শ্রীমঙ্গলে পৌঁছার পর অল্প সময়ের ভেতর সিলেট থেকে অন্যরাও হাজির হলো। সবাই একসঙ্গে ভালো করে নাশতা সেরে বেরিয়ে পড়ি। আপাতত গন্তব্য বিষামণি। সেখানকার এক কটেজে আমাদের জন্য অপেক্ষায় ছিল ঢাকা, চট্টগ্রাম আর খুলনা থেকে আসা ৯ জনের একটি দল। সেখানে ছোট্ট করে পরিচয় সেরে চড়ে বসি আমাদের জন্য অপেক্ষায় থাকা ঢাউস সাইজের জিপে। সামনের আসনে আমার সঙ্গে রেজা ভাই। চা বাগানের ভেতর হয়ে আঁকাবাঁকা পথ পেরিয়ে তারপর লাউয়াছড়া অরণ্য। জিপের চালক রূপকদা জানতে চাইলেন, নূরজাহান চা বাগান নাকি ভানুগাছ হয়ে যেতে চাই। চা বাগান হয়ে তুলনামূলক কম সময়ে হামহাম যাওয়া যাবে। পদ্মছড়া, মাধবপুর আর পাত্রখোলা চা বাগান পেছনে ফেলে জিপ এসে থামে কুরমা বাজারে। গ্রাম্য বাজারটিতে কয়েক মিনিটের বিরতির ফাঁকে কিছু শুকনো খাবার আর পানি ট্রাভেল ব্যাগে পুরে আবার রওনা হই। এগুলোই পরের ছয়-সাত ঘণ্টার একমাত্র সম্বল। কুরমা বাজার ছাড়ার পর চম্পারাই চা বাগানের কাছে এসে জিপ থেমে যায়। এখান থেকে পদযুগলই ভরসা। কলাবনপাড়ার ছোট ছোট শিশুরা বাঁশের লাঠি নিয়ে ট্রেকারদের জন্য অপেক্ষা করছিল। ওদের কাছে থেকে দলের সবার জন্য একটা করে লাঠি নেওয়া হয়। কলাবনপাড়া থেকে গাইড ইকবাল ভাই আমাদের সঙ্গে যোগ দেন। পাড়ার পাশ দিয়ে বয়ে গেছে স্রোতস্বিনী এক ছড়া। তার পরই বন। বনের শুরুতেই বেগুনি ফুলে ফুলে ছেয়ে আছে হিজলগাছের সারি। যেন আমাদের বরণ করে নেওয়ার অপেক্ষায়!
বনবিট অফিসে নাম এন্ট্রি করে তারপর ঢুকে পড়লাম বনে। আমাদের ট্রেকিংয়ের শুরু পাহাড়ের গা বেয়ে চলে যাওয়া বুনোপথ ধরে। এই পথই নিয়ে যাবে অরণ্যের গহিনে। ট্রেইলের ওপর গহিন বন ক্রমেই ওপরে উঠে গেছে উঁচু পাহাড়ের ঢাল বেয়ে। হাঁটতে হাঁটতে সামনে পড়ল একটি সাঁকো। দুই পাশে আড়াআড়ি একটি গাছ ফেলে রাখা। সাঁকো দেখে কয়েকজনের পিলে চমকে যায়। তবে একে অপরের সহযোগিতায় সেটি পার হওয়া গেল সহজেই। তারপর পথ আবার উঠে গেল পাহাড়ের ওপর দিকে। হাঁটতে হাঁটতে আবার পড়ল সাঁকো। তারপর আবারও! এভাবে চার-চারটি সাঁকো পার হওয়ার পর পথ আরো খাড়া হয়ে উঠে গেছে পাহাড়ের চূড়ায়। গাছের বড় বড় শিকড় ধরে আর লাঠির সাহায্যে চূড়ায় উঠে গেলাম। গাইডের নির্দেশে সবাই একসঙ্গে থামি। তাঁর দেওয়া ওষুধ মেশানো ছাই আর কেরোসিন ভালো করে মেখে নিলাম হাতে-পায়ে, গলায় ও কাঁধে। হামহামের বড় আতঙ্কের নাম জোঁক। সহযোগী হিসেবে আছে জংলি মশা। এসবের হাত থেকে বাঁচাবে এই ওষুধ। আবারও ট্রেইল ধরে পথচলা। একটির পর একটি পাহাড় পেরিয়ে চলতে থাকি। পাহাড় চূড়ার একপাশে এক চিলতা ঢাল দিয়ে ট্রেইল গেছে। অসাবধানতায় পা একটু হড়কালেই হাজার ফুট নিচের দুর্ভেদ্য বাঁশবন। যেতে যেতে দেখা হয় বন রাঙিয়ে ফুটে থাকা নানা রঙের বুনোফুল। পাহাড়ি কলা, বনকাঁঠাল আর বনডুমুরের দেখাও মিলল পথে পথে। ঘণ্টাখানেক হাঁটার পর বিশ্রামের জন্য থামলাম সবাই। বিস্কুট আর পানিতে গলা ভিজিয়ে পদযুগলকে জানিয়ে দিলাম, থামলে চলবে না। হামহাম বেড়ানো শেষে ফিরছিল কয়েকজন। তাদের কাছে আর কত দূর জানতে চাইলে উত্তর দিল—সবে তো শুরু! শুনে কিছুটা হতোদ্যম হলেও মনোবলে চিড় ধরল না। প্রায় দুই ঘণ্টা ট্রেকিংয়ের পর পৌঁছে গেলাম শেষ পাহাড়টির চূড়ায়। আর