Monday, December 23
Shadow

রম্য সায়েন্স ফিকশন : আকালুর একদিন : ধ্রুব নীল

রম্য সায়েন্স ফিকশন : আকালুর একদিন

মধ্যবয়সী অবিবাহিত বিজ্ঞানী আকালু সবে তার সকালের নাশতায় কামড় দিয়েছেন, এমন সময় হন্তদন্ত হয়ে দৌড়ে এলেন তার একমাত্র সহকর্মী ড. নিনিনি। বয়সে আকালুর সমান। এখনও বিয়ে করেননি। মহাকাশযান চৈতালীতে আকালু একমাত্র পুরুষ আর নিনিনি একমাত্র নারী। জীবনের দীর্ঘ সময় দুজন একসঙ্গে মহাকাশযানেই কাটিয়েছেন। ছুটে এসে বাচ্চাদের মতো মাথা চাপড়ে নিনিনি যা বললেন তাতে খানিকটা বিরক্তই হলেন বিজ্ঞানী আকালু।
‘ড. আকালু! মহাবিপদে পড়েছি! আমাকে বাঁচাও! আমার ব্রেনবুক আবারও হ্যাক হয়েছে। কারা জানি উল্টাপাল্টা বার্তা পাঠাচ্ছে। উফফ…এ খাঁচা ভাঙব আমি কেমন করে! এ খাঁচা ভাঙব…উফফ কী সব গাইছি বলো তো? এটা নিশ্চয়ই হ্যাকারদের কাণ্ড! কী অদ্ভুত গান রে বাবা! এ খাঁচা ভাঙব…।’
‘হ, বুঝসি। উল্টাসিধা চিন্তা করছিলা হয়তো, এ জন্য ভাইরাস ঢুকসে। হ্যাকারদের কাম। এই যে আমারে দেখো, ব্রেইনবুক-ট্রেইনবুক কোনো অ্যাকাউন্ট নাইক্কা, ঝামেলাও নাইক্কা।’
আকালুর কথায় কান না দিয়ে তিড়িংবিড়িং করে বিশ্রামকক্ষের দিকে ছুট লাগালেন নিনিনি। এ টাইপ ভাইরাস থেকে বাঁচতে ঘুমাতেই হবে। ঘুমের মধ্যে টেকনিশিয়ান রোবট এসে ব্রেনবুক রিস্টার্ট দিয়ে দেবে।
বিজ্ঞানী আকালুর চিন্তায় খেলা করছে অন্য কিছু। সেই চিন্তা জানার কিংবা হ্যাক করার সুযোগ নেই কারো। সরকারি চাকরি করলেও সরকারের কাজ কারবার নিয়ে খুব একটা ভাবেন না। ভাবলেও কিছু যায়-আসে না। কারণ তার পকেটে সব সময়ই একটা চিন্তা-জ্যামার থাকে। মস্তিষ্কে সরকারের নজরদারি ঠেকানোর মোক্ষম যন্ত্র! ইদানীংকার খবর দেখেই যন্ত্রটা বানিয়েছেন আকালু।
গতকালই ঢাকা পশ্চিমের ক ব্লকের একটা চেংড়ামতোন ছেলেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। সে নাকি মনে মনে সরকারকে গালি দিচ্ছিল। ব্রেনবুক অ্যাকাউন্টে তার চিন্তা ধরে ফেলে সরকারের বিশেষ টেকনো-গোয়েন্দা বাহিনী। সরকারের এক মন্ত্রী আবার বড় বড় গলায় বলল, এ দেশের সবার মতপ্রকাশের স্বাধীনতা আছে। কিন্তু উল্টাপাল্টা চিন্তা করলে সরকার তো বসে থাকবে না। আপনারা মত প্রকাশ করেন। উল্টাপাল্টা চিন্তা করতে যান ক্যালা!

