Saturday, December 21
Shadow

সায়েন্স ফিকশন উপন্যাস : মায়াদ্বীপ ২৩৯০

সায়েন্স ফিকশন উপন্যাস মায়াদ্বীপের গল্প ভবিষ্যতের। একটি দ্বীপ। বাংলাদেশের মূল ভূখণ্ড থেকে অনেক দূরে। তবে এর বাসিন্দারা বাঙালি ও গ্রামীণ জীবন যাপন করছে। দ্বীপের শাসনভার এক কোম্পানির হাতে। গ্রামবাসীর কাছে ওই কোম্পানিই হলো সরকার। তারাই সর্বেসর্বা। গ্রামবাসীর কাছে তাদের দ্বীপটাই আস্ত একটা দেশ। বাংলাদেশের অস্তিত্ব সম্পর্কেই তারা জানে না। অন্তু নামে এক সাহসী কিশোরের মনে প্রশ্ন জাগে। সে বেরিয়ে পড়ে দ্বীপ ছেড়ে। আবিষ্কার করে তাদের মতোই আরেকটা দ্বীপ।  

 

পর্ব-১

 

উত্তর-পূবের সৈকতে বিধ্বস্ত অবস্থায় হারু মাঝিকে দেখতে পেয়ে গ্রামবাসী একটার পর একটা প্রশ্ন করেই যাচ্ছে।

‘তুমি কোথায় ছিলা?’

‘তুমি কী খাইসো? তোমার হাতে পুটলিতে কী আছে?’

‘তুমি এত শুকাইয়া গেলা কেন?’

‘আহারে বেচারা না খাইয়া পেটে পিঠে এক হইয়া গ্যাছে।’

কেউ কেউ এসে একটা কলা কিংবা ডাব এগিয়ে ধরছে। হারু মাঝি কিছুই মুখে দিচ্ছে না। সে কারো দিকে সরাসরি তাকাচ্ছেও না। তার দৃষ্টি দূর আকাশে। সেখানে কিছু খুঁজছে না। কেমন যেন আলাভোলা দৃষ্টি। উত্তর না মিললেও প্রশ্ন থামছে না। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটা কেউ করছে না। হারু মাঝির নৌকা যদি ডুবেই গিয়ে থাকে তবে সে ঘাটে ফিরলো কী করে? মাছ ধরতে তো গিয়েছিল দক্ষিণ পাড়ে, উত্তর দিক থেকে ফিরে আসলো কী করে? সাগরে এতটা পথ সাঁতরে আসা সম্ভব নয়।

যে লোকটাকে ঘিরে গ্রামবাসী এখনও গোল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সে লোকটা আচমকা আকাশ থেকে চোখ সরিয়ে সবাইকে ঘাড় ঘুরিয়ে এক পলক দেখে নিল। তারপর আবার আকাশের দিকে তাকিয়ে ভারিক্কি গলায় বলল, ‘আমি হারু মাঝি না। আপনারা ভুল করতাসেন। আমার নাম পরাণ। আমি মাধবপুর থেকে পলাইয়া আসছি। যে নৌকায় চইড়া এই গেরামে আসছি সেইটা ঐ যে দূরে সাগরের মাথা দেখতাসেন, ওইখানে। ডুইবা গেছে। তিন মাইল সাঁতার কাইটা আসছি। আপনেরা আমারে মাছের তরকারি দিয়া চাইরটা ভাত দেন। খিদা লাগছে।’

 

 

ধ্রুব নীলের সায়েন্স ফিকশন উপন্যাস : মায়াদ্বীপ ২৩৯০

পর্ব-২

‘রতন শুনেছিস? হারু মাঝি এখনও জানে না যে সে হারু মাঝি। গলার স্বর হুবহু এক, দেখতে এক, শুধু চুল দাড়ি বড়, কিন্তু তারপরও বলে সে হারু মাঝি না। নিজের বাড়িতে গিয়াও বলে এইটা নাকি তার বাড়িই না!’

রতনও দুদিন ধরে এটা ভাবছিল। কী হয়েছে হারু মাঝির? কোথায় ছিল এতদিন? জমির আল ধরে স্কুলে যাওয়ার পথে হারু মাঝি বা পরাণ নামের লোকটাকে নিয়ে ভীষণ চিন্তায় পড়ে যায় রতন ও ফটিক নামের দুই কিশোর। এর মধ্যে রতন চুপচাপ গোছের। একটু ভাবুক প্রকৃতির। বয়স চৌদ্দ পনের। পরনে হাফ হাতার শার্ট আর ফুল প্যান্ট। কদিন আগেই ভাল ফল করায় পোশাকগুলো উপহার দিয়েছে কোম্পানি। মাথাভর্তি কোঁকড়া চুল। ছুটি পেলে বনে জঙ্গলে আর সৈকতে ঘুরে বেড়ায়। মায়াদ্বীপ গ্রামে যে দশ পনেরটা পাড়া আছে এর সবই তার চেনা। বন্ধু বলতে একমাত্র ফটিক।

জমি পেরোনোর পর উঁচু রাস্তায় উঠতে হয়। তারপর জঙ্গলের মাঝে মেঠো পথ। খানিক গেলেই একটা জলার মতো জায়গা। সেখানে টুনু পাগলাকে দেখা যাবেই। দিনভর পাখি মারার ফাঁদ নিয়ে বসে থাকে। নিজেই বানিয়েছে ফাঁদটা। পাখি এসে একটা কাঠির ওপর বসলেই খপ করে লেগে যায় খাঁচা। জলার শেষে একটা বড় পুকুর। পুকুরে তেলাপিয়া মাছ ঝাঁক বেঁধে ঘুরে বেড়ায়। রতন মাঝে মাঝে বড়শি দিয়ে ধরে। তবে কোম্পানির গার্ডরা দেখলে মাছ নিয়ে যায় উত্তরের গোডাউনে। কোম্পানির লোকজন কারো সঙ্গে মেশে না। তাদের জামাকাপড়ও আলাদা। গ্রামের সবাইকে খাবার থেকে শুরু করে সব কিছু কোম্পানির গুদাম থেকেই নিয়ে আসতে হয়। রতন এখনও খ কার্ড পায়নি। মানে গুদাম থেকে খাবার নিতে পারবে না। কলেজ পাশ করলে কোম্পানিতে চাকরি হবে। চাকরি হলে সেও একটা খ কার্ড পাবে। এই কার্ড দেখালে পরিবারের সবার জন্য খাবার দিয়ে দেবে কোম্পানি। যখন যা দরকার হবে তা-ই পাবে। এরপরও রতনের কোম্পানিতে কাজ করার ইচ্ছে নেই।

‘আচ্ছা ফটিক ধর আমি পাশ করে যদি কোম্পানিতে কাজ না করি?’

‘মাথা খারাপ! খাবার দেবে কে শুনি? কলেজ পাশ করে কাজ না করলে খাবার তো বন্ধ। আমি বাপু না খেয়ে থাকতে পারবো না।’

‘আমি অন্যকিছু করতে চাই।’

‘পারলে কথাটা কোম্পানিকে গিয়ে বল। কাজে ফাঁকি দিয়েছিল বলে নিতুনদাকে বিনা চিকিৎসায় মরতে হয়েছিল মনে নেই! চ কার্ড নেই তো চিকিৎসাও নেই। বাজে কথা রেখে চল অপুদের বাড়ির পাশে গাব গাছে উঠি।’

‘গার্ড দেখলে খবর আছে। পঞ্চাশ বার কান ধরে..।’

‘আরে ধুর। গার্ডরা এখন ঘুমুচ্ছে। আর এদিকে আমার রকি কাকুর ডিউটি আছে। উনি থাকলে কিছু বলবে না।’

‘ঠিকাছে তুই যা, আমি বরং স্কুলে যাই। দেখি হারু মাঝির আর কোনো খবর পাওয়া যায় নাকি। শুনলাম তার কথা নাকি কোম্পানি পর্যন্ত চলে গেছে। হারু বেচারাকে না আবার ধরে নিয়ে যায়।’

এইসব বলতে বলতে যে যার পথে এগিয়ে গেল দুই কিশোর।

রতনদের স্কুল পশ্চিম পাড়ায়। সৈকত ঘেঁষে। মেঠো পথের শেষে ঘন জঙ্গল। জঙ্গলের মাঝে মাঝে ফালি ফালি করে বানানো রাস্তা। চৌরাস্তার মোড় এলে সোজা যেতে হয়। বামে উত্তর পাড়ায় আছে কোম্পানির অফিস। ডানে দক্ষিণপাড়ার সৈকত। ঠিক মোড়ে আছে একটা কালো মঠ। কেউ বলে অনেক আগে এক দ্বীপে কোম্পানির সঙ্গে এক বৌদ্ধ এসে এটা তৈরি করে যায়। অবশ্য এখন ওই ধর্মের কেউ আর এই দ্বীপে নেই। মঠটার মাথার ওপর রান্নার হাঁড়ির ঢাকনার মতো একটা চাকতি। ওটার কাজ কী কেউ জানে না।

রতন স্কুলে গিয়ে দেখলো কেউ নতুন কিছু জানে না। শুধু এটুকু শুনেছে হারু মাঝি নাকি পালিয়ে বেড়াচ্ছে। কোম্পানির লোকজন তাকে খুঁজছে। নিশ্চয়ই মাছ ধরে খেয়ে ফেলেছে ব্যাটা। গোডাউনে কিছু জমা না দিলে তো গ্রেফতার হবেই। মায়াদ্বীপ গ্রামে সবাই খুব শান্তিতে আছে। কৃষকরা ফসল ঝাড়াই মাড়াই করে সব গোডাউনে দিয়ে আসে। তাঁতীরা তাদের কাপড় রেখে আসে। মাঝে মাঝে বাইরে থেকেও কাপড় আসে। জেলেরা মাছ ধরে সব দিয়ে আসে। কাজের বিনিময়ে আবার সেই খাবার ও কাপড় পায় সবাই। কেউ অসুস্থতার কারণে কোনো দিন কাজ না করতে পারলে সমস্যা নেই। তার চিকিৎসা কোম্পানিই করে দেয়। মাঝে মাঝে সবাইকে ভাল ভাল খাবারও খেতে দেয়। বছরে এক মাসের ছুটিও আছে। সারাদিন কাজ নেই শুধু খাও দাও। এতকিছুর পরও রতনের মাঝে মাঝে মনে হয় কোম্পানিতে কাজ করবে না। নিজের মতো করে যা করার করবে। এমনটা মনে হওয়া যে মায়াদ্বীপের কোম্পানি আইনে গুরুতর অপরাধ তা সে ভাল করেই জানে। তবু ভাবনাগুলো একেবারেই নাছোড়বান্দা।

 

 

ধ্রুব নীলের সায়েন্স ফিকশন উপন্যাস : মায়াদ্বীপ ২৩৯০

পর্ব-৩

রাত আটটা বাজতেই মায়াদ্বীপ ঘুমিয়ে পড়ে। শেয়ালের ডাক শুনে ভয় পেয়ে ঝিঁ ঝিঁ পোকারাও চুপ হয়ে যায়। ডোবা থেকে ব্যাঙগুলো কোরাস ধরে। একটু পর ধুপ ধাপ করে দৌড়ে যাওয়ার শব্দ। বনবেড়াল আর অনেক কাঠবিড়ালি আছে সমুদ্রঘেরা মায়াদ্বীপে। রতনের পড়ায় মন বসে না। মা ঘুমিয়ে পড়েছে। বাবা কোম্পানিতে ওভারটাইম করতে ব্যস্ত। বাবার কথা মনে হতেই রতনের কল্পনার চোখে কোম্পানির বিশাল ফ্যাক্টরির ছবি ভেসে ওঠে। ফ্যাক্টরির পাশে কোম্পানির বড় অফিস। সেখানে কোম্পানির একেবারে নিজেদের লোক ছাড়া আর কেউ ঢুকতে পারে না। বাবার কাজ হলো একটা ধাতব পাতকে গোলাকার বাক্সের মতো বানানো। বেশিরভাগ কাজ যন্ত্রেই হয়। তবে তদারকি করতে হয় মানুষকে। একেবারে শেষ ধাপে তৈরি হয় জাহাজের মতো দেখতে একটা বিচিত্র যান। মায়াদ্বীপ গ্রামের কেউ কোনদিন সেই জাহাজে চড়েনি। কোম্পানির বড় পদে থাকা লোকগুলো রাতের আঁধারে সেই যানগুলো নিয়ে অন্য কোথাও চলে যায়। বাবা শুধু একবার ভেতরটা দেখার সুযোগ পেয়েছিল। তবে এসবের কিছুই দেখেনি রতন। যারা ফ্যাক্টরিতে কাজ করে না তাদের অফিসের আশেপাশে যাওয়ার অনুমতি নেই। কাছে গেলেই মানুষের মতো দেখতে যন্ত্র নাকি ধরে ফেলে। মানুষের মতো যন্ত্র জিনিসটা কেমন অনেক ভেবেও কল্পনা করতে পারেনি রতন।

কোম্পানির অফিসে মায়াদ্বীপ গ্রামের সকল পরিবারের কেউ না কেউ কাজ করে। ফটিকের বাবা নেই, তার মা আর বড় বোনকে কাজ করতে হয় ওই কারখানায়। তাদের কাজ নাকি সারাদিন একগাদা ছোট ছোট লোহার বলকে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় নিয়ে যাওয়া। এরকম একটা একঘেয়ে কাজ দিনের পর দিন সবাই কীভাবে করে ভেবে পায় না রতন। তবে যারা কাজ করতে যায় তাদের প্রত্যেকের এক কথা, কোম্পানিতে কাজ করতে নাকি তাদের খুব মজা লাগে। এটা আরও ভাবায় রতনকে। এসব কাজে মজা পাওয়ার প্রশ্নই আসে না। নিশ্চয়ই কোনো গ-গোল আছে। রাতে পড়ার সময় তার আবারো মনে হয়, বড় হয়ে সে কিছুতেই কোম্পানিতে কাজ করবে না। অন্য কোনো উপায় বের করতেই হবে।

একটা চিন্তা মাথায় আসতেই উত্তেজনায় শিহরণ বয়ে গেল রতনের শরীরে। গ্রামের কেউ কোনোদিন কাজটা করেনি। করবে কি! করার কথা কারোর মাথাতেই আসেনি। রতন যদি করে দেখাতে পারে তবে সে-ই হবে প্রথম। মায়াদ্বীপ ছেড়ে বাইরে গেলে কেমন হয়!

 

 

 

ধ্রুব নীলের সায়েন্স ফিকশন উপন্যাস : মায়াদ্বীপ ২৩৯০

পরদিন সকাল। স্কুলে একটু আগেই এসেছে রতন। ফটিক এখনও আসেনি। প্রথম ক্লাস নেবেন রমাকান্ত স্যার। নিজেকে পরিচয় দেন শ্রী সঞ্জয় চক্রবর্তীর ষষ্ট প্রজন্ম হিসেবে। মায়াদ্বীপের আগেকার লোকগুলোর সব তথ্য আছে স্কুলের লাইব্রেরিতে। সেখানে কিছু বই আছে। বেশিরভাগই গল্পের বই। সবই মায়াদ্বীপ গ্রামের শিকার কাহিনী। দুয়েকটা ভূতের বইও আছে। কিন্তু রতনের ওসব হাস্যকর গল্প মনে হয়। এ পর্যন্ত কোথাও একটা ভূতও দেখেনি সে। মাঝে মাঝে মনে হয় কোম্পানির লোকগুলোই বুঝি ভূত সেজে গ্রামে বসে আছে।

‘আজ তোদের কোম্পানি আইন পড়াবো।’

উফফ বিচ্ছিরি! মনে মনে ভাবলো রতন। কোম্পানির কোন নিয়ম ভাঙলে কী শাস্তি এসব তার সহ্য হয় না। কোম্পানির কোনো নিয়মই তার মানতে ইচ্ছে করে না। তারচেয়ে অপুর সঙ্গে কাটাকুটি খেলা যায়।

‘অ্যাই অপু! হারু মাঝির সন্ধান পাওয়া গেল?’

‘নারে। হারু মাঝিরে ভূতে ধরসে। কথা বলিস না। কোম্পানি আইনের পরীক্ষায় পাশ না করলে কোম্পানি জীবনেও চাকরি দেবে না।’

‘আমার দরকার নেই চাকরির।’

‘তাহলে তো না খেয়ে মরবি।’

‘আমি এখানে থাকবো না। পালাবো।’

‘সাবধান! এসব কথা বলিস না। কোম্পানির লোক কী করে যেন সব শুনে ফেলে। গতবছর রাজুর কথা মনে নেই! পিটির সময় চিৎকার করে বলেছিল সে নাকি কোম্পানিকে দেখে নেবে। পর দিন থেকে তাকে আর কেউ খুঁজে পায়নি।’

‘হুম, তারপরও। আমি ভয় পাই না।’

ক্লাস শেষে সবাই যার যার বাড়ি ফিরে যায়। দুয়েকজন জড়ো হয়ে খানিকক্ষণ খেলে। কিন্তু কয়েক মাস হলো কোম্পানি কোনো খেলার বলও দিচ্ছে না। পুরনো ছেঁড়া বল দিয়ে কেউ আর খেলতে চায় না। রতন এটা ওটা ভাবতে ভাবতে এগিয়ে চলল। কোম্পানির আইনের চেয়ে তার ইতিহাসের দিকে ঝোঁক বেশি। লাইব্রেরিতে যে কয়টা ইতিহাসের বই আছে তাতে সবই মায়াদ্বীপের কাহিনী। মায়াদ্বীপের আগে মানুষ কোথায় ছিল, সমুদ্রটা কত বড় এসবের কিছুই লেখা নেই কোথাও। ইতিহাসের কথা মনে হওয়াতেই অবচেতন মনে অপুর সঙ্গে তাদের বাড়ির দিকে হাঁটতে শুরু করে দিল। অপুর দাদার কাছ থেকে গল্প শুনবে বলে।

মায়াদ্বীপের সবচেয়ে বুড়ো লোকটা অপুর দাদা রাসেল খন্দোকার। বয়স আশির মতো। মায়াদ্বীপের বাইরে বের হওয়ার রাস্তা উনি ছাড়া আর কারোর জানার কথা নয়। কোম্পানির শুরু থেকেই কাজ করছেন তিনি। এখন বৃদ্ধ ভাতা পান। রতন গেছে তার সঙ্গে দেখা করতে। বৃদ্ধের কথা কিছুটা জড়িয়ে গেলেও বোঝা যায়। বয়সের ভারে ঠিকমতো দাঁড়াতে পারেন না। সারাদিন উঠোনে পিঁড়িতে বসে রোদ পোহান।

‘স্লামালিকুম দাদা। কেমন আছেন?’

‘কিডা? ও মতিনের পোলা? আসো আসো। পড়াশোনা কেমুন চলতাসে? কোম্পানিতে কবে ঢুকবা?’

‘দাদা, কোম্পানির ইতিহাস জানতে এসেছি। আপনি যখন প্রথম আসেন..।’

পুরনো দিনের কথা বলার সুযোগ পেলে খুশি হন দাদা। রতনকে থামিয়ে দিয়েই বলতে শুরু করলেন।

‘তখন সম্ভবত ২২৫০ সন। মানে আইজ থেইকা গুইনা গুইনা ১৪০ বৎসর আগের কথা। আমার দাদার বাবা জনাব আলাউদ্দিন খন্দোকার তখন তাগড়া যুবক। তিনি তার পরিবার ও দলবল লইয়া হাজির হয় মায়াদ্বীপে। তারা পত্তন করলেন ধরো গিয়া  দক্ষিণ পাড়ে। সমুদ্রের তর্জনগর্জন ওই দিকটায় একটু কম। তার উপর বাসাবাড়ি বানানের লাইগা গাছগাছালি আর নারকোল গাছ ছিল অনেক। মায়াদ্বীপ তখন পুরাটাই জঙ্গল। চারদিকে শিয়াল আর বন্য গরু। এক বৎসরের মাথায় দাদা হইল। আস্তে আস্তে বাড়তে থাকলো গেরামের লোক। জেলে পাড়া তাঁতী পাড়া হইল। মসজিদ হইল মন্দির হইল। দাদায় পাকা শিকারি ছিল। তারপর ত্রিশ বছর পর আমার বাপের জন্ম। তখন গেরামে কিছুই ছিল না। পরে যখন কিছু বসতবাড়ি হইল তখন ধরো গিয়া আরো কয়েক নৌকা মানুষ আইলো। হেরা কইথেইকা আইলো কেউ কইতে পারে না। কেউ কিছু লেইখাও গেল না। আমার দাদা ছিল বিদ্বান মানুষ। তার মতো আরো কয়েকজন পড়াশোনা জানতো। জ্ঞানবিজ্ঞানের কথা জানতো টুকটাক। এরপর ধরো গিয়া কোম্পানি আইসা পড়লো। কোম্পানি আসার পর থেইকা সব বদলাইয়া গেল। সবার হাতে হাতে ঘড়ি। চাকরি দিল। বাপে বড় হইলো। বিয়া করলো। এরপর আমরা যখন ছোট ছিলাম তখন দেখলাম মক্তব হইলো, স্কুল হইলো। গেরামে মানুষ তখন দুই তিন হাজার। সব্বাই গরু পালতো, ছাগল পালতো। এরপর জমিজমা বাড়লো। সাগরে নতুন চর গজাইলো। কোম্পানি আইসা নিয়ম কইরা দিল কেউ কোনো ফসল ঘরে জমা করবার পারবো না। সবাই নতুন সিস্টেম মাইনা নিল।’

‘কেন মেনে নিল কেন?’

‘না মাইনা উপায় আছে? কোম্পানির লোকজনের ক্ষমতা অনেক। অস্ত্রশস্ত্র ছিল। আচানক সব যন্ত্র। এক টিপে মানুষ গায়েব। তারউপর হের আবার ওষুদ পথ্য দেয়। না মানলে তো আর কেউ ওষুদ পাইতো না। যন্ত্রপাতি পাইত না। বাত্তি পাইত না।’

‘তারা কোত্থেকে এসেছে?’

‘তা তো জানি না নাতি। তয় মানুষ তারা সুবিধার না। আমরা কাজ করছি পেটের ক্ষুধায়।’

‘তারা তো কত কিছু দেয়। গল্পের বই, গানের যন্ত্র।’

‘সব তো তাগো সুবিধার লাইগা। আমরা যদি বাঁইচা না থাকি, সুস্থ না থাকি, তাইলে কাম করবে কারা। জাহাজ বানাইবো কারা!’

‘জাহাজগুলা কই যায়? মায়াদ্বীপের বাইরে? সেখানে কী আছে?’

‘আমার বাপে একবার জানবার চাইছিল। চুরি কইরা উঠছিল জাহাজ নৌকায়। কিন্তুক ধরা পইড়া যায়। দুই বছর জেল খাটছে। চেহারাও দেখি নাই। জেল থেকে ছাড়া পাইয়া বাপ পুরা চুপ মাইরা গেল। দুই বছর কারোর দেখা সাক্ষাৎ পায় নাই। মাথা আউলাইয়া গেল পুরাই। খালি কয়, হেইপারে তারে কেউ চিনে না। বার বার কইতো হেইপারে জাদু আছে। মানুষ উইড়া বেড়ায়। জেলখানায় থাকতে কিসু না কিসু হইসে। খালি কয়, ওরে ধলা আমরা গেরামে আছি এটাই বালা। হেইপারে যাওনের দরকার নাই। মানুষ আর মানুষ নাই।’

‘তার মানে ওই পারে মানুষ আছে! তারা কোন গ্রামের? তাদের গ্রামের নাম কী? এখান থেকে কতদূর?’

‘তাগো কোনো গেরাম নাইরে, কোনো গেরাম নাই। জাহাজে তিন দিনের পথ। এখন তুমি যাও। আমি ভিতরে যাই। বহু রোদ পোহানি অইসে। আর একটা কথা বলি, বাপে আমারে আজীবন কইসে মায়াদ্বীপের বাইরে কী আছে সেইটা নিয়া যাতে কিছু না জিজ্ঞেস করি। কোনোদিন না যাই। আমারও ইচ্ছা আছিল চুরি কইরা একবার জাহাজে উইঠা পড়ি। কিন্তু বাপ মরা নাতিটার দিকে তাকাইয়া আর সাহস অইল না। তুমিও বাপু এইডা নিয়া বেশি প্রশ্ন কইরো না। আর প্রশ্ন কইরো না।’

রতন মনে মনে ঠিক করে ফেলেছে প্রশ্ন করা যাক আর না যাক, উত্তর জানা চাই। আর এখন উত্তর পাওয়ার একটাই উপায় আছে। যেতে হবে হারু মাঝির কাছে।

 

 

সায়েন্স ফিকশন উপন্যাস : মায়াদ্বীপ ২৩৯০

সারাটা বিকাল টই টই করলো দুই বন্ধু। সন্ধ্যায় একটু শীত শীত পড়তেই দুজনে সোজা চলে এসেছে হাজুনি বুড়ির বাড়িতে। পিঠা খাবে। বুড়ি একাই থাকে। কাজ বলতে গ্রামের ছেলেমেয়েদের পিঠা খাওয়ানো আর কাক তাড়ানো। একজন সঙ্গী অবশ্য আছে। তার কাজ হলো উঠোনের বেড়ার ওপর বসে শিকারির মতো তাকিয়ে থাকা। আশপাশে একটা কাকও ঘেঁষতে দেয় না। কেউ উড়ে আসলেই কা কা করে কান ফাটিয়ে দেয়। হাজুনি বুড়ি তার পোষা কাকটার নাম দিয়েছে কেরামত।

চুলায় একটার পর একটা খড়ি দিতে দিতে কোম্পানির মু-ুপাত করে বুড়ি। কোম্পানিকেই পারলে চুলোয় ভরে দেয়। নিয়মকানুনের তোয়াক্কা করে না একটুও। কেউ ভয় দেখালে বলে, ‘ছুডু বেলা থেইকা ওই বজ্জাতগুলারে ডরাইয়া আসতেসি। আর পারুম না বাপু। আমারে ধইরা নিলে নিকগা।’ বুড়ি তার বাগানের সবজিও গোডাউনে জমা দেয় না। ব্যাপারটা অবশ্য কোম্পানি জানে না। জানলে নির্ঘাৎ বুড়ির সমস্ত কিছু কেড়ে নেবে।

‘ও বাপধন, আইজ তো গুড় নাই।’

‘গুড় ছাড়াই খাব। তোমার পিঠা এমনিতেই মজা।’

পিঠা খেতে খেতে ফটিক বলল, ‘সবাইকে মেপে মেপে চাল না দিলে যখন খুশি পিঠা খাওয়া যেত। পিঠা খাওয়ার জন্য বছরের শুরুর দিনের জন্য অপেক্ষা করতে হয়। যত্তসব।’

‘এই জন্যই বললাম, কোম্পানির চাকরি করবো না। কোম্পানি খুব বাড়াবাড়ি করছে।’

‘খুব বালা কইস বাজান। তয় সাবধান। একবার ঢুইকা পড়লে কিন্তুক আর বাইর হইতে পারবা না।’

পিঠাপর্ব শেষ হতেই দুজন রওনা দিল কবরস্থানের পাশে বাঁশঝাড়ের কাছে হারু মাঝির বাড়িতে। লোকমুখে শুনেছে হারু মাঝি নাকি বের হয়ে এসেছে। সারাদিন বাড়িতেই পড়ে থাকে। 

রতন বলল, ‘মাঝি আবার তেড়ে আসবে না তো?’

‘কে জানে আসতেও পারে। তিন মাস সাগরে একা একা পড়েছিল। মাথা ঠিক নাও থাকতে পারে।’

কথা বলতে বলতে বাঁশঝাড়ের সামনের রাস্তায় চলে এসেছে দুজন। আকাশে চাঁদ থাকায় পথ চলতে সমস্যা হচ্ছে না। জঙ্গলের ভেতর বিচিত্র সব পোকামাকড়ের শব্দ। অনেকক্ষণ হলো দুজনের কেউ কোনো কথা বলছে না। ফটিক সম্ভবত ভয় পেয়েছে। হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়লো রতন। অন্যরকম একটা শব্দ শুনতে পেল। পোকা এমন শব্দ করে না। শব্দটা যান্ত্রিক। বিপ বিপ করে ডাকছে একটা প্রাণী। জঙ্গলে ঢুকলেই দেখা যাবে কী সেটা। ফটিক বাধা দিল। সে ঢুকতে রাজি নয়। রতন ইশারায় বুঝিয়ে দিল, যাবে আর আসবে। বাধ্য হয়ে ফটিকও ঢুকে পড়লো। বেশি হাঁটতে হলো না। দুটো ঝোপ পার হতেই নজরে এলো বিচিত্র শব্দের উৎস। পোকামাকড় নয়। গোল চাকতির মতো যন্ত্রটা। ভেতর থেকে চিঁ চিঁ শব্দ আসছে। 

‘আমার মনে হয় সাগর থেকে এসেছে। কী হবে এটা দিয়ে?’ বলল রতন।

জঙ্গলে ঢোকার পর থেকেই ভয়ে ভয়ে আছে ফটিক। যন্ত্র দেখায় মন নেই। বের হতে পারলেই বাঁচে। ‘স্যারকে দেখালে বলতে পারবে। কিন্তু মৎস্যবিজ্ঞানের স্যার কি যন্ত্র নিয়ে বলতে পারবে? যন্ত্রের ক্লাস তো কলেজে না উঠলে পাবো না।’

‘ক্লাসে এটা শেখাবে না। আমি নিশ্চিত। দেখ, পেছনে কোম্পানির চিহ্ন। ইংরেজিতে ছোট করে ‘সি’ লেখা। চারপাশে সাদা বৃত্ত। এখন প্রশ্ন হলো, যন্ত্রটা জঙ্গলে কেন?’

‘তার আগে চল হারু মাঝির বাড়ি যাই।’

‘চল।’

যন্ত্রটা পকেটে নিয়ে হাঁটতে শুরু করলো দুই কিশোর।

হারু মাঝির বাড়ির দরজা খোলা। বেড়ার ফাঁক দিয়ে ভেতরের আলো দেখা যাচ্ছে। দুবার মৃদু কণ্ঠে ‘হারু মাঝি বাড়ি আছো?’ বলল রতন। কেউ সাড়া দিল না। বাধ্য হয়ে ভেতরে ঢুকে পড়লো দুই কিশোর। হারু মাঝিকে দেখে আঁতকে উঠলো। বিছানায় জুবুথুবু হয়ে বসে আছে। মেঝেতে শূন্য হাঁড়িপাতিল। মাঝির খাওয়াও হয়নি। 

‘হারু মাঝি খাওনি?’

হারু মাঝি মুখ তুলে চাইল। খুব দুর্বল দেখাচ্ছে। চোখ দুটো দেবে গেছে। মুখ ভর্তি দাঁড়ি গোঁফ। ঠিক সেদিনের মতোই আবার বলল, ‘আমি হারু মাঝি না। আমার নাম পরাণ। আমি মাধবপুর থেইকা আসছি। আমার কথা কাউরে বইলো না।’ রতন বুদ্ধি করে বলল, ‘আমরা তোমার গ্রামে যাওয়ার জন্যই এসেছি। তুমি আমাদের বল কিভাবে যেতে হবে।’ ফটিক রতনকে কনুই দিয়ে গুতো দিয়ে বলল, ‘আমি কিন্তু কোথাও যেতে আসিনি! গেলে তুই একাই যাবি!’

হারু মাঝি ওরফে পরাণ আবার অন্যমনষ্ক হয়ে গেল। এক চিলতে হেসেও উঠলো। আবার চুপ। রতন পকেট থেকে যন্ত্রটা বের করতেই ঝট করে চোখ ফেরাল হারু মাঝি ওরফে পরাণ। ধমক দিয়ে বলল, ‘এইটা কোথায় পাইসো! এইটা ফালাইয়া দাও! খবরদার হাতে নিবা না। এইটা অপয়া। সব কয়া দিবো!’

‘তুমি জানো এটা কী?’ রতনকে দেখে মনে হচ্ছে না সে হারু মাঝির কথা শুনে যন্ত্রটা ফেলে দেবে।

‘খবরদার! ওরা খবর পাইয়া যাইবো। আস্তে কথা বল! ওরা সব শুইনা ফালায়। গত দুই দিন যাবৎ লুকাইয়া ছিলাম। আর ভালা লাগে না, তাই চইলা আসছি। তোমরা যাও! তোমরা যাও!’

হারু মাঝির কথা শেষ হবার আগেই বাইরে প্রথমে শোঁ শোঁ পরে ধুপধাপ শব্দ হলো। রতন ঝট করে যন্ত্রটা পকেটে ঢুকিয়ে ফেলল। বিপ বিপ করেই যাচ্ছে উদ্ভট পোকার মতো। ধড়াম করে খুলে গেল হারু মাঝির ঘরের দরজা। দুটো লোক। পরনে অন্যরকম পোশাক। এমন পোশাক কেবল কোম্পানির বড় কর্তাদের গায়েই দেখে আসছে রতন। কর্তারা যখন স্কুল পরিদর্শনে আসতেন তখনই এই বিচিত্র পোশাক পরে আসতেন। ভয় পেয়ে চোখ উল্টে অজ্ঞান হবার দশা ফটিকের। দুহাত পেছাতে গিয়ে দুটো পাতিল উল্টে ফেলেছে। ঠন ঠন শব্দে কেঁপে উঠলো শন বাঁধানো ঘরটা। লোকদুটোর হাতে অদ্ভুত এক যন্ত্র। কেমন যেন শীতল আর ঠা-া চোখের মতো একটা নল আছে যন্ত্রটায়। নলটা হারু মাঝির দিকে বাড়িয়ে রেখেছে তারা। আরেকজনের হাতে একটা বাক্স। সেই বাক্স থেকেও যন্ত্রের মতোই চিঁ চিঁ শব্দ আসছে। রতন কিছু বুঝে ওঠার আগেই বাক্স হাতে থাকা লোকটা তার প্যান্টের পকেটে হাত ঢুকিয়ে দিল। তারপর পাশের জনকে বলল, ‘নিরো, জিপিএসটা এই বাচ্চাটার পকেটে এলো কী করে! এটা তো সাব-জিরোটুতে থাকার কথা। অবশ্য শয়তানটাকে পেয়ে ভালই হলো।’

‘হা হা হা।’ লোকটার কথা শুনে অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো হারু মাঝি ওরফে পরাণ। তারপর প্রথম লোকটার দিকে তাকিয়ে মুখ নাচিয়ে বলল, ‘তোমাদের নৌকা আমি ডুবাইয়া ফেলাইছি! হা হা হা। দুইটা যন্ত্রপক্ষীও খতম।’

‘সব নষ্ট করতে পারোনি পরাণ। এবার আর রক্ষা নাই।’ এই বলেই প্রথম লোকটা তার হাতের যন্ত্রটা হারু মাঝির বুক বরাবর নিয়ে কিসের মধ্যে যেন একটা চাপ দিল। একটা আলোর ঝলক। হারু মাঝিকে চোখের সামনে কাটা কলাগাছের মতো ধুপ করে বিছানায় পড়ে যেতে দেখলো রতন আর ফটিক। তাদেরকে যেন দেখতেই পায়নি, এমন ভাব করে লোকদুটো হারু মাঝিকে বাইরে নিয়ে গেল। বাইরে বের হওয়ার সাহস হলো না দুই কিশোরের। ফটিক মাটির মেঝেতে বসে থাকলেও রতন উঁকি দিল বেড়ার ফাঁক দিয়ে। একটা দানব যন্ত্রের মধ্যে ওরা হারু মাঝিকে বসালো। এরপর যন্ত্রটার সামনে গিয়ে বসলো আরেকজন। একটা সুইচ চাপ দিতেই ঘড় ঘড় শব্দ করে উঠলো যন্ত্রটা। খানিকপর শূন্যে উঠে গেল। নিচে প্রচ- বাতাস ছাড়ছে যন্ত্রটা। যেন সব উড়িয়ে নিয়ে যাবে। এরপর শোঁ করে হাওয়া! রতনের চোখ বড় বড় হয়ে গেল। এতদিন বাবার কাছে এই যন্ত্রের গল্পই শুনে এসেছে। এবার চোখের সামনেই দেখলো আস্ত একটা গাড়ি! তারচেয়েও বড় কথা হলো, লোকগুলো হারু মাঝিকে পরাণ বলেই ডেকেছে। তার মানে এ নিশ্চয়ই হারু মাঝি নয়! হারু মাঝির মতো দেখতে অন্য কেউ! মাধবপুর নামেও নিশ্চয়ই আরো একটা গ্রাম আছে, ঠিক মায়াদ্বীপের মতোই। রতনের চোখজোড়া ধীরে ধীরে সরু হয়ে গেল। ফটিকের দিকে না তাকিয়েই বলল, ‘আমরা মাধবপুর যাবো। তবে কোম্পানির জাহাজে নয়। তোর চাচাতো ভাই তো মাছ ধরে? তাকে বল দুদিনের জন্য অসুস্থ হয়ে যেতে। তার বদলে আমরা ডিউটি দেব।’

 

 

ধ্রুব নীলের সায়েন্স ফিকশন উপন্যাস : মায়াদ্বীপ ২৩৯০

স্কুলের সময় হয়ে গেলেও আজ ক্লাসে যেতে ইচ্ছে করছে না। তার ধারণা ক্লাসে ঠিকমতো সব শেখাচ্ছে না। তা না হলে সে জানতো জিপিএস মানে কী, উড়ন্ত গাড়িই বা বানায় কী করে। তারচেয়েও বড় কথা যন্ত্রপক্ষী জিনিসটা কী? পাখির মতো দেখতে যন্ত্র? কোম্পানির লোকজন চায় না ওরা এসব শিখুক।

এক ছুটে অপুদের বাড়িতে গেল রতন। ফটিক গেছে তার চাচাতো ভাইয়ের বাসায়। নৌকার ব্যবস্থা করতে হবে।

 ‘দাদা, জিপিএস কী?’

