ডিসেম্বর ২৭: শাংহাই ম্যাগলেভ ট্রেন। গতি, নীরবতা আর ভবিষ্যতের কল্পবিজ্ঞানের আরেক নাম। চাকা ছাড়াই ছুটবে রেল। ঝমাঝম শব্দ না করেই হু হু করে এগিয়ে যাবে গন্তব্যে। এ বিস্ময় আবিষ্কার হয়েছে আগেই। তবে সেই বিস্ময়ে সম্প্রতি নতুন মাত্রা যোগ করল চীন। সম্প্রতি একটি পরীক্ষামূলক পরিবেশে চীনের ম্যাগলেভ প্রযুক্তি ভেঙেছে ঘণ্টায় ৭০০ কিলোমিটারের বিশ্ব রেকর্ড। আবার আরেক নকশায় চীন দেখিয়ে দিল এই গতি অদূর ভবিষ্যতে ছুঁতে পারে এক হাজার কিলোমিটারের মাইলফলক। অর্জনটি শুধু একটি সংখ্যার গল্প নয়; এটি মানুষের কল্পনাকে ছাড়িয়ে যাওয়ার সাহসের গল্প।
চীনের শাংহাইতে অবস্থিত ম্যাগলেভ ট্রেন লাইনটি বিশ্বের প্রথম বাণিজ্যিক উচ্চগতির ম্যাগনেটিক লেভিটেশন রেল ব্যবস্থা। এই ট্রেন চাকা ও রেলের সরাসরি সংস্পর্শ ছাড়াই চলে। দীর্ঘ সময় ধরে এটি ছিল বিশ্বের দ্রুততম বাণিজ্যিক ট্রেন পরিষেবা। এবার নিজের সেই রেকর্ড নিজেই ভাঙলো শাংহাই ম্যাগলেভ ট্রেন।
জেনে নেওয়া যাক কীভাবে চলে ম্যাগলেভ ট্রেন
ম্যাগনেটিক লেভিটেশন মানেই চুম্বকের শক্তি কাজে লাগিয়ে ভেসে থাকা। এ ট্রেনের নিচে থাকে না কোনো চাকা। পুরোটা সময় ট্রেনটাকে ধরে রাখে অদৃশ্য চৌম্বকীয় শক্তি।
ট্রেনের তলায় আর রেলের ভেতরে বসানো আছে শক্তিশালী ইলেক্ট্রোম্যাগনেট। বিদ্যুৎ প্রবাহিত হতেই সক্রিয় হয় সেই চুম্বক। একদিকে আকর্ষণ, অন্যদিকে বিকর্ষণ—এই দুই অদৃশ্য বলের খেলায় ট্রেনটি রেলের ওপর ভেসে ওঠে। বিন্দুমাত্র ঘর্ষণের ঘটনা ঘটে না এতে।

কিন্তু ভেসে থাকলেই তো চলবে না—ট্রেনকে এগোতেও হবে।
এখানেই কাজ করে আরেক বিস্ময়—লিনিয়ার মোটর। সাধারণ মোটরে যেমন ঘূর্ণন হয়, এখানে ঘূর্ণন নেই; আছে সোজা পথে ধাক্কা দেওয়ার পালা। রেলের ভেতরে থাকা চৌম্বকগুলো একের পর এক সক্রিয় হয়। সামনে টানে, পেছনে ঠেলে। এই চৌম্বকীয় ঢেউয়ের ওপর ভর করেই ছুটে চলে ট্রেন।
ছোটা শুরুর পর জ্যামিতিক হারে বাড়তে থাকে গতি। ঘর্ষণ না থাকার কারণে এ ট্রেনে নেই কোনো ঝাঁকুনি। এই ব্যবস্থায় একমাত্র প্রতিরোধ শক্তিটা হলো বায়ুপ্রবাহ।
শাংহাই ম্যাগলেভ লাইনটি পুতোং আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর এবং লংইয়াং রোড স্টেশনের মধ্যে চলাচল করে। মোট দৈর্ঘ্য প্রায় ৩০ কিলোমিটার। এই পথ অতিক্রম করতে সময় লাগে মাত্র ৮ মিনিট ১০ সেকেন্ড।
