রোমান্টিক থ্রিলার ‘কৃ’ পর্ব ৫ পড়ুন এখানে
পর্ব ৬
এরপর? আমি সময় গুলিয়ে ফেলেছি। এক সপ্তাহ আগের ঘটনাকে মনে হচ্ছে গতকালের ঘটনা। আবার গতকালটা মনে হয় ছিলই না।
এতসব সমস্যার মাঝেও আমার লেখালেখি ও অফিস চলল। মাস শেষে বেতনও পেলাম। এর মধ্যে নতুন ঘটনার মধ্যে যা ঘটল, আমি সে রাতের পর থেকে মদ খাওয়া একদম ছেড়ে দিলাম। কোন রাতের পর? ওই রাতটা ঠিক কোন রাত ছিল? কৃর সঙ্গে শারীরিক মিলনের কোনো স্মৃতি আমার মাথায় নেই। শুধু ডেথ মেটাল মিউজিক আর আলোছায়ার নাচানাচিটা মনে আছে। আর দুই জগতের মাঝে পাহাড়ের মতো দাঁড়িয়ে থাকা সেই ভারী দরজাটা।
আমি ঠিক করেছি কৃকে পুরোপুরি ভুলে যাব। কিন্তু যতই বলি, ততই যেন আরো সূক্ষ্মভাবে তাকে মনে পড়তে লাগলো। যে রাতে আমরা প্রথম ও শেষবার উড়েছিলাম, সে রাতে তার শরীর থেকে কড়া বকুল ফুলের গন্ধ পেয়েছিলাম। সম্ভবত খোঁপায় একটা বকুল ফুলের মালা ছিল।
‘তুমি আমাকে সত্যিই ডিভোর্স দিতে চাও?’
‘অ্যাঁ.. কী?’
‘কোন দুনিয়ায় ছিলে তুমি? কোন দুনিয়ায় থাকো সারাটা দিন!’
তারমানে এতক্ষণ রেশমার সঙ্গে আমার ঝগড়া বা স্বাভাবিক কোনো বিষয় নিয়ে কথা হচ্ছিল। আর আমি কল্পনার চোখে কৃর নীল শাড়ির পাড়ের নকশাটা দেখছিলাম।
‘আমি ঘুমাবো।’
‘কথা শেষ করে ঘুমাও। ঘুমানোর জন্য সারা জীবন পড়ে আছে। তুমি ভেবেছো আমি কিছু জানি না?’
আমি মুখটাকে যতটা সম্ভব স্বাভাবিক রেখে রেশমার দিকে তাকালাম। ও কতটুকু কী জানতে পেরেছে? ঘুমের ঘোরে কৃ কৃ করলে ওর কিছু বোঝার কথা নয়। ঘুমের ঘোরে রেনু, বিথি কিংবা নাবিলা টাইপ নাম বলে বিড়বিড় করলে ধরা খাওয়ার কথা।
‘তুমি বাচ্চা চাও আমি জানি। ডিভোর্স দেবে দাও। কিন্তু দয়া করে সত্যিটা বলো।’
আমি কিছু বললাম না। রেশমা এখন কাঁদবে। এখন কয়টা বাজে? দেয়ালঘড়িতে আটটা। রাত আটটা না সকাল আটটা। মাথাটা গেছে। বাইরে তাকালাম। অন্ধকার।
‘আমি চললাম। তুমি থাকো তোমার লাইফ নিয়ে। মদ খাও, গাঁজা খাও। আরো যা যা খুশি খাও। বাসাটা ছেড়ে অন্য কোথাও আশ্রয় নাও দয়া করে। দুমাস ধরে বাড়িভাড়াও দিচ্ছ না।’