এখান থেকেই প্রথমবার কানে আসে, সেই মনমাতানো অপূর্ব আওয়াজ—ঝরনার শব্দ। এবার উতরাই পথ ধরে নেমে যেতে হবে নিচের ছড়ায়। এই পথই সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ। খাড়া আর পিচ্ছিল। নিচে নামার পর দেখলাম, পাহাড়ি ছড়া বয়ে চলেছে সশব্দে। প্রবল স্রোত। শেওলাধরা বড়সড় পাথর ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে আছে সবখানে। এবার হাঁটতে হবে ছড়া ধরে স্রোতের উজানের দিকে। ঘোলা পানির নিচে কী আছে, ঠাহর করার সুযোগ নেই। এখানে হাতের লাঠিই যেন অন্ধের যষ্টি! লাঠি ঠুকে ঠুকে পানির তলায় পাথর, গর্ত আর পচা গাছের অবশিষ্ট আন্দাজ করে পা ফেলতে হলো। দলের অন্যদের থেকে কিছুটা এগিয়ে গিয়েছিলাম। তারপর হঠাৎ করেই পিলে চমকে গেল। উজানে আচমকা পানকৌড়ির মতো পানির ওপর ভেসে উঠল কিছু একটার গলা! ওরে বাবা, এ যে সাপ! ভয় ছিল—স্রোতের তোড়ে যদি ওটা ভেসে আসে। তবে ভাগ্য ভালো। প্রায় পাঁচ-ছয় ফুট লম্বা সাপটি ছড়ার পাশে কচুর ঝোপ বেয়ে পাহাড়ের দিকে চলে গেলে হাঁপ ছাড়লাম। ছড়ার শেষ দিকে পাহাড়ের বাঁক। সেই বাঁক ঘুরেই সজোরে চিত্কার দিয়ে উঠলাম! এ চিত্কার আনন্দ আর বিস্ময়ের। এক ছুটে চলে যাই হামহামের সম্মোহনী সান্নিধ্যে। হামহাম তার হিমশীতল পরশে দূর করে দিল পথের সবটুকু ক্লান্তি। রেজা ভাই, রাফি, আতিক, লিটন, রুবেল, কুহু, মাইশা, আমির, লোপা, অনামিকা, আকাশ, ইয়াসিন, আসিফ, লাবণ্য আর আমি—সবাই যার যার মতো মেতে উঠলাম জলকেলি আর পানি ছোড়াছুড়িতে।
অরণ্যের বিশালতার গহিনে হামহামের শাঁ শাঁ ছন্দ ছাড়া পৃথিবীতে যেন আর কোনো শব্দই নেই! তারপর একসময় বড় বড় ফোঁটায় বৃষ্টি পড়তে শুরু করে। সঙ্গে মেঘের কড়াৎ কড়াৎ গর্জন। গাইড বারবার সতর্ক করলেন, বৃষ্টির মাত্রা বাড়লে ছড়ায় ফ্ল্যাশফ্লাড হতে পারে। তখন আর ফেরা সম্ভব হবে না। রাত কাটাতে হবে এখানেই। গাইডের সতর্কতা আমলে নিয়ে ছড়ায় নেমে ফেরার পথ ধরলাম। ছড়া পার হয়ে পাহাড়ে ওঠার সময় ভর করল আরেক আতঙ্ক। সকালবেলা পাহাড়ের ট্রেইল শুকনো ছিল বলে জোঁকের উত্পাত ছিলই না। তবে বৃষ্টি হওয়ায় এখন সেই ভয় তাড়া করছে। পথের ওপর ঝুলে থাকা লতা-গুল্ম থেকে ৯-১০টির মতো জোঁক হাতের লাঠিটা দিয়ে সরিয়ে দিলাম। তার পরও দুইটা প্যান্টের ওপর চড়ে বসল। শুরুতেই বুঝতে পেরেছিলাম বলে রক্ষা। হাঁটতে হাঁটতে যেন পথ আর শেষই হচ্ছিল না। দিনের আলোও নিভে যেতে শুরু করেছে। আবছা আলোতে পাহাড়ি পথ পেরিয়ে কলাবনপাড়ায় পা রাখতে রাখতে একেবারে সন্ধ্যা হয়ে এলো। পাড়ার অখ্যাত এক রেস্তোরাঁয় সবাই খেতে বসলাম। কুপি বাতির টিমটিমে আলোয় আলুভর্তার সঙ্গে দেশি মোরগ আর ডাল দিয়ে খাওয়াটা হলো ভরপুর। প্রথমবারের মতো স্বাদ নেওয়া চা পাতার ভর্তাটাও ছিল দারুণ। কলাবনপাড়া থেকে বিদায় নিয়ে জিপের উদ্দেশে হাঁটা শুরু করার সময় চম্পারাই চা বাগান ঢেকে গেছে ঘুটঘুটে অন্ধকারে।
কিভাবে যাবেন
হামহাম যেতে চাইলে প্রথমে আসতে হবে শ্রীমঙ্গল। ঢাকা থেকে বাস বা ট্রেনে আসা যাবে। শ্রীমঙ্গল থেকে কলাবনপাড়ায় যাওয়ার জন্য আছে রিজার্ভ জিপ বা সিএনজি অটোরিকশা। কলাবনপাড়ার একমাত্র রেস্তোরাঁটিতে যাওয়ার সময়ই খাবারের অর্ডার দিয়ে যাবেন। রাত্রিবাসের জন্য ফিরতে হবে শ্রীমঙ্গল শহরে।