যাত্রীবাহী বাস, লঞ্চ ও ট্রেন যোগাযোগ বন্ধ করে দিলেও বিকল্প পথে হাজারো মানুষ বাড়ি ফিরছেন। আর তাই বাংলাদেশের গ্রামে করোনাভাইরাস সংক্রমণের ঝুঁকি এখন বেশি।
গ্রামে করোনাভাইরাস সংক্রমণ রোধে গত বৃহস্পতিবার থেকে সরকারি-বেসরকারি সব অফিস ১০ দিন ছুটি ঘোষণা করা হয়। তবে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার যে উদ্দেশ্য নিয়ে এই ছুটি ঘোষণা করা হয়েছিল, তা কতটুকু কাজে আসবে তা নিয়ে সংশয় সৃষ্টি হয়েছে। আগে থেকে বিদেশফেরত ব্যক্তিরা গ্রাম-গঞ্জে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে অবস্থান করছেন। তাদের হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকার নির্দেশনা দেওয়া হলেও বেশিরভাগ ব্যক্তিই তা মানছেন না। হোম কোয়ারেন্টাইনে না থেকে তারা সর্বত্র ঘোরাঘুরি করছেন। পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে সরকার সংক্রামক ব্যাধি আইন অনুযায়ী এসব ব্যক্তির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশনা দেয়।
দেশের অনেক জায়গায় গত কয়েকদিনে হোমে কোয়ারেন্টাইনের শর্ত না মানার দায়ে বহু মানুষকে জরিমানা করা হয়েছে। এরপর সরকার বিদেশফেরতদের নাম-ঠিকানা সংগ্রহ করে বাড়ি বাড়ি গিয়ে তাদের খুঁজে বের করার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু বিদেশফেরতরা ঠিকানা হিসেবে যেসব স্থানের নাম উল্লেখ করেছেন, সেখানে গিয়ে তাদের পাওয়া
যাচ্ছে না। তারা অন্যত্র থাকছেন। এর মধ্যে ছুটি পেয়ে ঢাকার রাজপথ পুরোপুরি ফাঁকা করে হাজারো মানুষ গ্রামে ফিরেছেন। এতে তারা গ্রামকেও অনিরাপদ করে তুলেছেন। এখন গ্রামে করোনাভাইরাস সংক্রমণের ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, যেভাবে গ্রামে মানুষ ফিরেছে, সেটি অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। যেখানে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে বলা হলো, সেখানে গাদাগাদি করে বিভিন্ন পরিবহনে মানুষ গ্রামে ফিরেছেন, সেটিতে আরও ঝুঁকি তৈরি হলো।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও ভাইরোলজিস্ট অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, করোনাভাইরাস ইস্যুতে সরকারের সিদ্ধান্তগুলো অনেক বিলম্বে এসেছে। বিদেশফেরতদের কোয়ারেন্টাইনে রাখতে না পারা সংশ্নিষ্ট দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের চরম অবহেলা ও ব্যর্থতা। প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইনে সবাইকে যেহেতু রাখা যাবে না, সুতরাং তাদের হোম কোয়ারেন্টাইন নিশ্চিত করতে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়ার প্রয়োজন ছিল। সেটিতেও ব্যর্থতার পরিচয় মিলেছে। এখন টানা ১০ দিন ছুটি ঘোষণার পর মানুষ ইচ্ছামতো গ্রামে ছুটছেন। যেন বাধা দেওয়ার কেউ নেই। গ্রামে যাওয়ার পথে এসব মানুষ অন্যদের সঙ্গে মিশেছেন, আবার গ্রামে ফিরেও পরিবারের সদস্য ও প্রতিবেশীদের সংস্পর্শে যাবেন। এভাবে কী করোনা পরিস্থিতি সামাল দেওয়া সম্ভব হবে? এখন গ্রামেও ঝুঁকি তৈরি হলো। তবে এখন জরুরি ভিত্তিতে গ্রামে ফেরা এসব মানুষের হোম কোয়ারেন্টাইন নিশ্চিত করার তাগিদ দেন তিনি।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন অনুষদের সাবেক ডিন ও করোনা প্রতিরোধ জাতীয় কমিটির সমন্বয়ক অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ সমকালকে বলেন, গ্রামে হাজারো মানুষ ফিরে যাওয়ার ঘটনা নিঃসন্দেহে আতঙ্কের। তবে এখন তাদের সামাজিক দূরত্ব মেনে চলতে হবে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর করোনা প্রতিরোধে যেসব নির্দেশনা দিয়েছে, সেগুলোর যথাযথভাবে প্রয়োগ করতে হবে। অর্থাৎ, বাড়িতে ফিরে নিজেকে অন্যদের কাছ থেকে দূরত্বে রাখতে হবে।