‘কোম্পানির যন্ত্র। এইটা দিয়া ওরা কেমনে জানি সব টের পাইয়া যায়। এইটা হইল ধর গিয়া টের পাওনের যন্ত্র। আমি বহু আগে একবার সাগরের কূলে পাইছিলাম।’

‘হারু মাঝিকে ওরা ধরে নিয়ে গেছে কেন? তাছাড়া আমার তো মনে হয়..।’

‘তা তো ধরবই। পলাইতে চাইলে কি পলানো যায়? নিয়ম কানুন আছে না?’

‘অবশ্য ওরা পরাণ বলে ডেকেছে, তার মানে এ হারু মাঝি নয়।’

‘কইতে পারি না বাবা।’

‘মাধবপুরের নাম শুনেছেন?’

‘হুমম..।’

দাদা হুট করে চুপ হয়ে গেলেন। তারপর রতনের দিকে ঠায় তাকিয়ে রইলেন। কিছু বলবেন বলে মনে হলো না। তার মানে তিনি নিশ্চয়ই মাধবপুরের নাম শুনেছেন। হঠাৎ নিরবতা ভেঙে বললেন, ‘অপুর বাপেরও এই মাধবপুর ব্যারাম হইছিল। বছর দুয়েক আগের কথা। আমরা গেছিলাম মাছ ধরতে। ঝড়ে নৌকা গেল উলটাইয়া। পুলায় গেল পইড়া। বাঁচনের কতা না। আমি আশা ছাইড়া দিলাম। পরে নৌকাডা খুঁইজা পাই। আমি বাঁইচা যাই। পুলার তো বাঁচনের কতা না। এক মাস পর কই থেইকা আরেকটা নৌকায় সে হাজির হইলো মায়াদ্বীপে। আমারে চিনলো না। নিজের পুলারেও চিনলো না। অপুর মা কত কানলো! অপু কত বাপ বাপ কইরা গলা ফাটাইলো। কারো লগে কতাই কইলো না। পুলায় আমার খালি কয়, হে নাকি মাধবপুর গেরাম থেইকা আসছে। হে নাকি অপুর বাপ না। শ্যাষে পাগল পুলায় আমার গলায় দড়ি দিল। সবাই মনে করলো অপুর বাপে পাগল হইয়া মইরা গেছে।’

অপুর দাদা চোখ মুছলেন। রতন হা করে তাকিয়ে এতক্ষণ কথাগুলো শুনলো। আগে করলেও এখন আর সে কিছুতেই বিশ্বাস করছে না অপুর বাবা পাগল হয়ে গিয়েছিলেন। তিনি হয়তো অপুর বাবাই ছিলেন না। তাই যদি হয়, তবে প্রশ্ন থেকে যায় তিনি মাধবপুর ছেড়ে মায়াদ্বীপে এলেন কেন?

‘চাচা কোন দিক থেকে এসেছিলেন? যেদিক দিয়ে হারু মাঝি এসেছিল?’

‘হ, উত্তর-পূব দিক থেইকা আসছে। আইসাই পাগলের মতো বক বক শুরু করছিল।’

রতনের ভ্রƒ কুঁচকে গেল। দুয়ে দুয়ে চার হচ্ছে। মাধবপুর বলে নিশ্চয়ই কোনো জায়গা আছে। কেউ কেউ পালিয়েছে সেখান থেকে। তারপরও একটা বড় কিন্তু রয়ে গেছে। হারু মাঝির মতো হুবহু অপুর বাবার মতো দেখতে একজন জুটে গেল কী করে?

রতনের প্ল্যান আপাতত একটাই। বাবা যখন ভোরে কারখানায় যাবে তখনই বের হবে। ফটিক যেতে রাজী না হলে একাই যাবে। বেলা থাকতে ফিরেও আসবে। তবে দিনে দিনে ফিরে আসার ব্যাপারটায় তার খানিকটা সন্দেহ আছে।

রাত হয়ে গেছে। বাবার ফেরার সময় হয়ে গেছে। গ্রামের ভেতর হাঁটছে আর ভাবছে রতন। কোম্পানির কাজকর্ম যুগের পর যুগ ধরে রহস্যই হয়ে আছে। কেউ কোনোদিন বুঝতে পারেনি। রতন জানে গ্রামের লোকজনকে দিয়ে ওরা আসলে কাজ করিয়ে নিচ্ছে। ওরা নিশ্চয়ই সংখ্যায় কম। কিন্তু ওদের কাছে যন্ত্র বেশি। বিশেষ করে ওই নলের মতো দেখতে যন্ত্রটা নিশ্চয়ই বড় ধরনের অস্ত্র। এক আলোর একটা ঝলকেই মানুষ অজ্ঞান। আচ্ছা, হারু মাঝি ওরফে পরাণ নামের লোকটা বেঁচে আছে তো? তারচেয়েও বড় প্রশ্ন হলো কী আছে মাধবপুর গ্রামে? উত্তর পেতে কাল ভোরেই রওনা দেবে।

 

 

ধ্রুব নীলের সায়েন্স ফিকশন উপন্যাস : মায়াদ্বীপ ২৩৯০

এত ভোরে আগে কোনোদিন ওঠেনি রতন। বাবা প্রতিদিনই ওঠে। বাবা কিছু জানতে চাওয়ার আগেই রতন বলল, ‘আজ মৎসবিজ্ঞানের প্র্যাকটিক্যাল আছে বাবা। মনু মাঝি আমাকে নিয়ে যেতে রাজি হয়েছে।’

‘বেলা থাকতে ফিরা আসলেই হইলো। আর মনে কইরা ডুব পোশাক পইরা নিবি। মনুরে কইলেই পরাইয়া দিবো। কুম্পানির লোক যাতে না দেখে। খেয়াল রাখিস।’

‘দেখবে না বাবা। আমি পানির নিচেই থাকবো।’

ডুব পোশাক পরলে জলের নিচেও শ্বাস নেওয়া যায়। কোম্পানির লোকজন জেলেদের সাপ্লাই দিয়েছে এ পোশাক। চাইলে এ পোশাক পরে এক ডুবেই অনেক দূর চলে যাওয়া যায়। এই পোশাক আবার জেলে ছাড়া আর কারো পরার নিয়ম নেই।

নৌকার সঙ্গে ফটিকের চাচাতো ভাই কলিমের ডুব পোশাকটাও পাওয়া যাবে নিশ্চয়ই। পোশাক একটা কিন্তু ওরা দুজন। এই সমস্যা নিয়ে আপাতত ভাবছে না রতন। ব্যাগে কিছু শুকনো খাবার আর ফল নিয়েই দিল ছুট।

ঘাটে যাওয়ার আগে পথের পাশে কোম্পানির গুদাম ঘর পড়ে। সাত সকালে সেখানে হাজির কেউ কেউ। এর মধ্যে স্কুলের সহপাঠী নালিনীর বাবাকে দেখলো গুদামের লাইনে দাঁড়িয়ে চেঁচামেচি করছে। তার কথাবার্তা শুনে যা বুঝলো, তা হলো কোম্পানি এবারও তার জন্য নতুন পোশাক আনেনি। ‘আমি কি মানুষ না! সারাদিন খাটাখাটনি করি, আমার জামা আসে না কেন! কোম্পানির কাছে জবাব চাই।’ হাঁটতে হাঁটতেই ব্যাপারটা নজরে এলো রতনের। ভেতর থেকে অন্যরকম পোশাক পরা একটা লোক এসে শীতল চোখে তাকাতেই শান্ত হয়ে গেলেন নালিনীর বাবা। একটা কথাও বললেন না। রতনের মাথায় ঢুকলো না ব্যাপারটা। মানুষজন কোম্পানির লোকদের এত ভয় পায় কেন?

ঘাটে পৌঁছেই দেখলো জেলেরা সব ব্যস্ত হয়ে নৌকা ছাড়ছে। ব্লিপ ব্লিপ শব্দ করে একটার পর একটা নৌকা শোঁ শোঁ করে ছুটে চলেছে সাগরের বুক লক্ষ্য করে। গতি কমসে কম একশ মাইল তো হবেই। রতন নৌকাবিজ্ঞানের ক্লাসে যা জেনেছে তা হলো, এসব নৌকা চাইলে এক হাজার মাইল বেগেও ছুটতে পারে। তখন নাকি পানির ওপর দিয়ে উড়ে উড়ে যায়। কিন্তু দেড় হাজার মাইল দূরেই নীল-সুবজ নিয়ন্ত্রণ লাইন। ওটা পার হওয়া যাবে না কিছুতেই। ওটা পার হলেই কোম্পানির লোকজন চলে আসবে। ধরা পড়লেই কঠিন শাস্তি। শাস্তিটা কী তা জানে না রতন। এখন পর্যন্ত কেউ ওই লাইন পার হয়নি। তার আগেই প্রচুর মাছ ধরা পড়ে।

জায়গামতো ফটিক এসে হাজির। তাকে রতনের চেয়েও বেশি উত্তেজিত মনে হচ্ছে। চাচাতো ভাই রাজি করাতে তাকে দুটো বড় মিথ্যে বলতে হয়েছে। প্রথমে সে বলেছে তারা সাগরের বুকে একটা গুপ্তধনের খোঁজ পেয়েছে, বিষয়টা নিশ্চিত হতে যাচ্ছে। আর দ্বিতীয়টা হলো হারু মাঝি ইতিমধ্যেই সেই গুপ্তধনের খোঁজে বের হয়ে গেছে বলে তাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।

পাঁচ নম্বর ঘাটে কলিমের নাম লেখা নৌকাটা খুঁজে পেতে সমস্যা হলো না। সাত সকালে জেলেরা মহা ব্যস্ত। কারো দিকে তাকানোর সময় নেই। রতন আর ফটিককে কলিমের নৌকায় উঠতে দেখে কেউ প্রশ্ন করলো না। জেলেরা এমনিতেই চুপচাপ গোছের। প্রশ্ন করে কম। পাছে আবার বেশি কৌতুহলী হতে গিয়ে কোম্পানির হাতে ধরা না খায়।

‘ফটিক, তোর ব্যাগে সব আছে তো?’

‘হ্যাঁ, পানি বানানোর যন্ত্র, দুই ডজন কলা, পাঁচটা আতাফল, এক প্যাকেট চিড়ে আর একটা গুড়ের চাক।’

‘চলবে। খেতে হবে হিসেব করে।’

‘ওকে।’

কথা বলে আর সময় নষ্ট করলো না। রতন ভাবছে, একশ মাইল বেগে ছুটলে সীমানা পার হতে সময় লাগবে দশ ঘণ্টা। এরপর কোম্পানির লোকজন টের পেলে তাদের ধরতে এলেও সময় লাগবে সাত আট ঘণ্টা। কারণ কোম্পানির নৌকাকে কেউ কখন দেড়শ মাইলের বেশি জোরে ছুটতে দেখেনি। রতনের মন বলছে সীমানা পার হলেই মাধবপুরের দেখা পাবে। হারু মাঝি আর অপুর বাবার মতো দেখতে লোকগুলো বলেছে তাদের নৌকা মায়াদ্বীপের এক মাইল দূরে থাকতে ডুবে গেছে। তার মানে কোম্পানির লোকজন নিশ্চয়ই তাদের নৌকা ডুবিয়ে দিয়েছিল। আচ্ছা..। আরে! হুট করে মাথায় বুদ্ধি খেলে গেল রতনের।

‘ফটিক, নৌকার পাটাতনে গোপন কোনো কুঠুরি আছে কিনা দেখতো। জিপিএস লুকানো থাকতে পারে।’

‘হুমম। ঠিক ধরেছিস। দেখছি দাঁড়া।’

রতনের মনটা ফুরফুরে হয়ে গেল। অপুর দাদার কথা যদি সত্য হয়, তবে ওই জিপিএসটাই যত নষ্টের গোড়া। ওটার কারণেই কোম্পানি সহজে ধরে ফেলতে পারে।’

‘পেয়েছি!’

ফটিক বিজয়ীর মতো করে গোল চাকতিটা উঁচু করে ধরে আছে।

‘গুড! এবার এটাকে জেটির নিচে লুকিয়ে রাখগে। কোম্পানি আমাদের জীবনেও খুঁজে পাবে না।’

সীমানা পার হবার আগ পর্যন্ত নৌকার গতি কম রাখা যায়। তবু তর সইছিল না রতনের। আস্তে আস্তে নৌকার সামনের একটা বোর্ডে লাগানো দ-টা ঠেলে বাড়াতে লাগলো গতি। দুজনেই যার যার আসনে বসে নিজেদের বেল্ট দিয়ে আটকে রেখেছে। গতি বাড়লেও পড়ে যাওয়ার ভয় নেই। তবে ডুব পোশাক একটা হওয়ায় আপাতত দুজনের কেউই সেটা পরছে না।

এক ঘণ্টা কেটে গেছে। মায়াদ্বীপকে দূর থেকে একটা ছোট্ট বলের মতো দেখাচ্ছে। তবে কোম্পানির বড় টাওয়ারটা স্পষ্টই দেখা যাচ্ছে। টাওয়ারের গায়ে ছাতার মতো গোল গোল চাকতিগুলোকে শামুকের খোলের মতো দেখাচ্ছে। ধীরে ধীরে ঘুরছে সেগুলো।

কলা খেতে খেতে কিছু একটা ভাবছে ফটিক। রতনের চোখ সামনের দিকে। কাঁটাওয়ালা যন্ত্রটা বলছে তারা দ্বীপ ছেড়ে একশ মাইল দূরে। মায়াদ্বীপ এখন আর চোখে পড়ছে না। পথ চিনে আবার ফিরতে পারবে কিনা সেটা ভাবছে না রতন। তবে পথ হারালে কোম্পানির লোকজনও তাদের খুঁজে পাবে না, এমনটা ভাবতেই গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠছে।

ফটিক বেল্ট খুলে উঠে দাঁড়ালো। মাথার উপরের কাচের ঢাকনাটা সরিয়ে দিল। প্রচ- বাতাসে উড়িয়ে নিয়ে যাওয়ার দশা।

‘কোনো নিশানা দেখতে পাচ্ছিস?’

‘নাহ। মনে হয় কোনো লাইন টাইন নাই।’

‘আমারও তাই মনে হচ্ছে। জেলেদের ভয় দেখানোর জন্যই এসব বানিয়েছে কোম্পানি।’

‘লাইন নেই, তবে একটা নৌকা দেখতে পাচ্ছি। পশ্চিমের দিকে যাচ্ছে। ঢাকনার ওপর বিদঘুটে একটা যন্ত্র বসানো।’

রতন উঠে দাঁড়ালো। নৌকার ড্রয়ার হাতড়ে একটা যন্ত্র বের করে আনলো। জেলেরা এটা দিয়ে দূরের জিনিস দেখে। যন্ত্রে চোখ লাগাতেই পরিষ্কার চিহ্নটা দেখতে পেল।

‘কোম্পানি! ওটা কোম্পানির নৌকা! কিন্তু এই মাঝ সমুদ্রের কী করছে। গতিও কম। দেখ দেখ! নৌকাটা আবার উল্টো দিকে যাচ্ছে। টহল দিচ্ছে না তো! আরে! ফটিক! একটা পিলার দেখা যাচ্ছে। ওটাই সম্ভবত লাইন। পিলারটার ওপর ছাতার মতো দেখতে কী যেন একটা ঘুরছে। দেখতে একেবারে চোখের মতো।’

ফটিক খালি চোখেই দেখতে পাচ্ছে সব। মনে মনে ভীষণ হতাশ দুই কিশোর। রতন চোখ থেকে যন্ত্রটা নামিয়ে ফটিকের দিকে বাড়িয়ে ধরলো। দুজনের কেউ কোনো কথা না বললেও বোঝা যাচ্ছে সামনে সমস্যা এখন দুটো। কোম্পানির টহল নৌকা আর সেই পিলার। টহল নৌকাকে কোনোভাবে ফাঁকি দেওয়া গেলেও পিলারটা কী করে সে সম্পর্কে বিন্দুমাত্র ধারণা নেই তাদের।

 

 

ধ্রুব নীলের সায়েন্স ফিকশন উপন্যাস : মায়াদ্বীপ ২৩৯০

‘বাহ, বড় দুটো টুনা ধরা পড়েছে।’ রতন বলল।

‘ওটা টুনা নয়, বড়চোখা মনে হয়।’ ফটিক মাছ চেনে ভাল। মাছ ডাকার যন্ত্রটা তার হাতেই ধরা। যন্ত্রটায় দুটো বোতাম আছে। একটা চালু করার সুইচ। আরেকটা উপরে নিচে ওঠানো নামানো যায়। যত উপরে ওঠানো হবে তত শক্তিশালী সংকেত বের হবে যন্ত্রটা থেকে। আর ওই সংকেত সমুদ্রের পানিতে প্রবাহিত হয়ে পৌঁছে যাবে মাছের কানে। মাছগুলো মনে করবে সংকেত যেখান থেকে আসছে সেখানে বুঝি অনেক সুস্বাদু খাবার আছে। খাবারের লোভে ছুটে আসবে নানা জাতের মাছ। আর তখুনি ছোট নলের মতো দেখতে জালের সুইচে চাপ দিতে হবে। নল থেকে ছিটকে বের হবে সূক্ষ্ম গোলাকার জাল। এতদিন এসব কেবল মৎবিজ্ঞানের ক্লাসেই পড়ে এসেছিল দুই কিশোর। এখন একেবারে প্র্যাকটিকেল হয়ে যাচ্ছে।

আপাতত ঘণ্টাখানেক মাছ ধরবে ঠিক করেছে দুই কিশোর। কোম্পানির টহল নৌকাটা নিশ্চয়ই এতক্ষণে তাদের দেখে ফেলেছে। মাছ না ধরলে সন্দেহ করে বসবে। কাছে এসে দুয়েকটা প্রশ্ন করলেই পড়বে ধরা।

কোম্পানির টহল নৌকাটা দূরে গিয়ে থেমে আছে। মনে হয় বিরতি নিচ্ছে। রতনদের নৌকাটা লাইনের আরো কাছে এগিয়ে এলো। পিলারগুলোর গায়ে জাল দেখতে পেয়েছে। দূরে দেখার যন্ত্রটা দিয়ে পরিষ্কার দেখা গেছে জালের বুনট।

একে একে দশ পনেরোটা মাছ ধরে ফেললো ফটিক। রতন উবু হয়ে ডুব পোশাক পরছে। একটা পরিকল্পনা এসেছে মাথায়, তবে কাজ করবে কিনা জানে না। মারাত্মক ঝুঁকিও আছে কাজটায়।

‘ফটিক, তুই মাছ ধরা চালিয়ে যা। থামিস না।’

‘কিন্তু কতক্ষণ?’

রতন কিছু বলল না। নৌকার ধাতব পাটাতনের শেষপ্রান্তে থাকা ড্রয়ারের ভেতর আরো তিনটি মাছ ধরার সংকেত যন্ত্র পেয়েছে। সবকটা ডুব পোশাকের পকেটে ভরে নিয়েছে। পিঠের দিকে ভারি দুটো বস্তু। এগুলোর ভারেই তলার দিকে নেমে যেতে পারবে রতন। অনেক আগে একবার ডাইভিং করেছিল। নিয়মকানুন সব মনে আছে ভালো করেই। জেলেদের মুখে শুনেছে সাগরের এদিকটায় হাঙ্গর না থাকলেও তিমিরা দল বেঁধে ঘোরাঘুরি করে। রতনের যে প্ল্যান, তাতে হাঙ্গর তিমি সবই লাগবে।

‘একটা ইল ধরা পড়েছে রে! শক দেবে না তো।’

‘ছেড়ে দে। দিতেও পারে। পরে আবার তোকে বাঁচাতে আমার প্ল্যান করা হবে না।’

প্রস্তুত রতন। পকেটে তিনটা সংকেত যন্ত্র। সাঁতরে লাইন পর্যন্ত যেতে বড়জোর আধ ঘণ্টা। পিঠের ধাতব বস্তুটায় ছোট দুটো পাখা আছে। ওগুলো চালু করে দিলে আরো দ্রুত এগিয়ে যাবে। মাথায় বিশেষ মুখোশটা পরে নিল। শ্বাস নিয়ে দেখলো সব ঠিকঠাক আছে। মুখোশ থেকে মৃদু যান্ত্রিক শব্দ শুনতে পাচ্ছে। পানি থেকে অক্সিজেন বানানোর কাজ করে ওগুলো।

‘আধ ঘণ্টার মধ্যে ফিরে আসবো। আর যদি না আসি, তুই বাড়ি চলে যাস।’

‘আমি তোকে ছাড়া যাচ্ছি না। দরকার হলে সোজা নৌকা নিয়ে হামলা করবো লাইনে।’

‘কোম্পানির নৌকার ওপর ওটা দেখেছিস তো? একদম ভ্যানিশ করে দেবে!’

‘করুক! আমি আছি। শেষ দেখে ছাড়বো।’

টুপ করে সাগরে পড়ে গেল রতন। সামান্য দুলে উঠলো নৌকাটা। পানি বেশ স্বচ্ছ। নিচের অনেকখানি দেখা যাচ্ছে। সাগর এদিকটায় মোটামুটি অগভীর। নৌকার সামনে জুড়ে দেওয়া মিটার বলছে মাটি আছে ঠিক দেড়শ ফুট নিচে।

ডুব দেওয়ার পরপরই রতনের মনে হলো একগাদা অন্ধকার ছেঁকে ধরেছে। একটু পরেই সূর্যের আলোয় সব পরিষ্কার হয়ে উঠলো। মুখোশের ওপরে একটা বাতি আছে। ওটা জ্বলে উঠতেই চকমক করে উঠলো সমুদ্রটা। তলদেশে পৌঁছাতে বেশিক্ষণ লাগলো না। চারপাশে চোখ বুলিয়ে নিল। রঙিন প্রবাল আর ছোট ছোট মাছের সারি। মাছগুলো খুব ভয় পেলেও রতনকে ঘিরে চক্কর খাচ্ছে। এমন সব মাছ দেখছে যেগুলো কোনোদিন বইয়ের পাতায় দেখেনি। এগুলো সম্ভবত গভীরেই থাকে। তাই জেলেদের জালে ধরাও পড়ে না। রতনের পকেট থেকে একটা সংকেত যন্ত্র বের করে আনলো। সুইচ চাপ দিতেই জ্বলে উঠলো লাল আলো। তবে সুইচটাকে একেবারে নিচের দিকেই রাখলো। ছোট ছোট মাছগুলো ছোটাছুটি শুরু করে দিয়েছে। রতনকে ঘিরে চক্কর খাচ্ছে সবাই। দুয়েকটা বড় মাছও ছুটে এলো। ব্যাপারটায় মজা পেলেও নিজের মিশনের কথা ভুলে গেল না রতন। পিঠের পাখাদুটো চালু করে দিতেই ছুটে চলল নিষিদ্ধ লাইন বরাবর। দুটো ভয়ংকর ইল মাছ পাশ কাটিয়ে গেল। ক্লাউন ফিশের ঝাঁকও পিছু নিয়েছে। সংকেত বন্ধ করতেই হট্টগোল লেগে গেল মাছের ঝাঁকে। সবাই এলোমেলো ছুট লাগালো। বড় মাছগুলোও বিভ্রান্ত হয়ে এদিক ওদিক তাকাতে লাগলো। যেন এতক্ষণ খাবারের স্বপ্ন দেখছিল তারা।

‘এক কিলোমিটার দূরে তিমির ঝাঁক। এক কিলোমিটার দূরে তিমির ঝাঁক। দুটো হাঙ্গরও থাকতে পারে।’

ভীষণ চমকে উঠলো রতন। মুখোশটা কথা বলছে! এতক্ষণ যান্ত্রিক শব্দ শুনে আসলেও পরিষ্কার বাংলায় কথাগুলো শুনলো রতন। তবে কণ্ঠটা কেমন যেন যান্ত্রিক। একই কথা বারবার বলে যাচ্ছে। এক কিলোমিটার দূরে তিমির ঝাঁক মানে রতনকে দ্রুত কাজ শেষ করে ফিরতে হবে। তিমিগুলো নিশ্চয়ই এদিকে ছুটে আসছে। বিপদ আঁচ করেও রতন মুখে হাসি ফুটে উঠলো। তার পরিকল্পনা ভালমতোই কাজ করবে তাহলে। লাইন বরাবর ছুটতে লাগলো নতুন উদ্যমে। খানিক পর বদলে গেল মুখোশের কণ্ঠ। ‘দুইশ গজ দূরে নীল-সবুজ নিয়ন্ত্রণ লাইন। আপনি আর এগোতে পারবেন না। আর মাত্র দেড়শ গজ… একশ ত্রিশ গজ… একশ গজ….। নিয়ন্ত্রণ লাইন স্পর্শ করলে শাস্তি পেতে হবে। শাস্তি পেতে হবে। পঞ্চাশ গজ.. চল্লিশ গজ।’ মুখোশের কান বরাবর যান্ত্রিক কণ্ঠটা বলেই যাচ্ছে। না ফেরা পর্যন্ত থামবে না মনে হচ্ছে। রতন চেষ্টা করছে মুখোশের যান্ত্রিক শব্দে মন না দিতে।

দশ গজ বাকি থাকতে থামলো রতন। মুখোশের বাতিতে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে পিলারের তলদেশ। শুধু উপরে নয়, নিচেও জাল লাগানো। কেউ যেন ডুব পোশাক পরে পার হতে না পারে সে জন্য এ ব্যবস্থা। জালটা দেখেই বোঝা যাচ্ছে সহজে ছিড়বে না। তবে ফাঁকগুলো অতটা মিহি নয়। একটা হাত অনায়াসে ঢুকে পড়বে। রতন সময় নষ্ট করলো না। পকেট থেকে একটা সংকেত যন্ত্র বের করে সুইচ অন করলো। এরপর মাত্রার বোতামটাকে টেনে সবচেয়ে উঁচুতে উঠিয়ে দিল। চটপট জালের ভেতর হাত গলিয়ে যন্ত্রটা ছুঁড়ে মারলো নিয়ন্ত্রণ লাইনের ওই পারে। ডান দিকে কিছুদূর এগিয়ে দ্বিতীয় সংকেত যন্ত্রটাও ছুঁড়ে মারলো একই কায়দায়। তিনটি ছুড়ে মারতেই রতনের মুখোশের কণ্ঠটা চেঁচাতে শুরু করলো। ‘বিপদ সংকেত দশ। বিপদ সংকেত দশ। তিমির ঝাঁক আধ মাইল দূরে। আর মাত্র পাঁচ মিনিট। পাঁচ মিনিট। চার মিনিট পঞ্চাশ সেকেন্ড। চার মিনিট চল্লিশ সেকেন্ড।’

রতন চোখ বন্ধ করে ছুটছে। বাড়িয়ে দিল পাখার গতি। পানি কেটে নৌকার মতোই ছুটছে। আর মাত্র দেড় মিনিট। ওই যে দেখা যাচ্ছে নৌকার পাটাতন। ছোট একটা কালো ছায়ার মতো দুলছে। পাশেই আরেকটা বড় ছায়া। কী ওটা? এক মিনিট বাকি থাকতে ঝপ করে ভেসে উঠলো রতন। উঠেই বুঝতে পারলো ভুল হয়ে গেছে। হারু মাঝির দিকে যেমন একটা নল তাক করা ছিল ঠিক তেমন একটি ভয়ালদর্শন নল তার দিকেও তাক করে রেখেছে কোম্পানির এক লোক।

 

 

ধ্রুব নীলের সায়েন্স ফিকশন উপন্যাস : মায়াদ্বীপ ২৩৯০

ফটিকের হাত বাঁধা। নৌকায় মাথা নিচু করে বসে আছে। রতন বুঝতে পারলো তার জন্যই অপেক্ষা করছিল কোম্পানির টহল নৌকাটা। মোট দুজন কর্মী। দুজনের হাতেই ভয়ংকর সেই যন্ত্র।

‘উঠে এসো খোকা। কোনো দুষ্টুমি না। করলেই গুলি মেরে ভ্যানিশ করে দেব। আমার হাতে এটা কী তা নিশ্চয়ই জানো না। এটার নাম বন্দুক। এটা থেকে গুলি বের হয়। আর আশা করি তুমি জানতেও চাইবে না গুলি বের হলে কী হয়।’

রতন চুপচাপ উঠে বসলো। নৌকার দুলুনির কারণে পড়তে গিয়েও পড়েনি। কোম্পানির এক কর্মী এসে দাঁড়ালো তাদের নৌকায়। রতনকে ইশারা করলো বসে পড়তে। দুলুনি আগের চেয়ে বেড়ে গেছে। রতনের মুখে হাসি। যাক কাজ হচ্ছে তাহলে। মাছ ধরার সংকেত যন্ত্রগুলো পুরোমাত্রায় চালু করে জালের ওপাশে ফেলে দিয়েছে। বড় বড় তিমি হাঙ্গরও খাবারের টানে ছুটে আসবে এদিকে। যন্ত্রগুলোর দিকেই ছুটবে ওরা। আর তখুনি..। ভাবনা শেষ না হতেই দারুণ ঝাঁকুনি দিয়ে উঠলো নৌকাটা। বন্দুক ধরা লোকটা ছিটকে পড়ে গেল পানিতে। মুহূর্তের মধ্যে মাছের ঝাঁক পাগলের মতো তাকে টেনে নিয়ে গেল জালের দিকে। কোম্পানির নৌকায় থাকা দ্বিতীয় লোকটা কী করবে বুঝে উঠতে পারছে না। তার নৌকাটাও ভয়ানকভাবে দুলছে। বেশ কিছু বড় বড় মাছ লাফিয়ে উঠে পড়ছে নৌকায়। গায়ে এসে বাড়ি খাচ্ছে। রতন আর ফটিকের দিকে নজর নেই লোকটার। একছুটে নৌকার ভেতরে ঢুকে পড়লো। এরপর ভেতর থেকে চেঁচিয়ে উঠলো, ‘কন্ট্রোল রুম! কন্ট্রোল রুম! সমুদ্রে একটা কিছু ঘটেছে। রবিনকে মাছেরা টেনে নিয়ে গেছে। বোট উল্টে যাচ্ছে। কন্ট্রোল লাইন ভেঙে পড়েছে। টাওয়ার ডাউন। টাওয়ার ডাউন। দুটো ছেলে লাইন পার হওয়ার চেষ্টা করছে। আই রিপিট! কন্ট্রোল রুম!’ লোকটা কার সঙ্গে কথা বলছে বুঝতে পারলো না রতন। নৌকার ভেতর তো আর কেউ নেই। একটু পর নৌকার ভেতর থেকে যান্ত্রিক গলা শুনতে পেল। ঠিক যেমনটা সে শুনেছিল ডুব পোশাকের মুখোশে। যান্ত্রিক কণ্ঠটা বলল, ‘টেল ইউর পজিশন।’ লোকটা হড়বড় করে কী যেন বলল এক বর্ণ বুঝলো না দুই কিশোর। দূরে তাকিয়ে দেখলো দানবীয় শব্দ করে ভেঙে পড়ছে একটার পর একটা টাওয়ার। তিমির ঝাঁক নিশ্চয়ই গুঁতো দিয়ে জাল উপড়ে ফেলেছে। একটু পর আরো মারাত্মক গ-গোল লেগে যাবে এদিকটায়। তিমির ঝাঁক যখন দেখবে নিচে আসলে কোনো খাবারই নেই, পুরোটাই সংকেতের ফাঁকি তখন তাদের মাথা বিগড়ে যেতে পারে।

রতনের হাত খোলা। দ্রুত ফটিকের বাঁধন খুলে দিল। এরপর আর বলে দিতে হলো না। নৌকাটা চালু করেই মাথার ওপরের কাচটা লাগিয়ে দিল। এখন নৌকা উল্টে গেলেও আর বিপদ নেই। এক ঝটকায় গতি বাড়িয়ে দুইশ মাইল করে দিল। কোম্পানির নৌকাটা পশ্চিম দিকে ছুট লাগিয়েছে। রতনরা যাচ্ছে উত্তর-পূবে। উত্তেজনায় চোখ ঠিকরে বেরিয়ে আসার দশা রতন আর ফটিকের। মুহূর্তের মধ্যেই নিয়ন্ত্রণ লাইন পার হয়ে গেল তাদের নৌকা। পেছনে তাকিয়ে টা টা দেবে রতন, তার আগেই দেখলো ঝপ করে শূন্যে ছিটকে গেল কোম্পানির নৌকাটা। তলায় মারাত্মক গুতো খেয়েছে। শূন্য থেকে নিচে পড়ার আগেই ওটাকে খপ করে আঁকড়ে ধরলো তিমিটা। তার আগে অবশ্য ছিটকে বেরিয়ে গেছে কোম্পানির লোকটা। রবিন নামের সঙ্গীটার মতো তার অবস্থাও কী হবে আঁচ করতে পারছে রতন।

নৌকার গতি আবার কমে এসেছে। সম্ভবত জ্বালানি ফুরিয়ে আসছে। জরুরি অবস্থার জন্য আরো দুটো ব্যাটারি রাখা আছে। এগুলোকে একটা বাক্সে জুড়ে দিলেই চলতে শুরু করবে নৌকা। কিন্তু তাড়া নেই দুই কিশোরের। প্রথমবারের মতো অন্যরকম একটা অনুভূতি পেল দুজন। মুক্তির অনুভূতি।

‘ফটিক, আমার মনে হয় আমরা এখন স্বাধীন। যা ইচ্ছে করতে পারব।’

‘হুম। ঠিক। কেমন যেন লাগছে। ভালই।’

‘এখন মাধবপুরের খোঁজ পেলেই হয়।’

‘উত্তরপূবে এগোতে থাকলে পাবো হয়তো।’

‘আর যদি না পাই?’

