নাম শুনলেই জড়িয়ে ধরে এক ঝাঁক শীতলতা। আর মুখে দিলে তো কথাই নেই। তুলতুলে মিষ্টি বরফের শিহরণ জাগানো এক গল্পের শুরু যেন। বিশ্বজুড়ে স্বাদের বিস্ময় হয়ে ঘুরে বেড়ায় হাতে হাতে। আর এই বিস্ময়ের জন্ম হয়েছিল প্রায় তিন হাজার বছর আগে প্রাচীন চীনে। আজ আমরা যাকে ‘আইসক্রিম’ নামে চিনি, সেই জমাট মিষ্টির প্রথম ছোঁয়া লেগেছিল চীনের রাজপথ আর নির্জন প্রাসাদবাগানে। তখন ছিল না কোনো ফ্রিজ, ছিল না আধুনিক মেশিন—তবু চীনের রাজদরবারে তৈরি হয়েছিল দুধ, চাল, মধু আর তুষারের অপূর্ব মিশ্রণে এক শীতল অভিজাত খাবার।

চীনের এই প্রাচীন কৌশল পরে ইউরোপ, আরব, এবং এশিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে নানা রূপে নানা স্বাদে। এমনকি এক পর্যায়ে উপমহাদেশের মোগল রাজদরবারকেও মাতিয়ে তোলে আইসক্রিম। আইসক্রিম শুধু খাবারের জগতেই নয়, সভ্যতার বিনিময়ে সাংস্কৃতিক সংযোগেরও এক মিষ্টি প্রতীক।
এবার কড়া নাড়া যাক আইসক্রিমের সুপ্রাচীন ইতিহাসের দরজায়—
ফরাসি আইসক্রিম মাস্টার ও রন্ধনশিল্পী জেরার্ড টোরাঁ। ১৯৬৩ সালে নরম্যান্ডিতে জন্মগ্রহণকারী টোঁরা অনেক পুরস্কার জেতেন। ২০০৩ সালে আইসক্রিম এবং আইস স্কাল্পটিং-এর বিশ্ব চ্যাম্পিয়নও তিনি। আর সেই টোরাঁই জানালেন, আইসক্রিমের উৎস প্রাচীন চীনে, যেখানে প্রায় ৩,০০০ বছর আগে বানানো হতো ভাত ও দুধের এক ধরনের হিমায়িত মিশ্রণ।
২০০৬ সালে আইসক্রিমের ঐতিহাসিক রেকর্ড অনুসন্ধানের জন্য ব্যাপকভাবে পড়া শুরু করেন টরিন। ২০১০ সালে, তিনি আইস অ্যাসোসিয়েশনের নৃবিজ্ঞানের গ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ট্যুর শুরু করেন। এরপরই তিনি এমনটা জানান বিশ্ববাসীকে।
এ ছাড়াও বিভিন্ন নথিতে জানা যায়, প্রাচীন চীনের থাং রাজবংশে ‘সুশান’ নামের এক ধরনের জমাট দুধের তৈরি খাবার জনপ্রিয় ছিল, যা গরু বা ছাগলের দুধ থেকে চিজ বানানোর সময় উপরের ক্রিমটা তুলে বানানো হতো। দুধের এই ক্রিম গরম করে গলিয়ে ছাঁকনিতে ঢেলে পাহাড়ের মতো একটি আকৃতির ছাঁচে ফেলা হতো — সেখান থেকেই এর নাম হয় ‘সুশান’, অর্থাৎ ‘ক্রিম-পাহাড়’। এরপর বরফে ঠান্ডা করে জমিয়ে, ফুলের পাপড়ি দিয়ে সাজিয়ে পরিবেশন করা হতো রাজদরবারে।
থাং রাজপরিবারের প্রিয় এই ডেজার্ট এতটাই গুরুত্বপূর্ণ ছিল যে, থাং সম্রাট কাওচোংয়ের দ্বিতীয় পুত্র প্রিন্স চাংহুয়াইয়ের সমাধিফলকেও এর চিত্র পাওয়া যায়। তাতে দেখা যায়, রাজপুত্রকে ‘সুশান’ বা বরফযুক্ত দুধের ক্রিম পরিবেশন করা হচ্ছে।
চীনা কবি ওয়াং লিংরানের একটি কবিতায় সুশানকে এমনভাবে বর্ণনা করা হয়েছে যা একাধারে কঠিন ও তরলের মাঝামাঝি, আর জিভে পড়া মাত্র গলে যায় —আর এতেও পরিষ্কার হয় যে, আধুনিক আইসক্রিমের পূর্বসূরি আসলে কে।
থাং আমলে সাধারণ জনগণের নাগালের বাইরে ছিল বরফ। শীতকালের বরফ সংগ্রহ করে সেটাকে মাটির গভীরে বিশেষ কুঠুরিতে সংরক্ষণ করে রাখা হতো। আর এর দাম ছিল সোনার সমান। এ কারণে প্রাচীন চীনে আইসক্রিম ছিল একপ্রকার বিলাসিতা—সংরক্ষিত থাকতো সম্রাটদের জন্য।