রম্য সায়েন্স ফিকশন

সে যাক, আকালুর চিন্তা এখন সৌরজগতের কাছে আচমকা গজিয়ে ওঠা একটা ছোটখাটো গ্রহ নিয়ে। গ্রহটা বেশ চালাক। নিজেকে ধরা দিতে চাচ্ছে না। হুটহাট রাডারে আসে আবার হারিয়ে যায়। নাসাও নাকি এটাকে নিয়ে হিমশিম খাচ্ছে।
‘স্যার, চা নেন। লেবু চিপা দিসি। চিনি শেষ, আগামী এক বছর আর চিনির দেখা পাইবেন না। ঢাকা স্টেশন থেকে সাপ্লাই বন্ধ।’
রোবট পিয়নের নাম গবুচন্দ্র। বড়ই সাদাসিধে। ড. আকালুর প্রিয় পাত্র।
‘কী বলিস গবু! বাজেটে টান পড়ল নাকি!’
‘নেপচুনের লগে একটা হাইপার ব্রিজ হইতাসে স্যার। ডাইরেক ঢাকা টু নেপচুন। অনেক টেকা খরচা হইতাসে।’
‘কিন্তু নেপচুন যাব কোন দুঃখে! এখন তো দুনিয়ার সবাই অ্যানড্রোমিডার জমি কিনতেসে শুনলাম।’
‘ঘটনা আছে। নেপচুনে আমগো নেতারা সেকেন্ড হোম বানাইতে বানাইতে গোটা গ্রহটারে সেকেন্ড বাংলাদেশ বানাইয়া ফেলসে। এই জন্য গ্রহটার লগে একটা সেতু দরকার।’
‘চায়ের লগে টোস্ট কই?’
গবুচন্দ্র টোস্ট আনতে গেল। চায়ে চুমুক দিতে দিতে বড় পর্দাটার সামনে বসলেন আকালু। অনেক দিন বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হয় না। এর মধ্যে আবার একটা হাইপার ডাইভ দিয়েছেন বলে পৃথিবীর বন্ধুরা তার চেয়ে অনেক বুড়িয়ে গেছে। নম্বর টিপতেই কথা শোনা গেল ত্রাহি খন্দকারের।
‘খবর কী দোস্ত?’
‘ওরে আকালু রে! আমার অবস্থা ভয়াবহ। আন্তগ্যালাক্টিক সৌর নির্বাচনের দায়িত্ব পড়সে একার ঘাড়ে। সব মিলাইয়া পৌনে তিন লাখ ইলেকশন ইউনিট। কোথায় কী ঘটতাসে কিসুই জানি না। একটা কিসু ঘটলে সবাই আমার কাছে জানতে চায়। সরকারি দল বিরোধী দল আধা-বিরোধী দল সবাই আমার উপরে নাখোশ। বড়ই বিপদে আছি। সোয়া তিন লাখ অনলাইন পত্রিকার ফোন রিসিভ করতে করতে আমি ক্লান্ত।’
‘সব ছেড়েছুড়ে আমার মতো স্পেসশিপ নিয়া বাইর হইয়া পড়।’
‘খাড়া একটা ফোন আসছে। হ্যালো, জি জি, আমরা কাউকে ছাড় দিব না, হনুলুলু গ্রহের চিয়াবা সম্প্রদায়ের নেতা উরিত্রা আচরণবিধি লঙ্ঘন করেছেন? তার প্রার্থিতা বাতিল…।’
আকালুর হাতে অখণ্ড অবসর। সদ্য আবিষ্কৃত গ্রহটা অনেকক্ষণ ধরে সিগন্যালও দিচ্ছে না। সৌরজগতের নির্ধারিত জায়গা অতিক্রম করার পরই আমেরিকা। আন্তর্জাতিক স্পেস স্টেশনটা এখন আলাদা একটা অঙ্গরাজ্য। স্টেশন এরিয়ার প্রবেশমুখে জ্বলজ্বলে হলোগ্রাফিক সাইনবোর্ডে লেখা, এখানে মহাকাশযানের বর্জ্য ফেলা নিষেধ, আদেশ অমান্যে পাঁচ কোটি ইউরো জরিমানা।
আকালু ইচ্ছা করেই বাথরুমের ফ্লাশটা ছেড়ে দিলেন। অবশ্য তার রাগের এই অতিক্ষুদ্র নমুনা ধরা পড়ল না কোনো মার্কিন রাডারে। তিনি আবার মনোযোগী হলেন তার সদ্য আবিষ্কারের দিকে। গ্রহটার মতিগতি বোঝার চেষ্টা চালালেন। পাশে বসলেন ড. নিনিনি। ইদানীং তিনি কারণে-অকারণে আকালুর ঘনিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টা করছেন।
আকালু : নিনিনি, সইরা বসো।
