class="post-template-default single single-post postid-49477 single-format-standard wp-custom-logo group-blog vl-boxed aa-prefix-matin-">
Shadow

অ্যালোভেরা চাষ করে কেমন লাভ হয়

চাষীদের কাছে এখন লাভজনক ভেষজ অ্যালোভেরা। নাটোর সদর উপজেলার লক্ষীপুর খোলাবাড়িয়া ভেষজ গ্রামের চাষীরা অ্যালোভেরা চাষ করে বছরে বিঘা প্রতি ২ থেকে ৩ লাখ টাকা লাভ করছেন। প্রতিদিন সে গ্রাম থেকে এক ট্রাক অ্যালোভেরা গাছের পাতা দেশের বিভিন্ন জায়গায় চলে যায়।

Aloe vera cultivation profit অ্যালোভেরা চাষে লাভ কেমন

১৯৯০ সালে প্রথম নাটোরের লক্ষীপুরের খোলাবাড়িয়া গ্রামের আফাজ পাগলা অ্যালোভেরা চাষ শুরু করেন। ১৯৯৭ সনে সে গ্রামে এর চাষ ছিল মাত্র ২ হেক্টর। বর্তমানে গ্রামটিতে প্রায় ২৫ হেক্টর জমিতে আ্যলোভেরা চাষ হয়।

 

বাণিজ্যিকভাবে ভেষজ গাছের চাষ করে আয় করুন

 

উৎপত্তি ও বিস্তার : অ্যালোভেরার আদি নিবাস উত্তর আফ্রিকায় হলেও তা এখন বাংলাদেশসহ এশিয়ার আরও অনেক দেশে জন্মাচ্ছে।

অ্যালোভেরা বহুবর্ষজীবী ভেষজ উদ্ভিদ এবং দেখতে আনারস গাছের মতো। এর পাতাগুলি পুরু, দু’ধারে করাতের মতো কাঁটা এবং ভেতরে লালার মতো পিচ্ছিল শাঁস থাকে। কার্ল লিনিয়াস ১৭৫৩ সনে সর্বপ্রথম এ গাছের প্রজাতি Aloe perfoliata varvera নামে বর্ননা করেন। পরে ১৭৬৮ সনে নিকোলাস লরেন্স বুরম্যান এর প্রজাতির নাম দেন Aloe vera (L.) Burm.f.

অ্যালোভেরা গাছ বেশ কয়েক বছর বাঁচে। এটা একটি রসালো বা সাকুলেন্ট প্রকৃতির গাছ। এই গাছ ৬০ থেকে ১০০ সেন্টিমিটার লম্বা হয়, গাছের গোড়া থেকে অনেকগুলো পাতা একের পর এক ঊর্ধ্বমুখীভাবে বের হয়। পাতা বেশ মাংসল, পুরু, নরম, সবুজ ও দুই কিনারা কাঁটাযুক্ত বা করাতের মতো। গ্রীষ্মকালে লম্বা ডাটায় এর ফুল ফোটে। ফুলের ডাটা ৯০ সেমি লম্বা হয়। ফুলের রং হলদে, নলাকার।

Cultivation of Aloe Vera

দুই হাজার বছর পূর্ব থেকেই এই গাছ ভেষজ চিকিৎসায় ব্যবহার হয়ে আসছে। প্রসাধন ও ওষুধ শিল্পের কাঁচামাল হিসেবে আ্যালোভেরার নির্যাস ব্যবহৃত হয়ে আসছে।

শরীরের নানা রোগ দূর করতে এ গাছের ব্যবহার সর্বজনবিদিত। এর পাতা কাটলে ভেতরে জেলির মতো থকথকে তালের শাসের মতো সাদা স্বচ্ছ শাস পাওয়া যায়। হালকা তিক্ত স্বাদের এ শাস শরীর ঠাণ্ডা রাখার জন্য ও শক্তি বাড়ানোর জন্য শরবত করে খাওয়া হয়। শহর বন্দরে অনেক খুচরা বিক্রেতা ফুটপাতে এই শরবত বিক্রি করে থাকে।

অ্যালোভেরা থেকে ভেষজ ওষুধ তৈরি করা হয়। ভেষজ ছাড়াও অ্যালোভেরা ময়েশ্চারাইজিং লোশন, ইয়োগার্ট, পানীয়, ডেজার্ট ইত্যাদি তৈরিতে ব্যবহার করা হয়।