তিনি গ্রামে ফেরত যাওয়াদের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘পৃথক কক্ষে অবস্থান করতে হবে। পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকে নিজেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন রাখুন। অন্তত ১৪ দিন বাইরে ঘোরাঘুরি করবেন না। এসব বিষয় না মানলে নিজের পাশাপাশি পরিবারের সদস্য মা-বাবা, ভাইবোন, স্ত্রী, ছেলেমেয়েসহ প্রতিবেশী সবার জন্য ঝুঁকি তৈরি হবে। সর্বোপরি দেশের সবার জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াবে। সুতরাং সামাজিক দূরত্ব মেনে চলে নিজে নিরাপদ থাকুন, সবাইকে নিরাপদ রাখুন।’
গ্রামে করোনাভাইরাস নিয়ে বিশেষজ্ঞরা যা বললেন
বিপুলসংখ্যক মানুষ গ্রামে যাওয়ায় ঝুঁকির বিষয়টি স্বীকার করে জাতীয় রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) পরিচালক অধ্যাপক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা বলেন, ছুটি পেয়ে গ্রামে ফেরা মানুষগুলো কিছুটা ঝুঁকি তৈরি করেছে- এটি অস্বীকার করার উপায় নেই। তবে তাদের প্রতি আহ্বান থাকবে, সবাই যেন গ্রামে করোনাভাইরাস ঠেকাতে বাড়িতে গিয়ে হোম কোয়ারেন্টাইনের শর্ত পুরোপুরি মেনে চলেন। পরিবারের সদস্য, প্রতিবেশী সবার সঙ্গে দূরত্ব বজায় রাখতে হবে। ঘরের মধ্যে পৃথকভাবে অবস্থান করতে হবে। অন্যথায় রোগটি ভয়াবহ আকারে ছড়িয়ে পড়তে পারে। সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখলে আমরা এই রোগটি মোকাবিলা করতে সক্ষম হবো। সুতরাং সবাইকে এই নির্দেশনাটি মেনে চলতে হবে।
বিচ্ছিন্ন করেও ঠেকানো যায়নি যোগাযোগ :স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গত ১৮ ফেব্রুয়ারি থেকে ১৮ মার্চ পর্যন্ত চার লাখ ৩৯ হাজার ৯৫৩ দেশি-বিদেশি নাগরিক বাংলাদেশে প্রবেশ করেছেন। গতকাল বৃহস্পতিবার পর্যন্ত হোম কোয়ারেন্টাইনে আছেন মাত্র ৪৭ হাজার ৩৬১ জন। অর্থাৎ, ১০ দশমিক ৭৬ শতাংশ মানুষ নিময় মেনে ঘরে থাকছেন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, জেলা প্রশাসন ও সিভিল সার্জনরা স্বাস্থ্য বিভাগের কাছে জানিয়েছেন, তালিকায় থাকা বিদেশফেরত বেশিরভাগ ব্যক্তিকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। কারণ বিদেশফেরতরা ঠিকানা হিসেবে যেসব স্থানের নাম উল্লেখ করেছেন, সেখানে গিয়ে তাদের পাওয়া যায়নি। তারা অন্যত্র থাকছেন।
আবার কয়েকটি জেলা থেকে অভিযোগ আসছে, বিদেশফেরতদের একটি বড় অংশ সামাজিক দূরত্ব না মেনে ইচ্ছামতো ঘোরাঘুরি করছে। তাদের সবাইকে খুঁজে বের করা প্রশাসনের পক্ষে কঠিন ব্যাপার। গ্রামে করোনাভাইরাস ছড়ানো ঠেকাতে তাদের সচেতনতাও বেশি জরুরি।
সংশ্নিষ্টরা জানান, করোনাভাইরাস মোকাবিলায় বিশ্বের অনেক দেশ ‘লকডাউন’ পদ্ধতি গ্রহণ করেছে। এই পদ্ধতি গ্রহণের সফলতাও মিলেছে হাতেনাতে। বাংলাদেশে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয় ৮ মার্চ। এরপর থেকে প্রতিদিনই আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। গতকাল পর্যন্ত আক্রান্তের সংখ্যা ৪৪ জনে পৌঁছেছে। মৃত্যু হয়েছে পাঁচজনের। করোনা সংক্রমণ বাড়তে থাকায় সর্বত্রই আতঙ্ক ছড়ায়।
করোনা রোধে প্রথমে মাদারীপুরের শিবচর উপজেলার সঙ্গে অন্যান্য স্থানের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়। সরকারিভাবে ঘোষণা না দিলেও এটিকে কার্যত লকডাউন বলা যায়। এরপর দেশের আরও কয়েকটি উপজেলায় সংক্রমণ ছড়ানোর পর শিবচরের মতো বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়েছে।
ইতোমধ্যে সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করতে সারাদেশে সেনাবাহিনী কাজ করছে। আগে থেকে পুলিশ বাহিনী মাঠে ছিল।
জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ বলেন, পুরো বিশ্বই করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলায় হিমশিম খাচ্ছে। আমরা পরিস্থিতি মোকাবিলায় সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি। কিন্তু সরকারের একার পক্ষে সবকিছু সম্ভব নয়। সাধারণ মানুষকে সরকারের নির্দেশনা মেনে চলতে হবে। যদি এসব নির্দেশনা মেনে না চলেন, তাহলে ঝুঁকি তৈরি হবে। সেটি সবাইকে বুঝতে হবে।