‘তাহলে আর কী, ফিরে যাব মায়াদ্বীপে। কোম্পানির লোকজন মনে হয় না জানবে এটা আমাদের কাজ। কারণ জানানোর মতো কেউ তো আর নেই।’

কথা বলতে বলতে দুলতে দুলতে এগিয়ে চলল নৌকা। দুপুর গড়িয়ে বিকেল। শুকনো খাবার আর পানি খেয়ে নিল। নৌকার একটি খোপে চুলাও পেয়ে গেল। একটা মাছ কোনোমতে ঝলসে নিল রতন।

‘খেতে খারাপ না। কী বলিস।’

‘সমুদ্রের পানি থেকে একটু লবণ বানিয়ে নে। উমম। টুনার স্বাদই আলাদা। কোম্পানির খ কার্ড জাহান্নামে যাক। এখন আমরা ইচ্ছেমতো মাছ ধরবো আর খাব।’

‘ব্যাপারটা আসলেই মজার। কোম্পানি চুলোয় যাক।’

সন্ধ্যা নামল সমুদ্রে। তার আগে চুপচাপ সূর্যের ডুবে যাওয়া দেখল দিগন্তে। অন্ধকার হতেই আলো জ্বলে উঠলো নৌকায়। ¯্রােতের টানে উত্তর-পুবে ভেসে ভেসে চলেছে। সুইচ আপাতত বন্ধ। নৌকার সামনে যন্ত্রপাতিতে ঠাসা বোর্ডটায় একটা কম্পাস আছে। ওটা দেখেই পথ চিনে নিচ্ছে। ফটিক নৌকার তলায় পাতা বিছানায় ঘুমুচ্ছে। রতন বসে আছে নৌকার ওপরের ছাদে। এক ফালি চাঁদ আছে। চাঁদের দিকে তাকাতেই মায়ের কথা মনে পড়লো। প্র্যাকটিকেল ক্লাস তো এক দিনের ব্যাপার। তাই কাল সকাল থেকেই শুরু হবে দুশ্চিন্তা। খোঁজ করতে ছুটবে অন্য জেলেরাও। আর একবার সীমানা পার হবার কথা জানাজানি হয়ে গেলেই দারুন ব্যাপার ঘটবে। গ্রামের লোকজন নিশ্চয়ই খুশি হবে। আর সবাই খুশি হলে মাও খুশি হবে। তবু মনের ভেতর কোথায় যেন খচ খচ করতেই লাগলো।

এদিকে মায়াদ্বীপের সমুদ্রসীমায় এরইমধ্যে যা ঘটে গেছে তার কিছুই টের পায়নি গ্রামবাসী। তবে যাদের টের পাওয়ার কথা তারা বসে থাকেনি। খবর পৌঁছে দিয়েছে সঙ্গীদের। খুব একটা তাড়া নেই কারও। এদিকে রাত দশটা বাজতেই ঝুম অন্ধকারে ঢাকা পড়ে যায় মায়াদ্বীপ। খেয়েদেয়ে সবে শুতে গেছে রতনের মা-বাবা। এমন সময় দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ। দরজা খুলতেই চমকে গেলেন রতনের বাবা। কোম্পানির দুজন লোক দাঁড়িয়ে। হাতে ভয়ালদর্শন এক অস্ত্র। কোনো কথা বললো না কেউ। রতনের বাবার হাতে একটা গোলাকার চাকতি পরিয়ে দিল লোকটা। একটু পর রতনের মায়ের হাতেও পরালো একই চাকতি। এরপর কোনো কথা না বলে চলে গেল লোক দুটো। কিছুই ঘটেনি এমন ভাব করে রতনের মা বলল, চলেন ঘুমাই। কোম্পানি আমাদের ভালোর জন্যই করে সব কিছু।’ একই ঘটনা ঘটলো ফটিকের বাড়িতেও। ফটিকের মা চাকতিটা পরতে চায়নি দেখে তাকে ঠিক হারু মাঝির মতোই অজ্ঞান করে দিয়েছে কোম্পানির লোকেরা। ফটিকের বোন শিউলি বুঝতে পারলো বড় ধরনের গ-গোল পাকিয়েছে ফটিক।

 

 

ধ্রুব নীলের সায়েন্স ফিকশন উপন্যাস : মায়াদ্বীপ ২৩৯০

১০

পরদিন সন্ধ্যা। সারা দিনে দুটো মাত্র মাছ ধরতে পেরেছে। তাও আধ কেজির বেশি হবে না। পানি বানানোর যন্ত্রটা কাজ করছে না। ব্যাটারিতে ঝামেলা করছে। সূর্যের আলো থাকলেও চার্জ হচ্ছে কম। লোনা স্বাদটা থেকেই যাচ্ছে। হিসেব করে গিলতে হচ্ছে সব কিছু।

‘রতনরে। আমরা তো ফিরতেও পারবো না মনে হয়।’

‘অতিরিক্ত জ্বালানিগুলো আছে এখনও। এখন হয় এগিয়ে যেতে হবে। না হয় ফিরে যেতে হবে।’

‘আমি কিছু জানি না। তুই কী করবি কর।’

‘এত কষ্ট করেছি পিছু হটার জন্য নয়। আমার মনে হয় তুই হলেও সামনে এগিয়ে যাওয়ার পক্ষে থাকতি।’

ফটিক কষ্ট করে হাসলো। কিছু বললো না।

রতন একটা বাড়তি জ্বালানি বোতল লাগিয়ে দিল পাটাতনে থাকা বাক্সটায়। কম্পাসে দিক ঠিক করে উত্তরে ছুটতে শুরু করলো একশ মাইল বেগে। আরো তিন দিন ছোটার মতো জ্বালানি আছে। তাই এখনই দুশ্চিন্তা ভর করছে না দুই কিশোরের মাথায়।

‘এই ফটিক ওঠ! দেখ দেখ!’

ফটিক সিটে হেলান দিয়েই ঘুমুচ্ছিল। রতনের ধাক্কা খেয়ে কিছুক্ষণ চোখ ডলল। ভোরের আলো ফুটলো সবে। শান্ত সমুদ্র। নৌকার গতিও কম।

‘কোথায় কী?’

‘আরে দূরে নয়। নৌকার মাথায় দেখ।’

‘দেখলাম তো, একটা পাখি। গাংচিলের মতো দেখতে। কী হয়েছে?’

‘আরে বোকা! গাংচিল মানে আশেপাশে কোথাও মাটি আছে। আমরা মাধবপুরের কাছাকাছি!’

ফটিক ওপরের কাচ তুলে এদিক ওদিক তাকালো। কোথায় কোনো দ্বীপ নজরে পড়লো না।

‘কোন দিকে?’

‘তুই আসলেই বোকা। পাখিটা আছে না! ওটা যেদিকে উড়ে যাবে, সেদিকেই।’

‘দে ওটাকে তাড়িয়ে।’

ফটিকের কথা শেষ হওয়ার আগেই পাখিটা উত্তর দিকে উড়াল দিল। তারমানে মাধবপুরকে বাম পাশে রেখে তারা সামনে এগিয়ে যাচ্ছিল। তড়িঘড়ি করে আবার নৌকার মাথা ঘুরিয়ে নিল।

‘ভাগ্যিস পাখিটা ছিল। না হলে কপালে খারাবি ছিল।’

পাখির পেছন পেছন ধীরে সুস্থে ছুটছে রতনদের নৌকা। পুব আকাশ ঝলমল করে সূর্যটা উঠতেই চোখে পড়লো উত্তরের দিগন্তে মাথা তুলে থাকা দ্বীপটা। উঁচু দুটো পাহাড়ও দেখতে পাচ্ছে। আরো এগোতেই চোখে পড়লো লম্বা দুটো টাওয়ার। টাওয়ার দেখেই মুশড়ে গেল রতন। কিন্তু একটা ব্যাপার চোখ এড়ালো না। টাওয়ারের ওপরে ছাতার মতো যন্ত্রগুলো স্থির। মায়াদ্বীপের মতো এগুলো ঘুরছে না। নিশ্চয়ই বিকল হয়ে গেছে। তার মানে কোম্পানির কিছু না কিছু হয়েছে।

মিনিট দশেক পর আরো কাছে চলে এলো দ্বীপটা। ভাঙাচোরা জেটিও নজরে পড়লো। তার পাশে সৈকতে উল্টে পাল্টে আছে কয়েকটা নৌকা। জেলে তো দূরে থাক একটা কুকুরও নজরে পড়ছে না। সৈকতের পরে জঙ্গল। খানিকটা উঁচু হয়ে চলে গেছে গাছের সারি। অনেক গাছের আগা পুড়ে গেছে। বোঝা যাচ্ছে দাবানল নয়। আগুন লাগলে আগে গোড়ার দিকটাই পোড়ার কথা। রতনের মনে বিপদের গন্ধ উঁকি দিয়ে গেল।

নৌকা ভিড়িয়ে জেটিতে বেঁধে সৈকতে নামলো দুজন। চারদিকে ছমছমে নিরবতা। সৈকতে নারকেল ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। অনেক দিন এদিকটা কেউ মাড়ায়নি। নাকি গ্রামে লোকজনই নেই? আপাতত উত্তর দেওয়ার মতো আশপাশে কাউকে পেলেই হয়।

‘কেউ আ…ছেন!’

বারকয়েক ডাকার পরও কেউ সাড়া দিল না। দুচারটে পাখির ডাক শোনা যাচ্ছে কেবল। রতনের পকেটে দুটো মাছ ধরার যন্ত্র। পেছনের পকেটে একটা ছোট ছুরিও আছে। বিপদে পড়লে অস্ত্র হিসেবে কাজে লাগবে ভেবেই নিয়ে এসেছিল। এতক্ষণ কাজে না লাগলেও এখন লাগবে। ফটিক দুটো ডাব কুড়িয়ে এনেছে। ছুরি দিয়ে মুখটা ফুটো করে ঢক ঢক করে গিলে নিল। পানি অতোটা মিষ্টি নয়, তবে ভালোই শক্তি পাবে। 

‘শুনছিস শব্দটা?’ ফটিকের কথায় কান খাড়া করে রইল রতন। যান্ত্রিক গুন গুন শব্দ। উপর থেকে আসছে। মানে উড়ন্ত কিছু হবে হয়তো। জঙ্গলের ওপাশ থেকে আসছে। কম্পাস বের করলো। শব্দটা আসছে উত্তর দিক থেকে। দক্ষিণে পুরোটাই সৈকত। তারা এসে উঠেছে গ্রামের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে। শব্দের উৎস ধরে এগিয়ে গেল দুই কিশোর। ঝাউ গাছ আর নারকেল গাছে ছাওয়া চারদিক। গোলপাতা আর সাইকাসও আছে অনেকগুলো। তবে ঝোপঝাড়ই বেশি। পায়ে হাঁটা পথটা নজরে পড়তে দেরি হলো না। ওটা ধরেই হাঁটছে। যত যাচ্ছে শব্দের মাত্রা ততোই বাড়ছে।

জিনিসটা প্রথমে রতনের নজরে পড়লো। একটা ঝাউ গাছের ওপর ডানা ঝাপটে উড়ছে। তবে সামনে এগোচ্ছে না। দেখতে কাকের মতোই। কিন্তু সামনের ঠোঁটটা একটু বেশিই লম্বা আর চকচকে।

‘এমন পাখি জন্মেও দেখিনি। এভাবে শব্দ করছে কেন? আর দেখ ডানা ঝাপটাচ্ছে কত জোরে।’

‘হারু মাঝি মানে ওই পরানের কথা মনে আছে? দুটো যন্ত্রপক্ষীকে নাকি সে মেরে ফেলেছিল।’

‘হুম, এটাই সেই যন্ত্রপক্ষী? কিন্তু হারু মাঝি ওটাকে মারলো কেন?’

মাথার ওপর দিয়ে একটা বক উড়ে গিয়ে বসলো ঝাউ গাছটার ডগায়। সঙ্গে সঙ্গে যা ঘটলো তার জন্য প্রস্তুত ছিল না দুজন। বকটার দিকে ঝট করে তাকালো যান্ত্রিক পাখিটা। চোখ দুটো ধপ করে জ্বলে উঠলো। সঙ্গে সঙ্গে দুচোখ থেকে দুটো উজ্জ্বল রশ্মি ছিটকে বেরিয়ে এলো। সেকেন্ডের মধ্যে পুড়ে ছাই হয়ে গেল বকটা।

পা দুটোকে গাছের মতো মনে হচ্ছে। নড়তে পারছে না দুই কিশোর। সামনে একটা ঢিবির মতো উঁচু জায়গা। যন্ত্রপক্ষীটা এখনও ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। এদিক ওদিক ঘাড় ঘুরিয়ে দেখছে। অনেকটা পাহারাদারের মতো। আশপাশে কেউ নড়লেই যেন অগ্নিদৃষ্টি হেনে ভস্ম করে দেবে।

‘ফটিক নড়াচড়া করিস না! পাখিটার চোখের দিকে খেয়াল রাখ। অন্যদিকে তাকালেই একটু একটু করে সরবি।’ রতনের গলায় একটুও জোর নেই। পাখিটা অন্যদিকে তাকালো ঠিকই তবে দুজনের একজনও নড়ার সাহস পেল না।

‘রতন, চল দৌড়াই।’

‘না! দেখিসনি কেমন জোরে চোখ দিয়ে আগুন ছুটে আসে! পেরে উঠবো না। আস্তে আস্তে শুয়ে পড়। হামাগুড়ি দিয়ে এগোই।’

বুদ্ধিটা পছন্দ হয়েছে ফটিকের। দুজনে ধীরে ধীরে বসে পড়লো। উবু হয়ে এগোতে শুরু করলো। ঢিবির চুড়ায় পৌঁছানোর আগেই ঘটলো অঘটন। কোত্থেকে একটা কাঠবিড়ালি এসে দাঁড়ালো দুজনের সামনে। কোনোদিন মানুষ দেখেনি এমন ভাব করে ভেংচি কেটে নাচতে শুরু করে দিল।

‘হুস! হাস! যা ভাগ!’

কাজ হলো না। কাঠবিড়ালি লাফাচ্ছেই। যন্ত্রপক্ষীটাও ততক্ষণে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখতে শুরু করেছে ওটাকে। রতন স্পষ্ট দেখতে পেল পাখিটার চোখ ধীরে ধীরে লাল হচ্ছে। এক ধরনের যান্ত্রিক শোঁ শোঁ শব্দও শুনতে পেল। যেন আগুন ছোড়ার জন্য আবার তৈরি হচ্ছে পাখিটা। ফটিকের দিকে তাকাল। ওর চোখ বন্ধ। ‘ফটিক! তুই ডানে লাফ দিবি আর আমি বা..।’ কথাটা শেষ হওয়ার আগেই আলোর ঝলকানি। ঢিবি থেকে গড়িয়ে পড়লো দুই কিশোর। নাকে পোড়া গন্ধ ঢুকতেই বুঝতে পারলো কাঠবিড়ালিটার দশা।

খানিকটা গড়িয়ে স্থির হতেই যা দেখলো তাতে আত্মা উড়ে গেল দুইজনের। যন্ত্রপক্ষীটা ঠিক তাদের মাথার ওপর স্থির হয়ে ডানা ঝাপটাচ্ছে। চোখ দুটো টকটকে লাল!

 

 

ধ্রুব নীলের সায়েন্স ফিকশন উপন্যাস : মায়াদ্বীপ ২৩৯০

১১

কতক্ষণ পাখিটার দিকে তাকিয়ে ছিল ভুলে গেছে রতন। তবে সেটা পাঁচ সেকেন্ডের বেশি নয় নিশ্চয়ই। চোখ বুজে ফেলল। যেকোনো মুহূর্তে ওই দানব চোখ জোড়া থেকে বের হয়ে আসবে উত্তপ্ত…। ভাবনা শেষ না হতেই ধাঁই করে কী যেন আঘাত করলো পাখিটাকে। ঠং করে শব্দ হলো। ছিটকে পড়লো দশ গজ দূরে। যান্ত্রিক গোলযোগের শব্দ শুনতে পেল। আঘাতটা জোরেসোরেই ছিল। একটা ডানা ভেঙে পাশে পড়ে আছে। পাখিটা উঠে দাঁড়াতে চেষ্টা করলো। এরপর আবার ধীরে সুস্থে পড়ে গেল। ভেতর থেকে ধোঁয়া বের হতেই বোঝা গেল সহজে ওটা আর দাঁড়াতে পারবে না। চিৎ হয়ে পড়ে থাকা দুই কিশোর আকাশের দিকে তাকিয়ে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল। এমন সময় আকাশ ঢেকে দিয়ে একটা ছায়া পড়লো। মানুষের দেখা পেয়ে স্বস্তিটা যেন দ্বিগুণ বেড়ে গেল।

মেয়েটার বয়স তাদের মতোই হবে। পরনে অদ্ভুত এক পোশাক। মায়াদ্বীপের মেয়েদের মতো শাড়ি পরেনি। চেহারায় বুদ্ধিদীপ্ত আর কঠোর একটা ভাব। হাতে একটা তীর ধনুকের মতো অস্ত্র। এটা দিয়েই পাখিটাকে মেরেছে।

‘তুমি নিশ্চয়ই বিল্টু নও। কারণ বিল্টু কোনো ড্রোনকে আদর করে চাল খাওয়াতে আসবে না।’

কথাটা ফটিকের দিকে তাকিয়ে বললেও উত্তর দিল রতন। ‘আমি রতন। মায়াদ্বীপ থেকে এসেছি। ও আমার বন্ধু ফটিক।’

‘আমি পায়েল। চলো জায়গাটা নিরাপদ নয়।’

দুজনে কথা না বাড়িয়ে পায়েলকে অনুসরণ করলো। মিনিট দুয়েক কেউ কোনো কথা বললো না। পায়েলই নীরবতা ভাঙলো, ‘তোমাদের বোটটা কোথায়?’

‘বোট? সে আবার কী?’ বলল ফটিক।

‘যেটায় চড়ে তোমার এখানে এসেছো। নিশ্চয়ই উড়ে আসোনি।’

‘ওহ, নৌকার কথা বলছো। ওটাকে বোট বলে নাকি!’

‘নৌকা! ফিউশন ব্যাটারি ইঞ্জিন নেই ওটায়?’

‘ইয়ে ব্যাটারি আছে আরও যন্ত্রপাতি আছে। কোনটার কী নাম তা জানি না। ওই ভাঙা জেটিতে বাঁধা আছে।’

‘যাকগে। দ্বীপে আমরা কজন ছাড়া আর কেউ নেই। তোমাদের নৌকা কেউ নেবে না।’

নৌকা শব্দটা উচ্চারণ করার সময় একটু বিদ্রƒপ ছিল পায়েলের কণ্ঠে। রতন সেটা ধরতে পারলো।

‘দেখো, তোমরা যেটাকে বোট বলো, সেটা আমাদের কাছে নৌকা। এতে দোষের কী আছে!’

রতনকে রাগতে দেখে হাসলো পায়েল। তবে হাসির মধ্যে বিদ্রƒপ ছিল না।

জঙ্গলের মাঝে একটা মাঝারি আকারের ঢিবির সামনে দাঁড়াল তিন জন। পায়েল চেঁচিয়ে উঠলো, ‘দরজা খোলো! আমি!’ একটু পর ঢিবির দেয়ালটা ফাঁক হয়ে গেল। একটা দরজা। তাতে উঁকি দিল একটা নারীমুখ। চেনা চেনা লাগলো রতনের। কিছু ভাবার আগেই চমকে উঠলো ফটিকের চিৎকারে, ‘মা! মা তুমি এখানে কী করে এসেছো! মা!’

ফটিকের বিস্ময় এখনও কাটছে না। গুহার মতো ঘরে তারা দুজন বাদে আছে আরো পাঁচজন। একজনের সঙ্গে এখনও দেখা হয়নি। ঘরটা বেশ অন্ধকার আর স্যাঁতস্যাঁতে। একটা বড় হলরুমের মতো দেখতে। মাঝে একটা বাথরুম ছাড়া আর বাড়তি কোনো জায়গা নেই। একপাশে একগাদা যন্ত্রপাতির জঞ্জাল ছড়িয়ে আছে।

পায়েলের বাবার নাম সুলতান। তার পরনে কোম্পানির লোকদের মতো পোশাক। রুস্তম নাম যে লোকটার তার বয়স পঁয়ত্রিশের নিচে হবে না। শরীর পালোয়ানের মতো। আর যাকে দেখে ফটিক মা বলে চেঁচিয়ে উঠেছে, পায়েল তাকে শারমিন খালা বলে ডাকছে। ফটিক দুয়েকবার ভুল করে মা ডেকে ফেললেও তাতে কেউ হেসে উঠছে না। ঘরে ঢুকেছে মিনিট পাঁচেক হলো। এরইমধ্যে সবাই তাদের আপন করে নিয়েছে।

রতন আর ফটিকের চোখ বার বার চলে যাচ্ছে আস্তানার এক কোণে দাঁড়িয়ে থাকা বিশাল একটা যন্ত্রের দিকে। দেখতে অবিকল মানুষের মতো, হাত-পা আছে। মাথাও আছে। তবে ধাতব কিছু দিয়ে বানানো ওটা। আকারেও খানিকটা বড়। হাতগুলোর আগা কেমন যেন ভয়ানক দেখতে। দেখেই কোম্পানির লোকের হাতে থাকা সেই বন্দুকের কথা মনে পড়ে গেল তার। কিশোরদের কৌতুহল মেটালো রুস্তম- ‘এইটা হইল গিয়া রোবট। যন্ত্র কিন্তু মানুষের মতো হাঁটাচলা করবার পারে।’

‘বাহ দারুন তো! কিন্তু কাজটা কী এদের?’

ফটিকের প্রশ্নের উত্তর দিল পায়েল, ‘তোমরা যেটা দেখছো, আসলে ওটা অনেক পুরনো আমলের রোবট। মল্লযোদ্ধা সিরিজের প্রথম সংস্করণ। এখন অবশ্য দারুন দারুন সব রোবট ঘুরে বেড়ায়। এটা কোম্পানির পুরনো আমলের একটা পাহারাদার রোবট। এগুলোর অত বুদ্ধিশুদ্ধি নেই। অর্ডার অনুযায়ী কাজ করে। কোম্পানির মূল অফিসের পাহারা দেয়াই কাজ। তবে অনেক শক্তি। এক গুলিতে ছাই বানিয়ে দেবে। আর ভয়ের কারণ নেই, এখানে যেটা দেখছো, ওটা একটা অ্যান্টিক। কোম্পানির প্রথম দিককার রোবট। ভেতরে কিছু নেই। পুরোটাই ফাঁপা।’

এতদিন ধারণা ছিল না। এখন কোম্পানির শক্তি সম্পর্কে একটু একটু ধারণা হচ্ছে রতনের। মানুষের মতো যন্ত্র মানে কী, সেটাও বুঝতে পেরেছে। তবে ভয় পাচ্ছে না আগের মতো। কোম্পানিকে বোকা বানিয়ে এতদূর আসতে পেরেছে যখন বাকি কাজেও সমস্যা হবে না। কিন্তু বাকি কাজটা কী, সে ব্যাপারে এখনও চিন্তা করেনি রতন। সম্ভবত মায়াদ্বীপে ফিরে গিয়ে সবাইকে কোম্পানির ব্যাপারে বলে দেওয়া। কিন্তু তাতে কাজ হবে কিনা কে জানে।

ফটিকের খিদে পেয়েছে। রান্না করা মাছ খেতে দিল শারমিন খালা। রতন ইশারায় বুঝিয়ে দিল তার বাথরুম চেপেছে। পায়েল বলল, ‘বিল্টু বের হোক, তারপর। একটাই বাথরুম এখানে।’ গুহার মতো ঘরে বাথরুম আছে দেখে রতন বুঝে গেল, অনেক সময় নিয়েই ঘরটা বানানো। বোধহয় নিরাপদে দিন কাটানোর জন্যই এটা তৈরি করেছিল মাধবপুরের মানুষ। এখনও অনেক প্রশ্নের উত্তর বাকি। দরজার সামনে আনমনে দাঁড়িয়ে আছে রতন। দরজা খোলার শব্দে পেছনে তাকাতেই ভূত দেখার মতো চমকে উঠলো। ‘আরে ফটিক! তোকে দেখলাম খাচ্ছিস! বাথরুমে ঢুকলি কখন!’ বলেই ভুলটা বুঝতে পারলো। তার আগে বিল্টু বলল, ‘ইয়ে, মানে তুমি কে? আমি তো ফটিক না, আমি বিল্টু।’

শারমিন খালার রান্না এতই মজা লাগছে যে এতক্ষণ ঘনিয়ে ওঠা বিস্ময় কেটে গেছে দুই কিশোরের। ফটিক আর বিল্টু দেখতে এক হলেও দুজনের কথা বলা ও হাঁটার ভঙ্গি আলাদা। তাছাড়া ফটিক পরে আছে ফুল প্যান্ট আর ঢোলা শার্ট আর বিল্টু পরেছে হাফ প্যান্ট আর স্যান্ডো গেঞ্জি।

‘খালা আরেকটু ভাত লাগবে। আর শুধু ঝোল দিলেই চলবে।’ ফটিক আর বিল্টুর মধ্যে আরেকটা বড় মিল পাওয়া গেল, দুজনই খেতে ভালবাসে।

খাওয়ার ফাঁকে দুই কিশোরের মনে জমে থাকা অনেকগুলো প্রশ্নের মধ্যে দুয়েকটার জবাব দেওয়ার চেষ্টা করলেন পায়েলের বাবা।

‘তোমরা ব্যাপারটা বুঝবে না। তাও বলি। তোমাদের মায়াদ্বীপ আর এই মাধবপুর হলো কোম্পানির প্রজেক্ট। মানে এক ধরনের পরীক্ষার জায়গা। নতুন কোনো ওষুধ কিংবা খাবার পরীক্ষা করতে হলে আগে এই দুই গ্রামের মানুষের ওপরই পরীক্ষা চালানো হয়। তাছাড়া গ্রাম দুটোকে কারখানাও বলতে পারো। অনেক অল্প খরচে এখানে কাজ করিয়ে নেয় কোম্পানি। প্রায় দেড়শ বছর ধরে চলছে এটা। গ্রামের মানুষগুলোর মধ্যে এমন একটা জিন, মানে হুমম.. তোমাদের শরীর ঠিক অন্যদের মতো নয়। কোম্পানির লোকজন তোমাদের জন্মের সময়ই একটা গ-গোল করে রাখে যাতে তোমরা গ্রাম ছেড়ে বাইরে না যেতে চাও।’

ফটিকের বিশেষ মন নেই। রতন বলল, ‘মানে বলতে চাচ্ছেন আমাদের কৌতুহল কম? কিন্তু এটা কোম্পানির লোকজন ঠিক করে দেয় কী করে?’

‘ঠিক ধরেছো। আসলে ব্যাপারটা হলো তোমাদের কারো জন্ম স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় হয়নি। তোমরা মানে তুমি ফটিক, বিল্টু, শারমিন এরা সবাই কারো না কারো ক্লোন। কোম্পানির ভুলের কারণে দেখা গেছে একই সময়ে একই কোষের দুটো ক্লোনও হয়ে গেছে। ক্লোন মানে হলো একই রকম হবে সব কিছু।’

‘তা বুঝলাম। এতে সুবিধা কী?’

‘সুবিধা হলো তোমাদের মধ্যে কোম্পানি তাদের মতো করে জিন ম্যাপ বসিয়ে দিয়েছে। কার স্বভাব চরিত্র কেমন হবে সেটাও ঠিক করে এই জিন। ওটা প্রত্যেকের শরীরেই থাকে। তবে তোমাকে দেখলাম ব্যতিক্রম।’

রতনের মনে পড়ে গেল একটা ঘটনা। বছর দুয়েক আগে একবার মা তাকে গল্প শুনিয়েছিল, তার যখন জন্ম হয় তখন নাকি মা পালিয়ে ছিল। হাসপাতালের ভয়ে বাড়িতেও আসেনি। হাজুনি বুড়ির বাড়িতেই নাকি রতনের জন্ম। জানতে চাইলে মা বলেছিল, কোম্পানির লোকজন পেটের বাচ্চাকে মেরে অন্যের বাচ্চা কোলে ধরিয়ে দেয়। কিন্তু মা একথা জানলো কী করে?

‘আমি আর পায়েল কোম্পানিরই লোক ছিলাম। পরে কোম্পানির কুকীর্তির কথা জানতে পারি ধীরে ধীরে। কিন্তু আমি একা আর কী করবো। গ্রামটা ফাঁকা হয়ে যেতে শুরু করে মাস দুয়েক আগ থেকে। কোম্পানির নতুন ওষুধ খেয়ে মারা যায় অর্ধেক লোক। যারা বেঁচেছিল তাদের ধরে নিয়ে গেছে ঢাকায়। যারা বেঁচে ছিল ওদের মেরেছে ভাড়াটে খুনি আর রোবট পাখি দিয়ে।

‘ঢাকা? কী দিয়ে ঢাকা?’

‘আরে না, শহরের নামটাই ঢাকা। তোমরা কখনও দেখোনি। অনেক কিছু আছে সেখানে। ভালো কথা তুমি আর ফটিক বোধহয় জানোই না যে তোমাদের একটা দেশ আছে।’

‘হ্যাঁ, জানি তো, মায়াদ্বীপ।’

‘উঁহু, মায়াদ্বীপ একটা ছোট্ট গ্রাম। তোমাদের আমাদের দেশের নাম বাংলাদেশ।’

‘এ আবার কেমন নাম! জীবনেও শুনিনি! এ আমার দেশ হয় কী করে!’

‘তোমরা কিন্তু বাংলা ভাষাতেই কথা বলছো। আমরাও কিন্তু একই ভাষায় কথা বলছি। আর তোমাদের পূর্ব পুরুষরা বাংলাদেশ থেকেই মায়াদ্বীপে গিয়েছিল।’

রতন আর ফটিক ঠিক বুঝতে পারছে না ব্যাপারটা। তাদের জগৎ বলতে এতদিন মায়াদ্বীপই ছিল। এখন মনে হচ্ছে আরও অনেক কিছুই আছে।

‘কিন্তু আমাদের পূর্ব-পুরুষরা বাংলাদেশের কথা বলে যায়নি কেন?’

‘বলেছিল, কিন্তু কোম্পানি আসার পর সব ইতিহাস মুছে দেয়। স্কুলের পাঠ্যবইও ওরাই তৈরি করেছে। আমি ছিলাম কোম্পানিতে, আমি জানি এসব। তবে বিশ্বাস করো, মনে প্রাণে চাইনি এসব হোক। আসলে উপায় ছিল না।’

খাওয়া শেষে বিশ্রাম নিচ্ছে সবাই। গুহার মতো হলেও ভেতরটা একটা বাড়ির মতোই। আলাদা আলাদা খোপ আছে। বাথরুমের মধ্যে কলও আছে। সেই কলের নলটা আবার সমুদ্রের সঙ্গে লাগানো। সেখান থেকে যান্ত্রিক উপায়ে ভেতরে পানি আসে। এমন পানি তোলার যন্ত্র রতন মায়াদ্বীপের দেখেছে। কিন্তু নাম বলতে পারলো না। 

রতন মেঝেতে পাতা বিছানায় শুয়ে শুয়ে পড়ছে আর ভাবছে। একটু আগেই পায়েল তাকে একটা ইতিহাসের বই দিয়েছে। এমন বই জীবনেও পড়েনি রতন। ইতিহাস ব্যাপারটা যে এতটা মজার আগে বোঝেনি। মানুষ আগে ইয়া বড় এক গ্রামে বাস করতো। না না গ্রাম না। ওটাকে দেশ বলে। এরপর দুইশ বছর আগে অনেক বড় বন্যা হয়। সমুদ্রের পানি বেড়ে গিয়ে দেশটার অর্ধেকটার মতো ডুবে যায়। অনেক মানুষ মারা যায়। পরে আস্তে আবার সব ঠিক হয়ে আসে। একদল মানুষ মূল ভূখণ্ডে থাকতে না পেরে বেরিয়ে যায়। ঝগড়া আর যুদ্ধ লেগেই থাকতো। এসব দেখে অনেকে জাহাজে চেপে চলে যায় দূর দেশে। অন্য কোনো দ্বীপের খোঁজে। রতন জেনেছে তাদের মায়াদ্বীপ আসলে একটা দ্বীপ। মাধবপুরও তাই। কিন্তু মূল ভূখণ্ডের প্রতি রতনের তেমন কোনো আগ্রহ নেই। সেখানে জ্ঞান বিজ্ঞানে মানুষ অনেক এগিয়ে গেছে। অনেক উঁচু উঁচু বাড়িতে থাকে। সব কাজ যন্ত্র করে দেয়। কিন্তু যারা দেশ ছেড়ে বাইরে চলে গিয়েছিল, তাদের কাছে কিছুই পৌঁছায়নি। আর এমনই কিছু দ্বীপে আস্তানা গেড়েছে মূল ভূখণ্ড থেকে আসা কোম্পানি। পুরো বইটা একদিনে পড়ে শেষ করা সম্ভব না হলেও রতন যতটুকু পারছে পড়ছে। পায়েলের বাবার সঙ্গে আরো গল্প করতে পারলে আরো অনেক কিছু জানা যেত। হুট করে আবার মায়ের কথা মনে পড়ে গেল রতনের। মনটা খারাপ হয়ে গেল। কিন্তু ফিরে গিয়ে তো এমন সব গল্প বলতে পারবে, যেটা কেউ জীবনেও শোনেনি। এদিকে ফটিক নিশ্চিন্তে ঘুমুচ্ছে। কোনো চিন্তা নেই তার মধ্যে। তবে কি দুশ্চিন্তা করার ব্যাপারটাও পাল্টে দিয়েছে কোম্পানি? হতেও পারে। প্রতি বছরই তো তাদের স্কুলে এসে কী কী সব ওষুধ খাওয়াতো কোম্পানির লোকেরা।

বিকেলের দিকে সবাই গুহা ছেড়ে বের হলো। রুস্তম, ফটিক আর বিল্টু একসঙ্গে সামনের সারিতে হাঁটছে। বাকিরা পেছনে। জঙ্গলের মধ্যে মেঠো পথ ধরে এগিয়ে যাচ্ছে সবাই। উদ্দেশ্য কিছু ফল আর পানি নিয়ে আবার ডেরায় ফিরে যাওয়া। পায়েলের বাবার হাতে একটা বন্দুক দেখতে পেল রতন। কীভাবে ওটা কাজ করে সেসবও শেখা হয়েছে। যন্ত্রপাখিদের মারতে এটার নাকি জুড়ি নেই। অনেকগুলোকেই মেরেছে পায়েলের বাবা।

রুস্তম চুপচাপ গোছের। কোম্পানির ওষুধ খেয়ে তার পরিবারের সবাই মারা গেছে। শারমিন খালারও একই ঘটনা। পায়েলের বাবা বিল্টুকে খুঁজে পায় জঙ্গলের একটি গর্তে। তারও কেউ বেঁচে নেই।

ফটিক আর রুস্তমের মধ্যে খানিকটা বন্ধুত্বের মতো হয়ে গেছে বলা যায়। জঙ্গলের পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে দুজন টুকটাক আলাপ সারছে।

‘রুস্তম ভাই, যন্ত্রপাখিগুলো আসবে না তো?’

‘আইতেও পারে। তবে ইদিকটায় বেশি ঘুরাঘুরি করে না। পূবের দিকে বেশি উড়ে। ওইখানেই ওগুলার চার্জিং ইশটিশন। বজ্জাতগুলার ব্যাটারিও শেষ হয় না।’

রতন গল্প করছে পায়েলের সঙ্গে। সেও প্রতিরক্ষার জন্য তীর ধনুক নিয়ে বের হয়েছে। রতনের পকেটে আছে মাছ ধরার একটা সংকেত যন্ত্র। সামনে পুকুর পেলে দুচারটে মাছ ধরা যাবে। আর না পেলে সমুদ্র তো আছেই।

‘আচ্ছা পায়েল, এখানে কদিন থাকবে তোমরা। আমরা মায়াদ্বীপ ফিরে যেতে চাই। সবাইকে কোম্পানির কথা ফাঁস করে দেব।’

‘বাবার প্ল্যান হলো আগে ঢাকা যাবে। সেখানে সরকারের কাছে কোম্পানির কথা ফাঁস করে দিতে হবে। তাহলে কোম্পানির কাজকর্ম বন্ধ হয়ে যাবে। সরকার মানে হলো যারা দেশ চালায়।’

‘হ্যাঁ হ্যাঁ জানি, বইতে পড়লাম। কিন্তু যাবে কী করে? নৌকা তো একটা।’

‘আরো বোট আছে। কোম্পানির হেডকোয়ার্টারে। ওরা সবকটা নিয়ে যায়নি। দুয়েকটা রেখে গেছে। কিন্তু হেডকোয়ার্টার ঘিরে রেখেছে ড্রোনগুলো। কাছেই ঘেঁসা যায় না। কোম্পানি জানে না যে আমরা বেঁচে আছি। জানলে অনেক আগেই এসে মেরে ফেলতো। আর হ্যাঁ, মায়াদ্বীপ গিয়ে কাকে কী বোঝাবে শুনি! কোম্পানির কাছে যে অস্ত্র আছে তার নমুনা তো এখানেই দেখছো। তোমাদের গ্রামের লোকেরা তো পেরে উঠবে না। একটা ড্রোন ছেড়ে দিলেই সব পুড়ে মরবে।’

‘হুম, সেটাই ভাবছিলাম। তবে উপায়?’