আমি অবাক হলাম না। আরামদায়ক একটা আলস্য ছেঁকে ধরেছে। সব মনে পড়ল। ঘটনা কিছুই না। নিখুঁত অভিনেতা হয়ে উঠছি দিন দিন। দুটো বইয়ের জন্য গত মাসেই লাখ খানেক টাকা পেয়েছি। ব্যাংকেও আছে আগের জমানো টাকা। তার মানে বাসা ভাড়া ইচ্ছে করেই দিচ্ছি না। বাড়িওয়ালা বের করে দেবে এই অপেক্ষায় আছি।
রেশমার মা-বাবা যথেষ্ট ধনী। মেয়ের নামে ফ্ল্যাট জমি সবই দিয়েছেন। আমাকেও অনেকবার এটা ওটা দিতে চেয়েছেন। আমি পাত্তা দেইনি কোনোদিন। পাত্তা যতই দিচ্ছি না, ততই যেন তাদের আহ্লাদ আরো উপচে পড়ছে আমার জন্য। আমিও বোঝাতে পারি না, আমার কাছে জীবনের যে সংজ্ঞা, সেটার সঙ্গে তাদের কন্যার বানানো সংজ্ঞার যোজন যোজন ফারাক। তবে পার্থক্য নেই কৃর সঙ্গে। আমরা দুজনই জীবনকে সম্ভবত একই চোখে দেখছি।
আমাদের কাছে জীবন মানে বদ্ধ মাতাল হয়ে থাকা গুটিকয়েক ক্ষণ। আমার আর কৃর জীবনে সেটা এসেছে এ নিয়ে দুবার। দুবারই আমরা জীবনকে ছুঁয়েছি। নেশাও চড়েছিল খুব। তবে কব্জা করতে পারেনি। কে জানে তার সঙ্গে আমার জীবনের আর কোনো অধ্যায় বাকি আছে কিনা। তবে আমি নিশ্চিত এখন বিছানায় শুয়ে ঘুমানোর পর সকালে উঠে দেখবো সব আমূল বদলে গেছে। কৃ ছাড়া বাকি সবই হয়ে যাবে আমার চোখের ভুল।
সকালে কিছুই বদলালো না। রেশমা যথারীতি ব্যাগ গুছিয়ে চলে গেছে। সাধারণত সিনেমায় আমরা যা দেখি, এভাবে বিদায় নেওয়ার সময় স্ত্রীরা কাগজে একটা নোট ফোট রেখে যায়। রেশমা আদিখ্যেতা দেখায় না। ও চলে গেল এমনভাবে যেন কোনোকালে সে আমার সঙ্গে ছিলই না। আদৌ কি ছিল?
টেনশনে পড়লাম সকালের নাশতা নিয়ে। কৃ থাকলে..।
‘অর্ডার দিয়েছি। এসে পড়বে একটু পর। আজ খাব মাসালা দোসা। সঙ্গে স্ট্রবেরি জুস। আহা!’
‘ওহ। তুমি! কোন ফাঁকে আসো আর যাও।’
যেন কৃ অনেক দিন ধরেই সকালে এভাবে সেলোয়ার কামিজ পরে আমার সঙ্গে ছিল। আমি পাশ ফিরে শুলাম। বাথরুম চাপলেও উঠতে ইচ্ছে করলো না। চোখ মেলে তাকালাম না, যদি আবার স্বপ্ন হয়ে সব ভ্যানিশ হয়ে যায়।
‘উঠে ফ্রেশ হয়ে নাও। আজ আমরা ওড়াওড়ির মধ্যে নেই। আজ আমরা ঘুরবো। তুমি অফিসে ফোন করে বলো তোমার গায়ে পক্সের মতো গোটা গোটা কী যেন উঠেছে। দেখবে পুরো দশ দিনের ছুটি পেয়ে গেছো।’
‘দশ দিন করবোটা কী?’