নিনিনি : ওহ…সরি। তা আকালু তোমার গ্রহটা নাকি জ্যান্ত। ওইটা নাকি তোমার লগে বাতচিত করতেসে।
মনে মনে গবুচন্দ্রের ওপর খেপে গেলেন আকালু। বজ্জাত রোবটটার কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সফটওয়্যার যে এভাবে অকৃত্রিম বোকামি করবে, কে জানত! নাকি বুড়ো রোবটটার অন্য কোনো মতলব আছে! নিনিনির সঙ্গে তার একটু গল্পের আয়োজন করে দিতেই…।
নিনিনি : কই বলো! গ্রহ তোমারে কী বলতে চায়?
আকালু : কিসু কইতে চায় না। আমারে সিগন্যাল দিতেসে আমি যেন তার ভেতরে ল্যান্ড করি।
নিনিনি : আমারে লগে নিবা বিজ্ঞানী? অবশ্য আমি তো তোমার লগেই আছি! হি হি।
আকালু : ফালতু কতা না কইয়া সিগন্যাল পাডাও। আমেরিকানরা গ্রহডারে পাইলে কইব জঙ্গি আছে, এরপর বোমা মাইরা উড়াইয়া দিব।
নিনিনি : এক কাম করো, যা আছে কপালে, চলো ল্যান্ড করি। ওহ, আম্মা ফোন দিসে, একটু কতা কই আসি।
নিজে নিজে বিড়বিড় করতে করতে আড়ালে গেলেন নিনিনি। আকালু আড়চোখে দেখছেন আর শুনছেন। কাউকে ব্রেনবুকে কথা বলতে দেখলে তার বিচিত্র লাগে। তার চেয়েও বড় কথা, নিনিনির বাড়ি নোয়াখালী ইউনিটে। দ্রুত বলতে শুরু করলে কিছুই বোঝেন না আকালু।
‘আম্মা কী কইবা তাতাই কও। টাইম নাই। আঁই আকালুরে লই নতুন দুনিয়ায় নামমু একটু হর।’
‘তুই আর যাই করস, এই হাগলছাগলরে বিয়া করিস না।’
‘তোঁয়ার জামাই বলোক। অনেক টিঁয়াহইসা। চিন্তা নাই। হেতের অ্যানড্রোমিডায় দুইডা ফ্ল্যাট আছে।’
‘মঙ্গল গ্রহে কিনলেও এককেন কতা আছিল। যকগই (যা হোক) হেতেরে কইস মাইজদী স্পেস স্টেশনের (এমএসএস) কাছদি যদি যায় তাইলে যেন তোর চাচীর লগে এট্টু দেহা করে।’
‘আমরা অখন ওকগা নতুন গ্রহে যাইতেসি আম্মা। এমএসএস বহুত দূর। রাইখলাম।’
এ কথোপকথনে আকালু একটা বিষয়ই বুঝতে পেরেছেন, সেটা হলো, অ্যানড্রোমিডায় তার ফ্ল্যাটবিষয়ক কথা হয়েছে মা-মেয়ের মধ্যে। মাথা ঠাণ্ডা করতে দ্রুত কাজে মন দিলেন আকালু।
গ্রহটার যত কাছে আসতে লাগলেন, ততই যেন চোখ কপালে উঠে যাওয়ার দশা। গ্রহটা মাঝেমধ্যে উধাও হয়ে যাচ্ছে!
‘মনে হইতাসে, অন্য কোনো মাত্রায় আছে এই গ্রহ। এটা সম্ভবত কোনো সময় চক্কর। ঢুইকা পড়লে অন্য সময়ে যাওন যাইব।’
‘তাইলে চলো গ্রহে নামি। এক মাস আগে ফেরত গিয়া দেখি আসি আমার কানের দুলটা কই রাখসিলাম।’
গ্রহের অবয়বটার কাছাকাছি আসতেই সিগন্যালে অনেক অস্পষ্ট কথাবার্তা শুনতে পেলেন আকালু। অনেক শোরগোল। শব্দগুলো নিশ্চয়ই অতীত বা বর্তমান থেকে আসছে। আরো কাছাকাছি আসতেই ডিসপ্লে তে ঝিরঝির করে অনেক দৃশ্য ভেসে উঠল। মানুষ মাটি নিয়ে কী যেন করছে। ভেতরে কী যেন ঢুকিয়ে দিচ্ছে আর অমনি গাছের মতো কী যেন বের হচ্ছে মাটি ফুঁড়ে। কম্পিউটারে বর্ণনা চালু করে দিলেন আকালু। কম্পিউটার বকবক করে যাচ্ছে। কিছু বুঝতে পারছেন, কিছু পারছেন না।
‘এটা হলো কৃষিকাজ। মাটিতে মানুষ আগে গাছ লাগাত। তবে সিগন্যাল আসছে ভবিষ্যৎ থেকেও। মানে ভবিষ্যতেও মানুষ গাছ লাগাবে। তবে অন্য কোনো গ্রহে। গাছ লাগালে গাছ বাড়ে। তা থেকে ফসল হয়। ওটা মানুষ খায়।’
