class="post-template-default single single-post postid-22101 single-format-standard wp-custom-logo group-blog vl-boxed aa-prefix-matin-">
Shadow

করোনা দিনের কড়চা-২

করোনাআহমেদ তাকদীর


বিদায় পকু মকু

প্রয়োজনীয় অপ্রয়োজনীয় সব কিছুই আমাদের মধ্যে এক প্রকার মায়া তৈরী করে। সহসা এটা বোঝা যায় না। দূরত্ব বা বিয়োজন এটা স্পষ্ট করে। আমার চেয়ারের পাশেই আমাদের পাখির খাঁচাটি থাকে। দুটো কোয়েল। সারাদিন কিচমিচ করে। ডানা ঝাপটায়। কোয়েলের ডাক অতি উচ্চ স্কেলে। মিতার পড়াশুনোর ব্যঘাত যাতে না ঘটে তাই মাঝে মধ্যে আমরা বারান্দায় খাঁচাটি রেখে আসি। সকালে বা রাতে মন চাইলে ল্যাপটপটি নিয়ে একটু বসি। এক আধ লাইন লেখার চেষ্টা করছি। কিন্তু কি অদ্ভুদ ওদের ডাক না শুনলে মন ভালো লাগে না। মনে হয় কি যানি নেই। চার দিনের ব্যবধানে আমার দুটো পাখিই শেষ। মেয়েটার কান্নাকাটি, পাখিদের দেহাবশেষ ফেলে দেয়া ইত্যাদি নিয়ে ব্যস্ততায় ওদের প্রতি মায়া অনুভবের সময় হয়নি। আজ বৌদ্ধ পূর্ণিমা। আকাশে ইয়া বড় চাদ। কিছুক্ষণ বারান্দায় বসে সিগারেট খেলাম। আকাশ দেখলাম। চাদ দেখলাম। ল্যাপটপ নিয়ে বসতেই কেমন উস্কুখুস্কু। কি জানি নেই। মিতাও একটু পর পর পায়চারি করে। যদিও ওর এমএস পরীক্ষা চলছে, অনলাইনে। কিন্তু একটু পর পর সে বারান্দায় ফাকা খাঁচার দিকে তাকিয়ে থাকে। আবার এসে চেয়ারে বসে। বিষয়টি আজই লক্ষ্য করলাম। আমার কেমন একটা শূন্যতাবোধ হচ্ছিল। কেমন একটা মায়া পড়ে গিয়েছিলো। প্রতিদিন দুবার খাবার দেয়া। পানি দেয়া। মাঝে মধ্যে হাতে ধরে দেখা। দু একদিন পর পর খাঁচা খুলে দিতাম। ঘরময় ঘুড়ে আবার খাচায় ঢুকে যেতো ওরা। পাখির খাঁচার মুখটি এখনো খোলা। পাখি নেই। কি অদ্ভুদ। এই চেয়ারটাতে আর বসতে ভালো লাগছে না। এমনকি আকাশের চাঁদও ভালো লাগছে না। কিভাবে যেনো ওরা দুজন সংসারের অংশ হয়ে গিয়েছিলো। ওদের প্রতি এত মায়া জন্মেছিলো বুঝিনি। মৃত্যুই সেটা বুঝিয়ে দিলো।


