পোলাটারে তার দুনিয়াতে নিয়া যাওনের রাস্তা একটাই। তোরে মরতে হইব।’
‘দূর ছাই! এসব হাবিজাবি শোনার টাইম নাই। চলো, ঢাকায় ঘুরতে যাই। অনেকদিন ঢাকা দেখি না।’
‘নোটবইটা আমাকে দাও।’
আদেশের সুরে বলল রেনু। সুতরাং মানতেই হবে। গ্রামে আমাদের আদিখ্যেতা আহ্লাদের কথা সবাই জানে। আমরা তোয়াক্কা করি না। গ্রামের লোকেরাও করে না। আমি রেনুর কোমার জড়িয়ে ধরি হাঁটি মাঝে মাঝে। আজ আর সাহস হলো না। পাশপাশি হাঁটছি, অথচ হাত ধরছি না, এটা নবম আশ্চর্য বটে। অষ্টমটা হলো রেনু আমার দিকে ফিরেও তাকাচ্ছে না। একমনে উল্টে যাচ্ছে নোটবইটার পাতা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Please disable your adblocker or whitelist this site!