অ্যালোভেরা পাতার রস, ২-৪ চামচ করে দিনে একবার খেলে যকৃতের ক্রিয়া বৃদ্ধি করে। কোন জায়গা যদি আগুনে পুড়ে যায় তাহলে টাটকা পাতার শাস ওই জায়গায় লাগালে চট্জলদি আরাম পাওয়া যায়। এতে ফোসকা পড়ে না, চামড়ার দাগ হয় না। অ্যালোভেরার শাঁস প্রতিদিন একবার তালুতে নিয়ম করে লাগালে মাথা ঠাণ্ডা হয়।

অ্যালোভেরা শাঁস প্রতিদিন নিয়ম করে কয়েক সপ্তাহ লাগালে চুলকানি থেকে আরাম পাওয়া যায়। কোমরে ব্যথা হলে শাস অল্প একটু গরম করে মালিশ। করলে আরাম পাওয়া যায়। অ্যালোভেরা শাস ১-২ চামচ ও ২ চামচ মিছরি একসঙ্গে সেবন করলে শরীরে উত্তেজনা বৃদ্ধি পায়।

অ্যালোভেরা পাতার রস মেখে দিলে চেহারার ত্বক নরম হয় এবং ক্ষতচিহ্ন দূর হয়। মুখের মেছতা খুব গুরুতর হলে অ্যালোভেরা পাতার রস পানির সঙ্গে মিশিয়ে খেলে (প্রতিদিন দু’বার, প্রত্যেকবার ১০ মিলিলিটার), মেছতা প্রতিরোধ করা যায়।

 

অ্যালোভেরার একটি পাতা, মধু এ একটি ছোট শসা ছোট করে মিশিয়ে করে মাস্ক করে এবং মেচতার ওপর রেখে দেন, চামড়ার ফুস্কুড়িও প্রতিরোধ করতে পারে।

 

 সহজ পদ্ধতিতে অ্যালোভেরার চাষ

অ্যালোভেরা চাষ : মাটি ও জলবায়ু

সবরকম জমিতেই অ্যালোভেরা চাষ সম্ভব তবে দোআঁশ ও অল্প বালি মিশ্রিত মাটিতে গাছের বৃদ্ধি ভালো হয়। সুনিস্কাশিত জমি যেসব জমিতে পানি জমে না এরুপ উচু জমিতে অ্যালোভেরার চাষ করা যায়। তবে লবণাক্ত ও চরম অম্লীয় মাটিতে ভালো হয় না। নিচু ও পানি জমা জমিতে গাছ পচে যায়। যে কোন দোআঁশ মাটিতে চাষ ভালো হয় তবে বেলে দোআঁশ মাটি উত্তম। এঁটেল মাটিতে চাষ না করা ভালো। ছায়া জায়গায় হবে না, অ্যালোভেরার জন্য দরকার সারাদিন রোদ পড়ে এমন জমি।

 

অ্যালোভেরা চাষ : জমি তৈরি

অ্যালোভেরা চাষ করতে হলে জমি প্রথমে ভালোভাবে পরিষ্কার করে চাষ দিতে হবে। চাষের সময় হেক্টর প্রতি ১০ থেকে ১২ টন গোবর মিশিয়ে দিতে হবে। ওই সময় হেক্টর প্রতি ২২৫ থেকে ২৫০ কেজি টিএসপি ও ৭৫ থেকে ১০০ কেজি এমওপি সার দিতে হবে।

নাটোরের অ্যালোভেরা চাষিরা সাধারণত বেশি করে গোবর সার দিয়ে এর চাষ করেন। খুব কম চাষীই রাসায়নিক সার দেন। অনেক চাষীরা প্রচুর ছাই ব্যবহার করে থাকেন। তবে কেউ কেউ বিঘা প্রতি ২৫ থেকে ৩০ কেজি টিএসপি এবং ১০ কেজি এমওপি সার জমি প্রস্তুতের সময় ব্যবহার করেন।

সার মেশানোর পর জমিতে চারা লাগানোর জন্য বেড তৈরি করতে হবে। বেড হবে ১.৫ থেকে ২.২৫ মিটার চওড়া। প্রতি দুই বেডের মাঝে ৪০ থেকে ৫০ সেন্টিমিটার নালা রাখতে হবে।