‘তুমি কিছু করবে না সোনা। যা করার আমি করবো।’
বলেই আমার ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ল কৃ। শীত শীত লাগছিল একটু। তার শরীরের উষ্ণতায় সেটা কেটে গেল। খেয়াল করলাম কৃর চুল আবার বড় হয়ে গেছে। চুল নিয়ে অবশ্য আমার কোনো মাথাব্যথা ছিল না। বস্তুত কোনো কিছুতেই আমার মাথাব্যথা ছিল না। কৃ যেমনই হোক, তাকে আমার চাই।
এরপরের দশটা দিন খুব স্বাভাবিক। ধোঁয়াটে কিছু ঘটেনি। বিভ্রান্ত হইনি একটিবারের জন্যেও। রেশমাও নিরুদ্দেশ। একবার ফোনও করেনি। নাকি সে অপেক্ষায় আছে আমি গিয়ে আবার তাকে নিয়ে আসবো। সম্ভবত এই দশদিন আমার ফোনটাও বন্ধ ছিল। আর আমি সম্ভবত অন্য এক নেশায় বুঁদ হয়ে ছিলাম বলেই..। কৃর নেশায়।
কৃর সঙ্গে প্রতিটি মুহূর্তই আমার কাছে বিশেষ লাগার একটা কারণ আছে। প্রতিটি মুহূর্তেই তার সঙ্গে আমার ইলেকট্রোম্যাগনেটিক পালসের আদান-প্রদান ঘটে। ব্যাখ্যা করতে পারব না। তাই ইচ্ছে করেই খটমটে নামটা দিয়ে রাখলাম। শুধু আবেশ শব্দটা ব্যবহার করলে ব্যাপারটা পরিষ্কার হতো না।
‘চলো নারিন্দা যাই।’
‘গেলাম।’
‘নারিন্দায় কেন যাব জানো তো?’
‘নাহ।’
‘ঝুনুর বিরানি খাবো।’
‘ঝুনু রান্না করবে?’
‘তুমি কিচ্ছু চেন না। আজ চেনাব।’
‘রিকশায় যাব?’
‘এই ভরদুপুরে তোমাকে কোলে করে নিয়ে যেতে হবে?’
‘হে হে। মন্দ হয় না। জ্যামে পড়লে অন্তত উড়িয়ে নিয়ে যেও।’
‘পরে সবাই লাইন ধরবে।’
‘তাও ঠিক। চলো রিকশায় যাই, হেঁটে যাই, তারপর ফাঁকা পেলে উড়ে যাব।’
‘তোমাকে ওড়ানোটা ঠিক হয়নি। লোভে পেয়ে বসেছে।’
আমি আবার সেই ভুবন ভোলানো হাসিটা দেওয়ার চেষ্টা করলাম। কাজ হলো না। আকাশে ঝড়ের ইঙ্গিত। এর মধ্যে রিকশা নেওয়াটা রিস্কি। আচমকা বাতাস বেড়ে গেলে উল্টে পাল্টে যেতে পারে। গেলেই ভালো। ঝড়ে রিকশা উল্টে গেলে কৃ তখন আমাকে নিয়ে উড়াল দেবে। লোকে দেখবে দুটো যুবক যুবতী ঝড়ে উড়ে যাচ্ছে। কেউ কেউ ছবিও তুলে ফেলবে।
কৃ সঙ্গে থাকলে আমার কল্পনাগুলো বাস্তবে ঘটতে শুরু করে। হলোও তাই। ঝিগাতলা পেরোতেই তুমুল বাতাস। সাইনবোর্ড উড়ে গেল মাথার উপর দিয়ে। কৃ আমাকে শক্ত করে পেঁচিয়ে রেখেছে। রিকশাওয়ালা সাইড করে রাখার চেষ্টা করছে। পারছে না। রিকশাটা উল্টো দিকে চলতে শুরু করেছে। আমি ভয়ার্ত চোখে তাকালাম কৃর দিকে। বোঝাতে চাইলাম, এ অবস্থায় রিকশা না ছেড়ে বরং রিকশাটাকে নিরাপদে নেওয়া দরকার আগে।
কৃ আমার কথা বুঝলো কিনা জানি না। তবে রিকশাটাকে দেখলাম একটা পিলারের গায়ে ধাক্কা লেগে দাঁড়িয়ে যেতে। রিকশাওয়ালা কোনোমতে চাকার সঙ্গে পিলারের শিকল পরিয়েই ছুট। এপ্রিলে এমন দমকা বাতাস হুটহাট আসবেই। তবে কৃ থাকতে আমি প্রস্তুতি নিয়ে ভাবি না। বস্তুত কোনো কিছু নিয়েই ভাবি না। কৃর চোখে চিন্তার ছাপ দেখলাম। এবার অন্যরকম একটা আনন্দ ছেঁকে ধরলো। কৃ আমাকে নিয়েই চিন্তিত! বাহ। এবার তার ক্ষমতার চূড়ান্তটা দেখা যাবে। দুহাত দিয়ে আমার কোমর পেঁচিয়ে রেখেছে। আমি চিৎকার দিয়ে বললাম, ‘এখুনি না। লোকজন দেখলে আরেক বিপদ। একটু অপেক্ষা করি। বাতাস কমে যাবে।’
কিন্তু বাতাস কমার কোনো লক্ষ¥ণ নেই। কৃ সামনের দিকে কেমন যেন বড় বড় চোখে তাকিয়ে আছে। মনে হচ্ছে না সে ঝড় তুফান নিয়ে চিন্তিত।
‘কী হয়েছে?’