‘আগে মূল ভূখণ্ডে চলো। সরকারকে কোম্পানির কথা ফাঁস করতে হবে। তারপর সাহায্য নিয়ে গ্রামে ফিরে এসে সবাইকে বলা যাবে। তা না হলে কোম্পানি রাতারাতি পুরো গ্রাম সাফ করে ফেলবে, বুঝলে!’

পায়েলের কথায় চিন্তায় পড়ে গেল রতন। অবশ্য এ ব্যাপারে পায়েলেরই ভালো জানার কথা। সে তো মূল ভূখণ্ডেই বড় হয়েছে। মাধবপুরে এসেছিল বাবার সঙ্গে। সবাই মারা যাওয়ার কয়েক মাস আগে। মনটা তবু গ্রামের জন্য খচখচ করছে। কোম্পানির কাছে যত যাই থাকুক, একটা বুদ্ধি ঠিকই বের করে ফেলবে।

সবাইকে থামার ইঙ্গিত দিলেন পায়েলের বাবা। ইশারায় চুপ করতে বললেন। রতনও শুনতে পেল শব্দটা। সরসর জাতীয় শব্দ। সামনে একটা বাঁশঝাড়। ওটার ওপর থেকেই আসছে। এমন সময় আকাশ কাঁপিয়ে কাঁ কাঁ চিৎকার ছুড়ে একটা বক উড়ে গেল মাথার ওপর দিয়ে।

‘সবাই দৌড়াও! গুহার দিকে!’

পায়েলের বাবার কথা কানে আসতেই শুরু হলো রুদ্ধশ্বাস দৌড়। বকের ডাক শুনে ফেলার কথা যন্ত্রপাখির। আর কাছাকাছি আসলে তাদেরও দেখে ফেলবে। সবাই সমানতালে দৌড়াতে পারছে না। শারমিন খালা বার বার পিছিয়ে পড়ছে। তার জন্য একটু পর পর দাঁড়িয়ে যাচ্ছে রুস্তম। খানিক পর যান্ত্রিক পাখা ঝাপটানোর শব্দটাও কানে এলো। পায়েলের বাবাকে দেখা গেল উল্টো দিকে ফিরে দৌড়াচ্ছেন। বন্দুক তাক করে গুলি ছুড়ছেন ঠিকই কিন্তু লাগলো না। একটা নয়, দুটো ড্রোন। পায়েল তীর ধনুক উঁচু করার চিন্তা বাদ দিয়েছে। আর মিনিট খানেক দৌড়ালেই আস্তানায় পৌঁছে যাবে সবাই। পাখিগুলো খেপেছে বেশ। একটু পর পর চোখ গরম করে শক্তিশালী আলোটা ছুড়ছে। গুনে গুনে বিশ সেকেন্ড পর বুকে পানি ফিরে এলো সবার। পায়েলের বাবার কথা শুনে থামলো সবাই। ‘ওগুলো ফিরে গেছে! সম্ভবত চার্জ শেষ। তবে আজ আর নয়। ফিরে যাওয়া যাক।’

সন্ধ্যার পর পরই শেয়ালের দল চিৎকার শুরু করে দেয়। বের হবার জো থাকে না। রাতের খাবার বলতে একটা করে ফল আর কিছু মাছ। মসলা না থাকায় পুড়িয়েই খেতে হবে। ফটিক আর বিল্টু পড়েছে চিন্তায়। রতনের দিকে একটা পানির বোতল এগিয়ে পায়েল বলল, ‘এটা তোমাদের তিন জনের জন্য। তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়। পরে খিদে বেড়ে গেলে আর ঘুমুতে পারবে না।’ রতন ভাবছে। খিদে নিয়ে নয়। কম খেয়ে অভ্যস্থ সে। ভাবছে অন্য কিছু।

‘আচ্ছা পাখিগুলো খোঁজে কী করে? মানে ওরা তো যন্ত্র। ওদের তো কিছু বোঝার ক্ষমতা নেই। কী দেখে মানুষ চেনে? আর আসল পাখিকে মেরে ফেলল, কিন্তু নিজের মতো দেখতে যন্ত্রপাখিকে কেন মারে না?’

প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিয়েছে পায়েলের বাবার দিকে। বন্দুক পরিষ্কার করছিলেন তিনি। হাতের কাজ না থামিয়েই বললেন, ‘আমাদের মতো যন্ত্রেরও চোখ কান আছে। ওগুলোকে বলে সেন্সর। ওরা অনেক ধরনের সংকেত টের পায়, যেগুলো মানুষ পায় না। আর নিজেদেরকে ওরা চিনতে পারে। এর জন্য আলাদা সেন্সরও আছে।’

‘মাছের মতো তারাও সংকেত বোঝে?’

‘মাছের মতো মানে?’

‘মানে এই যে এ যন্ত্র থেকে যে সংকেত বের হয়।’

‘ও, ওটা তো একটা লো ফ্রিকোয়েন্সি সিগনাল প্রসেসর। হ্যাঁ, টের পাবে। ভালো কথা, ওটা ভুলেও চালু কোরো না। একবার টের পেলে দলবল নিয়ে হানা দেবে।’

‘না করবো না। কিন্তু আপনি এত কিছু কী করে জানলেন? ওহ আচ্ছা আপনি তো কোম্পানিতে..।’

‘হুম আমি ওটা তৈরির সময় দেখেছি। কিন্তু আমাদের জানানো হয়েছিল ওটা সামরিক কাজে লাগবে। দেশ রক্ষার জন্য। কিন্তু এখন নিজেদের মানুষই মারছে ওরা।’

রতন গভীর চিন্তায় ডুবে গেল। তবে তার চকচকে চোখ দেখে আর কেউ না হোক ফটিক ঠিকই বুঝেছে রতন এবার একটা কিছু দেখিয়ে ছাড়বে। হুট করে ফটিকের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন ছুড়লো রতন, ‘টুনু পাগলা! টুনু পাগলার বুদ্ধি কাজে লাগাতে হবে!’ এরপর রুস্তমের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আমার অনেকগুলো ছোট ছোট বাঁশ লাগবে। আর সেগুলো বাঁধার জন্য দড়ি লাগবে।’

রুস্তমেরও আগ্রহ বাড়ছে রতনের কথায়। ‘সবই আছে এখানে। যা যা লাগে নিয়া নাও। কিন্তু বানাইবা কী?’

‘ফাঁদ বানাবো! পাখি ধরার ফাঁদ!’

 

 

সায়েন্স ফিকশন উপন্যাস : মায়াদ্বীপ

১২

ভোরের দিকে ঘুমিয়ে পড়লো রতন। সারা রাত কাজ করেছে। আগে কোনো দিন না বানায়নি। তবে নিশ্চিত কাজ করবে ফাঁদটা। ঘুম দেখেই বোঝা যাচ্ছে সে কতটা নিশ্চিন্ত। ভোরের দিকে ঝুড়ি হাতে বাইরে গিয়েছিলেন শারমিন খালা। সঙ্গে পায়েল। সাবধানে হাঁটছে দুজন। শুকনো পাতায় পা পড়তেই থমকে দাঁড়াচ্ছে।

‘ছেলেটার বুদ্ধি আছে অনেক। ও মনে হয় না ক্লোন।’

‘হুম। ক্লোন হলেই যে বুদ্ধি কমে যাবে তা নয়। তোমারও তো ক্লোন আছে মায়াদ্বীপে। দেখলে না ফটিক কিভাবে মা মা বলে চেঁচিয়ে উঠলো।’

‘ক্লোন না মানে জিনেটিকেলি কিছু করা হয়নি। ওকে দেখে আমার বাবার কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। বাবাও এমন অদ্ভুত অদ্ভুত সব আইডিয়া নিয়ে ঘুরতো।’

দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন শারমিন খালা। পায়েল জানে কোম্পানির ফ্যাক্টরিতে কাজ করতে গিয়ে আর ফেরেননি শারমিন খালার বাবা। বেছে আছেন নাকি মারা গেছেন কেউ জানে না। তবে কোম্পানি যে কাউকে বাঁচিয়ে রাখবে না সেটা তো জানা কথা।

সৈকতের পাশে চলে এসেছে দুজন। এখনও গাছের আড়ালেই আছে। এদিকটায় কিছু ফলের গাছ আছে। বিশেষ করে কলা আর পেয়ারা পাওয়া যায়। গ্রামবাসীরাই লাগিয়েছিল। যাদের কেউই আর বেঁচে নেই। মেরে ফেলার পর লাশগুলোও নিয়ে গেছে কোম্পানি।

সমুদ্রে তাকাতেই থমকে গেল দুজন। পা দুটোকে মনে হচ্ছে ভারি পাথর। একটা মাঝারি আকারের জাহাজ দ্বীপের দিকে এগিয়ে আসছে। জাহাজের গায়ে কোম্পানির লোগোটা দেখা মাত্র চিনতে পারলো দুজন।

‘শারমিন খালা! এখুনি না দৌড়ালে দেখে ফেলবে!’

কিন্তু শারমিন খালার কানে কথাটা গেল না। ফলভর্তি ঝুড়ি হাতে ঠায় দাঁড়িয়ে আছেন। পায়েলের নিজের গায়েও যেন এক ফোঁটা শক্তি নেই। জাহাজটা আরেকটু কাছে আসতেই দেখতে পেল সামনের দিকে স্যুট টাই পরা দুজন লোক, দুজনের হাতেই দুটো ভয়ংকর রাইফেল। নিশ্চয়ই কোনোভাবে জেনেছে যে মাধবপুরে এখনও জীবিত কেউ আছে। নাকি রতন আর ফটিকের পিছু নিয়েই এসেছে? উত্তর জানার সময় নেই। এখুনি দৌড়াতে হবে!

এক ঘণ্টা কসরত করে ফাঁদটাকে জায়গামতো বসাতে পারলো রতন। ঢিবি থেকে সামনের দিকে। যেখানে এর আগে একটা কাঠবিড়ালিকে কাবাব হতে দেখেছিল। ফটিক আর বিল্টুও হাত লাগিয়েছে ফাঁদটাকে একটা মাঝারি আকারের গাছের ডালে বেঁধে রাখতে। রুস্তম গেছে পানির সন্ধানে। পায়েলের বাবা ঢিবির ওপর শটগান হাতে এদিক ওদিক তাকাচ্ছেন।

‘ফাঁদ তৈরি। পাখিটা এই কাঠির ওপর বসলেই ওপর থেকে খাঁচাটা পড়বে। আর খাঁচার ভেতর পাথরভর্তি একটা থলে আছে। ওটার চাপে পাখিটা সহজে উঠতে পারবে না।’

চিন্তায় পড়ে গেল ফটিক ‘কিন্তু পাখিটা এখানে বসবে কেন? এটাকে তো আর টোপ গেলাতে পারবো না। ওটা তো যন্ত্র।’

‘যন্ত্রের জন্য যন্ত্রই হবে টোপ। এই যে।’

হাতের মাছ ধরার সংকেত যন্ত্রটা দেখাতেই সব পরিষ্কার হয়ে গেল। এমন সময় পায়েল আর শারমিন খালাকে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসতে দেখে সতর্ক হলো সবাই। কাছে এসে ঘটনা খুলে বলতেই আর দেরি করলো না কেউ। সবাই ভেতরে ঢুকে পড়লো। রুস্তমও কলস ভর্তি পানি নিয়ে হাজির। কল চাপার সময় সেও জাহাজের শব্দ পেয়েছে। সবাই ভেতরে গেলেও পায়েলের বাবা বন্দুক হাতে ঢিবির দরজার মুখে উবু হয়ে বসে আছেন। রতন মাছ ধরার সংকেত দ-টা চালু করে জায়গামতো রেখেই ছুটে এলো ঢিবির ভেতর। পায়েল কয়েকবার বাবাকে ডাকলো। কিন্তু নড়ার ইচ্ছে নেই তার। কেন নড়ছেন না তার একটা কারণ অবশ্য আছে। কাউকে সেটা বলেননি।

মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই পরিচিত সেই যান্ত্রিক ডানার গুঞ্জন। ওড়ার জন্য এগুলোকে ডানা ঝাপটাতে হয় না। পেটের দিকে শক্তিশালী পাখা আছে। পাখিটা সোজা এগিয়ে আসছে টোপ বরাবর। মনে হবে যেন তরঙ্গের সংকেতই তার এক নম্বর শিকার। একদম জলের মতো কাজ করলো ফাঁদটা। সংকেত যন্ত্রটার ওপর বসে অগ্নিদৃষ্টি হানার আগেই ধড়াম করে পড়লো খাঁচাটা। ভারি পাথরের বস্তাটা চেপে বসায় দুটো ডানা দুপাশে ছড়িয়ে ভ্যাবাচেকা খাওয়ার মতো পড়ে আছে পাখিটা। এক ছুটে এগিয়ে গেলেন পায়েলের বাবা। পাখিটার লেজের দিকে গিয়ে দাঁড়ালেন। সামনে জীবন্ত কিছু পেলেই চোখ দিয়ে ভস্ম করে ফেলবে। বন্দুক উঁচিয়ে যান্ত্রিক পাখিটার পিঠ বরাবর তাক করলেন। ট্রিগার টানতে যাবেন এমন সময় দরজার পাশ থেকে চিৎকার ছুড়লো রতন, ‘না! এক মিনিট! ওটাকে গুলি করবেন না আংকেল! আরেকটা বুদ্ধি পেয়েছি। ওটাকে ধরে নিয়ে আসুন।’

পায়েলের বাবার চোখ কুঁচকে গেলেও গুলি করলেন না। আলগোছে খাঁচাটা সরিয়ে যান্ত্রিক পাখিটার পেটের দিকে হাত রাখলেন। পুরোটাই পাতলা কোনো সংকর ধাতু দিয়ে গড়া। সুইচটা পেতে দেরি হলো না। ওটা চাপ দিতেই থেমে গেল গুঞ্জন। এক অর্থে বলা যায় মারা গেছে পাখিটা। ফাঁদ থেকে মুক্ত করে ওটাকে নিয়ে এগিয়ে আসছেন পায়েলের বাবা। এমন সময় আচমকা পেছনে যেন বোমা ফাটলো। দাউ দাউ করে জ্বলে উঠলো ফাঁদটা। কাঁধে বন্দুক ঝোলানো। হাতে যন্ত্রপাখি। ছুট লাগালেন পায়েলের বাবা। টোপ থেকে বের হওয়া সংকেত পেয়ে কখনও যে আরো দুটো পাখি  হাজির হয়েছে টের পাননি। যেকোনো মুহূর্তে শক্তিশালী রশ্মি এফোঁড় ওফোঁড় করে দিতে পারে। তার আগেই দুদ্দাড় করে লাফিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়লেন পায়েলের বাবা। রতন দরজা লাগাতে যাবে তার আগেই মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়লো। হুড়মুড়িয়ে ধসে পড়লো দরজার ওপরের মাটির ছাদ। ধসে পড়েছে ঢিবির মুখ! রতন সরে যাওয়ার আগেই ডান পায়ে আছড়ে পড়লো মাটির চাকা। দারুণ চোট লাগলেও হাড় ভাঙেনি। হামাগুড়ি দিয়ে চলে এলো নিরাপদ দূরত্বে। একটা পাখির পেটে গোল কী যেন দেখেছিল। ওটার কারণেই বিস্ফোরণটা ঘটেছে। এমন ঘটনা জীবনেও দেখেনি রতন। ভয়ও পেয়েছে ভীষণ।

‘বোমা ছিল ওটা!’ বলল পায়েল। রতনের ডান পা ছিলে গেছে অনেকখানি। সেখানে ব্যান্ডেজ করছে শারমিন খালা। শান্ত হয়ে যাওয়া যন্ত্রপাখিটাকে মেঝেতে রেখে ধুলো ঝাড়ছেন পায়েলের বাবা। রুস্তম, ফটিক আর বিল্টু ধসে পড়া দরজায় বের হবার পথ পরিষ্কার করছে। মাটির স্তূপ সরাতে না পারলে একেবারে সত্যি সত্যিই জীবন্ত কবর হয়ে যাবে সবার। ঢিবির তলার এই আস্তানা ছেড়ে বের হবার আর রাস্তা নেই।

‘আংকেল সংকেত যন্ত্রটা কি বাইরেই রয়ে গেছে?’

নতুন আতংক ভর করলো পায়েলের বাবার চেহারায়। আতংক জিনিসটাই ছোঁয়াছে। বিপদের মাত্রা বুঝতে পেরে মুহূর্তে সবার মুখ পানসে হয়ে গেল। সংকেত যন্ত্রটা যতক্ষণ আছে ততক্ষণ ওটার আশপাশে ঘুর ঘুর করবে যন্ত্রপাখিগুলো। অন্যরাও এসে ভিড় করবে একটু পর। এমনকি কোম্পানির লোক দুটোর কাছে যদি সেন্সর থাকে, ওরাও চলে আসবে সংকেতের গন্ধ পেয়ে। ওদের শক্তিশালী রাইফেলের কাছে পায়েলের বাবার বন্দুক কোনো কাজেই আসবে না। বন্দুকটা তিনশ বছরের পুরনো বলেই ওটাকে এতদিন আগলে রেখেছিলেন। কখনও যুদ্ধ করার কথা ভাবেননি।

যান্ত্রিক পাখিটা বেশ হাল্কা। এ জন্যই উড়তে পারে। পেটের কাছে চালু করার সুইচ ছাড়াও আরেকটা লাল বোতাম আছে। ‘ওটা রেড এলার্ট। ওটা চালু করে দিলে অনেকগুলো সেন্সর কাজ করবে না। চোখের সামনে যেটা নড়বে সেটাকেই লেজার ছুড়বে।’

‘হুম, তাই তো বলি, একটা যন্ত্রপাখি কেন আরেকটা যন্ত্রপাখিকে আগুন ছোড়ে না।’

হুট করে বিদ্যুৎ খেলে গেল রতনের মাথায়। ঝট করে ফটিকের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘হাজুনি বুড়ির কথা মনে আছে! বুড়ির পোষা কাকটা কী কা- করে বেড়ায় জানিস তো?’ ফটিক মনে মনে খুশি হলেও কিছু ধরতে পারেনি। ‘আরে! বুড়ির মতো কাক দিয়ে কাক তাড়াবো আমরা!’

 

 

সায়েন্স ফিকশন উপন্যাস : মায়াদ্বীপ

১৩

প্রায় আধ ঘণ্টার চেষ্টায় দরজার কাছে মাটি সরিয়ে একটা বড় ফুটো করতে পেরেছে সবাই। হাঁপিয়ে গেছে ফটিক বিল্টু আর রুস্তম। পায়েলের বাবা পাখিটার মেরামত করতে ব্যস্ত। কয়েকটা ছোট ক্লিপ খুলে গিয়েছিল, ওগুলো আঠা দিয়ে জুড়ে দিয়েছেন। এখন সুইচ অন করতেই ভয়ানক এক খুনি হয়ে যাবে পাখিটা। ফুটো দিয়ে বাইরে তাকালো রুস্তম। ইশারায় জানালো অন্তত পাঁচটা যন্ত্রপাখি বসে আছে গাছের ডগায়। মাঝে মাঝে টহল দিচ্ছে। রতন আর পায়েলের বাবা ইশারায় কী যেন বলল। তারপর পাখিটাকে রতনের হাতে তুলে দিলেন তিনি। রতন প্রথমে ফুটো দিয়ে পাখিটার মাথা বের করে দিল। পেটের কাছে হাত দিয়ে খুঁজে নিল সুইচটা। ভেবে আর সময় নষ্ট করলো না। সুইচটা অন করেই বাইরে ছুড়ে দিল পাখিটাকে। ঝন ঝন শব্দ করে ওটা আছড়ে পড়লো দেয়ালের ওপাশে। বুকের মধ্যে ছ্যাঁৎ করে উঠলো সবার। পাখিটা বিকল হয়ে গেলে আর রক্ষে নেই। ওটাই এখন একমাত্র ভরসা। রতন ফুটো দিয়ে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে। পায়েলের বাবা মাথা নিচু করে আছেন। মেরামত হয়নি বোধহয়। বাকিরাও বুঝতে পেরেছে বড় ধরনের ঝামেলা হয়ে গেছে। পিনপতন নিরবতা ভাঙলো একটা যান্ত্রিক গুঞ্জন। রতনের পাশে দাঁড়িয়ে গর্তে চোখ রেখে বাইরে দেখার চেষ্টা করলো ফটিক। সেই ফাটালো বোমাটা, ‘পক্ষিটা উড়তাসে! ইয়াহু। এইবার খেলা জমবে!’

পরবর্তী পাঁচ মিনিট কানে আঙুল দিয়ে রাখলো সবাই। দরজার ফুটো দিয়ে খবর জানাল ফটিক। ‘সব কটা শেষ। আমাদের কাকটা বসে আছে। মনে হয় আর দম নেই। কিন্তু একটা সমস্যা আছে!’

‘কী!’ একসঙ্গে জানতে চাইল সবাই।

‘পাখিটা ঠিক দরজার দিকেই তাকিয়ে আছে। আর কোনোদিকে তাকাচ্ছে না। রতন! আর কোনো বুদ্ধি?’

পায়েল ঠোঁট কামড়ে কী যেন ভাবলো। এরপর ফটিককে দরজার সামনে থেকে সরিয়ে দিয়ে বাইরে তাকালো। ‘হুম, আমার একটা বুদ্ধি আছে। কাঁটা দিয়ে কাঁটা তুলবো এবার।’

ভেতরে বাঁশের অভাব নেই। একটা লম্বা ফালি নিয়ে তার আগায় লাল রঙের একটা কাপড় বেঁধে নিল পায়েল। রতন বুঝতে পারলো কী করতে যাচ্ছে। এগিয়ে গেল। ‘কাজটা আমি করি?’ পায়েল হাসলো। কিছু বলল না। ‘কেন? নিজেকে নায়ক প্রমাণ করতে চাও? হা হা। সরে দাঁড়াও।’ পায়েলের বাবা একটু দেরিতে বুঝতে পারলেন ঘটনাটা। ততক্ষণে দরজার ফুটো দিয়ে লাল কাপড় বাঁধা বাঁশটাকে বাইরে পাঠিয়ে দিয়েছে পায়েল। একছুটে পায়েলের হাত থেকে ওটা কেড়ে নেয়ার আগেই গুড়–ম করে শব্দ শোনা গেল দরজার ওপাশে। বাঁশের আগায় কাপড়টাকে নড়তে দেখে পাখিটা নিশ্চয়ই আগুন ছুড়েছে। কিন্তু এই আগুনে তো দরজার সামনে মাটির স্তূপ সরবে না!

পায়েলকে প্রচ- বকা দিতে যাবেন, তার আগেই গুড়–ম করে কেঁপে উঠলো পুরো ঘরটা। দরজার কাছে কিছুই হয়নি। তবে দেয়াল ঘেঁষে ছাদের ওপর ফুটো হয়েছে একটা। যন্ত্রপাখিটা ডিম পেড়েছে! দুদ্দাড় করে সবাই নিরাপদ দূরত্বে সরে গেল। দ্বিতীয় বোমাটা ফাটতেই মাথার ওপর আকাশটা স্পষ্ট হলো অনেকখানি। একটু পর যান্ত্রিক পাখা ঝাপটানোর ঝন ঝন শব্দটা আরো কাছে শোনা গেল। পায়েল একপাশের দেয়াল থেকে উবু হয়ে তুলে নিল তার অস্ত্র। তীরের আগায় শক্ত ধাতব পাত লাগানো। ধনুকটাকে টান টান করে ধরলো। দুপা এগিয়ে গেল। পাখিটার পেট দেখা যাচ্ছে। বাধা দিলেন না বাবা। তিনিও জানেন মেয়ের নিশানা মিস হবার নয়। ঘরের বাসিন্দাদের দিকে অগ্নিদৃষ্টিতে তাকাতেই ছুটে গেল তীর। মাথাটা একেবারে এফোঁড় ওফোঁড় হয়ে খুলেই পড়ে গেল। বাকি যান্ত্রিক দেহটা কিছুক্ষণ এলোমেলো ডানা ঝাপটে গর্তের মুখ থেকে আছড়ে পড়লো মেঝেতে। এবার আর ওটাকে বাঁচিয়ে রাখার দরকার মনে করলো না ফটিক। ছুটে গিয়ে গায়ের জোরে খুবলে নিতে লাগলো যন্ত্রপাখির নাটবল্টু।

এক ঘণ্টা পর। ভেতরে পড়ে থাকা বাঁশ দিয়ে একটা মই বানিয়েছে রুস্তম। সবার আগে পায়েলের বাবা বন্দুক বাগিয়ে উঠলেন ঢিবির ছাদে। এদিক ওদিক চোখ বোলালেন। কোথাও কোনো শব্দ নেই। বিক্ষিপ্তভাবে কয়েক জায়গায় শুকনো পাতা জ্বলছে। ঢিবি থেকে লাফিয়ে নিচে নামলেন। অনেকগুলো গাছ উপড়ে গেছে। আশপাশে যান্ত্রিক পাখিগুলোর ধ্বংসাবশেষ। গুনে দেখলেন, কমপক্ষে দশটা উড়ে এসেছিল। পা টিপে টিপে এগোচ্ছেন সুলতান। চোখ সামনের দিকে। খেয়াল করলেন না কখন পেছনে বন্দুক বাগিয়ে দাঁড়িয়েছে কোম্পানির এক লোক।

 

 

সায়েন্স ফিকশন উপন্যাস : মায়াদ্বীপ

১৪

টেনশনের ছাপ পায়েলের মুখে। বাকিরা অনেকটা নিশ্চিন্তে আছে।

‘বাবার এত দেরি হচ্ছে কেন?’

‘গিয়ে দেখে আসি।’

‘দাঁড়াও রতন, আমি যাচ্ছি। তুমি থাকো।’

তর তর করে মই বেয়ে উঠে গেল রুস্তম। আর আধ ফুট লম্বা হলে অবশ্য মইয়ের দরকার হতো না। উঠে এদিক ওদিক তাকালো। দেখা গেল না পায়েলের বাবাকে। উঠে সামনের দিকেই হাঁটতে শুরু করে দিল।

‘একদম নড়বে না। খুলি গুড়ো করে দেব!’ লোকটা পেছন থেকে না আসলে রুস্তম নির্ঘাৎ হামলা করে বসতো। পেছন থেকে আসায় চেহারাটা দেখারও সুযোগ হলো না। তার আগেই রাইফেলের বাটের প্রচ- আঘাতে চোখের সামনে দুলে উঠলো গোটা মাধবপুর।

রুস্তমের খোঁজ নেই দেখে দুশ্চিন্তা যেন লাফিয়ে দ্বিগুণ বেড়ে গেল পায়েলের। শারমিন খালা বললেন, ‘তোমার বাবাকে খুঁজছে এখনও। চিন্তা কোরো না।’

‘আমি যাচ্ছি।’ পায়েল মই বেয়ে উঠতেই তার পিছু নিল রতন। পেছন পেছনে বেরিয়ে এলো বিল্টু আর শারমিন খালা। পায়েলরা গেল সামনের দিকে, বাকিরা পেছনে। বাথরুম চাপায় আস্তানার ভেতরেই থেকে গেল ফটিক।

‘বাবা! বাবা! রুস্তম ভাই! হ্যালো!’ পায়েলের চিৎকারে সাড়া দিল না কেউ। সাগরের ঢেউয়ের শব্দ ছাড়া গোটা মাধবপুর যেন মৃত্যুপুরী।

রতনের মন বলছে, গ-গোল আছে এর মধ্যে। কোম্পানির লোক দুটো এদিকে আসেনি তো?

গাছের আড়াল থেকে ভয়ালদর্শন রাইফেলের নলটা বের হতেই সব পরিষ্কার হয়ে গেল।

পায়েলকে দেখে হাসলো লোকটা। রাইফেলের নল দেখে প্রথমে থমকে গেলেও দ্রুত ভাবতে শুরু করে দিয়েছে রতন। পায়েল চেনে লোকটাকে। ‘মিস্টার প্রলয় সাহা! বাবা কোথায়! কী করেছো তুমি?’

‘ওহ মাই লিটল প্রিন্সেস! তোমার বাবার যেখানে থাকার কথা, সেখানেই আছে!’

সাদা পোশাক পরা লম্বা মতোন লোকটার চিবিয়ে বলা কথাগুলো শুনে রতনের মনে হলো এ লোক চোখ বুঁজে মানুষ মেরে ফেলতে পারবে। মাথায় চকচক করছে টাক। তাতে একটা চুলও নেই। রতনের সঙ্গে চোখাচোখি হলো।

‘বাহ, ছোকড়াটাও আছে দেখছি! তুমি তো রীতিমতো সেলিব্রেটি। তোমার কীর্তির কথা গোটা কোম্পানি জানে। ভয় পেয়ো না, তোমাদের এখনই মারবো না। তবে সামান্য তেড়িবেড়ি করলেই…। আর তোমাদের বন্ধুদের পারলে সতর্ক করে দাও। যেদিকটায় গিয়েছে সেখানে আমজাদ খুঁজতে গেছে। সে আমার মতো অতোটা ভদ্রলোক নয়।’

পায়েল রতন কিছু বলার আগেই শোনা গেল শারমিন খালার চিৎকার। দুজনকে দুই হাতে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে আসছে কোম্পানির দ্বিতীয় লোকটা। রাইফেলটা পিঠে ঝোলানো।

‘বাহ, আরেক নায়কও আছে দেখছি। তখন তো দুজনে মিলে খুব নাকাল করেছো আমাদের। এখন একেবারে বেড়াল হয়ে গেছো! হে হে।’

বিল্টুকে ফটিক ভেবেই কথাটা বললো প্রলয় নামের লোকটা। ফটিককে না দেখে মনের কোণে ছোট্ট একটা আশা দেখলো রতন। এখন ওরা খুঁজতে নিচে না নামলেই হয়। রতনের ভাবনাটা শেষ না হতেই আমজাদ নামের দানবের মতো দেখতে লোকটা এক লাফে ঢিবির ছাদে উঠে গেল। মই বেয়ে নেমে গেল নিচে। কিন্তু মিনিট দুয়েক পর খালি হাতে ফিরতে দেখে আবার জ্বলে উঠলো আশার বাতিটা। নাহ, ফটিককে পায়নি শয়তানটা। কিন্তু ফটিক কি পারবে ওদের বাঁচাতে? আপাতত ভাবার সুযোগ নেই। সামনে পিছে রাইফেল বাগিয়ে হাঁটছে কোম্পানির লোক দুটো। মাঝে হাত বাঁধা চার জন। সৈকত ধরে হাঁটতে হাঁটতে একটা জেটি নজরে পড়লো। তার সামনে কোম্পানির বোটটা বাঁধা। সেখানেই উঠবে তারা। দ্বীপ ছেড়ে বাইরে নিয়ে যাবে না তো! বাজে চিন্তাটা ঝেড়ে ফেলল রতন। দ্বীপের বাইরে এভাবে তাদের নিয়ে গেলে ঝামেলায় পড়বে কোম্পানি। হয় তাদের এখানেই মেরে ফেলবে, না হয়…। ভাবনায় ছেদ পড়লো প্রলয় সাহার কথায়।

‘মিস পায়েল ও অন্যরা। তোমরা তোমাদের অতীতের দিন, সুখকর স্মৃতি, এসব ভাবতে শুরু করে দাও। সম্ভবত আজকের দিনটাই তোমাদের শেষ দিন। ততক্ষণ কেন তোমাদের বাঁচিয়ে রাখা হবে সেটা জানতে চাইলে ভদ্রলোকের মতো বোটে উঠে পড়।’

বাথরুম থেকে বের হয়েই ফটিক কাউকে পেল না। তবে দরজার কাছে এসে ফুটোয় চোখ রাখতেই সব বুঝে গেল। চটজলদি বুঝে উঠতে পারলো না কী করা উচিৎ। তবে এটুকু বুঝলো, এখুনি পালাতে হবে। কিন্তু কোথায়! মাটির তলায় কোনোরকম বানানো আস্তানা। কোনো রুম বা দরজার বালাই নেই। বাথরুমে ঢুকেও লাভ হবে না। সবার আগে সেখানেই খুঁজবে। ঘরের কোণে চোখ পড়তেই হাসি ফুটে উঠলো মুখে। মল্লযোদ্ধা সিরিজের প্রথম রোবটার এক পাশে এক ধরনের হাতল আছে। টান দিতেই পাশ দিয়ে দুভাগ হয়ে গেল। ভেতরে প্রচুর জায়গা। ঢুকে আবার ডালাটা লাগিয়ে দিলো। রোবটের পেট বরাবর থাকা ফুটোটা দিয়ে বাইরে চোখ রাখতেই দেখতে পেল ভয়ানক বন্দুক হাতে লোকটাকে।

এদিক ওদিক তাকিয়েই লোকটা বুঝতে পারলো বেশি খোঁজাখুঁজির দরকার নেই। ছাদের গর্ত বেয়ে চলে যেতেই রোবটের পেট থেকে বেরিয়ে এলো ফটিক। সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে গেল না। অপেক্ষা করলো একটা কিছুর জন্য। নৌকা স্টার্ট নেওয়ার শব্দ কানে আসতেই এক ছুটে বেরিয়ে এলো। নৌকাটা চলে যাচ্ছে। শব্দ শুনে বুঝলো উত্তরেই যাচ্ছে। দ্বীপটা উত্তর দিকে বেশ খানিকটা এগিয়েছে। তবে দ্বীপ ছাড়িয়ে চলে গেলে আর রক্ষে নেই। একা একা দ্বীপে আটকে থাকার চেয়ে বন্দি হওয়াই ভাল ছিল। হঠাৎ করে এক রাশ ভয় চেপে ধরলো ফটিককে। ভাবনা চিন্তার সময় নেই। নৌকার পিছু নেয়া চাই! আর এ জন্য আগে দক্ষিণে রেখে আসা নিজেদের নৌকাটার কাছে যেতে হবে।

দুই মিনিট লাগলো নৌকার কাছে পৌঁছাতে। ভেতরের সুইচে চাপ দিতেই বুঝতে পারলো মস্ত ভুল হয়ে গেছে। ব্যাটারির চার্জ শেষ! এক লাফে নৌকা ছেড়ে নামলে ফটিক। প্রবালে লেগে পায়ের সামান্য কেটেও গেছে। সেদিকে দেখার সময় নেই। মনে প্রাণে আশা করছে কোম্পানির নৌকাটা যেন দ্বীপেই থাকে। ঝোপঝাড় ঠেলে দুদ্দাড় করে ছুটছে ফটিক। চওড়ায় বেশি নয়। দ্বীপের পূব প্রান্তে যেতে মিনিট দশেক দৌড়াতে হবে। কোম্পানির নৌকা যদি চলে না যায় তবে পূব প্রান্তেই পাওয়া যেতে পারে। দৌড়াতে দৌড়াতে আচমকা আছাড় খেল ফটিক। ছিটকে গেল একটা ঢিবির ঢালে। যে বস্তুটা সঙ্গে পা জড়িয়ে গিয়েছিল উঠে গিয়ে সেটাকে লাথি মারবে ঠিক করলো। কিন্তু লাথি মারার আগেই চেপে বসলো কৌতুহল। হাত বাড়িয়ে কুড়িয়ে নিল গোলাকার নলওয়ালা ধাতব দ-টা। মনে পড়ে গেল সেই বন্দুকের কথা। তবে বন্দুকের নলের মতো চিকন নয় এটা। সামনের গোলাকার নলটা বেশ চওড়া। কাজে লাগবে ভেবে সঙ্গেই রাখলো। ফেলে দিল না।

অচেনা পথ ধরে হাঁটছে ফটিক। মায়াদ্বীপের সঙ্গে খুব একটা তফাৎ নেই মাধবপুরের। সেই মেঠো পথ, জলাভূমি, বাঁশ ঝাড়। তবে একটা ব্যাপার ধরতে পেরে দিনে দুপুরেও ভেতরটা কেঁপে উঠলো ফটিকের। রতন আর পায়েলরা ছাড়া মাধবপুরে এখন কেউ বেঁচে নেই! আশপাশে সুনসান নীরবতা। দুটো মাটির বাড়ি পার হয়ে এসেছে। কাকপক্ষীও নেই। কেবল শেয়াল চোখে পড়েছে কয়েকটা। দু চারটে গরু আর ভেড়াও দেখেছে। কিন্তু মানুষ না থাকাটা আসলেই ভয়ংকর। তারচেয়েও বড় কথা গ্রামের মানুষগুলোকে যদি কোম্পানি মেরেও থাকে, তবে লাশগুলো কোথায়?