ট্রেনটি মাত্র ২ মিনিট ১৫ সেকেন্ডের মধ্যে ৩০০ কিলোমিটার প্রতি ঘণ্টা গতিতে পৌঁছাতে সক্ষম। উদ্বোধনের পর বহু বছর ধরে এর সর্বোচ্চ বাণিজ্যিক গতি ছিল ৪৩১ কিলোমিটার প্রতি ঘণ্টা, যা ২০২১ সালের আগে পর্যন্ত এটিকে বিশ্বের দ্রুততম বাণিজ্যিক ট্রেনে পরিণত করেছিল। বর্তমানে পরিচালনাগত কারণে গতি সীমিত করে ৩০০ কিলোমিটার প্রতি ঘণ্টায় রাখা হয়েছে।
তবে সম্প্রতি পরীক্ষামূলক একটি সুপারকন্ডাক্টিভ ইলেকট্রিক ম্যাগলেভকে মাত্র দুই সেকেন্ডে ঘণ্টায় ৭০০ কিলোমিটার গতিতে পৌঁছাতে সক্ষম হয়েছে। এটিই এখন বিশ্বের দ্রুততম সুপারকন্ডাক্টিভ ম্যাগলেভ।
৪০০ মিটার লম্বা পরীক্ষামূলক লাইনে ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব ডিফেন্স টেকনোলজির ম্যাগলেভ গবেষণা দল এই সাফল্য অর্জন করে। পরীক্ষায় টন-স্কেল ভার নিয়ে ম্যাগলেভটি সর্বোচ্চ ৭০০ কিলোমিটার প্রতি ঘণ্টা গতিতে পৌঁছায় এবং এটিকে নিরাপদভাবে থামানো হয়।
আবার চীনের শানশি প্রদেশের দাতং শহরে সম্প্রতি টি-ফ্লাইট নামের এমন এক ম্যাগলেভ ট্রেন তৈরি করতে চলেছে যার গতি ঘণ্টায় সর্বোচ্চ এক হাজার কিলোমিটার পর্যন্ত ওঠানো যেতে পারে। পরীক্ষামূলকভাবে চললেও এটি হবে এখনকার চলমান হাইস্পিড ট্রেনের তুলনায় তিন গুণ বেশি গতিসম্পন্ন। এই ট্রেন চালু হলে বেইজিং থেকে শাংহাই যেতে লাগবে মাত্র এক ঘণ্টা।
চায়না অ্যারোস্পেস সায়েন্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি করপোরেশনের ম্যাগলেভ ও ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক প্রপালশন ইনস্টিটিউটের প্রকৌশলী চাও মিং বলেন, টি-ফ্লাইট চীনের প্রধান নগরকেন্দ্রগুলোকে যুক্ত করে একটি ‘এক ঘণ্টার অর্থনৈতিক বৃত্ত’ গড়ে তুলতে সহায়তা করবে। হাইস্পিড রেল ও বেসামরিক বিমান চলাচলের সঙ্গে মিলিয়ে এটি তৈরি করবে একটি সমন্বিত ত্রিমাত্রিক পরিবহন নেটওয়ার্ক।
এই ট্রেনের অস্বাভাবিক গতির পেছনে রয়েছে দুটি বিপ্লবী প্রযুক্তি—লো-ভ্যাকুয়াম টিউব এবং ম্যাগনেটিক লেভিটেশন।
এই টি ফ্লাইট ট্রেনে বিশেষ টিউবের ভেতর থেকে বাতাস বের করে প্রায় শূন্যচাপের পরিবেশ তৈরি করা হয়। এতে বাতাসের বাধা থাকে না। একই সঙ্গে চৌম্বকীয় ভাসমান প্রযুক্তির কারণে ট্রেন ও রেলের মধ্যেও থাকে না কোনো স্পর্শ। দুই প্রযুক্তির সম্মিলিত প্রভাবে ট্রেন ছুটে চলে অবিশ্বাস্য গতিতে।