‘ওরা দেখে ফেলেছে।’
‘কারা?’
‘অন্য কৃ রা।’
‘তুমিই তো কৃ।’
‘আরে.. অন্য কৃ। আমার মতো।’
‘দেখুক।’
‘ওরা চায় না আমি..।’
‘ধুর.. আমি বাঘ না ভালুক। জানলে কী সমস্যা।’
‘ওরা চায় না।’
দুশ্চিন্তায় পড়ার মতো কথা। কিন্তু একচুলও ভয় লাগল না। ইচ্ছে করছে এই ঝড়ে সত্যিই উড়াল দিতে পারলে চমৎকার একটা স্মৃতি হতো। কৃর দিকে তাকালাম অনুনয়ের দৃষ্টিতে। ঝড় বা আমার কাতর দৃষ্টি নয়। কৃ তার দুশ্চিন্তামাখা চেহারায় রিকশার হুডটা সরিয়ে আমাকে ধরে পেছনের দিকে ছুট দিল। শোঁ শোঁ শব্দে কানের পর্দা ফাটার দশা। পেছনে বা সামনে না গিয়ে কৃ ছুটছে সোজা উপরের দিকে। বাতাসের সঙ্গে তাল মেলাতে সামান্য কোণাকুণি করে উঠছে। আমি যথারীতি আঁকড়ে ধরে আছি তাকে। ছুটে গেলে একটা কেলেংকারি ঘটে যাবে। পরদিন নিউজ হবে, ঝড়ে উড়তে উড়তে আছড়ে পড়লেন সাংবাদিক। উচ্চমার্গীয় গল্পটল্প যারা লেখেন, তারা লিখবেন মরে যাওয়ার আগে সে যতক্ষণ উড়েছিল।
এসব ভাবতে ভাবতে মনে হলো ঝড় কেটে গেছে। কৃ আমাকে নিয়ে এখন ছুটছে। কোন দিকে জানি না। চোখ মেলেও বুঝতে পারছি না। হেলিকপ্টারে চড়ার অভ্যাস থাকলে বোঝা যেত। ওপর থেকে আমার কাছে মহাখালী যা পটুয়াখালীও তা।
ল্যান্ডিংটা ঠিকমতো হলো। প্যারাসুটে আনাড়িরা যেভাবে নামে, অনেকটা সেভাবেই যেন আছড়ে পড়লাম। ভাগ্যিস কিছু ভাঙেনি। কৃ ছুটে এসে দেখতে লাগল আমি ব্যথা পেয়েছি কিনা।
‘তোমার চোখে এক্সরে পাওয়ার আছে?’
‘আমি ক্রিপটন গ্রহ থেকে আসিনি! গ্রহটা কোথায় সেটাও জানি না!’