বিকেল হয়ে গেছে। একটু পর সন্ধ্যাও হয়ে আসবে। আশপাশে অনেক বাসা আছে। একটায় ঢুকে পড়লেই হয়। কিন্তু গা ছমছম ভাবটা কিছুতেই কাটছে না। হাতের বন্দুকটা আরও জোরে আঁকড়ে ধরলো ফটিক।

একটা উঠোনের পেয়ারা গাছ থেকে পাকা পেয়ারা ছিড়ে খেতে শুরু করলো। খড়ের গাদার নিচে হেলান দিয়ে জিরিয়ে নেবে বলে ঠিক করলো। একটা পানির তোলার কলও পেয়েছে। ভাগ্যিস আস্তানা থেকে একটা বোতল নিয়ে এসেছিল। পেয়ারায় দ্বিতীয় কামড় বসাতেই বিপদ এসে হাজির। দুটো বিশাল সাইজের শেয়াল লাল লাল চোখ করে তাকিয়ে আছে। ফটিককে ঠিক পছন্দ করতে পারছে না তারা। আগুন চোখে হিং¯্রতা যেন উপচে পড়ছে। এক পা এগুলো শেয়াল দুটো। পেছনে তাকানোর সাহসও হলো না ফটিকের। এমন বিপদে জীবনেও পড়েনি। তাই বিপদের মাত্রাও বুঝতে পারছে না। শেয়াল কি মানুষ খায়? জানে না। জানলেও এই মুহূর্তে মনে পড়ার কথা নয়। লাল চোখ আর ধারালো দাঁত বের করা শেয়াল দুটো আরও দুপা এগিয়ে আসলো। ফটিকের ডান হাতের মুঠো স্বয়ংক্রিয়ভাবে শক্ত হয়ে গেল। আঙুলগুলো শক্ত করে চেপে বসেছে বন্দুকের মতো দেখতে দ-টার ট্রিগারে। পায়েলের বাবার কাছ থেকে শিখেছে কী করে এটা চালাতে হয়। কী হবে জানে না ফটিক। তবে ভরসা বলতে ওটাই। শেয়াল দুটো আর পাঁচ কি ছয় হাত দূরে। সামনের তাক করে দাঁত মুখ শক্ত করে টেনে দিল ট্রিগার। একটা মৃদু যান্ত্রিক বিপ শব্দ শুনলো। তবে কিছুই বের হলো নলের মুখ দিয়ে! 

 

 

সায়েন্স ফিকশন উপন্যাস : মায়াদ্বীপ

১৫

বোটটা থেমেছে একেবারে মাধবপুরের একেবারে উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে। বিশাল পরিমাণ ফাঁকা উঁচু নিচু জায়গার শেষ প্রান্তে একটা দুর্গের মতো বাড়ি। ওটাই কোম্পানির অফিস। বোট থেকে নেমেই বুঝতে পারলো রতন। বাকিরা আগে থেকেই চেনে জায়গাটা। দুর্গের সদর দরজায় একটা রোবট দেখতে পেল। তবে এটা আগেরটার মতো বিশাল নয়। ওটাকে মানুষের মতো নড়তে দেখে অবাক হলো রতন। আরও অবাক হলো অবিকল মানুষের মতো করে কথা বলতে দেখে। কোম্পানির দানবের মতো দেখতে লোকটা কী  যেন বলল রোবটটাকে। সঙ্গে সঙ্গে দরজা খুলে দিল ওটা। আর রতনরা যখন ভেতরে ঢুকছিল, পুরোটা সময় হাতের বিশাল বন্দুকটার নল ধরে রেখেছিল তাদের দিকেই। পায়েল ফিসফিস করে শুধু একবার বলল, ‘এটা খুব ভয়ংকর। সম্ভবত শিকারি-৩৪৬ সিরিজের। একটু তেড়িবেড়ি করলেই গুলি করে বসবে।’

রতনের সঙ্গে চোখাচোখি হলো শিকারি রোবটের। যান্ত্রিক চোখ দুটোর মাঝে দারুন এক খুঁতখুঁতে ভাব লুকিয়ে আছে। যেন মনের কথাও বুঝে ফেলার চেষ্টা করছে। রতন নিশ্চিত কাজটা রোবটকে দিয়ে হবে না।

ভেতরে ঢুকতেই একের পর এক বিস্ময় চেপে ধরছে রতনকে। অদ্ভুত এক পরিবেশ। গেইট থেকে আরও ভেতরে বড় একটা বাড়ি। বিচিত্রভাবে বানানো। বাঁশ, মাটি বা গাছের ডাল দিয়ে নয়। আরও শক্ত কিছু। দেখলেই ভয় জাগে।

‘পায়েল এটা কী? কোম্পানির অফিস?’

‘হুম। রাজপ্রাসাদ বলতে পারো। তবে এখন কেউ নেই। সবাই চলে গেছে।’

বাড়িটার গেইটের সামনের আরেকটা শিকারি রোবট। তাকেও কানে কানে কী যেন বলল প্রলয় সাহা নামের নেতাগোছের লোকটা। দরজা খুলে দিতেই ভেতরে ঢুকলো সবাই।

বিচিত্র সব চেয়ার, মোমদানি, আর বাতি দেখতে দেখতে এগিয়ে চলল রতনরা। পেছনে অস্ত্র হাতে আরেকটা রোবটকেও আসছে। ওটা আকারে ছোট। চোখও শান্ত। ফিসফিস করে পরিচয় জানিয়ে দিল পায়েল, ‘ওটার নাম ঈগল। মারাত্মক বুদ্ধি।’

‘যন্ত্রের আবার বুদ্ধি কীসের!’ কথাটা একটু জোরেই বলে ফেলেছে রতন। সঙ্গে সঙ্গে ঠং ঠাং শব্দ করে দৌড়ে এলো ঈগল। রতনের চোখে চোখ রেখে যান্ত্রিক কণ্ঠে বলল, ‘আমার সেলফ লার্নিং প্রোগ্রাম মানুষের চেয়ে তিন হাজার গুণ বেশি শক্তিশালী। আর তুমি যে টেবিলের ওপর থেকে অস্ত্র মনে করে যেটা নিয়েছো ওটা একটা মোবাইল ফোন। চাইলে ওটা রেখে দিতে পারো। ভয়ের কারণ নেই।’

রতন ধীরে সুস্থে ঢোক গিলল। ঈগলের চোখ তাহলে ঈগলের মতোই। একটা সরু গলির মতো পথ। মাথার ওপর বাতি জ্বলছে। পায়েলকে জিজ্ঞেস করায় উত্তর দিল।

‘মোবাইল ফোন দিয়ে দূরে থাকা মানুষের সঙ্গে কথা বলা যায়।’

‘ফটিকের সঙ্গে কথা বলা যাবে?’

‘নাহ। ওর কাছে তো ফোন নেই।’

‘একদম চুপ!’

আমজাদের ধমক খেয়ে আর কোনো কথা বলল না কেউ। প্রলয় সাহা একটা দরজার সামনে দাঁড়াতেই নিজে থেকে দুফাঁক হয়ে গেল দরজাটা। এসব যতই দেখছে ততই আরও রাগ জমছে রতনের। কোম্পানির লোকজনের কাছে কত কিছু! কত যন্ত্র! এসবের কিছুই ওরা পায়নি। নামও শোনেনি। এমনকি তাদের পড়ার বইতেও এসব নিয়ে কিছু বলা নেই। কোম্পানির লোকজন চায়নি ওরা সব জানুক।

রুমটার ভেতর বেশ আলো। মাঝখানে কয়েকটা চেয়ার পাতা। পাশে একটা বড় টেবিলের ওপর একগাদা যন্ত্রপাতি। তাতে আবার কয়েকটা চৌকোনো বাক্স দেখতে পেল। বাক্সের ভেতর ছবি নড়ছে। পায়েল রতনের কানে কানে বলল, ‘ওটা হলো কম্পিউটার। অনেক কাজ করতে পারে। আর এখন যা দেখছো সেটা হলো মূল ভূখণ্ডের রাজধানী ঢাকার ছবি। কোম্পানির লোকজন এখানে বসে কোথায় কী হচ্ছে সব দেখে। কেউ জানে না। সরকারও জানে না।’

‘হুম। সরকারটা কে?’

‘বাদ দাও। তোমার বুঝে কাজ নেই।’

আমজাদ কটমট করে তাকাতেই চুপ হয়ে গেল দুজন। পায়েলের বাবা হালকা করে কেশে নিলেন, ‘প্রলয়, তোমার প্ল্যানটা বলবে? মেরে ফেলার হলে তো আগেই মেরে ফেলতে। বাঁচিয়ে রাখতে না।’

টেকো মাথার লোকটা সামান্য হেসে আবার চুপ করে গেল।

‘ওহ সুলতান। তুমি এখনও বড্ড অস্থির রয়ে গেলে। তুমি জানো আমরা কীভাবে কী করি। কীভাবে কথা আদায় করি। অবশ্য এখন আর চিন্তা নেই। হাতে অনেক উপায় আছে।’

উপায় শব্দটা উচ্চারণ করার সময় প্রলয় সাহা একবার সবার দিকে মুখ ঘুরিয়ে ক্রুর হাসি হাসলো। সবাই বুঝে গেছে ব্যাপারটা। পায়েলের বাবা এমন একটা কিছু জানে যা কোম্পানির লোক দুটো জানে না। সেই কথাটা আদায় করার জন্য তারা দরকার হলে অন্যদের ওপর অত্যাচার চালাবে। পায়েলের বাবা বেশ স্বাভাবিক স্বরে বললেন, ‘দেখ, আমি একা হলে না হয় কথা ছিল। হয়তো বলতে চাইতাম না। কিন্তু এখন আমার মেয়েও তোমাদের হাতে বন্দি। আমি যদি সত্যিই জেনে থাকি, তবে কোডটা তোমাদের বলেই দিতাম। আমার মেয়ের জীবনের চেয়ে তো কোডটা বড় নয়।’

রতন এক বর্ণ বুঝতে পারছে না দুজনের কথাবার্তার। কীসের কোড নিয়ে কথা বলছে দুজন।

‘হুম। তুমি আসলেই বুদ্ধিমান। তুমি আমাকে বিশ্বাস করাতে চাইছো যে তুমি আসলেই জানো না। কিন্তু যদি জেনে থাকো? সেই ঝুঁকি আমি নিতে পারবো? সুতরাং তুমি যদি নাও জেনে থাকো, তবে তোমার মেয়ে এবং সঙ্গে আরও যারা আছে, তাদের আমি টর্চার করবোই। আর যদি বলে দাও তাহলে অন্তত তোমার মেয়েকে বাঁচিয়ে রাখবো কথা দিচ্ছি।’

সুলতানের চেহারাই বলে দিচ্ছে ঘোরতর বিপদে পড়েছেন তিনি। মনে মনে ভাবছেন অন্য কিছু।

‘দেখ কোডটা পেলে তোমরা একটা গণহত্যা চালাবে। এটা আমি হতে দিতে পারি না। আর…।’

‘ওকে। অনেক বক বক হয়েছে। তোমাকে কোডটা মনে করার জন্য এক ঘণ্টা সময় দিচ্ছি। ততক্ষণ পাশের রুমে গিয়ে একটু রিলাক্স হও। শত হলেও আমরা পুরনো কলিগ।’

আমজাদকে ইশারা করতেই সে অস্ত্র বাগিয়ে সবাইকে পাশের আরেকটা ঘরে নিয়ে গেল। এ ঘরে বসার জায়গা নেই। পুরোটাই খালি। আলোও কম। ওপরে একটা জানালা দিয়ে আলো আসলেও সেটা সূর্যের নয়। রতন জোরেসোরে ভাবতে শুরু করলেও এখন পর্যন্ত কোনো উপায় খুঁজে পায়নি। চারদিকে এত যন্ত্রের ভিড়ে সে খানিকটা অসহায় বোধ করছে।

ঘরের দরজা বন্ধ করে আমজাদ চলে যেতেই সবার কৌতুহল মেটানোর প্রয়োজন অনুভব করলেন পায়েলের বাবা সুলতান।

‘কোম্পানি তৈরি হয় আজ থেকে প্রায় দেড়শ বছর আগে। দেশে একটা বড় ধরনের বিপর্যয় লেগে যায়। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, যাই হোক, ওসব বুঝবে না। তারপর সরকারের একটা অংশ ঠিক করে দেশের যত কোম্পানি হবে সব তারাই চালাবে। আর কাউকে কোনো ব্যবসা করতে দেওয়া হলো না। সবাই হয়ে গেল এক কোম্পানির চাকরিজীবী। কিন্তু এ সিস্টেম বেশিদিন কাজ করলো না। নতুন করে অনেক কোম্পানি হলো ঠিকই। কিন্তু সরকারের ওই অংশের হাতে আগের সেই কোম্পানি রয়ে গেল। ইচ্ছেমতো গবেষণা আর ব্যবসা করতে লাগলো এরা। আমি নিজেও না বুঝে যোগ দেই।’

‘আংকেল ওরা জাহাজ বানায় কেন?’ রতনের প্রশ্নটা শুনে কিছুটা বিব্রত বোধ করলেন সুলতান। ধীরে সুস্থে বললেন, ‘ওরা সাবমেরিন বানায়, আবার রোবট যুদ্ধবিমানও বানিয়েছে। একটা ছোটখাট আর্মি গড়ে তুলেছে বলতে পারো। যুদ্ধ শুরু করলে ওদের সঙ্গে কেউ পারবে না। কোম্পানির ওপরের পদে যে লোকগুলো আছে ওরা কেউই সুবিধার নয়। তাদের কথায় সরকার ওঠে বসে। তবে কোম্পানির ব্যাপারটা এখন গোপন। সাধারণ মানুষেরা জানে না। জানলে সরকার বিপদে পড়ে যাবে। এই জন্যই তারা মায়াদ্বীপ আর মাধবপুরের মতো দ্বীপগুলোতে ফ্যাক্টরি তৈরি করে। এখানকার মানুষগুলোকে এক অর্থে বন্দি করে রেখেছে তারা।’

‘হুম। কিন্তু মানুষগুলো কোম্পানির চাকরি করে এত মজা পায় কেন বলতে পারেন?’

‘এখানেই তো ওদের চালাকি। বিজ্ঞানের গবেষণায় ওরা অনেক এগিয়ে গেছে। আমি নিজেও এ ধরনের গবেষণায় জড়িত ছিলাম। তবে একটুও বুঝতে পারিনি যে ওরা ব্রেইন সিম্যুলেটরকে এত বাজেভাবে ব্যবহার করবে। ওদের কাছে যন্ত্র আছে। ওটা মানুষের মাথায় ইচ্ছেমতো অনুভূতি তৈরি করে দিতে পারে। তারপর গোটা গ্রামে সেই তরঙ্গ ছড়িয়ে দিতে আছে বড় বড় টাওয়ার। ওগুলো দিয়ে চাইলে কোনো কারণ ছাড়াই খুশি কিংবা ভয় ঢুকিয়ে দিতে পারে ওরা।’

রতনের বাবা দম নিলেন। আবার বলতে শুরু করলেন, ‘এখন কোম্পানি বুঝে গেছে তাদের কাজ শেষ। তারা ঠিক করে প্রজেক্টগুলোকে নিশ্চিহ্ন করে দেবে। মায়াদ্বীপ আর মাধবপুর ছাড়াও আরও তিনটা গ্রাম ছিল। গ্রাম আছে ঠিকই, তবে মানুষ নেই। সবাইকে মেরে ফেলেছে কোম্পানি। লাশগুলোকে দূর সমুদ্রে ভাসিয়ে দেয়। কেউ টেরও পায় না। কোম্পানির অনেক সিনিয়র পর্যায়ের সিদ্ধান্ত ছিল এসব। আমার ডিউটি ছিল মাধবপুরে। মাধবপুরে হত্যাকা- শুরুর পরই খবর পাই আমি। কিছুতেই মেনে নিতে পারি না। চালাকি করে কোম্পানির অনেক যন্ত্রপাতি নষ্ট করে দিই। অনেক রোবটের কিল সুইচ অন করে দিয়ে অকেজো করে দেই। কিন্তু দেখতেই পাচ্ছো তোমরা, কাজটা আমি শেষ করতে পারিনি। তার আগেই ধরা পড়ে যাই। চালাকি করে পালিয়ে যাই আমি আর পায়েল। এই তোমাদের খুঁজে বের করে কোম্পানির নজরদারি আস্তানায় নিয়ে যাই। ততক্ষণে সবাই মারা গেছে ভেবে কোম্পানির লোকজন চলে যায়। কোনো বোট না থাকায় আমরা দ্বীপে আটকা পড়ি। এই সময় রতনরা এলো। রতনদের কারণেই সম্ভবত প্রলয় আর আমজাদ এখানে এসেছে।’

‘কিন্তু আংকেল কোডটা কীসের?’

পায়েলের বাবার অনেক কথা না বুঝলেও রতনের মাথায় কোড ব্যাপারটা গেঁথে গেছে। কোড দিয়ে নিশ্চয়ই ভয়ংকর কিছু ঘটবে।

‘কোম্পানির গণহত্যার কথা সরকার জেনে গেছে। এখন সরকারের ভেতর থেকে কোম্পানিকে চাপ দেওয়া হচ্ছে তারা যেন দ্বীপ দুটোকে ডুবিয়ে দেয়। দ্বীপ ডুবিয়ে দিতে হলে একটা কোড লাগবে। যে কোডটা ছিল কোম্পানির সবচেয়ে নিরাপদ একটা কম্পিউটারে। আমি ওটা নষ্ট করে দিয়েছি। এখন ওদের ধারণা কোডটা আমি জানি। অবশ্য আমি না বললেও ক্ষতি নেই। ওরা এমনিতেই বের করে ফেলবে। মাসখানেক সময় লাগবে তাতে। আর কোড মানে হলো একটা পাসওয়ার্ড। মানে গোপন সংকেত। দ্বীপের ঠিক মাঝখানে একটা ছোট কালো টাওয়ার স্টেশন আছে। এমনিতে চোখে পড়বে না। সেখানে একটা নম্বর লেখা বোর্ড আছে। সেই বোর্ডে কোডটা লিখে দিলেই আধ ঘণ্টার মধ্যে পানিতে তলিয়ে যাবে আস্ত দ্বীপ। ওরা এখন মায়াদ্বীপ ডুবিয়ে দিতে চায়। তাহলে কাজটাও সহজ হয়ে যাবে। মানুষ মারতে তাদের আর রোবট বা ড্রোন খরচ করতে হবে না। তাছাড়া ওসব সংখ্যায়ও কম।’

‘মানে আপনি এখন কোডটা দিয়ে দিলে ওরা সেটা মোবাইল ফোনে মায়াদ্বীপে পাঠিয়ে দেবে। আর সেখানকার কোম্পানির লোক সেই কোড দিয়ে আমাদের গ্রামটাকে ডুবিয়ে দেবে?’

রতনের চোখে মুখে দারুণ অন্ধকার এসে ভর করলো। মাথায় প্রচ- ব্যথা সত্বেও রুস্তম তাকে অভয় দিল, ‘আমরা এইডা হইতে দিমু না। জান দিয়া হইলেও কুম্পানিরে ডুবাইয়া মারুম।’ পায়েলের মনে একটা সূক্ষ্ম সন্দেহ আছে। তার ধারণা বাবা কোডটা জানে। কিন্তু কাউকে সেটা বলবে না। কিন্তু যদি কোম্পানির লোক পায়েলকে মেরে ফেলার হুমকি দেয়, বাবা নিশ্চয়ই কোডটা বলে দেবে। তখনই ঘটবে সর্বনাশ। পায়েল মনে মনে প্রার্থনা করছে, বাবা যেন সত্যিই কোডটা না জানে।’

পায়েলের কাছ থেকে পুরো ব্যাপারটা ধীরে ধীরে বুঝে নিতে শুরু করেছে রতন। দরজার নিচে একটা ছায়া নড়তে দেখলো। এতক্ষণ তাদের প্রতিটি কথাই শুনেছে কোম্পানির লোক। কথা শেষ হতেই ধড়াম করে দরজা খুলে ঢুকলো প্রলয় নামের লোকটা। এবার আর আমুদে ভাব নেই মুখে। জ্বলজ্বলে চোখে পায়েলের বাবার দিকে তাকিয়ে বলল, মিস্টার সুলতান তোমার সময় শেষ। আমি এক থেকে তিন পর্যন্ত গুনবো। সবাই হা করে তাকিয়ে আছে প্রলয় সাহার হাতে উঁচিয়ে ধরা বন্দুকটার দিকে। তার পেছনে রাইফেল বাগিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আমজাদ।

এক…। দুই…।

‘দেখ প্রলয় আমি জানি না! কসম! সত্যি!’

‘তিন..।’

পর পর তিনটা ব্লিপ শব্দ শুনতে পেল রতনরা। একটু পর মেঝেতে লুটিয়ে পড়লো শারমিন খালা। বিল্টু চেঁচিয়ে উঠলো। ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো পায়েল। বোকামিটা করলো রুস্তম। ঘোঁৎ ঘোঁৎ শব্দ করে তেড়ে গিয়ে আছড়ে পড়লো প্রলয় সাহার গায়ের ওপর। আরো একটা ব্লিপ শুনতে পেল সবাই। এরপর সব শান্ত। রুস্তমের নিথর শরীরটাকে একপাশে সরিয়ে গা ঝেড়ে বলল প্রলয় সাহা, ‘আর দশ মিনিট সময় দিলাম। এরপর ওই ছেলেটার পালা।’ বিল্টুর দিকে ইশারা করেই ঘুরে চলে গেল লোক দুটো। রতন এবার সত্যিই অসহায় বোধ করছে।

 

 

সায়েন্স ফিকশন উপন্যাস : মায়াদ্বীপ

১৬

কতক্ষণ চোখ বন্ধ করে রেখেছিল মনে নেই ফটিকের। হাতের যন্ত্রটা থেকে তখনও যান্ত্রিক শব্দ ভেসে আসছে। শেয়াল দুটো ছুট লাগাতেই চোখ বুজে চেপে ধরেছিল ট্রিগার। চোখে না দেখলেও শব্দ শুনে বুঝতে পেরেছে শেয়াল দুটো তার পাশ ঘেঁষে চলে গেছে। ফটিককে নিয়ে যেন তাদের বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা নেই এমন একটা ভাব করে চলে গেল। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাতেই দেখতে পেল শেয়াল দুটোকে। বিশ গজের মতো দূরে দাঁড়িয়ে ঘড়ঘড় করছে। তাদের দিকে তাক করে আবার ট্রিগার চাপতেই চোখে খুশির ঝিলিক খেলে গেল ফটিকের। যন্ত্রটা থেকে এমন একটা কিছু বের হচ্ছে যার কারণে শেয়াল দুটো ভয় পাচ্ছে ভীষণ। আর ভয়টা যে কোনো কারণ ছাড়া সেটাও পরিষ্কার। দুদ্দাড় করে দৌড়ে পালালো ওরা। বিশ্বজয় করেছে এমন ভাব করে দ্রুত উঠে দাঁড়ালো ফটিক। শেয়ালগুলোর মতো সেও বন জঙ্গল খাল পেরিয়ে ছুট লাগালো।

দশ মিনিট দৌড়েই হাঁপিয়ে গেল। বোতলের শেষ পানিটুকু খেতেই বামের আকাশে দেখলো সূর্য ডুবতে বসেছে। সামনে বিস্তীর্ণ মাঠ। মাঠের শেষ মাথায় একটা বিশাল বাড়ি। আর বাড়ির ওপারে সমুদ্র। কোণার জেটিতে ছোট্ট নৌকাটা দেখে ফটিকের মন থেকে বড় একটা বোঝা সরে গেল। ক্লান্তিটাও উবে গেছে। যাক রতনরা তাহলে ওই ঘরেই বন্দি আছে। হাতের অস্ত্রটার দিকে তাকালো একবার। নিজেকে নিজে বার বার বলে নিল, কোনো ভুল চুক নয়। একবারেই সফল হতে হবে। ধীরে সুস্থে এগিয়ে গেল ফটিক। অন্ধকার নামতেই ঝপ করে একগাদা বাতি জ্বলে উঠলো বাড়িটার চারপাশে। একটা বাতি আবার ডানে বামে নড়ছে। যেন নজর রাখছে মাঠের ওপর। ফটিকের টেনশন নেই। দুহাতে অস্ত্রটাকে পেছনে লুকিয়ে এগোচ্ছে সে। দরজার কাছে আসতেই দেখতে পেল পাহারাদার রোবটটাকে। হাতে বন্দুক নিয়ে তার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে। ফটিক আরো খানিকটা এগিয়ে আসতেই বন্দুক তাক করে এগিয়ে এলো শিকারি-৩৪৬। নিয়মমাফিক ভাঙা ভাঙা যান্ত্রিক কণ্ঠে বলল, ‘কোড বলুন।’

ফটিক হাসার চেষ্টা করলো। পারলো না। দেরি না করে পেছনের অস্ত্রটা তাক করলো রোবটের পেট বরাবর। ট্রিগারে চাপ দিল। কিছুই ঘটলো না!

‘কোড প্লিজ? এক মিনিটের মধ্যে কোড বলতে না পারলে অ্যারেস্ট করা হবে। স্যার আপনি যে ব্রেইন মেনিপুলেশন ব্যবহার করছেন সেটার সিরিয়াল নাম্বার আমার ডাটাবেজে আছে। আপনি কোড বলুন।’

মুহূর্তে আবার চুপসে গেল ফটিক। শেয়ালগুলো ছিল প্রাণী। আর এটাতো একটা যন্ত্র। যন্ত্রের ওপর অস্ত্রটা কাজ নাও করতে পারে। তবে মনে একটা ক্ষীণ আশা দেখতে পাচ্ছে। যন্ত্রটাকে তাকে স্যার বলে ডেকেছে। কারণটাও ধরতে পারলো সঙ্গে সঙ্গে। হাতের অস্ত্রটা কোম্পানির লোকেরাই ব্যবহার করতো। এটা দেখে রোবটটা তাকে কোম্পানির লোকই ভেবেছে। যন্ত্রগুলো আসলেই বোকা হয়।

‘ইয়ে, আমি কোম্পানির লোক। আর আমি কোড জানি না। ভুলে গেছি।’

‘আর ত্রিশ সেকেন্ড স্যার। এরপর আমি গ্রেফতার করতে বাধ্য হবো।’

‘ঠিকাছে ঠিকাছে, আমি গেলাম। কোড মনে করে আবার ফিরবো।’

‘ঠিকাছে স্যার। আপনি পঞ্চাশ গজ দূরে থাকুন স্যার।’

ফটিক মনে মনে বিরক্তই হলো। ভালোই বিপদ। এখন কোড পাবে কোথায়? দেয়ালটা কমসে কম দশ ফুট উঁচু। পেছন দিয়ে ঢোকার চিন্তা বাদ দিয়ে দিল। এক পাশে সমুদ্র। আরেকপাশে উঁকি দিয়ে দেখে এসেছে সেখানেও যান্ত্রিক গার্ড। অন্য কোনো উপায় ভাবতে হবে।

পঞ্চাশ গজের মতো দূরেই দাঁড়িয়ে আছে ফটিক। শীত লাগছে। আপাতত সহ্য করা ছাড়া উপায় নেই। আগুন ধরাতে হলে আবার সেই নিজেদের নৌকার কাছে ফিরে যেতে হবে। ওটা দক্ষিণ-পূর্ব দিকে। আর সে এসেছে উত্তর-পশ্চিম কোণে। একেবারে বিপরীত দিক। কী করবে ভেবে না পেয়ে হেঁড়ে গলায় রোবটটাকে ডাক দিল।

‘হেই, তোমার কি ব্যাটারির চার্জ শেষ হয় না?’

‘জ্বি স্যার। হবে। আর দুই ঘণ্টা বাকি।’

নাহ। দুই ঘণ্টা অনেক বেশি সময়। ভাবলো ফটিক।

‘তার আগেই চার্জ করাও। আমি আদেশ দিলাম।’

‘কোড না বলা পর্যন্ত আপনার আদেশ শুনতে আমি বাধ্য নই। আর চার্জ করতে গেলে দরজা বন্ধ করেই যাব। আপনি ঢুকতে পারবেন না।’

‘তোমার চার্জ শেষ হবে কেন? কোনো কাজ তো করতে দেখছি না।’

‘আমাকে অনেক কিছু প্রসেসিং করতে হয় স্যার। এই যে টহল দিচ্ছি এটাও এক ধরনের প্রসেসিং।’

‘প্রসেসিং মানে কী? চিন্তা?’

‘জ্বি স্যার। যত বেশি চিন্তা তত চার্জ শেষ।’

হুমম। মনে মনে ভাবলো ফটিক। রোবট গাধাটার মাথাটাকে ব্যস্ত রাখতে হবে। তাহলে তাড়াতাড়ি চার্জ শেষ হবে। আর চার্জ শেষ হলে যে-ই সে ভেতরে ঢুকবে তখনই একটা কাজ করতে হবে।

‘ঠিকাছে একটা প্রশ্নের জবাব দাও।’

‘কী প্রশ্ন বলুন স্যার!’

প্রশ্নের কথা শুনে মনে হলো রোবটটা খানিকটা খুশিই হলো। পাহারা দিতে দিতে সে সম্ভবত বিরক্ত।

‘বলতো কোন প্রাণী পানিতে এক পায়ে দাঁড়ায় আর মাটিতে দুই পায়ে হাঁটে?’

‘আমার ডাটাবেজে এমন কোনো প্রাণী নেই স্যার। আমি নেটওয়ার্ক সার্চ দিচ্ছি স্যার। হ্যালো, বেজ স্টেশন, শিকারি-৩৪৬ কপি ৫৪৮৫৬ কলিং, ইয়েস, কোন প্রাণী পানিতে দুই পায়ে…।’

ফটিক ভ্রƒ কুঁচকে কা- দেখছে। রোবটটা কার সঙ্গে কথা বলছে কে জানে! এভাবে মনে মনে কারো সঙ্গে কথা বলা যায় নাকি!

‘স্যার নেটওয়ার্কে উত্তর নেই। আমি গ্রাফ সার্চ করছি। এক মিনিট। নো অ্যানসার। স্যার আমি এনসাইক্লোপিডিয়া দেখছি… নো ম্যাচ। অনলাইন সার্চ.. নট ফাউন্ড।’

নিজে নিজে ইংরেজিতে বক বক করেই যাচ্ছে রোবটটা। ফটিক ভাবছে, করুক যত খুশি বক বক, চার্জ কমলেই হলো। বুদ্ধিটা কাজে এসেছে। দশ মিনিটের মধ্যে রোবটটার চোখের বাতি নিভু নিভু হতে দেখা গেল। টলতে টলতে সে দরজা খুলে ফিরে গেল। যাওয়ার সময় দরজা লাগাতে ভুল করলো না। এ সময়টার জন্য তৈরি ছিল ফটিক। কুড়িয়ে পাওয়া গাছের শক্ত লতাগুলো দিয়ে দরজা বরাবর একটা ফাঁদ বসিয়ে দিল। এমন ফাঁদ সে আগেও বানিয়েছে। বক ধরার জন্য। ধাঁধার উত্তরটাও যে বক!

মিনিট দশেক না পেরোতেই তরতাজা হয়ে ফিরলো শিকারি-৩৪৬ রোবট। দরজা খুলে বাইরে দাঁড়াতেই আড়াল থেকে লতার আরেক প্রান্ত ধরে টান দিল ফটিক। দুই পা জড়িয়ে ধড়াম করে আছড়ে পড়লো রোবটটা। নামে শিকারি হলেও এবার নিজেই শিকার হলো। এক আছাড়েই হাতের অস্ত্র ছিটকে পড়লো দূরে। শক্ত মেঝেতে পড়ায় ধাতব মাথাটা আর সামলাতে পারেনি। স্ফূলিংগ উঠছে। খানিক পর একেবারে নিস্তেজ হয়ে পড়লো। দেরি করলো না ফটিক। ছিটকে পড়ে যাওয়া বন্দুকটা হাতে নিয়ে দরজা খুলে ঢুকে পড়লো ভেতরে। তার মন বলছে সময় বেশি নেই। দরজার পরই বিশাল সমতল ভূমি। একটা রাস্তা গেছে সোজা বাড়ি পর্যন্ত। সেখানে গেটে আরেকটা রোবট দাঁড়িয়ে। এবার মেজাজ গেল বিগড়ে। ছুট লাগালো ফটিক। রোবটের অস্ত্র দিয়েই রোবটকে মারবে বলে ঠিক করেছে।

‘আমি আর গোনাগুনির মধ্যে নেই। সুলতান, এদিকে তাকাও! তুমি যদি কোড না বল তাহলে চোখের সামনে মেয়ের মৃত্যু দেখার জন্য তৈরি হও।’

‘আমি যা জানি না ওটা বলা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।’

চেঁচিয়ে উঠলো পায়েল, ‘বাবা! তুমি জেনে থাকলেও বলবে না! আমার একজনের চেয়ে একটা গ্রামের মানুষের জীবন অনেক বেশি দামি।’

হেসে উঠলো প্রলয় সাহা। ‘আমার মনে হয় না কথাটা ঠিক সুলতান, তাই না! প্লিজ আমাকে বাধ্য করো না গুলি করতে।’ রতন চুপচাপ বসে আছে। তার ধারণা ছিল প্রলয় সাহা আগে তাকেই গুলি করবে। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে তার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেছে। রুস্তম আর শারমিন খালার লাশ সরিয়ে ফেলেছে আমজাদ। মেঝেতে পড়ে থাকা রক্তের দিকে তাকিয়ে ভাবছে রতন। এভাবে মানুষ মানুষকে মেরে ফেলতে পারে এটা মায়াদ্বীপের মানুষ কল্পনাও করতে পারে না। বিল্টু একটু পর পর ফুঁপিয়ে উঠছে। শারমিন খালাকে সে মায়ের মতোই দেখতো। রতনের বিশ্বাস হচ্ছে না একটু পর পায়েলকেও মরে যেতে দেখবে। বন্দুকটা ভাল করে তাক করলেন প্রলয় সাহা। এখুনি গুলি করবেন। তার আগেই পায়েলের বাবা চেঁচিয়ে বললেন, ‘ঠিকাছে! স্টপ! বলছি!’

‘না বাবা!’