সোং যুগে চীনের শহুরে জীবনধারায় আসে আমূল পরিবর্তন। শহরে গড়ে ওঠে ‘আইসড ড্রিংক স্টল’ বা ঠান্ডা পানীয়ের দোকান। কবি ও লেখক মং ইউয়ানলাও তাঁর বইতে খাইফেং শহরের গ্রীষ্মকালীন দৃশ্য এভাবে তুলে ধরেন: ‘মানুষজন জলের ধারে বরফভর্তি পাত্রে রাখা ঠান্ডা ফলমূল, তাজা পদ্মবীজ বা ঠান্ডা মাছ উপভোগ করছে।’
এই সময়েই আইসক্রিম-জাতীয় খাবার রাজদরবার থেকে ধীরে ধীরে নাগরিক সমাজেও ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে।
১২০৬–১৩৬৮ সালের ইউয়ান রাজবংশের সময় নতুন এক ধরনের আইসক্রিম তৈরি হয় ‘বিংলাও’ নামে। যার মানে হলো বরফযুক্ত পনির। এটি তৈরি হতো ফল, মধু ও অন্যান্য উপাদান মিশিয়ে।
রেসিপিটি চীনা রাজপ্রাসাদ গোপন রেখেছিল। যদিও প্রচলিত গল্পটি হল, চেঙ্গিস খানের নাতি এবং ইউয়ান রাজবংশের সম্রাট কুবলাই খান, ইতালীয় অভিযাত্রী মার্কো পোলোর সাথে মূল্যবান রেসিপিটি শেয়ার করেছিলেন। আর সেটাই পরে ইতালিতে গিয়ে জেলাটো হয়ে যায়।
চীনের ছিং রাজবংশে আইসক্রিমের আরেকটি ব্যবহার দেখা যায়—ওষুধ হিসেবে! সম্রাট ও অভিজাতরা গরমে বরফে রাখা মিষ্টি ও ফল ব্যবহার করতেন, যা শরীরকে ঠান্ডা করতে, ব্যথা কমাতে এবং কাশির চিকিৎসায় সাহায্য করতো বলে ধারণা করা হতো।
ইউরোপে আইসক্রিম আছে ষোড়শ শতকের দিকে। এখানেও আসে চীন ঘুরে আসা মার্কো পোলোর নাম। আবার ওই সময়টায় এক ইতালিয়ান শেফকে ফ্রান্সে নিয়ে গিয়েছিলেন ক্যাথরিন ডি মেডিচ্চি। সেই শেফের হাত ঘুরে ফরাসিও পায় আইসক্রিমের স্বাদ।
চীনে আধুনিক ধাঁচের আইসক্রিমের উৎপাদন শুরু হয় বিংশ শতকের গোড়ায়। ১৯১৩ সালে শাংহাইয়ে ‘হেনিংসেন প্রোডিউস কোম্পানি’ নামের একটি আমেরিকান প্রতিষ্ঠান প্রথম পপসিকল বিক্রি শুরু করে।
১৯৫০ সালে শুধু কুয়াংমিং বছরে ৮০০ টন আইসক্রিম তৈরি করত। ৯০-এর দশকে তা দাঁড়ায় ১৫ হাজার টনে। তবে চীনের বাজার সংস্কারের ফলে আইসক্রিম ইন্ডাস্ট্রি এখন রীতিমতো বিশাল – বাজার মূল্য ১৬০ বিলিয়ন ইউয়ান! প্রতিবছর গড়ে তিন হাজার নতুন প্রতিষ্ঠান এই খাতে প্রবেশ করছে।
আর এখন আইসক্রিম ছাড়া গোটা দুনিয়াটা সম্ভবত একদিনও চলতে পারবে না। কারণ এখন প্রতিদিন মানুষ খাচ্ছে প্রায় সাড়ে ১৫ বিলিয়ন লিটার আইসক্রিম। চীনের আবিষ্কার এই আইসক্রিমের আরও কিছু তথ্য জানা যাক এবার—
প্রায় সব দেশের মানুষই নিয়ম করে আইসক্রিম খায়। তবে এক্ষেত্রে মাথায় রাখতে হয় স্বাস্থ্যর কথা। যুক্তরাষ্ট্রের বাসিন্দারা মাথাপিছু বছরে যেখানে ২৫ লিটারেরও বেশি আইসক্রিম খাচ্ছে, সেখানে চীনারা বছরে খায় মাত্র ৪ লিটার।
২০২৪ সালে বিশ্বে আইসক্রিমের বাজার ছিল ৭8 বিলিয়ন ডলারেরও বেশি। ২০২২ সালে ছিল প্রায় ৭০ বিলিয়ন ডলার।
জরিপে দেখা গেছে খাবার শেষে ডেজার্ট আইটেম হিসেবে নারীদের চেয়ে পুরুষরাই আইসক্রিম বেশি পছন্দ করে।
ভালো মানের আইসক্রিমে আছে ক্যালসিয়াম, ভিটামিন ডি, রিবোফ্লাভিন, ভিটামিন এ এবং ফসফরাস। মাঝে মাঝে আইসক্রিমের প্রোবায়োটিক হজমেরও সহায়ক।
আইসক্রিম এবং মস্তিষ্কের মধ্যে একটি আকর্ষণীয় সম্পর্ক রয়েছে। আমরা যখন আইসক্রিম খাই, তখন এটি মস্তিষ্কের আনন্দদায়ক অনুভূতির কেন্দ্রটি সক্রিয়। আর তখনই আমাদের মগজে ডোপামিন হরমোনের নিঃসরণ ঘটে। আর এই কারণেই আইসক্রিমকে বলা হয় মন ভালো করা খাবার।
সূত্র: সিএমজি বাংলা