 

অ্যালোভেরার চারা রোপণ

অ্যালোভেরার তিন রকম চারা লাগানো হয়-রুট সাকার বা মোথা, গাছের গোড়া থেকে গজানো চারা ও গাছের গোড়ার অংশ কেটে ফেলে পুরো গাছ। বাণিজ্যিকভাবে রুট সাকার লাগানো লাভজনক নয় বিধায় এটি লাগানো হয় না। পুরাতন গাছের গোড়া থেকে গজানো চারা মাতৃগাছ থেকে আলাদা করে প্রথমে এক খণ্ড জমিতে বা বেডে লাগানো হয়। সেখানে এসব চারা ২ থেকে ৩ মাস লালন পালন করে বড় করা হয়। পরে মূল জমি চাষ দিয়ে এসব চারা তুলে সেখানে লাগানো হয়। এতে চারার প্রতিষ্ঠা ভাল হয়। তবে এরূপ চারা লাগিয়ে পাতা তোলার জন্য ৬ মাস অপেক্ষা করতে হয়। তাই বাণিজ্যিক চাষের জন্য এরুপ চারা লাগানোর চেয়ে চাষীরা মোথা কেটে বাদ দিয়ে সরাসরি পুরাতন গাছ লাগাতে বেশি পছন্দ করে থাকেন। এতে দ্রুত পাতা তোলা যায়। এরকম গাছ লাগানোর ৩ মাসের মাথায় পাতা তোলা যায়।

অনেকদিন জমিতে থাকার পর একই গাছ থেকে উপর্যুপরি পাতা তোলার পর গাছের গোড়া যখন লম্বা হয়ে যায় এবং গাছ যখন খাড়া থাকতে পারে না, তখন গাছ কেটে ২/৩ টা পাতা বাদ দিয়ে সেসব গাছ লাগাতে হবে।

 

অ্যালোভেরা চাষ : রোপণের সময়

বছরের যে কোন সময় অ্যালোভেরার চারা লাগানো যায়। তবে শীত ও বর্ষাকালে চারা না লাগানো ভালো। সাধারণত কার্তিক-অগ্রহায়ণ মাসে চারা বেশি লাগানো হয়। কেননা এ সময় চারা লাগালে শীতের মধ্যে গাছ মাটিতে লেগে যাওয়ার চেষ্টা করে। শীতের সময় বাজারে অ্যালোভেরার পাতার চাহিদা থাকে না। তাই চাষিরা এ সময় পাতা সংগ্রহ থেকে বিরত থাকে। পক্ষান্তরে এই ২-৩ মাসের মধ্যে চারা জমিতে ভালোভাবে লেগে যায়। শীত শেষে বসন্তে নতুন পাতা ছাড়তে শুরু করলে পাতা সংগ্রহ করা শুরু হয়। এ পদ্ধতিতে চারা রোপণ করলে বেশি পাতা পাওয়া যায়।

 

রোপণ দূরত্ব : চারা সারি করে লাগানো হয়। সারি থেকে সারির দূরত্ব ৭ ইঞ্চি ও প্রতি সারিতে ৬ ইঞ্চি পর পর চারা লাগানো হয়। ১.৫ মিটার চওড়া বেডে ২ সারিতে ও ২.২৫ মিটার চওড়া বেডে ৩ সারিতে চারা রোপণ করা হয়।

 

অ্যালোভেরা চাষ : সার ও সেচ প্রয়োগ

সাধারণত কোন রাসায়নিক সার ব্যবহার করা হয় না। যদি ইউরিয়া সার দিতে হয় তাহলে বছরে একবার সবটুকু ইউরিয়া সার জ্যৈষ্ঠ-আষাঢ় মাসে জমিতে ছিটিয়ে দিলেই চলে। সার ছিটানোর পর আগাছা নিড়িয়ে মাটির সঙ্গে সার মিশিয়ে দিতে হয়। বেশি ইউরিয়া সার দিলে রোগের আক্রমণ ও প্রকোপ বেড়ে যায়। শুস্ক মৌসুমে জমিতে প্রয়োজন মাফিক সেচ দিতে হবে। মাঝে মাঝে জমির আগাছা নিড়িয়ে দিতে হবে। অ্যালোভেরা গাছ জমিতে প্রায় দুই বছর থাকে। তাই দ্বিতীয় বছরেও প্রথম বছরের ন্যায় একই হারে জমিতে সার ও সেচ দিতে হবে।