প্রলয় নামের লোকটা গায়ের সব শক্তি দিয়ে চড় বসিয়ে দিল পায়েলের গালে। তবে রুস্তমের মতো বোকামি করলেন না পায়েলের বাবা। তিনি শুধু জানেন তাকে বেঁচে থাকতে হবে যেকোনো উপায়ে।

‘কোডটা লিখে নাও বলছি।’

‘তুমি বল, আমার স্মৃতিশক্তি খারাপ নয়।’

পায়েলের বাবা ধীরে ধীরে কতগুলো সংখ্যা বলতে শুরু করলেন। রতন হা করে তাকিয়ে আছে তার দিকে। এই সংখ্যাগুলোই তাদের মায়াদ্বীপকে সমুদ্রের সঙ্গে মিশিয়ে দেবে! আর সংখ্যাগুলো অবলীলায় বলে যাচ্ছেন পায়েলের বাবা! এতগুলো মানুষের জীবন তার কাছে কিছুই না। ব্যাপারটা ধরতে পেরে পায়েল কাতর দৃষ্টিতে তাকাল রতনের দিকে। মাথা নিচু করে ফেলল রতন।

দশটার মতো সংখ্যা বলতেই চোখ কুঁচকে ‘স্টপ!’ বলে চেঁচিয়ে উঠল প্রলয় সাহা। ‘আমাকে গাধা ভেবেছো! কোডটার মধ্যে কোনো রিপিটেশন নেই। তুমি পর পর দুটো জোড়া বলেছ। আমার মনে হয় তুমি ভুল কোড দিচ্ছ! আই এম স্যরি সুলতান!’ ঘুরে ট্রিগারে চাপ দিতে যাবে, তার আগেই ঘটলো অদ্ভুত ঘটনাটা। দরজা খুলে হুড়মুড় করে ভেতরে ঢুকলো বিশালদেহী আমজাদ। ঢুকেই প্রলয় সাহার ওপর আছড়ে পড়লো। হাউ মাউ করে কাঁদছে পালোয়ানের মতো লোকটা! ধাক্কা খেয়ে প্রলয় সাহার হাত থেকে বন্দুক পড়ে গেল। হাত পা বাঁধা থাকায় রতনরা সেটা নিতে পারলো না বটে তবে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

‘স্যার! স্যার! ইঁ ইঁ ইঁ।’

বুড়ো মানুষের এমন বিচিত্র কান্না আগে দেখেনি ঘরে বন্দিদের কেউ। প্রলয় সাহাকে ছাড়ছেই না আমজাদ। ইনিয়ে বিনিয়ে বলছে, ‘স্যার আমার ডর লাগে! স্যার আমি বাড়ি যামু! স্যার আমারে মেরে ফেলবে!’ বিরক্তিতে চেহারা ভয়ানক হয়ে গেল প্রলয় সাহার। আমজাদের হাত থেকে নিজেকে ছাড়াতে পারছেন না। ‘কে মেরে ফেলবে তোকে! ছাড় আমাকে!’

‘আমি! আমি মেরে ফেলবো! তোকেও মেরে ফেলবো!’

‘ফটিক!’

একসঙ্গে চেঁচিয়ে উঠলো রতন বিল্টু আর ফটিক। ফটিকের হাতে সেই গোলগাল বন্দুকের মতো জিনিসটা। তাক করে আছে আমজাদ আর প্রলয় সাহার দিকে। প্রলয় সাহাও চুপসে গেছেন। একটু পর দুজনে দেয়ালের সঙ্গে সেঁটে গেল। দুজনেই থর থর করে কাঁপছে। ফটিক এক হাতে ভয় দেখানোর বন্দুকটা ধরে আরেক হাতে সবার বাঁধন খুলে দিল। সবার আগে খুলল সুলতানের বাঁধন। ছাড়া পেয়ে আর দেরি করলেন না। মেঝে থেকে প্রলয় সাহার বন্দুকটা তুলে তাক করতেই ট্রিগার থেকে আঙুল সরিয়ে নিল ফটিক। বাঁধন খুলতেই তাকে জড়িয়ে ধরলো রতন। কথা বলে কেউ আর সময় নষ্ট করলো না।

প্রলয় সাহার দিকে তাকিয়ে চাপা স্বরে বললেন পায়েলের বাবা, আমি একও গুনবো না। শুধু এটুকু বলছি, তোমাদের ওই ঈগল রোবটটাকে অকেজো করে দাও। না হয় এখুনি মরবে।

‘গুলি করা লাগবে না আংকেল। এতেই কাজ হবে।’ ভয় দেখানোর বন্দুকটা আবারো তাক করলো ফটিক। বিদ্যুৎ গতিতে আদেশ পালন করলো প্রলয় সাহা আর আমজাদ। দুজনের রাইফেল দুই হাতে ধরে রেখেছেন পায়েলের বাবা। তাকে দেখে পায়েল বলল, ‘বাবা তোমাকে তো একেবারে কমান্ডোর মতো দেখাচ্ছে।’

বরাবরের মতো প্রশ্ন ছুড়লো ফটিক, ‘কমান্ডো কী?’

পায়েল হাসলো, ‘ওসব পরে বোঝানো যাবে। অনেক কাজ বাকি। আমাদের আগে ফিউশন ব্যাটারি খুঁজে বের করতে হবে। তারপর ঢাকায় যাব সবাই।’

আপত্তি জানাল রতন, ‘উঁহু। আসল কাজ বাকি। মায়াদ্বীপে এখনও কোম্পানির অনেক লোকজন আছে। তাদের শায়েস্তা করতে হবে। আর তোমাদের সরকার যেহেতু চায় না কোম্পানির ব্যাপারটা প্রকাশ হোক, তাই আমার মনে হয় ঢাকায় গিয়েও লাভ হবে না। তবে হ্যাঁ, কী যেন বললে, ওই যে খবর জানিয়ে দেয়..।’

‘মিডিয়া?’

‘হ্যাঁ, ওদেরকে জানিয়ে দিতে পারো। আমরা চাই সবাই আমাদের কথা জানুক। সবাই জানলেই কাজ হবে। তাই তুমি আর আংকেল ঢাকায় যাও, আমরা তিন জন মায়াদ্বীপে যাব। বিল্টু আমাদের সঙ্গে যাক। ওকে দেখলে সবাই আমাদের কথা বিশ্বাস করবে।’

‘ঠিক বলেছো ছেলে! দারুন বুদ্ধি!’

রতনের প্রশংসা করে আর দেরি করলেন না পায়েলের বাবা। কোম্পানির লোক দুটোকে ভালো করে বেঁধে ফেললেন। ফটিককে বার কয়েক ভয় দেখানোর চেষ্টা করলো বন্দুক দিয়ে। সম্ভবত চার্জ শেষ ওটারও। কাজ করছে না। তবে এখন তারা নিরাপদ। রতনের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘এবার আমাদের মায়াদ্বীপ স্বাধীন করার পালা! তাই না রে!’

 

 

সায়েন্স ফিকশন উপন্যাস : মায়াদ্বীপ

১৭

প্রলয় সাহাকে দুটো ঘুষি মারতেই গড় গড় করে সব বেরিয়ে গেল। ফিউশন ব্যাটারি আর খাবার পেতে সমস্যা হলো না। একগাদা যন্ত্রপাতিও পেয়েছে। এর মধ্যে অনেকগুলোর কাজ রতন আর ফটিককে শিখিয়ে দিল পায়েল। বিশেষ করে স্যাটেলাইট মানচিত্র আর জিপিএস নামের দুটো যন্ত্র খুব পছন্দ হয়েছে রতনের। মানচিত্রের মধ্যে পুরো মায়াদ্বীপের কোথায় কী আছে সব দেখতে পাচ্ছে। এমনকি ফিরে যেতে হবে কী করে সেটাও বলে দেবে মজার যন্ত্রটা।

একটা ব্যাগে দরকারি যন্ত্রপাতি ভরে নিল। রোবট আর আমজাদের কাছ থেকে পাওয়া অস্ত্র দুটোও রতন আর ফটিক রেখে দিল। পায়েলদের নাকি অস্ত্রের দরকার নেই। এখন বন্দি দুজনকে নিয়ে কী করা যায় সেটাই ভাবছেন পায়েলের বাবা। মাথায় বন্দুক ঠেকিয়ে মেরে ফেলতেও বাধছে। যদিও ওরা অবলীলায় দুজনকে খুন করেছে। তবু এভাবে ঠা-া মাথায় মেরে ফেলা যায় না। বুদ্ধি দিল রতন। ‘এক কাজ করুন আংকেল। দুজনকে বেঁধে নৌকায় করে নিয়ে যান। মূল ভূখণ্ডে গিয়ে বিচার করবে সবাই।’ বুদ্ধিটা পছন্দ হলো পায়েলের বাবার।

কোম্পানির নৌকায় করে সবাই আবার ফিরে এলো মাধবপুরের দক্ষিণ সৈকতে। রতনদের নৌকাটা সেখানেই ভেড়ানো। নৌকায় ব্যাটারি লাগিয়ে ফিরে আসলো পুরনো সেই আস্তানায়। রাতটা এখানেই পার করে দিবে বলে ঠিক করলো। এদিকে দুই বন্দি হাত-পা বাঁধা অবস্থায় নৌকাতেই পড়ে রইল।

সকাল হতেই  দুই নৌকায় খাবার আর পানি বোঝাই করে নিল। রতন আর ফটিককে ইশারায় আলোচনার জন্য ডাকলেন। হাতে একগাদা কাগজপত্র। ঢিবির ওপর সমতল জায়গায় পা ছড়িয়ে বসলো তিন জন। একটা প্যাকেট থেকে একগাদা কাগজপত্র বের করে বোঝাতে শুরু করলেন পায়েলের বাবা সুলতান।

‘শোনো। কোম্পানির সব তথ্য এখানে আছে। এই যে প্রজেক্ট ২৪৫৬ মানে মায়াদ্বীপ। ওরা গ্রামটাকে একটা নাম্বার দিয়েই চেনে। তাদের হিসেবে দেখা যাচ্ছে মায়াদ্বীপকে ধ্বংস করতে ওরা আরও এক মাস সময় নেবে। কোড জানলে অবশ্য ভিন্ন কথা। মায়াদ্বীপের অফিসে কর্মী ছাড়া কোম্পানির একেবারে নিজস্ব লোক আছে মাত্র দশ জন। তবে ভেতরে পাহারাদার রোবট আছে অনেকগুলো। এই হলো ভেতরের নকশা। আর এই যে দেখছো টাওয়ার, এগুলো যত নষ্টের গোড়া। আগে এগুলো উড়িয়ে দিতে হবে। বিস্ফোরকের ব্যাপারটা মনে আছে তো?’

‘ইয়েস স্যার!’

রতন আর ফটিকের ব্যাগে তিনটা ছোট বাক্স দিয়েছেন পায়েলের বাবা। বাক্সের গায়ে লেখা সি-১০। অনেক শক্তিশালী বোমা। সঙ্গে কিছু আঠালো কাগজ। কিভাবে ব্যবহার করতে সেটাও শিখিয়ে দিয়েছেন। ওরা শুধু জানে, টাওয়ারের আগে বাক্সগুলো লাগিয়ে দূরে গিয়ে একটা যন্ত্রের সুইচ টিপলেই টাওয়ার বলে কিছু থাকবে না।

নকশাটায় আবারো চোখ বুলিয়ে নিল রতন। এক কোণায় একটা জেলখানাও দেখা যাচ্ছে। পরাণ নামের লোকটা নিশ্চয়ই সেখানে বন্দি।

বিকেল নামার আগেই তৈরি হয়ে নিল সবাই। রতন, ফটিক আর বিল্টু উঠে পড়লো রতনদের নৌকায়। বাকিরা উঠলো কোম্পানির নৌকায়। পায়েলের কাছ থেকে বিদায় নিল তিন কিশোর। বিদায়ের আগে পায়েল রতনকে মোবাইল ফোন ব্যবহার করা শিখিয়ে দিয়েছে। কোম্পানির অফিস থেকে নিয়ে আসা সেই ফোনটা রতনকে সারাক্ষণ কাছে রাখার কথাও বলে গেছে সে।

কয়েক দিনের মধ্যেই দেখা হবে, এমন প্রতিশ্রুতি দিয়েই নৌকা স্টার্ট দিলেন সুলতান। পায়েল হাত নেড়ে বিদায় জানাল। রতনরাও হাত নাড়লো। হাত নাড়তে গিয়ে খানিকটা কষ্টও লাগলো রতনদের। পায়েলের সঙ্গে এ কয়েক দিনে ভাল বন্ধুত্ব হয়ে যাওয়াতেই খারাপ লাগছে। তবে একটা ব্যাপার ভেবে খুশি সবাই। এতদিন তারা জানতো না যে মায়াদ্বীপের বাইরেও আরো গ্রাম আছে। আর সেই অজানা গ্রামের সঙ্গে তাদের দেখা হবে খুব তাড়াতাড়ি। এখন পায়েলের বাবা সময়মতো সাহায্য নিয়ে ফিরলেই হয়।

শক্ত ধাতব যন্ত্রের ভেতর জ্বলজ্বলে পর্দায় চলমান নকশা দেখে পথ চিনতে সমস্যা হচ্ছে না রতনদের। তবে এবার গতি বাড়িয়ে দিয়েছে অনেকখানি। বাতাসে সবার চুল সাপের মতো লিকলিক করছে। রাত হতেই যেখানটায় কোম্পানির সীমারেখা গুড়িয়ে দিয়েছিল, সেখানটায় চলে আসলো রতনদের নৌকা। কোথাও কেউ নেই। কোম্পানির লোকজন বোধহয় ধরেই নিয়েছে রতনরা আর ফিরবে না। তাই সীমানার বেড়া মেরামত বা পাহারা বসানোর দরকার বোধ করেনি। নির্বিঘেœ মায়াদ্বীপের দিকে ছুটে চলল রতনদের নৌকা। পায়েল যেটার নাম দিয়েছে বোট অব ফ্রিডম। মানে স্বাধীনতার নৌকা। রতন আর ফটিকের খুব একটা ভয় লাগছে না। পায়েলের বাবাও ঠিক কথা বলেছেন, একবার ভয় কেটে গেলে কোনো টাওয়ারেই আর কাজ হয় না। মানুষের মগজটা নাকি সময়ে সময়ে নিজেকে বদলে নিতে পারে। রতনের মনে ক্ষীণ আশা, কোনো না কোনোভাবে মায়াদ্বীপের সবার মগজ সে বদলে দিতে পারবে। 

 

 

সায়েন্স ফিকশন উপন্যাস : মায়াদ্বীপ

১৮

সূর্যটা সবে পশ্চিম দিকে হেলেছে। সন্ধ্যা নামতে আরও ঘণ্টা তিনেক বাকি। সময় বেশি নেই। কড়া রোদে চিক চিক করছে দক্ষিণ সৈকতের বালু। এদিকটায় নৌকা বাঁধার জেটি নেই। তাই কোনোমতে টেনেটুনে বালুতেই খুঁটি গেড়ে আটকে দিল নৌকাটা। সমুদ্রে মাছ ধরে ঝুড়ি হাতে বাড়ির পথ ধরেছে সেলু মাঝি। তিন কিশোরকে দেখে খানিকটা ভড়কে গেল। কারণ মাছটা যে জমা দেবে না বলেই ঠিক করেছিল।

‘সেলু মাঝি কী মাছ ধরলা?’ পাঁচ দিন পর নিজের গ্রামের পরিচিত মুখ দেখে গলা ফাটিয়ে ডাক দিল ফটিক। তার হাতের রাইফেল দেখে ভয় পেতে দেখা গেল না সেলু মাঝিকে।

‘ইয়ে মাত্র দুইটা গলদা ধরসি। তুমরা আবার কইয়া দিবানা তো? তা তোমার হাতে এইডা কী? বাহ তুমার দেখি যমজ ভাইও আছে।’

‘এইটা হলো বন্দুক। তীর ধনুকের মতো এটা থেকে ছোট পাথর বের হয়। অনেক জোরে।’

‘ওরে বাবা! তা এইটা দিয়া কী করবা?’

‘কোম্পানিরে উড়াইয়া দিবো ঠিক করসি। তুমি থাকবা আমাদের সঙ্গে?’

সেলু মাঝির চোখ দেখে মনে হলো সে জীবনেও এমন আজব কথা শোনেনি। বিড় বিড় করে কী যেন বলল বোঝা গেল না। মাছ নিয়ে হনহন করে জঙ্গলে অদৃশ্য হয়ে গেল। একটা ব্যাপার চোখ এড়ালো না রতনের। সেলু মাঝির হাতে একটা চুড়ির মতো কী যেন লেগে আছে। মাঝি যখন চলে যাচ্ছিল, জ্বলজ্বল করে জ্বলছিল ওই চুড়িটা। গ-গোলের আভাস পেয়ে সচকিত হয়ে গেল দুই কিশোর।

বাসায় ঢোকার আগেই আসল কাজটা সারতে হবে। গ্রামের সবাইকে জড়ো করতে হবে এক জায়গায়। আর কাজটা করতে প্রথমেই স্কুলে যেতে হবে। স্কুলের মাঠে জায়গায়ও আছে অনেক। তিন কিশোর দৌড় লাগালো স্কুলের দিকে। গ্রামটা অচেনা হওয়ায় বিল্টুর দৌড়াতে সমস্যা হচ্ছে। পথে অনেকে থামিয়ে কথা বলতে চাইলেও তিন কিশোর দাঁড়িয়ে সময় নষ্ট করলো না। শুধু ফটিক বলেই চলেছে, ‘জলদি কইরা স্কুল মাঠে আসেন সবাই। গ্রামে নতুন লোক আসছে।’ ইচ্ছে করেই এমনটা বলছে সে। নতুন লোকের কথা শুনলে সবাই আগ্রহ নিয়ে আসবে। সঙ্গে আরও দশ বারো জনকে নিয়ে আসবে।

স্কুলে পৌঁছেই দেখলো স্টোররুম তালা দেওয়া। রতন দেরি করলো না। হাতের রাইফেল দিয়ে তালাটা উড়িয়ে দিল। মাইকটা জুড়ে দিয়েই চেঁচিয়ে উঠলো। ‘প্রিয় মায়াদ্বীপবাসী সবাই স্কুল মাঠে চলে আসেন। যে যাকে পারেন তাকে সঙ্গে নিয়ে আসেন। গ্রামে নতুন মানুষ দেখতে আসেন।’

আধ ঘণ্টার মধ্যে স্কুল মাঠ কানায় কানায় ভরে গেল। এর মধ্যে দূরে কোণায় কয়েকজন কোম্পানির লোকও দেখতে পেয়েছে রতনরা। ওরা এগিয়ে আসছে না ভয়ে। কারণ রতন আর ফটিকের হাতে থাকা রাইফেলটা যে ভয়ানক অস্ত্র এটা তারা জানে। গ্রামবাসী জানে না বলেই কেউ ভয় পাচ্ছে না। তারা এসেছে মজা দেখতে। বিল্টুকে সামনে নিয়ে আসতেই হই চই শুরু হয়ে গেল। রতন মাইকে বলতে লাগলো, ‘এই যে দেখছেন এর নাম বিল্টু। এ এসেছে মাধবপুর গ্রাম থেকে। আমরা যাকে হারু মাঝি বলে এসেছি, সে আসলে হারু মাঝি না, সে ছিল পরাণ।’

ভিড়ের মাঝে অপুও ছিল। মনে মনে আঘাত পেলেও একটা উত্তর পেয়েছে সে। দীর্ঘদিন যে আধপাগলা লোককে বাবা বলে মনে করেছিল, সে আসলে তার বাবা ছিল না।

‘গ্রামবাসী, কোম্পানি আমাদের সবাইকে বোকা বানিয়ে রেখেছে। কোম্পানি আমাদের পরাধীন করে রেখেছে। আমরা মাধবপুরে গিয়েছিলাম। সেখানে সবাইকে মেরে ফেলেছে।’ রতন একে একে বর্ণনা করলো পুরো ঘটনা। তবে বর্ণনা করতে করতে একটা ব্যাপার খেয়াল করলো, ভিড়ের মধ্যে তেমন কোনো সাড়া নেই। সবাই প্রথমে বিল্টুর ব্যাপারে আগ্রহ বোধ করলেও পরে কোম্পানির প্রসঙ্গে আগ্রহ হারিয়ে ফেলল। রতন প্রথমে না বুঝলেও ফটিক এসে কানে কানে কথাটা বলতেই টের পেল আসল ঘটনা। মাঠে আসা অনেকের হাতেই জ্বলজ্বলে চুড়ি। চুড়িটার রঙ বদলে যাচ্ছে ঘন ঘন। কেউ কেউ রতনের দিকে আঙুল তুলে শাসাচ্ছেও।

‘অবস্থা সুবিধার নয়।’ বলল বিল্টু। ‘হুম আমাদের পালানো উচিৎ রতন। টাওয়ারগুলো ধ্বংস না করা পর্যন্ত কাজ হবে না।’

রতনরা দ্রুত স্কুলের বারান্দা থেকে নেমে গেল। এক দৌড়ে আবার বিল আর জলা পেরিয়ে দক্ষিণে চলে এলো। আসার সময় দেখতে পেয়েছে কোম্পানির লোক দুটো তাদের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে ছিল। তারা এখন কী করবে সেটাই দেখার বিষয়।

পুরোপুরি ব্যর্থ হয়নি রতনরা। গ্রামে একটা গুঞ্জন ছড়িয়ে গেছে। বিল্টুকে হাজির না করলে হয়তো কেউ পাত্তাই দিতো না। বিল্টুকে দেখে তারা আসলেই বেশ বিভ্রান্ত। কেউ কেউ ভয়ও পেয়েছে। তবে রতনের কাছেও ঘেঁষলো না কেউ। রতন আর ফটিকরা ঠিক করলো বিল্টু রতনের কাছেই থাকবে। তবে রতন মাকে বলবে ফটিক এসেছে থাকতে।

বাসায় ফিরেও অবাক রতন। মা কিছুক্ষণ তার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। দৃষ্টিতে প্রাণ নেই। রতন ভেবেছিল মা বুঝি দৌড়ে এসে তাকে কোলে তুলে নেবে। কিন্তু কিছুই হলো না!

‘কী রে রতন। কিছু খাবি? ক্ষিদা লাগসে? ফটিক তুমি বাসায় যাইবা না?’

‘না মা, ও থাকবে। তোমার কী হইসে?’

‘আমার আর কী হইবো। কিসুই হয় নাই। তোর বাপ কামে গেসে। আইতে রাইত হইবো।’

‘হুম।’ মায়ের হাতেও সেই চুড়িটা দেখতে পেল। গ্রামের আরও অনেকের হাতেও দেখেছে। পায়েলের বাবার কথাই ঠিক, টাওয়ার থেকে বের হওয়া সংকেত আর এই চুড়ি দিয়ে মায়াদ্বীপের মানুষদের নিজেদের কব্জায় নিতে শুরু করেছে কোম্পানি। কিন্তু এটা কতটা কাজ করবে সেটা এখনও ধরতে পারছে না রতন। পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ শুরু হবে রাতেই। কোম্পানি জেনে গেছে রতন আর ফটিক মায়াদ্বীপে বেঁচে ফিরে এসেছে। আজ রাতেই ওদের হয়তো ধরতে আসবে।

রাতে বাসায় ফিরে বাবাও একই রকম আচরণ করলো। সবাই যেন কোম্পানির সেই রোবটগুলোর মতো হয়ে গেছে। চোখে মুখে কোনো দুশ্চিন্তা বা আনন্দের ছাপ নেই। দুজনেই চুপচাপ। দরকার ছাড়া একটা শব্দও করছে না। হাতের চুড়িগুলোই নষ্টের গোড়া। বিছানায় শুয়ে শুয়ে ভাবছে রতন। চুড়িগুলো খুলতেই হবে।

চুপিসারে বিছানা ছাড়লো রতন। বিল্টু অঘোরে ঘুমাচ্ছে। তাকে জাগালো না। মা-বাবা দুজনেই অঘোরে ঘুমাচ্ছে। দুজনেই একই কায়দায় সোজা হয়ে শুয়ে আছে। বেড়ার ফাঁক দিয়ে চাঁদের আলো এসে পড়ছে মায়ের কপালে। আলোটা ঢেকে দিয়ে দাঁড়ালো রতন। ডান হাতের কব্জিতে সেঁটে থাকা চুড়িটার দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে আছে। সবুজ রঙের আভা ছড়াচ্ছে ওটা। তার মানে কোম্পানির লোক এসে পরিয়ে দিয়ে গেছে এটা। ফটিকের সেই ভয় দেখানো বন্দুকের কথা মনে পড়ে গেল। হাতটা ধরে টেনেটুনে দেখলো। সহজে খুলবে বলে মনে হলো না। ড্রয়ার থেকে কিছু যন্ত্রপাতি বের করে আনলো। বাবার একটা কাটার যন্ত্র খুঁজে পেল। ওটা দিয়ে খুলতে গেলে হাতে ব্যথা লাগবে না। তবে জেগে উঠতে পারে মা। অতশত ভেবে সময় নষ্ট করলো না রতন। কাটার হাতে আলতো করে চুড়িটা কাটতে শুরু করলো। নরম কোনো পদার্থ দিয়ে তৈরি। সহজে কাটছে না। তবে থামলো না রতন। কাটার জন্য যতই ঘষছে, ততই লাল আভা ছড়াতে শুরু করেছে চুড়িটা। হুট করে চোখ খুলে গেল মায়ের। বড় বড় চোখ করে রতনের দিকে তাকালেন। ‘কী করছিস রতন!’

মায়ের এমন কড়া গলা শুনে ভড়কে গেল রতন। কিন্তু চুড়ি কাটা থামালো না। অর্ধেকটা কেটে গেছে। হঠাৎ যা ঘটলো তার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিল না রতন। বাম হাতে প্রচ- জোরে থাপ্পড় বসিয়ে দিলেন রতনের মা। ভারসাম্য রাখতে না পেরে পড়ে গেল রতন। ঝপ করে উঠে দাঁড়ালো রতনের মা। দেখে মোটেই মনে হচ্ছে না যে তার কাঁচা ঘুম ভেঙেছে।

‘রতন তুই অন্যায় করছিস। কোম্পানি আমাদের সব কিছু। তুই কোম্পানির অবাধ্যতা করছিস!’

‘মা শোনো। চুড়িটা খুলে রাখি। তারপর তুমি যা বলবে তাই হবে। কোম্পানির কথামতোই চলবো।’

চিৎকার শুনে একই ভাবে ঘুম থেকে উঠে ঝট করে সোজা হয়ে দাঁড়ালেন রতনের বাবা মতিন। রতনের দিকে অগ্নিদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। তার চুড়িটাও জ্বলজ্বল করে লাল আভা ছড়াচ্ছে। রতন বুঝলো সময় নেই বেশি। কথা না বাড়িয়ে এক লাফে মায়ের হাতের চুড়িটা ধরে দুই হাতে হ্যাঁচকা টান দিল। ছিড়ে যেতেই নিভে গেল আলো। ধপ করে বিছানায় বসে পড়লেন রতনের মা।

‘কীরে বাবা! কী হইসে আমার! তুই কই ছিলি এতদিন?’

মায়ের স্বাভাবিক কণ্ঠ শুনে ভেতরে স্বস্তির ¯্রােত বয়ে গেল রতনের। কিন্তু বাবা! বাবা কোথায় গেল! এক ছুটে বেরিয়ে গেল রতন। ততক্ষণে উঠোন পেরিয়ে গেছেন বাবা। চাঁদের আলোয় আবছা দেখা গেল। ঝোপ মাড়িয়ে দুদ্দাড় করে ছুটছে বাবা। পিছু নিতে গিয়েও চিন্তাটা বাদ দিল রতন। সে জানে বাবা কোথায় যাচ্ছে। কোম্পানির লোকদের খবর দিতেই যাচ্ছে। বাবা এখন আগের বাবা নেই। রোবট হয়ে গেছে! ঘরে ফিরে গেল রতন।

রতন তার গুছিয়ে রাখা ব্যাগটা আবার পরীক্ষা করে নিল। পরিকল্পনা মাফিক দক্ষিণ টাওয়ারে যাবে আগে। আধ ঘণ্টা পর হন্তদন্ত হয়ে রতনদের উঠোনে এসে হাঁপাতে লাগলো ফটিক।

‘মা আর আপা পাগল হয়ে গেছে রে! আমারে আরেকটু হলে ধরে কোম্পানিতে নিয়ে যেত।’

‘চল কথা বলে সময় নষ্ট করা ঠিক হবে না। বিল্টু থাকুক ঘরে।’

চাঁদের আলোয় পথ দেখে চলতে সমস্যা হচ্ছে না। হাতের জিপিএস-এ স্পষ্ট জ্বলছে নিভছে টাওয়ারটা। তবে তার আগে একটা দুর্গম খাল পাড়ি দিতে হবে। পূর্ব দিকের সৈকতে সাধারণত কেউ যায় না। আর তাই ইচ্ছে করেই টাওয়ার বানানোর জন্য এদিকটাকে বেছে নিয়েছে কোম্পানি। মেঠো পথে চাঁদের আলোয় অদ্ভুত এক আলো-আঁধারি তৈরি হয়েছে। রতনের রাইফেলটা ব্যাগেই আছে। এখন বের করার দরকার নেই। ফটিক তবু তার ভয় দেখানোর বন্দুকটা উঁচিয়ে রেখেছে সামনে। কুকুর শেয়াল যা-ই পড়ছে তাকে ভয় দেখিয়ে তাড়াচ্ছে।

সামনে ঘন ঝোপ। ডিঙ্গিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। ডানে দক্ষিণের রাস্তা ধরে হেঁটে বাঁশঝাড় খুঁজে বের করলো। শীত বলে রক্ষা। তা না হলে কাদামাটিতেই আটকে যেত পা। এখন মাটি শুকনো। বেত গাছের ঝোপ পড়তেই বুঝলো খালের কাছাকাছি চলে এসেছে তারা। খালটা সোজা উত্তরে গিয়ে সমুদ্রের সঙ্গে মিশেছে। ¯্রােতবিহীন খালটা বেশ গভীর। হেঁটে পার হওয়া সম্ভব নয়। সাঁতার কাটতে গেলে কুমিরের ভয় আছে। পানিতে ভয়ের বন্দুকটা কাজ নাও করতে পারে।

খালের পাড়ে চাঁদের আলোয় দুই কিশোর চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। ওই পারে দানবের মতো দাঁড়িয়ে আছে টাওয়ারটা। চাঁদের আলো পড়ে ওটার মাথায় ঘুরতে থাকা চাকতিটা চকচক করছে। খানিক ভেবে শেষে সাঁতার কাটবে বলে ঠিক করলো রতন। ফটিক একটু উসখুস করছে। মোটাসোটা হওয়ার কারণে সাঁতারেও গতি কম। আর এদিকটায় কুমির আছে সন্দেহ নেই। ওদের যদি খিদা লাগে আক্রমণ করবেই।

‘রতন। একটা ভেলা বানাই।’

‘নারে! সময় নেই! আমার বাবাও গেছে কোম্পানিকে খবর দিতে। এতক্ষণে আমাদের খুঁজতে উড়ন্ত গাড়ি নিয়ে ওরা রওনাও দিয়ে দিয়েছে সম্ভবত। একবার ধরা পড়লে শেষ। মায়াদ্বীপ আর স্বাধীন হবে না।’

‘কিন্তু কুমিরের পেটে যাওয়াটাও তো সমাধান নয়।’

‘হুমম। ভাবছি। এক কাজ করলে কেমন হয়। আমি সাঁতার কাটবো, আর তুই উপর থেকে কুমিরগুলোকে ভয় দেখাবি।’

‘কিন্তু তাতে একটা ঝুঁকি আছে। তোর গায়েও তরঙ্গটা..।’

ফটিকের কথা শেষ হওয়ার আগেই ব্যাগ কাঁধে ঝুলিয়ে পানিতে নেমে গেল রতন। ফটিক হড়বড় করে বললেও একটা শব্দ কানে ঢুকলো না রতনের।

‘তোর গায়েও তরঙ্গটা লাগবে.. তুইও ভয় পাবি.. আর ভয় পেলে…।’

রতন ঝাঁপ দিয়েছে পানিতে। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই খালের দুপাশে পানিতে নড়াচড়ার শব্দ পেল ফটিক। সঙ্গে সঙ্গে তুলে নিল বন্দুক। কতদূর পর্যন্ত কাজ করবে জানে না। তারপরও তাক করে চেপে ধরলো ট্রিগার। সেকেন্ডের মধ্যে পানিতে মারাত্মক আলোড়ন তৈরি হয়ে গেল। হুটোপুটি শুরু করেছে এক ঝাঁক মাছ। তবে এগুলো যে মাছ নয় সেটা নিশ্চিত হয়ে গেল ফটিক। চাঁদের আলোয় খাঁজকাটা পিঠগুলোকে চকচক করতে দেখে ফটিকের পিঠেও কাঁটা দিয়ে উঠলো।

খালটা বড়জোর একশ ফুট চওড়া। এর মধ্যে চারভাগের এক ভাগ পার হয়ে গেছে রতন। নিজে সাঁতার কাটার কারণে পানির আলোড়নটা সেভাবে কানে এলো না। তবে বুঝতে পারলো একটা গ-গোল লেগেছে। পায়ে অনেক মাছের স্পর্শ পেল। পড়িমড়ি করে যেন ছুটছে সবাই। খানিক পর আকাশের চাঁদের দিকে চোখ পড়তেই আতঙ্কে জমে গেল রতন। চাঁদটাকে মনে হচ্ছে একটা শয়তানের মুখ। এখুনি গিলে ফেলবে। তারচেয়েও বড় কথা সাঁতার কিভাবে কাটতে হয় মনে পড়ছে না রতনের! দুহাত ওপরে তুলে খাবি খাচ্ছে। পেছনে ফটিকের চেঁচামেচি শুনতে পাচ্ছে। ‘রতন থামিস না। সাঁতরে যা! সাঁতরে যা!’ কিন্তু রতনের মনে হচ্ছে পৃথিবীটা একটু পর উল্টে যাবে আর সে পানির ওপর থেকে চলে যাবে সোজা পাতালে। ফটিককের কথাগুলোকে মনে হচ্ছে অশরীরি কোনো শেয়ালের চিৎকার। কিছুতেই সাঁতার কাটতে পারছে না রতন।

উপায় না দেখে ট্রিগার ছেড়ে দিল ফটিক। সঙ্গে সঙ্গে থেমে গেল যাবতীয় দাপাদাপি। রতনও বিভ্রান্তের মতো এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। ফটিক চেঁচিয়েই যাচ্ছে। ব্যাপারটা ধরতে দুই সেকেন্ড লেগে গেল রতনের। শুরু হলো প্রাণপণ সাঁতার। ভয় পেয়ে দূরে সরে গেলেও আবার ছুটে আসতে শুরু করছে কুমিরের দল। আর বিশ ফুট দূরেই পাড়। চাঁদের আলোয় পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে ওই পাড়ে ফুটে থাকা রক্তজবা আর নাম না জানা বুনো ফুল। আশার কথা হলো সেখানে অপেক্ষায় নেই কোনো কুমির।

টাওয়ারের গোড়ায় আঠালো কাগজ দিয়ে সি-টেন লেখা ছোট বাক্সটা বেঁধে লাল সুইচটা অন করে দিল রতন। কাজ শেষ। এবার নিরাপদ দূরত্বে ফেরার পালা। ফটিক খালের পশ্চিম পাড়ে আর রতন পুবে। ঠিক করলো দুজন দুদিক দিয়ে উত্তরে এগিয়ে যাবে। বিস্ফোরণের আগে অন্তত দুইশ গজ দূরে থাকতে বলেছেন পায়েলের বাবা। রতনের এগোতে সমস্যা না হলেও ফটিক বার বার আটকে যাচ্ছে।

মিনিট খানেক পর। উপরে শব্দ শুনে তাকাতেই নতুন আতঙ্ক ভর করলো দুজনের মনে। উড়ন্ত গাড়ির মধ্যে দারুণ শক্তিশালী বাতি লাগানো। ব্লিপ ব্লিপ শব্দ করে জঙ্গলের ওপর ইতিউতি আলো পড়ছে ওই গাড়ি থেকে। বোঝার বাকি নেই, দুই কিশোরকেই খুঁজছে কোম্পানির লোকগুলো। খালের পাড়ের জঙ্গলের কারণে ফটিককে সহজে দেখবে না, তবে রতনের দিকে আলো পড়তেই ধরা পড়ে যাবে। সেদিকেই যাচ্ছে উড়ন্ত গাড়িটার আলো!