আরেকটা ভিডিও এলো পর্দায়। বর্ণনা দিল কম্পিউটার।
‘এই মিষ্টি পানির ভাণ্ডারকে বলা হয় নদী। আর জ্বালানিবিহীন জলযানটি সরাসরি হাত দিয়ে চালাতে হয়। এর নাম নৌকা। নৌকায় বসে দুটি মানুষ পৃথিবীর উপগ্রহ দেখছে খালি চোখে।’
নিনিনির কণ্ঠে বিস্ময় ‘কয় কী! হেগো বুঝি ফুড ফ্যাক্টরি নাই! মাটি ফুঁড়ি খানা বাইর অয়! তাইজ্জবের ব্যাপার। তবে নৌকা বিষয়টা আমার ফছন্দ হইসে। আহা, এই পানি নিশ্চয়ই খাওন যাইব!’
আকালু ভেবে পেল না, নদীতে নৌকা চালাতে চালাতে মানুষটা ওই বস্তির মতো উপগ্রহটার দিকে তাকিয়ে আছে কেন। ওর চোখে তো টেলিস্কোপও নেই।
আকালুর ফোনে রিং হচ্ছে। গ্যালাক্টিক সার্ভারের সঙ্গে তার ফোনবুকের সংযোগ থাকা সত্ত্বেও নাম্বারটা আননোন দেখাচ্ছে!
‘হ্যালো।’
একটা খসখসে বুড়োর গলা শুনতে পেলেন আকালু।
‘আমি হইলাম তুমি। ভয় পাইয়ো না।’
‘কিডা?’
‘আমি আকালু, ভবিষ্যত থিকা তুমারে ফোন দিসি। আমার বয়স এখন ধরো ৯০।’
‘কন কী!’
‘তোমারে জরুরি বিষয় জানাইতে এত কাহিনী করতে হইসে, বুঝলা তো। সামনে যে গ্রহটা ঝিলিক মারতেসে, ওই কোনো গ্রহ না। ওইটা একটা সময় চক্কর। আর আমরা আছি অতীতে। মানে ভবিষ্যতে গিয়া টাইম মেশিন বানাইয়া আবার অতীতে আসছি।’
‘বুঝবার পারসি। কিন্তু কেমনে কী! এসব কী দেখতেসি ওস্তাদ!’
‘দেখাদেখির কিসু নাই। এই টাইম মেশিন গ্রহটাতে ঢুইকা তুমি সিধা ১৯৮০ সালের বাংলাদেশে চইলা যাবা। লগে একটা কম্পিউটার রিং পইরা যাইয়ো। ওইটা তোমারে চাষবাস, নৌকা চালানি, হাঁস-মুরগি পালা, সব শিখাইয়া দিব। আর ভুলেও নিনিনিরে বিয়া কইরা লইয়া আসবা না। ও এখনো আমার জীবন ফানা ফানা কইরা দিতেসে।’
‘ওকে ওস্তাদ। এখুনি রওনা দিতেসি।’
ভবিষ্যতের আকালুর পরের সতর্কবার্তায় খুশি খুশি লাগল আকালুর। বুড়ো মানুষ রাগের মাথায় কী না কী বলল, তাতে কান দেওয়ার দরকার কী! বড় কথাটা হলো, ৯০ বছর বয়সেও নিনিনি তাকে ছেড়ে যায়নি। সংসার করেছে। তো, তাকে বিয়ে না করার কোনো কারণ দেখছেন না আকালু।
আকালুর দিকে আড়চোখে তাকিয়ে নিনিনি বললেন, ‘তোঁয়ার চোখে এত ঝিলিক মারের কিল¬াই?’
‘টাইম মেশিনে অতীতে যাইতেসি। এরপর দুইজনে মিল¬া নৌকা চালামু আর চাঁদ দেখুম। ওইখানে কইলাম কোনো ব্রেনবুক-ট্রেনবুক নাই।’
‘আমি আর তুমি থাকলে ব্রেনবুকের দরকার নাই। অবশ্য পরে আইসা আম্মা, বড় আফা আর শেফালি খালারে নিলে…।’
আকালু কঠিন মুখ করে ফেললেন। সহসা জবাব দিলেন না। তবে মনে মনে এ-ও ভাবছেন, ১৯৮০ সালটা খারাপ না। সবাই যদি কাছাকাছি থাকে, তা হলে ওই সব বুকটুকের কী দরকার!

[লেখাটি ভালো লাগলে আমাদের লেখকদের জন্য নামমাত্র সম্মানি  পাঠাতে পারেন নগদ-এ নম্বর 01407-885500]

https://www.youtube.com/watch?v=v8m_Xlgtmus

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Please disable your adblocker or whitelist this site!