পাখিরা ফিরে আসছে
পাখিগুলো আসতে শুরু করেছে। প্রথমে আমরা পাত্তা দিইনি। কিন্তু এখন সকাল-সন্ধ্যা ওরা বারান্দা জুড়ে ওড়াউড়ি করে। ডানা ঝাপটায়। বিচিত্র সব সুরে ডাকে। এই প্রথম আবিস্কার করলাম বইয়ে পাখির যে ডাক পড়েছি তার থেকে ওরা আলাদাভাবে ডাবে। কি জানি, নেটের যুগে হয়তো কম্পোজিশন কিছুটা আধুনিক করেছে। গত ছ সাত দিন ধরে বিষয়টি খুব এনজয় করছি। আর এটা ওরির নতুন শখের কারণে। প্রতিদিন সন্ধ্যায় সে পাখিকে খাবার দেয়। পুরো বারান্দা জুড়ে। ওর ছোট ছোট খেলনা হাড়ি পতিলের কোনটায় চাল, কোনটায় ভাত আবার কোনটায় ওর সদ্য মৃত কোয়েলের খাবার। প্রথম প্রথম অবশ্য পাখি আসেনি। তবে দুদিন যেতেই অবস্থা বদলেছে। প্রথমে একটি দুটি কাক। পরে চড়–ই আর শালিক। আরো বেশ কিছু। এখন দিনভর পাখিদের আনাগোনা। তবে সন্ধ্যার পর আর পাখিরা আসে না। বিষয়টি নিয়ে ওরি খুব চিন্তিত। ওরা কোথায় যায়? নানা ভাবে, ঘুড়িয়ে ফিরিয়ে দিনে বেশ কয়েকবার তার এ প্রশ্ন আমাকে শুনতে হয়। আমি একেকবার একেকটি উত্তর দেই। মেয়ে আমার এ যুগের। সে চট করে আমার ভুল উত্তর ধরে ফেলে। মুখের ওপর বলে ফেলে বাবা কাল তো বলেছিলে পাখিরা রাতে ডাক্তারের কাছে যায়, আর আজ তো বলছে রাতে ঘুমায়। কিন্তু ওরা সন্ধ্যায় কেনো ঘুমায় বাবা? আমিতো অনেক রাতে ঘুমাই। আমি বলি ওদের সক্কাল সক্কাল উঠতে হয়। উঠে গান গাইতে হয়। তার পরও কাজ আছে। ওরা গাছে গাছে যায়। গাছের ফল খায়। সেই বিচি ওরা বিভিন্ন জনপদে পটি করে গাছ লাগায়। ওর সচঞ্চল জবাব বাবা তুমিইতো কিছু গাছ লাগাতে পারো, তাহলেতো পাখিদের কষ্ট কমে। আমি বলি ওটা ওর কষ্ট নয়, আনন্দ। আমি করলে ওরা মাইন্ড করবে মা। ওদের রুটিনে বাধা দিলে আমাকে এসে ঠোকর দেবে। উত্তরটি ওর পছন্দ হয়নি। কিন্তু কি করা। ঘরে বসে বসে আর ভালো লাগে না। পাখিদের মতো উড়ে উড়ে পটি করে আসলে অবশ্য মন্দ হয় না। আকাশেতো সামাজিক দুরত্বের বালাই নেই, তাই না?


মায়া…

পৃথিবীর ছোট, বড়, ক্ষুদ্র, ক্ষুদ্রাতি সবকিছু এক মায়ার জালে বাধা, বুঝলি। কারো নিস্তার নেই। কানেকটেড উইথ ইচ আদার। প্রতিটি প্রাণী, অপ্রাণী, নিরাকার সব্ব। ইটস কল ফেইট। আমাদের সবার ফেইট সবার সঙ্গে ইন্টারকানেকটেড। এক কমন ডেসটিনি। স্বপ্নের মধ্যে এক বুড়ো অধ্যাপক সমানে জ্ঞান দিয়ে যাচ্ছিল। এমনিতেই সকাল থেকে মন ভালো নেই। আমার অসুস্থ কোয়েলের একটি সকালে মারা গেছে। মেয়ের কান্না আর ওর মায়ের মুখ সামলাতে সামলাতে রোজারভারে দুপুরের পর ঘুমিয়ে পড়েছি। আর ঘুমের মধ্যে এ তাত্তি¡ক স্বপ্ন। ইদানিং দেখছি জ্ঞানী স্বপ্নের যন্ত্রণাতে ঘুমানো দায়। অবশ্য নিশ্চিন্তে ঘুমানোর সে ভাগ্যও আমার নেই। মেয়ের নিঠুর সঙ্গীত একটু পর পর জেগে উঠছে। ঘুমন্ত বাবার পেট ধরে ধাক্কা দিচ্ছে আর ওর পকু (কোয়েলের নাম) কেনো চলে গেলো। পকু কি তারা হয়ে গেছে? ও বাবা। ওর ধাক্কায় ঘুম ভেঙ্গে চোখ ডলতে ডলতে বলি মা রাত টাতো হতে দে। দিনের বেলায় পাখিরা তারা হয় না।