শাংহাই ম্যাগলেভ ট্রেন নিয়ে আরও কিছু তথ্য জানা যাক-
# এ ধরনের ট্রেন ট্রেন যেন বাম-ডানে না দুলে পড়ে যায়, এজন্য রেলের দুপাশে থাকে গাইডেন্স ম্যাগনেট। এ ছাড়া ট্রেনের অবস্থান সেন্সর দিয়ে মাপা হয় এবং সামান্য সরে গেলেই কম্পিউটার চুম্বকের শক্তি বাড়ায় বা কমায়।
# এ ধরনের ট্রেনের শক্তির যোগান দেয় বিদ্যুৎ। আর এ বিদ্যুৎ আসে সরাসরি গ্রিড থেকে। সুপারকন্ডাক্টিং ম্যাগনেটটিকে শীতল রাখতে ব্যবহার হয় তরল নাইট্রোজেন বা হিলিয়াম।
# চীনের ম্যাগলেভ ট্রেনে থাকে বিশেষ কম্পিউটার। যা প্রতি সেকেন্ডে হাজার হাজার হিসাব কষতে পারে। ট্রেন সামান্য বামে গেল কি না, ডানে ঝুঁকল কি না সেটা দেখে সঙ্গে সঙ্গে চৌম্বক শক্তি বাড়িয়ে-কমিয়ে ট্রেনকে আবার ঠিক মাঝখানে ফিরিয়ে আনা হয়।
# সুপারকন্ডাক্টিং ম্যাগনেট প্রচণ্ড শক্তিশালী হয়। এগুলোকে বেশ শীতল রাখতে হয় তাপমাত্রা হিমাঙ্কের নিচে নামিয়ে।
এসব দেখে মনে হবে, ম্যাগলেভ শুধু ট্রেন নয়—এ যেন চলমান পদার্থবিজ্ঞানের ক্লাস। যেখানে নিউটনের গতি, ফ্যারাডের বিদ্যুৎ, আর আধুনিক কোয়ান্টাম প্রযুক্তি একসঙ্গে কাজ করে।
চীনের এই ম্যাগলেভ প্রকল্পের নির্মাণকাজ শুরু হয় ২০০১ সালের ১ মার্চ এবং বাণিজ্যিক পরিষেবা চালু হয় ২০০৪ সালের ১ জানুয়ারি। পুরো প্রকল্পটি সম্পন্ন করতে সময় লাগে প্রায় আড়াই বছর এবং ব্যয় হয় প্রায় ১০ বিলিয়ন ইউয়ান। প্রথমদিকের শাংহাই ম্যাগলেভ ট্রেন সেটের দৈর্ঘ্য ছিল ১৫৩ মিটার। এতে আছে তিন শ্রেণির আসন ব্যবস্থা। মোট ধারণক্ষমতা ৫৭৪ জন। প্রথম শ্রেণি ও দ্বিতীয় শ্রেণির আলাদা বিন্যাসও রয়েছে।
২০১০ সালের পর চীনে নিজস্বভাবে তৈরি একটি চতুর্থ ট্রেন যুক্ত করা হয়, যা চীনের ক্রমবর্ধমান প্রযুক্তিগত সক্ষমতার প্রতিফলন। এই ট্রেনের পরিচালন ব্যয়ের বড় অংশ যায় শক্তি খাতে, এরপর রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচালন ব্যয়।
শাংহাই ম্যাগলেভ ট্রেন মূলত একটি পরীক্ষামূলক সাফল্য। এটি প্রমাণ
করেছে যে ম্যাগলেভ প্রযুক্তি কার্যকর এবং নিরাপদ হতে পারে। চীন বর্তমানে নিজস্ব ম্যাগলেভ প্রযুক্তির আরও উন্নয়নে কাজ করছে এবং বিভিন্ন দীর্ঘপথের ম্যাগলেভ রুট তৈরির পরিকল্পনাও নেওয়া হয়েছে।



