 

অ্যালোভেরা চাষ : বালাই ব্যবস্থাপনা

পাতার দাগ রোগ : অ্যালোভেরা গাছে পাতায় দাগ পড়া এক প্রধান সমস্যা। শীতকালে এ রোগ কম থাকে। কিন্তু শীত শেষে ফাল্গুন মাসে এ রোগের প্রকোপ বেড়ে যায় এবং পাতার ব্যাপক ক্ষতি হয়। এ রোগের আক্রমণে পাতার অগ্রভাগে আলপিনের মাথার মতো ক্ষুদ্র এক বিন্দুর মতো দাগ পড়ে, সেখান থেকে আঠার মতো কষ বের হয়। ঐ আঠা শুকিয়ে বাদামি দাগের সৃষ্টি করে। এভাবে আক্রান্ত গাচের পাতায় ধীরে ধীরে দাগ বড় হতে থাকে ও দাগের সংখ্যাও বাড়তে থাকে। ধারনা করা হয় এটি ব্যাকটেরিয়াজনিত রোগ তাই ছত্রাকনাশক প্রয়োগে তেমন ফল পাওয়া যায় না। এ রোগের কারণে

পাতার চেহারা নষ্ট হয়ে যায়। বাজারমূল্যও কমে যায়। তবে যারা বাণিজ্যিকভাবে অ্যালোভেরা চাষ করেন তারা ১৫ দিন পরপর চুন পানিতে গুলে স্প্রে করে থাকেন।

 

অ্যালোভেরার গোড়া পচা রোগ : গোড়া পচা রোগে গাছের গোড়া পঁচে যায়। পরে গাছ মারা যায়। বর্ষাকালেও গাছের গোড়ায় পানি জমে থাকলে বা ভেজা থাকলে গোড়া পঁচা রোগ হয়। ছত্রাকনাশক স্প্রে করলে এ রোগের হাত থেকে নিস্তার পাওয়া যায়।

 

পোকামাকড় : অ্যালোভেরা গাছে সাধারণত কোন পোকা মাকড় দেখা যায় না। তবে মাঝে মাঝে ছাতরা পোকা, জাব পোকা, স্কেল পোকা, লাল মাকড় ইত্যাদির আক্রমণ হতে পারে।

 

অ্যালোভেরার ফসল সংগ্রহ ও ফলন

অ্যালোভেরা চারা লাগানোর ছয় মাস পর থেকে পাতা তোলা শুরু করা যায়। বছরে ৯ – ১০ মাস পাতা তোলা যায়। শীতকালে পাতা তোলা বন্ধ থাকে। সাধারণত প্রতি ১৫ দিনে একটি পাতা বের হয়। তবে চাষীরা মাসে একটি গাছ থেকে ১-২ টি পাতা সংগ্রহ করে। গাছের বৃদ্ধি ও পাতা বড় হলে প্রতি মাসে ২ টি পাতা তোলা যায়। পাতা তোলার পর পানিতে ধুয়ে পরিস্কার করে ছায়ায় শুকিয়ে আটি বেঁধে বাজারে বিক্রি করা যায়। অথবা ঝুড়িতে কলাপাতা দিয়ে স্তরে স্তরে সাজিয়ে প্যাকেট করে দূরবর্তী বাজারে পাঠানো হয়।

 

অ্যালোভেরার বাজারদর ও লাভ

স্থানীয় ভাষায় ৫০ থেকে ৫৫ কেজি পাতার এক আঁটি বা বোঝাকে এক গাইট বলে। এক ট্রাকে ২০০ থেকে ৩০০টি গাইট ধরে। প্রতি ৬ গাইট অ্যালোভেরার বাজার দর প্রায় ২০০০ টাকা। এ হিসাবে এক বিঘা জমি থেকে বছরে ১.৫ থেকে ২ লাখ টাকার অ্যালোভেরা বিক্রি করা যায়। এক বিঘা জমিতে অ্যালোভেরা চাষ করতে বছরে প্রায় ৬০,০০০ থেকে ৮০,০০০ টাকা খরচ হয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Please disable your adblocker or whitelist this site!