ঘুম ছুটে গেলো। কিন্তু স্বপ্নের জ্ঞানী ভদ্রলোকের মুখ ভুলতে পারছি না। বিষয়টা যেনো ক্লাস টিচারের অংক হোমওয়ার্ক না করার পর অংক ক্লাসের সেই আতংক। কখন স্যার খাতা দেখতে চাইবে। ছোট বেলার কথা মনে পড়ে গেলো বয়স যখন অল্প ছিলো তখন জ্ঞান দিতে কে বাদ রেখেছে বলুন। রুনুর মা, কাশু চাচা (ভ্যান চালক) স্কুলের মুখে মোর্শেদভাই (চটপটি আলা) কে দেয়নি জ্ঞান। এক এক জন উপদেশ আর জ্ঞানের পাহাড় ঝেড়েছে। ভালো শ্রোতা ছিলাম। তাই জ্ঞানের সঙ্গে বাড়তি কিছু সুযোগও পেতাম। এই যেমন মোর্শেদভাই বললো জানেন এই শহরের অলিতে গলিতে একসময় আমার বাবার নাম ডাক ছিলো, মামা। কি করমু অল্প বয়সে বাপটা মইরা গেলো। আমার বাপ আর বর্তমান মেয়র এক সঙ্গে রাজনীতি করতো। কি জানি বাইচ্চা থাকলে আইজকা হয়তো আমি অন্য কিছু হইতে পারতাম। সবই মামা কপাল। কপালের লিখন না যায় খণ্ডন। মোর্শেদ ভাইয়ের এই গপ্প আমাদের শতবার শোনা। আজ মোর্শেদ ভাইয়ের আফসোস মনে পড়ছে আর ভাবছি আসলেইতো কত কিছুই হতে পারতো, কিন্তু হলো কই? সবই বোধ হয় মায়া।


সামাজিক দুরত্ব

অনেক অনেক আগের কথা। পৃথিবীর দুই প্রান্তে তখন বিচরণ দুই প্রজাতির। নিয়ন্ডারথাল ও হোমোসেপিয়েন্স। আফ্রোএশিয়া জুড়ে নিয়ন্ডারথাল আর ইউরোপ আমেরারিকা আর এশিয়ার এক অংশ জুড়ে হোমোসেপিয়েন্স। নিয়ন্ডারথালদের মাথা বড়, বুদ্ধি বেশি। সৃষ্টিশীল আর লোনলী। অন্যদিকে হোমোসেপিয়েন্সরা নেতৃত্বে বিশ্বাসী (আদতে বেশিরভাগ গাধারপাল)। দলবদ্ধ হয়ে বসবাস করে। যেহেতু নেতৃত্ব আছে সেহেতু তারা খুব সহজেই সভ্যতা তৈরি ও দখলকরা দুটোই পারে। তো এক বছর এ দু পক্ষের যুদ্ধ লাগলো। লোনলী নিয়েন্ডারথালরা সংঘবদ্ধ হোমোসেপিয়েন্স বা আমাদের পূর্বপুরুষদের কাছে গো হারা হেরে গেলো। টিকে রইলাম শুধু আমরা। মানে হোমোসেপিয়েন্স। পূর্বপুরুষদের দোয়ায় আমরা একে অন্যের সঙ্গে মিলে মিশে লাখ বছর পার করে দিলাম। সিন্ধু, মায়া, এজটেক, হরপ্পার পর গড়ে তুললাম আম্রিকা জাপান, চীনা আরো কত শক্তিশালী সভ্যতা।

সব হলো কিন্তু ভাইরাস ভাইরাল হওয়া বন্ধ হইলো ? নিয়ন্ডারথালরা তো মইরা ভূত। ওরা নিশ্চয়ই এখন দূর থেকে দেখে আর হাসে, খুব তো বাহাদুরি করছিলা, এখন তো ঘর থেইক্যা বাইর হইতে পারো না। পারলা না ভাইরাস করোনার সঙ্গে…ওরা মরে গ্রহ হলেও আমরা জানি এ ঘরে থাকা মানে পরাজয় নয় এটা আবার এগিয়ে যাওয়ার শক্তি। আমার তো অন্তত তাই মনে হয়।

বি.দ্র: এখানে উল্লেখিত ঐতিহাসিক বিষয়সমূহ একান্তই বিড়িখোড়িক। কেউ সিরিয়াসলি নিলে ফসিল বিজ্ঞানীরা অক্কা পাবে।

লেখকের ইমইেল: ahmed.takdir@gmail.com

 

করোনা দিনের কড়চা : আহমেদ তাকদীর

1 Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Please disable your adblocker or whitelist this site!