‘রতন, মাথা নিচু করে শুয়ে পড়।’

রতনের কান পর্যন্ত পৌঁছায়নি ফটিকের সতর্কবার্তা। তার ভেতর এখন দারুণ রাগ জন্মেছে। এভাবে চোরের মতো থাকতে রাজি নয়। ব্যাগ থেকে রাইফেল বের করে নিল রতন। গুলতি দিয়ে অনেক নিশানা তাক করে এসেছে। বন্দুকে তাই কষ্ট করতে হয়নি। আলো বরাবর দুবার ট্রিগার টানতেই নিভে গেল বাতি। শব্দ শুনে মনে হলো বাতিটা ভেঙেই গেছে। রতনের সাহস দেখে নতুন করে সাহস পেল ফটিক। শুরু হলো মরণপন দৌড়।

‘ফটিক, আড়ালে লুকিয়ে পড়।’ রতনের কথা কানে আসতেই ফটিক বুঝে গেল কী ঘটতে যাচ্ছে। একটা বড় সেগুন গাছের আড়ালে গিয়ে বসে পড়লো ফটিক। রতনও চালাকি করে খালে গলাপানিতে নেমে পড়লো। পকেট থেকে রিমোট কন্ট্রোলার বের করে সুইচে চাপ দিতেই দিনের মতো আলো হয়ে গেল চারদিকে। যেন কয়েক সেকেন্ডের জন্য ধাঁধিয়ে গেল গোটা মায়াদ্বীপের চোখ। আধ সেকেন্ডের মধ্যেই শোনা গেল কান ফাটানো গর্জন। তারপর চাঁদের আলো ঢেকে দিয়ে আকাশে উড়ে গেল একটা মস্ত কালো ধোঁয়ার কু-ুলি। প্রথম মিশন সফল হলো দুই কিশোরের।

এদিকে দক্ষিণ পাড়ের গ্রামবাসীদের মধ্যে যারা কোম্পানির বিশেষ চাকতি পরে ছিল, তারা অবাক হয়ে বাইরের গোটা আলোকিত আকাশটা দেখলো। তারপর যখন ক্লিক শব্দ করে তাদের হাতের চুড়িটা খুলে নিচে পড়ে গেল তখন বুঝতে পারলো একটা বড় ধরনের ঘোরের মধ্যে ছিল তারা। ঘোর কেটে গেছে। এটাও বুঝে গেল আলোময় ওই বিস্ফোরণের সঙ্গে তাদের ঘোর কেটে যাওয়ার একটা জোরালো সম্পর্ক আছে। তারচেয়েও বড় কথা স্কুল মাঠে বলা রতনের কথাগুলো তাদের সবার মনে পড়তে লাগলো। এমনকী তারা সবাই নিজেদের বন্দি ভাবতে শুরু করে দিল। দক্ষিণপাড়ার গ্রামবাসীরা জড়ো হতে শুরু করলো স্কুল মাঠে।

 

 

সায়েন্স ফিকশন উপন্যাস : মায়াদ্বীপ

১৯

দুই মিনিট নাকি দশ মিনিট গেছে বলতে পারবে না রতন আর ফটিক। দুজনেই এখন খালের পুব পাড়ে। ঝিঁ ঝিঁ পোকার ডাকটাকেও মনে হচ্ছে যান্ত্রিক শব্দ। মাথায় যেন ঝিম ধরে না যায়, এজন্য টুকটাক কথা চালাচালি করছে দুজন। একটা উঁচু ঢিবির আড়ালে বসে আছে। দুইশ ফুট দূরে টাওয়ার। কিন্তু কাছে যাওয়া যাচ্ছে না। দুটো পাহারাদার রোবট পায়চারি করছে। দুজনের হাতেই অন্যরকম দুটো অস্ত্র।

‘এটা থেকে কী রকম গুলি হয় কে জানে?’ ফটিকের কথা চিন্তার খোরাক পেল রতন।

‘দেখি পরীক্ষা করে! একটা ঢিল দে।’

টাওয়ারের ডান পাশে একটা ঝোপ আছে। সেখানটায় ঢিল ছুড়লো রতন। সঙ্গে সঙ্গে ঘুরে গিয়ে ঝোপ বরাবর ট্রিগার টানলো দুই রোবট। তেমন কোনো শব্দ না হলেও ঝোপ পুড়ে ছাই। ঢোক গিলল দুই কিশোর। তবে সাহস হারালো না। এতদূর এসে ফিরে যাওয়ার মানে হয় না।

‘আচ্ছা, কোম্পানির কার্ড তো আছে আমাদের কাছে।’ বলল ফটিক।

‘কিন্তু আমার মনে হয় এগুলো এখন কাজ করবে না।’

‘মাধবপুরের ঘটনা কি ফাঁস হয়ে গেছে?’

‘হুম। কারণ মাধবপুরের প্রলয় সাহা আর আমজাদ নিয়মিত যোগাযোগ রাখতো মায়াদ্বীপে। ওরা ওদের কাছ থেকে খবর না পেয়ে..।’

‘আরে রাখ! একটা চান্স নিয়েই দেখি।’

ফটিকের চোখেমুখে অন্যরকম উত্তেজনা। এর আগে দুটো রোবটকে কুপোকাত করে তার সাহস বেড়ে গেছে অনেকখানি। ধীরে সুস্থে এগিয়ে গেল কোম্পানির কার্ড আর রাইফেল হাতে। তাকে দেখেই দাঁড়িয়ে গেল একটা রোবট। তার চোখ থেকে বেরিয়ে আসলো একটা আলোর ঝলক। অন্য রোবটটা প্রথমে দাঁড়িয়ে পড়লেও পরে পায়চারি শুরু করে দিল।

‘ফটিক! তুমি অপরাধী! তোমাকে গ্রেফতার করা হলো।’

চমকে গেল দুজন। রোবটগুলো সব জানে! এখন উপায়।

ফটিক ধীরে ধীরে কার্ড উঁচিয়ে ধরলো। রোবটের চোখ থেকে এক ঝলক আলো এসে পড়লো কার্ডের ওপর।

‘ইয়েস স্যার। অর্ডার স্যার!’

‘আমি চাই তুমি অস্ত্রটা ফেলে দাও।’

‘কিন্তু তুমি ফটিক! ইয়েস স্যার! নো স্যার! অর্ডার পালন করা সম্ভব নয়।’

ফটিক বুঝতে পারলো রোবটটার ভেতর ঝামেলা লেগে গেছে। আগের বুদ্ধিটা আবারো কাজে লাগানো যাক।

‘আচ্ছা ঠিকাছে। তুমি আমার প্রশ্নের জবাব দাও।’

‘আমি ফটিক… এর.. প্রশ্নের জবাব দিতে.. বাধ্য নই। স্যার… প্রশ্নটা কী?’

‘যদি একটা বাক্সে সব কিছুই থাকে তাহলে বাক্সটা কোথায় আছে?’

স্কুলে ধাঁধা বলায় বিখ্যাত ফটিক ভাল করেই জানে, এর উত্তর বের করা সম্ভব নয়। মাথায় গ-গোল লাগবেই।

‘বাক্সের ভেতর সব কিছু থাকলে বাক্সটাও সেই বাক্সের ভেতর আছে। কিন্তু স্যার.. বাক্সটা বাক্সের ভেতর থাকতে পারবে না। সুতরাং.. সুতরাং… সুতরাং…।’

ব্যস এতেই কাজ হয়ে গেল। রোবটটা মাথা ঝাঁকিয়েই যাচ্ছে। দ্বিতীয় রোবটটার তা নিয়ে ভ্রƒক্ষেপ নেই। ফটিক তার সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই ওটা বলল, ‘বাক্সটার ভেতর সব কিছু থাকা সম্ভব না। বুঝলে ফটিক। বুঝলেন স্যার। বুঝলে..।’

যাক, রোবটটা একটু বেশি বুদ্ধিমান হলেও এটাও ফটিক আর কোম্পানির লোকের মধ্যে গুলিয়ে ফেলছে। তাই ধরে নেয়া যায় সহজে গুলি করবে না। ফটিক তার ব্যাগে হাত ঢোকাবে, অমনি বুক বরাবর বন্দুক তাক করলো দ্বিতীয় রোবটটা।

‘দাঁড়াও! ইউ আর আন্ডার অ্যারেস্ট! ধীরে ধীরে ব্যাগটা নিচে রেখে টাওয়ারের দিকে মুখ করে দাঁড়াও। নড়াচড়া করলে আমি গুলি করতে বাধ্য হবো।’

ধীরে ধীরে ব্যাগটা রাখলো ফটিক। ‘কিন্তু আমি তো কোম্পানির লোক।’

‘এইমাত্র আমার কাছে তথ্য আপলোড হয়েছে। তোমরা কোম্পানির নও। তুমি ফটিক। টাওয়ারের দিকে মুখ করে শুয়ে পড়।’

ফটিক ভাবছে রতনের কথা। ও নিশ্চয়ই একটা বুদ্ধি বের করবে।

এদিকে ফটিকের বিপদ দেখে ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালো রতন। রোবটটার মাথা বরাবর তাক করলো রাইফেলের নল। পর পর দুবার ট্রিগার টানলো। ঠুং ঠাং শব্দ হলো। ঝট করে ঘুরে দাঁড়ালো রোবটটা। কিছুই হয়নি! এক লাফে পিছনে ডাইভ দিল রতন। আরেকটু হলে পুড়ে কয়লা হতো। সামনের ঢিবিতে থাকা ঝোপগুলো জ্বলছে। রতনের দিকে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে রোবটটা। বাঁচার উপায় দেখছে না রতন। ভাবলো চোখ বুজে পড়ে থাকবে। তার আগেই ঘটলো ঘটনাটা। মাটিতে ধুড়–ম করে আছড়ে পড়লো রোবটটা। হাত থেকে ছিটকে গেল অস্ত্র। পেছনে ওটার কাঁধে চেপে আছে ফটিক। রোবটের মাথাটা ধরে উল্টো দিকে ধরে টানছে। দেরি করলো না রতন। এগিয়ে গিয়ে রোবটের হাত থেকে পড়ে যাওয়া অস্ত্রটা কুড়িয়ে নিল। ইশারা করতেই সরে গেল ফটিক। রতন ট্রিগার টেনে ধরতেই বন্দুক থেকে ঝিলিক দিয়ে বের হলো লাল রঙা আগুন। ধোঁয়া বের হতে শুরু করলো রোবটের পেট থেকে। বাক্স ধাঁধার সমাধানে ব্যস্ত থাকা বিভ্রান্ত রোবটটাকেও মেনে নিতে হলো একই পরিণতি।

দ্বিতীয়বারের মতো মায়াদ্বীপ আলোকিত হতেই গ্রামবাসী বুঝে গেল একটা কিছু ঘটেছে। কোম্পানির কিছু লোকজনকে দেখলো দুদ্দাড় করে জেলেদের নৌকা নিয়ে পালাচ্ছে। ওদেরকে দেখে সাধাসিধেই মনে হলো। ততক্ষণে উত্তরের সৈকতে পৌঁছে গেছে রতন আর ফটিক। অবাক হয়ে কোম্পানির লোকজনের পালিয়ে যাওয়া দেখলো। কিন্তু এভাবে পালাচ্ছে কেন? রতন আর ফটিককে দেখেও তারা কিছু বললো না কেউ। কারো হাতে বন্দুকও নেই। এরা মনে হয় প্রলয় সাহা বা আমজাদের মতো নয়। দেখেই মনে হচ্ছে এরা কোম্পানির হয়ে কাজ করতো। মানুষ খুন করতো না।

উত্তর-পুবের সৈকতের পাশে খোলা মাঠ। ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে। এরইমধ্যে গ্রামের ছেলে বুড়ো নারী পুরুষ সবাই জড়ো হয়েছে মাঠে। সবার হাতে কিছু না কিছু আছেই। কেউ লাঠি তো কেউ দা বটি নিয়ে হাজির। বেশিরভাগের হাতেই বাঁশঝাড় থেকে কেটে আনা বাঁশ। রতন আর ফটিক ঘাবড়ে গেল। কোম্পানির কাছে যে ধরনের অস্ত্র তাতে এসব কিছুই নয়। তবে আশার কথা হলো কারো হাতে সেই চুড়িটা দেখা গেল না। সবাই একযোগে কোম্পানির অফিসের দিকেই যাচ্ছে। ভিড়ের মধ্যে গুঞ্জন। দুয়েকজনের কথা কানে এলো রতন আর ফটিকদের।

‘কোম্পানি আমারে খাবার দেয় নাই গত এক হপ্তাহ। ক্যান? আমি তো কাম করসি। খালি এক দিন না জিগাইয়া খাইসি। এইটা কেমুন কতা।’

‘কোম্পানির ওষুধ খাইয়া আমার বইন মরসে। আমি এতদিন বুজি নাই। এখন আর রক্ষা নাই। আইজকা কোম্পানির একদিন কী আমাদের একদিন।’

রতন আর ফটিককে দেখে ভিড় ঠেলে এগিয়ে এলেন রমাকান্ত স্যার।

‘কী রে! তোদের হাতে এটা কী? অস্ত্র? কীভাবে কাজ করে? আমাকেও দে দেখি।’

‘না স্যার এটা আপনি চালাতে পারবেন না। তাছাড়া গ্রামের সবাইকে সরে যেতে বলুন। কোম্পানি অনেক ভয়ংকর। এভাবে লড়াই করতে পারবে না কেউ। আমরা..।’

রতনের কথা শেষ না হতেই বিকট ঘড় ঘড় শব্দ করে খুলে গেল কোম্পানির অফিসের দরজা। সবাই থমকে দাঁড়াল। কেউ কিছু বলছে না।  কোম্পানির অফিসের গেইটের ওপাশ থেকে ঝন ঝন শব্দ শোনা যাচ্ছে। এগিয়ে গিয়ে উঁকি দিল ফটিক। উঁকি দিয়েই এক দৌড়ে চলে এলো ভিড়ের সামনে। একটা উঁচু ঢিবির ওপর দাঁড়িয়ে চিৎকার ছুড়লো। ‘সবাই ফিরে যাও! কোম্পানির রোবট আসছে! ওদের হাতে বন্দুক আছে! গুলি করবে! চলে যাও!’

ভিড়ের মধ্যে আবার গুঞ্জন, ‘বন্দুক! রোবট! এসব কী কয় পুলাডা! আমরা ফিরা যাব না! কোম্পানিকে কইতে আসছি আমরা আর কোম্পানি মানি না।’

দরজার ওপাশ থেকে রোবটের দল বের হতেই চূড়ান্তভাবে হতাশ হলো দুই কিশোর। চোখের সামনে এভাবে মায়াদ্বীপকে ধ্বংস হতে দেখবে এমনটা ভাবেনি। কোম্পানির গেইট দিয়ে গুনে গুনে দশটা রোবট বের হলো। প্রত্যেকেই আকারে বেশ বড়। আগেরগুলোর মতো মানুষ আকারের নয়। একেকটা কমপক্ষে পনের ফুট লম্বা তো হবেই। হাতের বন্দুকটাও বিশাল। পুরো মায়াদ্বীপকে শূন্য করে দিতে এমন একটা কি দুটোই যথেষ্ট। কিন্তু একি! বিস্ময় আর কষ্টে গলা ধরে এলো রতনের। গ্রামবাসী  পিছু হটছে না। রোবটটরাও অস্ত্র বাগিয়ে প্রস্তুত। সবাই দুদ্দাড় করে হাতের লাঠি দিয়ে রোবটকে মারার জন্য দৌড় দিল। শুরু হলো লোমহর্ষক দৃশ্য। নির্বিচারে গুলি শুরু করেছে রোবটের দল। সামনের সারির বিশ পঁচিশ জন সঙ্গে সঙ্গে লুটিয়ে পড়লো মাটিতে। তবে মারা গেল না। সবাই কেমন যেন পাগলের মতো হাত-পা ছোড়াছুড়ি করে কাঁপছে। বিদ্যুতের শক লাগলে যেমনটা হয়। একটু পরই সবাই ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল। এক জন কি দুই জন রোবট পর্যন্ত পৌঁছাতে পেরেছে। কিন্তু ধাতব শরীরে বাঁশের লাঠি কিছুই করতে পারলো না। খানিক পর তারাও গুলি খেয়ে কাঁপতে শুরু করলো। রতন আর ফটিক বসে নেই। ঢিবির আড়াল থেকে একটা রোবটের পেট ফুটো করে দিতে পেরেছে। তবে বাকিগুলোকে এগিয়ে আসতে দেখে তারাও পিছু হটতে বাধ্য হয়েছে।

রতন ভাবছে তার বাবার কথা। মা তো বাড়িতে। বাবা কোথায়? আরে!

খোলা মাঠে অগনিত মানুষ শুয়ে আছে। রতনের দেখে মনে হলো কেউ মারা যায়নি। সবাই জ্ঞান হারিয়েছে।  যারা পেরেছে তারা পালিয়ে গেছে। রতন আর ফটিকের ইচ্ছে নেই পালিয়ে যাওয়ার। পালিয়ে যাবেই বা কোথায়। কোম্পানির কথামতো না চললে পরদিন আবার মারবে।

উত্তরের সৈকতে দৌড়ে গেল দুই কিশোর। যাওয়ার সময় কোম্পানির অফিসের দেওয়াল লক্ষ্য করে দুয়েকটা গুলি ছুড়তে গিয়ে দেখলো গুলি বের হচ্ছে না। হাতের অস্ত্রটা ছুড়ে ফেলে দিল ফটিক।

একটু পরই সকাল হবে। কোম্পানির কারখানায় কাজ শুরু হবে একটু বাদে। কারখানায় কাজ করতে না গেলে কী হবে কে জানে! রতন আর ফটিক উত্তর সৈকতের সেই খালের মাথায় ঝোপের আড়ালে বসে আছে। এমন সময় রতনের ব্যাগে যান্ত্রিক গুঞ্জন শুনতে পেল দুজন। ব্যাগ খুলতেই দেখলো মাধবপুরে কোম্পানির অফিস থেকে চুরি করে নেয়া মোবাইল নামের যন্ত্রটা থেকে শব্দ আসছে। পায়েলের শিখিয়ে দেওয়া সেই সুইচটায় চাপ দিয়ে যন্ত্রটাকে কানে ধরলো রতন। ওপাশ থেকে পায়েলের গলা শুনতেই চমকে উঠলো।

‘রতন শুনতে পাচ্ছো?’

‘হ্যাঁ! হ্যাঁ! পায়েল! তোমার কথা এর ভেতর ঢুকলো..।’

‘শোনো এসব পরে হবে। আগে বলে রাখি, আমরা ভোরে পৌঁছেছি। বাবা সরকারের সঙ্গে আলাপ করেছে। কিন্তু কেউ রাজি হয়নি। সরকার সম্ভবত চেপে যেতে চায়। আর খারাপ খবরটা হলো সরকারের ভেতর বাবার এক বন্ধু আছে। সে জানতে পেরেছে সম্ভবত আজকের মধ্যেই মায়াদ্বীপ প্রজেক্ট পুরোপুরি বাতিল করবে কোম্পানি।’

‘ওরা তো গুলি করলো আমাদের!’

‘সত্যিই করেছে?’

‘গুলি না গুলির মতো। সবাই জ্ঞান হারিয়েছে।’

‘হুম। ওটা গুলি নয়। ওটা ইলেকট্রিক শক। কোম্পানি গুলি করবে না। কারণ করলেই স্যাটেলাইটে ধরা পড়বে। এরইমধ্যে দুটো বিস্ফোরণ নাকি ধরা পড়েছে। তাই সময় বেশি নেই। সমুদ্র নিরাপত্তা বিভাগে বাবার কিছু বন্ধু আছে। তাদের সঙ্গে আলাপ করবে বলল। তারা যদি কিছু করতে পারে। তবে সরকার না চাইলে সম্ভব না। তবে আমি মিডিয়াকে জানিয়েছি পুরো ব্যাপার। ওরা আসতে পারে। ওরা আসলে আর যাই হোক, গণহত্যা চালাতে পারবে বলে মনে হয় না। তবে দ্বীপটাকে চাইলে….।’

পায়েলের কথা অস্পষ্ট হয়ে গেল। রতন কয়েকবার পায়েল! পায়েল! বলে চেঁচালো। ফটিকও ডাকলো। কিন্তু লাভ হলো না। তার আগেই রতন দেখলো তার হাতের যন্ত্রটার আলো নিভে গেল। সুইচগুলোতে চাপ দিয়েও কাজ হলো না। ‘মনে হয় চার্জ শেষ।’ ব্যাপারটা ধরতে পারলো ফটিক। তবে দুই কিশোরের মনে ক্ষীণ আশা জন্মালো পায়েলদের কাছে বিকল্প একটা কিছু আছেই। আপাতত দুজন রতনদের বাসায় চলে যাবে বলে ঠিক করলো।

দুর্গম খালের পাড় দিয়ে পাড়ি দেওয়ার সময় এটা ওটা ভাবছিল দুই কিশোর। কী করে রোবটগুলোকে শায়েস্তা করা যায় অনেক ভেবেও কুল পাচ্ছে না দুজন। ফটিক বলল, ‘চল চুরি করে ভেতরে ঢুকি।’

‘নারে পায়েলের বাবা কাজটা করতে মানা করেছেন। উনি কী সব সেন্সর যন্ত্রের কথা বলেছেন। কোম্পানি টের পেয়ে যাবে।’

খাল পেরিয়ে পথ ধরতেই কান্নার শব্দ। ভারি হয়ে গেল দুই কিশোরের মন। তারাই তো এ যুদ্ধের শুরু করেছে। অবশ্য গ্রামবাসীও চেয়েছিল যুদ্ধ করতে। তারপরও খানিকটা অপরাধবোধ কাজ করছে দুজনের মনে।

আসতে আসতে জানতে পারলো সব মিলিয়ে চল্লিশ জন জ্ঞান হারিয়েছে। তাদের মধ্যে দুয়েকজনের হুঁশ এখনও ফেরেনি। তবে অবাক করা ব্যাপার হলো এতবড় ঘটনা ঘটে যাওয়ার পরও কোম্পানির পক্ষ থেকে কোনো সাড়া শব্দ নেই। কেউ কাজে যায়নি দেখেও কোনো শোরগোল নেই। রকি কাকুর কাছ থেকে জানা গেল, তিনি নাকি কোম্পানির আরও কয়েকজন লোককে নৌকা করে পালাতে দেখেছেন। কথাটা শুনে মনের কোণে একটা ভয়ানক আশংকা তৈরি হলো রতনের। কোম্পানি নিজেকে গুটিয়ে ফেলছে না তো? তাই যদি হয় তবে সবাইকে মারার জন্য হামলা করছে না কেন? কোম্পানির তো অনেকগুলো রোবট যোদ্ধা আছে। নাকি আরও বড় কোনো পরিকল্পনা আছে..। ঝট করে ব্যাপারটা ধরতে পারলো রতন। কোম্পানি সরাসরি গোলা গুলি করতে চায় না। কারণ স্যাটেলাইট নামের যন্ত্রটার কারণে ধরা পড়ে যাবে। তারা যে দুটো টাওয়ার উড়িয়ে দিল সেটা পায়েল জানলো কী করে? নিশ্চয়ই ওই স্যাটেলাইট দিয়ে। তার মানে কোম্পানি বিকল্প কিছু ভাবছে।

‘ফটিক!’

‘কী!’

‘মহাবিপদরে! কোম্পানি দ্বীপটাকে ডুবিয়ে দেবে!?’

‘কিন্তু কোড ছাড়া ডোবাবে কী করে?’

‘এই দ্বীপের কোড তো তারা জানে। মাধবপুরের কোড জানতো পায়েলের বাবা।’

‘তারমানে এখন দ্বীপের ঠিক মাঝে কেউ একজন আসবে কোডটা লিখতে। কিন্তু দ্বীপের মাঝখান কোনটা বুঝবো কী করে? জায়গাটা পেলে ওখানে গিয়ে ঘাপটি মেরে বসে থাকবো। কেউ এলেই ক্যাঁক করে ধরবো। আগে চল বাসায় যাই। বিল্টু বেচারা কী করছে কে জানে!’

রতনদের বাসায় যেতেই ফটিককে জড়িয়ে ধরলেন রতনের মা।

‘বাবা ফটিক! তুই ঠিক আছিস! আহা! আমি চিন্তায় চিন্তায় শেষ। কোম্পানির লোক তোকে মারেনি তো? এদিকে রতনের বাবারও খবর নাই। কাইল রাতে রতন যাওনের পর কই থেইকা এক মানুষরে নিয়া আসলো। হ্যায় ফটিকরে জোর কইরা নিয়া গেল। সেই যে গেল আর আইল না।’

একে অন্যের মুখের দিকে তাকালো রতন আর ফটিক। বিল্টুকে ফটিক ভেবে কোম্পানির লোক তুলে নিয়ে গেছে।

‘বাবা ফটিক! রতনের বাবার কোনো খোঁজ জানো?’

‘ইয়ে খালা, আমি জানি না।’

বিল্টুর ব্যাপারটা চেপে গেল দুজন। তবে এসব ভেবে সময় নষ্ট করা যাবে না। আগে খুঁজে বের করতে হবে দ্বীপের  ঠিক মাঝের জায়গা কোনটা। তারপর দরকার হলে সি-টেন দিয়ে সেটাও ধ্বংস করে দেবে।

‘উফফ। আমি একটা বোকা! জিনিসটা তো ব্যাগে নিয়েই ঘুরছি!’

এই বলে ব্যাগের ভেতর থেকে জিপিএস যন্ত্রটা বের করলো রতন। ওটার পর্দায় গোটা মায়াদ্বীপ গ্রামটা দেখা যাচ্ছে। পায়েলের কাছ থেকে এটার ব্যবহারও শিখেছে। ঠিক মাঝে আঙুল রাখতেই বড় হয়ে গেল দ্বীপটা। মাঝে একটা সাদা বিন্দু দেখা যাচ্ছে। আবার আঙুল রাখতেই আরও চওড়া হলো মানচিত্রটা। এবার পরিষ্কার দেখতে পেল রাস্তার মোড়। মোড়ের ঠিক মাঝেই কালো গোলাকার ঘরটা দেখে চেনার বাকি রইল না।

‘মঠ! ওটা তাহলে এজন্যই বানানো হয়েছিল!’

 

 

সায়েন্স ফিকশন উপন্যাস : মায়াদ্বীপ

২০

প্রায় দশ মিনিট ধরে মঠের ঠিক পেছনের জঙ্গলে ঘাপটি মেরে আছে দুই কিশোর। মশা মারতে মারতে ফটিক বলল, ‘আমার মনে হয় না এত তাড়াহুড়ো করবে। কোড দেওয়ার পর মাত্র আধ ঘণ্টা সময় পাবে কোম্পানি। এই সময়ের মধ্যে..।’

‘সময়টা চাইলে বাড়িয়ে দিতে পারে ওরা। সশশশশ! আসছে।’

রাস্তা বরাবর ওপরে আকাশে একটা উড়ন্ত গাড়ি। শোঁ শোঁ শব্দ শুনতে পাচ্ছে। আশপাশে যারা ছিল সবাই ভয় পেয়ে দৌড়ে পালিয়েছে। গাড়ি থেকে প্রথমে একটা রোবট নামলো। শিকারি রোবটটার মতোই। রোবটের পিছু পিছু নামলো একটা লোক। পরনে সেই প্রলয় সাহার মতোই পোশাক। লোকটা এদিক ওদিক তাকালো না। রোবটটাকে গাড়ির সাথে দাঁড়াতে বলে সোজা চলে এলো মঠের কাছে। দেয়ালে কী যেন চাপ দিল। সঙ্গে সঙ্গে খুলে গেল দরজা। এটার অপেক্ষায় ছিল ফটিক আর রতন। ছুটে এসে ধাক্কা দিয়ে ভেতরেই ফেলে দিল লোকটাকে। এরপর নিজেরাও তড়িঘড়ি করে ঢুকে গেল ভেতরে। কোনোরকম চার পাঁচজন দাঁড়াতে পারবে ছোট জায়গাটিতে। মাঝে একটা বড় টেবিলের মতো যন্ত্র রাখা। ওটার মাঝে ইংরেজি অক্ষর আর সংখ্যা লেখা একটা বোর্ড।

মারাত্মক ভয় পেয়েছে লোকটা। দুহাত মুখের কাছে তুলে আত্মসমর্পণ করার মতো করে শুয়ে আছে। যেন ধরেই নিয়েছে তাকে এখন মরতে হবে।

‘উঠে দাঁড়াও। তেড়িবেড়ি করলে এফোঁড় ওফোঁড় করে দেব।’ ফটিকের হাতে ভয় দেখানোর যন্ত্র। গুলি না বের হলেও এটা দারুন কাজ করবে। কোম্পানির লোকটা ভয়ে কাঁপছে।

‘কীকক কী চাও তোমরা!’

রতন পরিষ্কার করলো তাদের চাওয়া। ‘আমরা জানি তুমি কী করতে এসেছো। আর কোডটা দিলে কী হবে সেটা তুমিও জানো। তুমি জেনেশুনে এতগুলো মানুষকে মেরে ফেলবে?’

‘আ আ আ আমার উপায় নেই খোকা। ওরা আমাকে মেরে ফেলবে। আমি ওদের চাকরি করি মাত্র। বিশ্বাস করো, কোডটা দেওয়ার একটুও ইচ্ছে ছিল না। আর কোডটা দিতে হবে আমার চোখ দিয়ে। ওরা বলেছে আমি যদি নিজে থেকে দিতে রাজি না হই, তা হলে ওরা আমার চোখ তুলে নেবে। বুঝতেই পারছো, আমার রাজি হওয়া না হওয়ায় কিছু যায় আসে না।’

‘ওরা কয়জন আছে?’

‘সবাই চলে গেছে। কিন্তু এখনও নেতা আছে পাঁচ জন। ওরাই ঠিক করেছে সবাইকে মেরে ফেলবে। তা না হলে ধরা খেয়ে যাবে সবাই। মায়াদ্বীপের কথা কেউ জানে না।’

‘হুমম। ঠিকাছে আমরা তোমাকে বাঁচিয়ে দিতে পারি। তবে তোমাকে আমাদের কথা মতো কাজ করতে হবে।’

‘তোমরা ওদের সঙ্গে পারবে না। তোমাদের কাছে অস্ত্র নেই। ওদের কাছে রোবট আছে, ড্রোন আছে।’

‘কিন্তু ওসব ব্যবহার করলে ওরা স্যাটেলাইটে ধরা পড়বে।’

‘বাহ তোমরা দেখি অনেক জানো! তাহলে তো মাধবপুরের কথাও শুনে থাকবে। সেখানে প্রথমে ওরা দ্বীপটাকে ডুবিয়ে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু একজনের কারণে…।’

‘সুলতান আংকেলের কারণে..।’

‘তোমরা সুলতানকে চেন! ও আমার বন্ধু! আমার নাম রাইসুল।’

‘তবে আপনার জায়গায় সুলতান আংকেল হলে তিনি নিজের চোখ নিজেই নষ্ট করে দিতেন। যাতে কেউ কোড চুরি করতে না পারে।’

কথাটা শুনে খানিকটা আহত হলেও সেটা প্রকাশ করলো না রাইসুল নামের হ্যাংলা পাতলা লোকটা।

‘এখন আপনার প্রথম কাজ হলো রোবটটাকে ডেকে বলবেন অস্ত্রটা রেখে সামনের ওই গর্তে উবু হয়ে যেন দেখে ভেতরে কী আছে।’

‘আচ্ছা আচ্ছা। বলছি।’

মঠ থেকে বেরিয়ে দুপা এগুলো রাইসুল। রোবটকে নির্দেশ দিতেই ওটা অস্ত্র রেখে রাস্তার সঙ্গে লাগোয়া একটা বড় গর্তে উঁকি দিয়ে দেখতে শুরু করেছে। এক ছুটে বেরিয়ে এসেই রোবটটার অস্ত্র তুলে নিয়ে ওটার মাথা ছাতু বানিয়ে দিল ফটিক। কিশোরদের সাহস দেখে ঢোক গিলল রাইসুল নামের লোকটা। রতন তার কাজে নেমে গেল। ব্যাগ থেকে বিস্ফোরক বের করে মঠের মাঝে রাখা যন্ত্রের গায়ে লাগিয়েই সরে এলো রাস্তায়। ভালো করে দেখে নিল আশপাশ। এরপর রাইসুলের সঙ্গে উঠে পড়লো উড়ন্ত গাড়িতে। এবার পরিকল্পনায় আর ভুল হচ্ছে না তাদের। নিরাপদ দূরত্বে সরে এসেই চাপ দিলো রিমোট কন্ট্রোলারে। মুহূর্তে যেন কেঁপে উঠলো গোটা মায়াদ্বীপ।  গ্রামবাসীর চিৎকার কানে এলো। ভয় পেয়েছে অনেকে। ভয় পেয়েছে গাড়ি চালাতে থাকা রাইসুলও। তবে ভয় পায়নি দুই কিশোর।

কোম্পানির মূল অফিসে ঢুকতে বেগ পেতে হয়নি। মাধবপুরের মতোই এটারও মূল অফিসের সামনে বিশাল পরিমাণ সমতল জায়গা। সেখানে অস্ত্র হাতে দুয়েকটা রোবট ঘুরে বেড়াচ্ছে। রাইসুলের নির্দেশ পেয়ে তারাও অস্ত্র হাতে মাটিতে শুয়ে পড়লো। কেউ দেখার আগেই দৌড়ে দিয়ে সেগুলো কুড়িয়ে নিলো ফটিক। রতন ব্যাগে ঢোকালো একটা। ফটিকের দুই হাতে দুটো অস্ত্র। আসার সময় রাইসুলের কাছ থেকে জেনেছে যা যা দরকার। বিল্টু আর রতনের বাবাকে আটকে রাখা হয়েছে একটা কক্ষে। সেখানে আরও অনেকেই নাকি বন্দি। সম্ভবত পরাণও আছে সেখানে।

গাড়ি থেকে নেমেই দুই কিশোরকে দ্রুত অনুসরণ করতে বললো রাইসুল। নিজে এক ছুটে দরজার কাছে চলে গেল। দরজায় পাহারাদার রোবট বারকয়েক ফটিক আর রতনকে দেখলো। রোববটার সঙ্গে রীতিমতো ঝগড়া জুড়ে দিল রাইসুল নামের লোকটা। ভারি ব্যাগ আর অস্ত্র নিয়ে দৌড়াতে কষ্ট হচ্ছে ফটিক আর রতনের। কানে আসলো রাইসুলের কথা, ‘ডোন্ট শ্যুট, দ্যাটস অ্যান অর্ডার। অস্ত্র ফেলে দাও! আমি নির্দেশ দিচ্ছি। পাসওয়ার্ড সি ওয়ান ওয়ান টু জিরো ফাইভ।’ কিন্তু এরপরও হাতের অস্ত্র ফেলে দেওয়ার কোনো লক্ষ্মণ দেখা গেল না। ফটিক তার হাতের অস্ত্র তুলতে ভয় পাচ্ছে। রোবটটা যদি তার আগেই গুলি করে বসে তবে সর্বনাশ। ওদের নিশানা ব্যর্থ হতে পারে, রোবটের নয়। শেষে জিতলেন রাইসুলই। তার কথামতো অস্ত্রটা নিচু করলো রোবট। তখুনি ছুটে এলো রতন আর ফটিকের গুলি। ঝাঁঝরা হয়ে গেল রোবটটা। শব্দ হতেই কোথায় যেন বিকট শব্দ হতে শুরু করলো। চেঁচিয়ে উঠলেন রাইসুল, ‘জলদি লুকাও! আমার পেছন পেছন এসো। একটা লম্বা জায়গা পেরোতেই বামে মোড় নিল। পেছনে চেঁচামেচি শুনতে পেল রতন। কোম্পানির উঁচু পর্যায়ের লোকজন। রোবটের হাঁটাচলার যান্ত্রিক শব্দও শুনতে পেল।

রাইসুল মাঝ বরাবর একটি ঘরের দরজা খুলতেই ভেতরে ঢুকলো দুই কিশোর। ঘরের শেষ প্রান্তে আরেকটি দরজা। সেটাও খুলল। এরপর বড় একটা খালি জায়গা। রাইসুলকে অন্ধের মতো অনুসরণ করছে দুই কিশোর। লোকটা আবার ফাঁদে ফেলবে না তো তাদের। এর আগে তো খালি বন্দুক দেখিয়ে লোকটাকেই বোকা বানিয়েছিল ওরা, এবার যদি তাদেরকেই বানায়। ফাঁকা জায়গাটা পেরিয়ে আরেকটা ঘরে ঢুকলো তিনজন। ঘরটার ঠিক মাঝে একটা গোল কালো চাকতি। রাইসুল এগিয়ে এসে কী কী করলো। একটা সুইচও চাপ দিল। সঙ্গে সঙ্গে প্রচ- ধাক্কা খেল রতন আর ফটিক। দুদ্দাড় করে তাদের হাতে থাকা অস্ত্র আর ব্যাগগুলো ছুটে গিয়ে লেগে গেল চাকতিটার গায়ে!