কৃ আবার মন পড়ে ফেলল আমার।
‘ও, ওকে। কিন্তু ডান পা মচকেছে মনে হচ্ছে।’
আশপাশে তাকিয়ে বুঝতে পারছি না কোথায় এসেছি। মফস্বলের মতো এলাকা। সামনে একটা খালের মতো। এখানে বৃষ্টি হয়ে গেছে একটু আগে। কারণ সারা গা কাদামাটিতে মাখামাখি। কৃর জামারও বারোটা বেজেছে। একটা গ্রামের বাড়ির মতো বাড়ি দেখা যাচ্ছে। আধাপাকা বাড়ি। ছাদে টিন। পাশে গোয়ালঘর। টিউবওয়েলও আছে। কৃর কাঁধে ভর দিয়ে ওদিকেই যাচ্ছি খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে।
গ্রামের পরিবেশে এমন একটা ঘরের স্বপ্ন কি আমি প্রায়ই দেখতাম? কিন্তু আমি তো কোনো কাজই পারি না। নাহ, পাখি ছিল আমার একসময়। লাভ বার্ড আর একগাদা বাজরিগার। পরে সব ছেড়ে দেই। গ্রামর হাঁস-মুরগি পালা এর চেয়ে কঠিন কিছু নয়।
‘কৃ, আমরা এখানেই থেকে যাব নাকি?’
‘গরুর ঘাস কাটবে? নাকি মুরগির হাগু পরিষ্কার করবে?’
‘আমি লিখব, আর তুমি এখানে কোথাও মাস্টারি করবে।’
‘কী শেখাবো?’
‘কী আর, উড়তে শেখাবে। গ্রামের ছেলেমেয়েরা আকাশে উড়বে আর ঢিল না ছুড়েই পাকা আম খাবে। ওই দেখো গাছে আম।’
‘এই ভরদুপুরে অচেনা গ্রামে একটা মেয়ে উড়ে উড়ে আম পাড়বে?’
সত্যি বলতে কি এতটাই খিদে আর তৃষ্ণা পেয়েছিল যে আমি সেটাই চাচ্ছি। কিন্তু কৃ আমার চাওয়াটাকে পাত্তা না দিয়ে বাড়ির উঠোনের দিকে হনহন করে হাঁটা দিল।
‘কেউ আছেন?’
সেকেন্ডের ব্যবধানে বাড়ির তিন দিক থেকে দৌড়ে তিনটা মেয়ে ছুটে এলো। একজন বয়স্ক, বাকি দুজন সম্ভবত ওই বয়স্ক নারীর মেয়ে কিংবা ছেলের বউ।
‘কিডা, শুক্কুরের মাইয়া মিতু?’
‘জ্বি না, আমি মিতু না।’
অন্যদের মধ্যে ফুসুর ফাসুর শুরু হয়ে গেল। আমার দিকে তাকিয়েও মন্তব্য করলো। কিছুই কানে এলো না।
‘আসো মা আসো। কার বাড়ির আত্মীয় তুমরা।’
এবার আমি এগিয়ে গেলাম। কিন্তু কথা বলার সুযোগ পেলাম না। তার আগেই কৃ তার সামনের শাড়ি পরা একটা মেয়েকে বলল, ‘আমার জামাটা একদম নোংরা হয়ে গেছে। তোমার কাছে একটা শাড়ি হবে?’
মেয়েটা এক দৌড়ে ভেতরে চলে গেল। আমি বয়স্ক নারীটার দিকে তাকিয়ে হেসে বললাম, ‘খালাম্মা। ঝড়ে পড়েছিলাম। এখন পথ ভুলে গেছি। এটা কোন গ্রাম?’
খালাম্মা জবাব দিলেন না। তিনিও ব্যস্ত হয়ে পড়লেন কৃকে নিয়ে।
‘তোমার নাম কীগো মা?’
‘জ্বি আমার নাম কৃ।’
‘এইটা কেমন নাম। তোমার ভালো নাম নাই?’