‘শোনো।’

বেশ শান্ত শোনালো রাইসুলের গলা। তোমরা আমাকে খুব খারাপ মনে করছো, কিন্তু আমার কোনো উপায় ছিল না। এতক্ষণ তোমাদের হাতে অস্ত্র আর বিস্ফোরক ছিল বলে কিছু বলিনি। এখন বলছি। কোম্পানিতে আসলে আর একজন মাত্র লোক আছে। বাকি সবাই চলে গেছে। সরকার আর চায় না ওরা থাকুক। কিন্তু..।’

‘সাবাশ! রাইসুল! গুড জব!’

রাইসুল তার কথা শেষ করার আগেই দুই কিশোরের কাঁধ চেপে ধরলো বিশালদেহী এক লোক। চোখের দিকে তাকাতেই পিঠের দিকটা শিরশির করে উঠলো দুই কিশোরের।

‘ইয়েস স্যার। তাদের হাতে আর কিছুই নেই। সব চুম্বক দিয়ে টেনে নিয়েছি। এখন আমার ছেলেকে..।’

‘ও হ্যাঁ অবশ্যই। তোমার ছেলে। শিওর। ছেড়ে দেব। তবে তোমাকে যে কাজটা দিয়েছিলাম, সেটা তো প- হয়ে গেল। আর তোমাকেও দরকার নেই, তোমার চোখেরও দরকার নেই। শুট হিম নিরো!’

কাকে গুলি করার নির্দেশ দিলো লোকটা! ভাবছে রতন। এমন সময় দরজা দিয়ে ঢুকলো একটা শান্ত শিষ্ট চেহারার রোবট। হাতে একটা ছোট বন্দুক। রাইসুল নামের লোকটার দিকে তাক করে ট্রিগার চাপতেই এক ঝলক আলো। সঙ্গে সঙ্গে পেছনের দেয়ালের সঙ্গে ধাক্কা খেলরাইসুল। চিৎকার দেওয়ারও সময় পেল না।

‘এবার খোকারা তোমরা চলো আমার সাথে। তোমাদের এখুনি মারবো না। তার আগে তোমরা কিছু কাজ করে দেবে।’

‘তোমাদের কোম্পানির দিন শেষ বুঝলে! আমরা সব জেনে গেছি!’

রাগে গলা কাঁপছে ফটিকের। রতন ঠা-া মাথায় উপায় বের করার বুদ্ধি ভাবছে। কিন্তু লোকটার গায়ে যে শক্তি, সেটা মনে হতেই চিন্তাটা গুলিয়ে যাচ্ছে বার বার।

যে পথে দৌড়ে এসেছিল, সে পথেই আবার দুজনের ঘাড় চেপে নিয়ে যাচ্ছে লোকটা। রতন আর ফটিক যেন দুটো পাখির ছানা। মাঠে চোখ গেল রতনের। ভয়ানক সেই রোবটগুলো সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে।

‘খোকারা তোমরা ভেবেছো দুচারটে বোমা ফাটালেই সব কেচে গেল? অবশ্য তোমাদের সাহসের তারিফ করতে হয়। ভয়ের কয়েকটা জিন তোমাদের মধ্যে নেই। আর এ জন্যই যত ঝামেলা পাকিয়েছো। যাই হোক, মায়াদ্বীপ ডুবছে, আজ রাতেই।’

‘তোমার কাছে কোড নেই শয়তান।’

কথাটা ইচ্ছে করেই বলেছে ফটিক। রতনের মতো সেও জানতে চায় মায়াদ্বীপ ডোবানোর আদৌ আর কোনো উপায় আছে কিনা।

‘হে হে। খুব চালাক না! আগে চলো তোমার সঙ্গীদের সঙ্গে দেখা করবে।’

কয়েকটা ঘর পেরিয়ে রতন আর ফটিককে নিয়ে একটা বড় রুমে ঢুকলো লোকটা। পেছন পেছন চুপচাপ গোছের নিরো নামের রোবটটাও এসেছে। ওটা চলেও নিঃশব্দে। কোনো যান্ত্রিক শব্দ হয় না।

ঘরের মেঝেতে হাত বাঁধা অবস্থায় পড়ে আছে বেশ কজন লোক। বিল্টু আর বাবাকে চিনতে পারলো রতন। বাকিদের মধ্যে পরাণকে চিনতে পারলো শুধু। চেহারা দেখে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে কারও কথা বলার মতোও অবস্থা নেই। রতনকে দেখে শুধু একবার বাবা হাসলেন। তারপর আবার মাথা ঘুরে পড়ে গেলেন। দরজা বন্ধ করে লোকটা চলে যেতেই রতন বাবাকে ধরে বসালো। ফটিক ব্যস্ত হয়ে পড়লো বাকিদের নিয়ে। আশপাশে পানি খুঁজলো। নেই। বেশিক্ষণ এভাবে থাকলে এমনিতেই মারা যাবে সবাই। সামনের দরজার ওপাশেই ভয়ংকর বন্দুক হাতে দাঁড়িয়ে আছে নিরো নামের রোবটটা। ছুটে গিয়ে তাই পেছনের দরজায় ধাক্কা দিল কাঁধ দিয়ে। লাভ হলো না। শক্ত ধাতব পাতের দরজা। পাশে একটা নম্বর লেখা বোর্ড। ঠিক যেমনটা দেখেছে মাধবপুরে। গোপন নম্বর ছাড়া এ দরজা খুলবে না।

‘রতন! রাইসুল যে কোডটা বলেছিল মনে আছে?’

‘হুম। পুরোটা মনে পড়ছে না। তবে প্রথম অক্ষর হলো সি তারপর.. তারপর ওয়ান ওয়ান টু জিরো। তারপরেরটা মনে নেই।’

ফটিক আন্দাজে শেষে ২ চাপলো। খুলল না দরজা। যান্ত্রিক শব্দ বলে উঠলো, ‘আপনি ভুল পাসওয়ার্ড দিয়েছেন। আপনি আর দুবার চেষ্টা করতে পারবেন।’ বোর্ডের ঠিক মাঝেই আছে ৫। এবার সেটা চাপলো। সঙ্গে সঙ্গে সবুজ বাতি জ্বললো বোর্ডটার গায়ে। খুলে গেল পেছনের দরজা। ওপাশেই তাকাতেই খুশির শিহরণ বয়ে গেল শরীরে। দরজার ওপাশেই ধাতব চাকতির সেই ঘর। যাকে কিনা চুম্বক বলেছিল রাইসুল। ঘরের মেঝেতে তখন রাইসুলের লাশ। ওটা দেখেই বন্দিদের ভেতর থেকে একটা ছেলে ছুটে গেল বাবা বাবা বলে। ছেলেটাকে দেখেই মনে হলো সে কোম্পানির মতোই বাইরের কেউ। গ্রামের নয়। আহারে বেচারা! তবে আফসোস করে সময় কাটানোর পাত্র নয় ফটিক আর রতন। নিজেদের ব্যাগ আর অস্ত্র নিয়ে নিল তড়িঘড়ি করে। ঠিক যে পথে তাদের ধরে নিয়ে গিয়েছিল বিশাল লোকটা সে পথেই বের হলো আবার। ডানে মোড় নিলেই রোবটের দল দেখে ফেলবে নির্ঘাৎ। উঁকি দিল। দশ গজ দূরে দরজা বরাবর অস্ত্র তাক করে আছে নিরো নামের বেঁটে মতোন রোবটটা। অনেকটা সময় নিয়ে নিশানা ঠিক করলো রতন। ট্রিগার টানতেই যেন পাগল হয়ে গেল নিরো। এলোমেলো গুলি ছুড়তে শুরু করেছে। তার গুলিতে মাঠে থাকা দানব রোবটগুলোর মধ্যে কয়েকটা উড়ে গেল। দেয়ালও উড়ে গেল বেশ কয়েক জায়গায়। তবে ভাগ্য ভাল যে সামনের দরজায় আঘাত লাগেনি। দশ কি পনের সেকেন্ডের মধ্যেই নিস্তেজ হয়ে গেল নিরো। ধুপ ধাপ পায়ের আওয়াজ পেয়ে বুঝলো কোম্পানির লোকটা আসছে। অস্ত্র তাক করে আছে দুজনই। কিন্তু লম্বা করিডরে কাউকে দেখা গেল না। ধুপধাপ শব্দটাও মিলিয়ে গেল। কোম্পানির লোকটা বেশ চালাক। ঘটনা আঁচ করতে পেরেছে নিশ্চয়ই।

‘রতন, আমাদের মনে হয় সবাইকে নিয়ে বের হওয়া উচিৎ। এখানে পদে পদে বিপদ।’

‘ঠিকাছে তুই যা সবাইকে নিয়ে আমি আগে মাঠের রোবটগুলোকে শায়েস্তা করি।’

পাঁচটা রোবট বৈদ্যুতিক শক দেওয়ার যন্ত্র হাতে পায়চারি করছিল। রতন ছুটে গিয়ে নিরোর হাত থেকে বন্দুকটা খুলে নিল। মাঠের রোবটগুলোকে খইয়ের মতো উড়িয়ে দিলো সেই বন্দুক। পাঁচটা রোবটের জন্য গুনে গুনে পাঁচবারই গুলি ছুড়তে হয়েছে। এরপরই শেষ হয়ে গেল গুলি। ফটিক সবাইকে বের করছে একে একে। বিল্টুও যাবে গ্রামে। তার কাজ হলো স্কুলের মাইক দিয়ে সবাইকে ঘটনা খুলে বলা। মায়াদ্বীপে কোম্পানি নেই এটা সবাইকে জানানো খুব জরুরি।

রাইসুলের ছেলে ফটিকদের বয়সী। জিজ্ঞেস করতেই বলল তার নাম রাসেল। সে গ্রামে যাবে না। এ গ্রামে তার কেউ নেই। বাবার সঙ্গে কোম্পানিতে বেড়াতে এসেছিল। এখন ফিরে যাওয়ার আগে বাবার মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে চায়। রতনের বাবাও রতনকে ফেলে যাবে না বলে জানাল। ফটিক এক ছুটে মূল গেইটের কাছে গিয়ে পাসওয়ার্ড বসিয়ে খুলে দিল দরজা। বাকিরা সবাই বের হতেই আবার ফিরে এলো। দানব গোছের লোকটার কোনো সাড়া শব্দই নেই। বিশাল বড় ভবনে কতটা রুম আছে জানা সম্ভব নয়। এর কোনো একটায় নিশ্চয়ই লুকিয়ে আছে লোকটা।

রতন ব্যাগ খুলে মোবাইলটা দেখালো রাসেলকে। রাসেল মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, ‘হ্যাঁ চার্জ দিতে পারবো। বাবাকে যেখানটায় মেরেছে সেখানে আছে।’

ফোনে চার্জ হওয়ার পর রাসেলই চালু করলো যন্ত্রটা। পায়েলের সঙ্গে কথা বলার ব্যবস্থাও সে করে দিল। ছেলেটা অনেক কিছু জানে দেখে খানিকটা ঈর্ষাকাতরও হলো ফটিক।

‘পায়েল।’

‘উফ! রতন কোথায় ছিলে তোমরা। ফোন অফ ছিল কেন? ওহ আচ্ছা বুঝতে পেরেছি। বাদ দাও। শোনো আমি বুঝতে পারছি না। কিন্তু একটা বড় গ-গোল হয়েছে। বাবাকে তার এক বন্ধু জানাল, তারা নাকি জানতে পেরেছে কোম্পানি একটা আর্মি তৈরি করেছে। সবাই ভাড়াটে খুনি। নিজেদের লোক নয়। ওরা রওনা দেবে সন্ধ্যার পরপর। রাত কিংবা ভোরে মায়াদ্বীপে পৌঁছাবে। ওদের কাছে অনেক গোলাবারুদ আছে। বাবা যদি এর মধ্যে সরকারকে রাজি করাতে পারে তাহলে ওদের ঠেকানো যাবে। কিন্তু সেটা সম্ভব হবে না বোধহয়।’

‘বুঝতে পেরেছি। এখানে কেউ নেই। নেতা যে ছিল, সেও মনে হয় পালিয়েছে।’

‘ভাড়াটে খুনিরা যদি খুন করে তাহলে কোম্পানির বিচার হবে না। আর কোম্পানি সরাসরি মারতে গেলে ধরা পড়ে যাবে। ওরা এখন সবাই ফিরে এসে নিজেদের হেডকোয়ার্টারে হাজির হচ্ছে। বুঝতে পেরেছো কেন? কারণ ওরা যদি প্রমাণ করতে পারে মায়াদ্বীপে খুনের সময় ওরা সেখানে ছিল না, তাহলে পার পেয়ে যাবে। সময় নেই রতন। নৌকা নিয়ে পালাও। যে কজন পারো।’

এই প্রথম রতনের মনে হলো, মায়াদ্বীপের সঙ্গে আরও অনেক গ্রাম থাকলে ভাল হতো। মূল ভূখণ্ডে থাকলেও কেউ এভাবে হামলা করতে পারতো না। এতক্ষণ সে ভেবে এসেছে যুদ্ধে তারা খুব সহজে জিতে গেছে। আসলে সত্যিটা হলো, যুদ্ধ এখনও শুরুই হয়নি। কোম্পানি চায়নি গ্রামবাসীকে নিজের হাতে তাদের মারতে। চাইলে আগেই মারতে পারতো।

সবাই কোম্পানির করিডরে বসে আছে। রতন অস্ত্র তাক করে আছে শেষ প্রান্তে। যেদিকটায় দানব লোকটাকে যেতে দেখেছে। শেষ প্রান্তে কয়েকটা ধাপের মতো আছে। ওপরে ওঠা যায়।

‘আমার ধারণা ও দোতলায় আছে। আর না হয় ছাদে থাকা উড়ন্ত গাড়ি নিয়ে চলে গেছে।’

‘হুম। কারণ ওরা আর আসবে না। আসবে ওদের ভাড়াটে সেনার দল। এবার আর আমাদের বাঁচার উপায় নেই।’

পায়েলের সঙ্গে আবার কথা বলতে চাইল রতন। তবে এবার ফোন ধরলো পায়েলের বাবা সুলতান।

‘রতন! আই অ্যাম সরি রতন! তোমাদের জন্য…।’

‘এখনও সময় আছে আংকেল। আমরা তৈরি। আমরা মানে আমরা চারজন। আমাদের হাতে..।’

‘কিছুতেই সম্ভব নয় রতন। ওরা রোবট নয়। ওরা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত খুনি। টাকা পেলে ওরা যেকোনো কিছু করতে পারে। আর তোমাদের কাছে তো টাকাই নেই। এখন শোনো, তুমি, ফটিক আর যে কজন পারো বোট নিয়ে পালাও।’

‘না আংকেল আমরা পালাবো না। দেখা যাক ওরা কেমন শক্তিশালী।’

‘না রতন। আমি খবর পেয়েছি ওদের হাতে এমন একটা বন্দুক আছে, যেটা থেকে সি-টেন এর মতো বুলেট বের হয়। তোমরা দাঁড়াতেই পারবে না।’

‘ওরা কয় জন?’

‘জানি না। তবে দুটো কি তিনটে বোট। এটুকু জানি। বড়জোর পনের কি বিশ জন হবে। কিন্তু গ্রামটাকে ধ্বংস করতে ওদের মতো দুই তিনজনই যথেষ্ট। তাছাড়া গ্রামবাসীর কাছে তো কোনো অস্ত্রই নেই। আর আমি ও আমার কয়েকজন বন্ধু…।’

আবার মাঝপথে কথা বন্ধ হয়ে গেল। রাসেল বলল, ‘নেটওয়ার্ক পাওয়া যাচ্ছে না। তার মানে নেটওয়ার্কের সুইচ অফ করে দিয়েছে শয়তানটা। সে এখনও এখানেই আছে। জলদি চলো! ছাদে চলো!’

ছাদের দিকে ছুট লাগালো সবাই। ধাপগুলো বেয়ে বেশ খানিকটা উঁচুতে উঠলো রতন, ফটিক আর রাসেল। রতনের বাবা অসুস্থ হওয়ায় নিচেই থেকে গেল। ছাদে উঠতেই দেখতে পেল একটা উড়ন্ত গাড়িতে খাবার বোঝাই করছে দানব লোকটা। রতনদের দেখতেই চুপসে গেল। হয়তো ভাবেনি এত তাড়াতাড়ি ধরা পড়ে যাবে। ভাড়াটে খুনির দলটার সঙ্গে দর কষাকষি করতেই অনেক সময় নষ্ট হয়েছে তার। নিজেদের অপকর্ম ঢাকতে তড়িঘড়ি করতে গিয়ে ভাবেনি নিজেকে এত বড় বিপদে পড়তে হবে। ফটিকের হাতে বড় নলওয়ালা সেই বন্দুক। মনে মনে ঠিক করেছে এটার চার্জ শেষ না হওয়া পর্যন্ত লোকটার মাথায় তাক করে ট্রিগার চেপে ধরে রাখবে।

‘দেখো, আমি তোমাদের বাঁচিয়ে দিতে পারি। তোমরা আমার সঙ্গে উড়ন্ত গাড়িতে উঠে বসো। আমরা নিরাপদে শহরে ফিরে যেতে পারি। আজ রাতেই গ্রামটা ধ্বংস হয়ে যাবে। ভাড়াটে সেনা..।’

‘আমরা জানি!’

‘ওহ.. তো ভালো কথা। আসো! চলে আসো! দেরি করছো কেন!’

ট্রিগারে চাপ দিল রাসেল। কাজ করলো না। তা দেখে ক্রুর হাসি খেল গেল দানব লোকটার চোখে। ফটিকের ইশারা পেয়ে রতন ইচ্ছে করে এমন ভাব করলো যেন তারও গুলি শেষ। এবার হো হো করে হেসে উঠলো লোকটা।

‘কী ছোকড়া, খেলবে এগুলো দিয়ে? যাও বাসায় গিয়ে খেলো গিয়ে। আমি চললাম।’

‘এক মিনিট!’

দুপা এগিয়ে এসে মাথা বরাবর তাক করেই ট্রিগারে চাপ দিল ফটিক। সঙ্গে সঙ্গে হাউমাউ করে উঠলো লোকটা। গুটিসুটি মেরে নিজেকে কিছু একটা থেকে আড়াল করার চেষ্টা করছে। একটু পর চিৎকার করে বলে উঠলো, ‘কত্ত বড় মাকড়শা! ওহ নো! মাকড়শা! বাঁচাও!’ ফটিক আরো এগিয়ে আসলো। এবার প্রচ- ভয়ে চিৎকার জুড়ে দিল। উঠে দাঁড়িয়ে এদিক ওদিক ছোটাছুটি করলো কিছুক্ষণ। ফটিক আরও কাছে এগিয়ে এলো। এরপর যা ঘটলো প্রস্তুত ছিল না কেউ। প্রচ- ভয়ে চিৎকার করতে করতে এক দৌড়ে ছাদ থেকে নিচে লাফ দিল লোকটা। শব্দ শুনেই বুঝলো বেঁচে থাকা সম্ভব নয় ওর পক্ষে।

দশ মিনিট পর। উড়ন্ত গাড়িতে চেপে বসেছে রাসেল। শহরে তার মা আর ভাইবোন আছে। তার চলে যাওয়াটাই স্বাভাবিক। তবে কথা দিয়েছে শহরে গিয়েই সবার আগে পুলিশকে জানাবে ঘটনাটা। তাছাড়া তার মোবাইল ফোনে নাকি কোম্পানির অনেক অপকর্মের ছবি আছে। ওতেই নাকি প্রমাণ হবে সব। রতন আর ফটিকের ইচ্ছে হলো জিজ্ঞেস করে পুলিশ জিনিসটা কী। শেষপর্যন্ত করলো না। কারণ দুজনেই জানে, পুলিশ যেমনই হোক, তাদের আগেই খুনিরা চলে আসবে মায়াদ্বীপে। যা করার নিজেদেরই করতে হবে।

 

 

 

 

২১

বিকেলের মধ্যে গ্রামের সবাইকে ব্যাপারটা জানানো হলো। সবাই জড়ো হয়েছে কোম্পানির ভেতরের মাঠে। পুরো অফিস আর কারখানা চষে গোটা বিশেক অস্ত্র পেয়েছে। রতন আর ফটিক সেগুলোর ব্যবহার শেখালো কয়েকজনকে। রকি কাকু আর রমাকান্ত স্যারও আছেন সেই দলে। হাজুনি বুড়ি চাইলেও তাকে অস্ত্র দিল না রতন। কারণ তাকেসহ গ্রামের বাকি সবাইকে ভেলা বানিয়ে খাল পাড়ি দিয়ে একেবারে দক্ষিণ-পূর্ব সীমান্তের জঙ্গলে লুকিয়ে যেতে বলল। যদিও রতনরা জানে ওখানে লুকিয়েও হয়ত শেষ রক্ষা হবে না। তবে সময় পাওয়া যাবে। ততক্ষণে যদি মূল ভূখ- থেকে কোনো সাহায্য আসে, তবে রক্ষা পাবে অনেকে। নিজেদের জীবন নিয়ে ভাবছে না বাকি বিশ জন। এর মধ্যে স্বয়ংক্রিয়ভাবে গোটা দলের নেতৃত্বে চলে এলো রতন আর ফটিক। প্ল্যানটাও তাদের। কোম্পানির অফিসের পেছনে উত্তরের সৈকতে জেটি আছে। ভাড়াটে সেনারা হয়তো সেখানেই আসবে। আবার নাও আসতে পারে। তারা যদি দক্ষিণ দিক দিয়ে আক্রমণ করে তবে মহাবিপদ। আবার এমনও হতে পারে ওরা সমুদ্র থেকেই আক্রমণ করে মায়াদ্বীপ ধ্বংস করে দিল। মূল ভূখণ্ডে তো অনেক নতুন নতুন যন্ত্র আছে। সেসব দিয়ে কী না সম্ভব।

ফোনে পায়েলের বাবার কাছ থেকে একটার পর একটা বিষয়ে শিখছে রতন। তার নির্দেশ অনুযায়ী কোম্পানির গুলির ভাণ্ডারের সন্ধানও পেয়েছে। সবার হাতে সেগুলো ভাগ করে দিল।

বিল্টুকে দিল বিশেষ একটা কাজ। যেটা করতে হলে তাকে কোম্পানির অফিসের ছাদে ঘাপটি মেরে বসে থাকতে হবে। সেখান থেকে সমুদ্রের পানি বড়জোর একশ গজ দূরত্বে। সন্ধ্যার মধ্যে সমস্ত পরিকল্পনা সেরে ফেলেছে রতন। ফোনে দুয়েকবার পায়েলের বাবার সঙ্গে কথাও হয়েছে। তিনি বলেছেন স্যাটেলাইটে ভাড়াটে খুনিদের অবস্থান ধরা পড়বে না। তবে তাদের পৌঁছাতে ভোর হয়ে যাবে। তিনি এসব তথ্য পাচ্ছেন সরকারের ভেতরে থাকা তার এক বন্ধুর কাছ থেকে। মায়াদ্বীপকে বাঁচাতে নাকি তিনি জীবন বাজি রেখেই এসব করছেন। মূল ভূখণ্ডে তাহলে এমন ভালো লোকও আছে। বুঝতে পারলো রতন।

রতনের কথামতো পশ্চিমের সৈকতে সবাই যার যার অবস্থান নিয়েছে। ঘড়িতে ভোর চারটার মতো বাজে। আকাশে মেঘ আর চাঁদ দুটোই আছে। এই দেখা যাচ্ছে, আবার সব অন্ধকার। পায়েলের বাবার হিসেব অনুযায়ী যে কোনো সময় দেখা যাবে ভাড়াটে যোদ্ধাদের নৌকার আলো। ফটিক আর রতন জেটি থেকে সবচেয়ে কাছে বেশ কটা নারকেল গাছের আড়ালে বসে আছে। হামলা হলে সবার আগে তাদেরকেই মোকাবেলা করতে হবে।

‘রতন, ওরা যদি জেটিতে না আসে। যদি সোজা উত্তরে চলে যায়। ধর ওদেরও কাছেও তো স্যাটেলাইট আছে। ওরা যদি ওপর থেকে সব দেখে।’

‘যতই যন্ত্র থাকুক, যুদ্ধে জিততে যন্ত্র নয়, বুদ্ধির দরকার। দেখ কী হয়।’

সাড়ে দশটা বাজতেই উত্তর সমুদ্র থেকে আলোর ঝিলিক ধরা পড়লো চোখের কোণে। শিষ বাজিয়ে সবাইকে সতর্ক করে দিল রতন। সবার জন্য বিশেষ বিশেষ সংকেতও তৈরি করে রেখেছে ও। শেয়ালের মতো ডাকলেই কাজ শুরু করবেন রমাকান্ত। পর পর দুবার শিষ বাজালেই সমুদ্র ঘেঁষা কোম্পানির অফিসের ছাদে বসে থাকা বিল্টু করবে তার কাজ।

নৌকা মোট তিনটা। আকারে বেশ বড়ই বলা যায়। কোম্পানির অফিস থেকে পাওয়া দূরের জিনিস দেখার যন্ত্রটা চোখে লাগালো রতন। নৌকাগুলো দুই কি তিন মাইল দূরে এখনও। এগোচ্ছে ধীরে ধীরে। ওরা নিশ্চয়ই জানে গ্রামের মানুষের হাতে বিস্ফোরক আর অস্ত্রসস্ত্র আছে। এ জন্যই সাবধানে এগোচ্ছে। খানিকটা এগিয়েই একটা নৌকা সরে যেতে লাগলো ডান পাশে মানে পুব দিকে। ঘুরে এসে দক্ষিণ পাড়ে হামলা করবে না তো! তাহলেই সেরেছে! অবশ্য পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ হলে আর চিন্তা নেই।

নৌকাগুলো আর এক মাইলের মতো দূরে। গতিও কমে এসেছে। দুটো নৌকা জেটির কাছে চলে এসেছে। স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে ভয়ানক পোশাক পরা লোকগুলোকে। আগাগোড়া কালো। শক্ত খোলসের মতো পোশাক পরে আছে। দেখে মনে হয় অনেক ভারি। মাথা ঢেকে দেওয়া শক্ত টুপিও পরে আছে। হাতে অন্যরকম বন্দুক।

পুব দিকে চলে যাওয়া তৃতীয় নৌকাটা উত্তরের জেটির দিকে এগোচ্ছে। আরেকটু কাছাকাছি এলেই শেয়ালের সঙ্কেত দেবে রতন। বাকি দুটো নৌকা পশ্চিমের জেটির দিকে আসছে। তৃতীয় বোটটা জেটি থেকে এখনও দুইশ গজ দূরে। এরই মধ্যে জঙ্গলের ভেতর থেকে ডেকে উঠলো শেয়াল। সত্যিকারের শেয়াল! মাথার চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে করলো রতনের। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে ভয়ংকর শব্দে বিস্ফোরিত হলো পুব দিকের জেটি। আগুনের কু-ুলিতে গোটা মায়াদ্বীপ আলোকিত হয়ে গেল। তৃতীয় নৌকাটার কিছুই হয়নি! রমাকান্ত সত্যিকারের শেয়ালের ডাককে রতনের সঙ্কেত ভেবে ভুল করেছে। তৃতীয় নৌকাটা দিক পাল্টে পশ্চিম দিকে বাকি তিনটি নৌকার দিকে এগোতে শুরু করলো। ওরা সতর্ক হয়ে গেছে। ভীষণ সতর্ক। ঠোঁট কামড়ে ভাবছে রতন। এখন উপায়! খানিক পর হাসলো। যাক, ভালোই হয়েছে তিনটা এক সাথে জড়ো হয়েছে।

‘ওরা আসছে!’

ফটিক সতর্ক করতেই যন্ত্রে চোখ রাখলো রতন। ধীর গতিতেই এগিয়ে আসছে নৌকাগুলো। চাঁদটা মেঘে ঢেকে যাচ্ছে বার বার। এবার আর ভুল করলো না রতন। শিষ বাজিয়ে দিল পর পর দুবার। বেশ ভাল তীর ছুঁড়তে পারে মাধবপুরের বিল্টু। পায়েলের কাছে শিখেছে। তীরের আগায় বেঁধে নেওয়া দ-গুলো ছুড়ে দিলো নৌকাগুলো যেদিকে আছে সেদিক বরাবর উত্তর সৈকতে। ছোঁড়ার আগে যন্ত্রের গায়ে লাগানো মাত্রা লেখা সুইচটাকে একেবারে উপরে তুলে দিতে ভোলেনি।

রতনের সঙ্কেত পেতেই  অস্ত্র হাতে এগিয়ে এলো আড়ালে থাকা বাকি আঠারো জন। রতন আর ফটিকও এগোলো। এখন ওদের ঠেকিয়ে রাখতে হবে যেকোনো উপায়ে। পালা করে গুলি ছুড়তে শুরু করেছে সবাই। গুলির শব্দ আর আলোর ঝলকানিতে নৌকাগুলো থমকে গেল। এরপর যা ঘটলো তাতে আঁতকে উঠলো গ্রামের যোদ্ধারা। নৌকা থেকেও পাল্টা গুলি ছুড়লো কেউ। একটা সবুজ আগুনের গোলা উড়ে গেল গ্রামের দিকে। ঠিক মাঝে গিয়ে বিস্ফোরিত হলো গোলাটা। প্রকা- আগুনের কু-ুলি আর সেই সঙ্গে দারুনভাবে কেঁপে উঠলো মায়াদ্বীপ। আশার কথা হলো গ্রামের সবাই এতক্ষণে দক্ষিণ-পুবে চলে গেছে। তাই কারোর মরার আশঙ্কা নেই। রতনরা গুলি থামালো না। বোটগুলো আর আধ মাইলের মতো দূরে। দ্বিতীয় গোলাটা পড়লো কোম্পানির অফিসের ছাদে।

‘বিল্টু!’

চিৎকার করলো ফটিক। কিন্তু তার চিৎকার কারো কান পর্যন্ত গেল না। তার আগেই তৃতীয় গোলাটা পড়লো সৈকতে। রমাকান্তকে পড়ে যেতে দেখলো। নিথর দেহটা দেখেই বোঝা গেল প্রাণ নেই। রতন আর ফটিক সবাইকে পিছু হটার ইশারা করে নিজেরাও সরতে লাগলো। সরতেই সরতেই ছুড়লো গুলি। লাগলো কিনা জানে না। রতন সময় গুনছে। বড়জোর দুই কি তিন মিনিট লাগার কথা ঘটনাটা ঘটতে। রতনরা গুলি ছুড়ছে দেখে নৌকায় থাকা লোকগুলো সহজে এগুনোর সাহস পাচ্ছে না বোধহয়। না এগোলেই ভালো। তাহলে তিমি আর হাঙ্গরের মতো বড় বড় মাছগুলো সহজেই হামলা চালাতে পারবে। সবচেয়ে কাজের কাজটা করেছে বিল্টু। তীরের আগায় যে যন্ত্রগুলো বেঁধে সমুদ্রে ছুড়েছে, ওগুলো আর কিছু নয়, মাছ ধরার সংকেত যন্ত্র। এর আগেও সমুদ্রের প্রাণীগুলো দারুনভাবে বাঁচিয়ে দিয়েছিল রতন আর ফটিককে। এবার মায়াদ্বীপকে বাঁচানোর পালা।

ভোরের আলো ফুটছে আস্তে আস্তে। সমুদ্রের তোলপাড়ের শব্দে কান পাতা দায়। গোটা দশেক মাছ ধরার যন্ত্র সর্বোচ্চ মাত্রায় ফেলে দেওয়া হয়েছে সৈকতে। আশপাশের পঞ্চাশ মাইলের মধ্যে যত মাছ আছে, সব হুমড়ি খেয়ে পড়েছে। আবছা আলোতে স্পষ্ট দেখলো রতনরা। তিনটি নৌকাই উল্টে গেছে। ভারি পোশাকের কারণে লোকগুলো সাঁতরাতে পারছে না। দুয়েকজনকে হাঙ্গরে গিলে খেতে দেখলো। বাকিরা যে পালাতে পারবে, সে আশাও ক্ষীণ। এর মধ্যে দুয়েকজন গোলা ছুড়লেও সেগুলো সমুদ্রেই পড়েছে। সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে লোকগুলোকে ডুবে যেতে দেখছে গ্রামের যোদ্ধারা। রতনের বারণ সত্ত্বেও আড়াল থেকে লাঠিসোটা হাতে গ্রামের অনেকে বেরিয়ে এসেছে পশ্চিমের সৈকতে।

পাড়ের কাছে কালো পোশাকটা দেখেই দৌড়ে গেল সবাই। এক জন সাঁতরে তীরে উঠতে পেরেছে। কিন্তু হাতের অস্ত্র গায়েব। সবাই মিলে লোকটাকে ধরে পরনের কালো খোলসটা খুলে ফেলল। বন্দি করে নিয়ে যাওয়া হলো তাকে। রতন আর ফটিক খুঁজতে গেল বিল্টুকে। কোম্পানির অফিস ভেঙেচুরে ধ্বংসস্তূপ হয়ে গেছে। কয়েকবার ডাক দিয়ে বুঝলো বিল্টু আর বেঁচে নেই।

দুপুর বেলা। শান্ত সৈকত ধরে হাঁটছে রতন আর ফটিক। মায়াদ্বীপে হঠাৎ করেই যেন নির্জনতা ভর করেছে। হঠাৎ উত্তর আকাশে চোখ পড়তেই থমকে গেল দুজন। একটা উড়ন্ত গাড়ি দেখা যাচ্ছে। আবার কোনো উটকো ঝামেলা নয়তো! আরেকটু কাছে আসতেই হাসি ফুটলো দুজনের চোখে। পায়েল আর সুলতান আঙ্কেল!

গাড়ি থেকে নেমেই ছুটে এলো পায়েল। তার চোখে মুখে উৎকণ্ঠা।

‘রতন ফটিক, তোমরা ভাল আছো!’

‘হুম। ওরা সবাই মারা গেছে। সমুদ্রে ডুবে। মাছেরা আমাদের সাহায্য করেছে।’

‘মানে!’

মৃদু হাসলো রতন।

রাইফেল হাতে এগিয়ে এলেন পায়েলের বাবা। তাকেও বিধ্বস্ত দেখাচ্ছে।

‘তোমার ফোন রেখেই রওনা দেই আমি। আর কিছু না পারি দুয়েকটা গুলি তো করতে পারবো। কিন্তু তোমরা করেছো কী!’

টুকটাক গল্প করতে করতে হেঁটে গ্রামের দিকে এগিয়ে চলল সবাই। সব শুনে পায়েল আর তার বাবা ভেতরে ভেতরে বেশ গর্ববোধ করলেন।

‘অনেক খুঁজেও আমরা বিল্টুর লাশ পাইনি। যে বোমা পড়েছে তাতে একেবারে ছাই হয়ে যাওয়ার কথা। তবে শেষ কথা হলো মায়াদ্বীপ এখন স্বাধীন।’

দুই হাত দুই কিশোরের কাঁধে রাখলেন সুলতান।

‘তোমরা কি এবার মূল ভূখ- দেখতে চাও?’

‘অবশ্যই চাই আংকেল। কিন্তু তার আগে আমাদের বাসায় চলুন। মা নতুন চালের ভাত আর ইলিশ রান্না করেছে।’

মায়াদ্বীপের মেঠোপথ ধরে আনমনে হাঁটছে পায়েল। যত দেখছে তত মুগ্ধ হচ্ছে। ঢাকার সঙ্গে কত্ত অমিল। এত গাছ। সৈকতের পাশে ঝাউবন, জঙ্গল, সেই জঙ্গলে আবার শেয়ালও দেখেছে। রতন আর ফটিক এটা ওটার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে ঠিকই, কিন্তু কিছু কানে যাচ্ছে না তার। হাঁটতে হাঁটতে মনে হচ্ছে প্রতিটি পদক্ষেপেই মায়াদ্বীপের প্রতি এক অদ্ভুত মায়ার টানে জড়িয়ে যাচ্ছে সে।

 

(উপন্যাসটির লেখকের জন্য সম্মানি পাঠাতে বিকাশ করতে পারেন এই নম্বরে- 01976-324725 )

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Please disable your adblocker or whitelist this site!