‘আমার ভালো নাম কৃ। খারাপ নাম আছে একটা। লুনা।’
কুটকুট করে হেসে উঠল বাচ্চাদের একটা দল। এই বাড়িরই সদস্য সবাই। আমি পড়লাম বেকায়দায়। কারো সঙ্গে কথাবার্তা হচ্ছে না। এদিকে কৃ চলে গেছে ভেতরে। আমি অসহায়ের মতো উঠোনে দাঁড়িয়ে।
খানিক পর এক কিশোরী কুটিল হাসি দিয়ে আমাকে ইশারায় কলতলা দেখিয়ে দিল। তার হাতে আবার চকচকে লুঙ্গি। কোনো পুরুষকে দেখা গেল না। তারা হয়তো কাজেকর্মে ব্যস্ত, না হয় শহরের দিকে দোকানপাট চালায়। যাই হোক, লুঙ্গির দরকার হবে বলে মনে হচ্ছে না। পানি দিয়ে জিন্সটাকে ভালো করে ধুয়ে নিলাম। আমার নিজেকে মনে হলো আমি এ বাড়িরই আত্মীয়। এমনটা মনে হওয়ার কারণ কৃ। সে এরইমধ্যে গল্প জুড়ে দিয়েছে সবার সঙ্গে। মেয়েটা নির্ঘাৎ তার ক্ষমতা কাজে লাগাচ্ছে। মানে কার মনে কী আছে সব পড়ে ফেলছে। আমি সে আড্ডায় যোগ দিতে পারছি না।
‘দুলাভাই, ভিতরে আসেন। খানা বাড়সি। খাইয়া লন।’
কিশোরী আবার বেণী দুলিয়ে চলে গেল।
পরের এক ঘণ্টা কাটল স্বপ্নের মতো। সময় কাটল তরতরিয়ে। কৃ সবাইকে বলেছে আমরা বিয়ে করে ঢাকা থেকে পালিয়ে এসেছি। কোথায় যাব না বুঝতে না পেরে যশোরের এ গ্রামে এসে আশ্রয় নিয়েছি। যা হবার হবে একটা ভাব নিয়ে আমি বসে আছি পুকুর ঘাটে। আমার সঙ্গে কথাই বলছে না কেউ। মাঝে মাঝে বাড়ির বড় ছেলে এসে চা দিয়ে যাচ্ছে আর গল্প করে যাচ্ছে। এক বর্ণও আমার মনে থাকছে না। শুধু এটুকু শুনতে পেলাম যে গ্রামে আমার অনেক পাঠক আছে। তারা আমার বিশাল ভক্ত।
এদিকে রাতে আমার আর কৃর বিয়ের অনুষ্ঠানের আয়োজনও করা হয়েছে। আমি চিন্তায় পড়ে গেলাম লোকগুলোর খরচাপাতি নিয়ে। তবে এ বিষয়ে কাউকে জিজ্ঞেস করার সাহস পেলাম না।
মাঝে একবার শুধু কৃর সঙ্গে দেখা হওয়ার সুযোগ হয়েছিল। ওই একবারই মনে হলো আমি আবার নতুন করে কৃর প্রেমে পড়েছি।
সাধাসিধে একটা কাতান শাড়ি। ঠোঁটে গাঢ় লিপস্টিক, কাজল, পায়ে আলতা, কানে বড় দুল, গলায় একটা ইমিটেশনের হার; আমার ইচ্ছে হলো হা করে অন্তত মিনিট পাঁচেক তাকিয়ে থাকি। কিন্তু কৃও যেন আমাকে চিনতে না পারার ভান করে চলে গেল হুড়মুড় করে। কিশোরী এবার আগের চেয়েও বেশি সাহস দেখিয়ে আমার কাছে এসে কটমট করে বলে গেল, ‘বাসর রাইতের আগে দেখা সাক্ষাৎ হইবো না। গেইটের জন্য টেকাপয়সা রেডি করেন।’
সত্যিই তো। গ্রামে তো গেইট ধরাধরির বিষয় আছে। উঠতে বসতে শ্যালক-শালিকারা গেইট ধরবে। টাকা দিয়ে পার হতে হবে প্রতিটা গেইট। মানিব্যাগে কার্ড আছে কয়েকটা। ক্যাশ নেই বললেই চলে। এই গ্রামে নিশ্চয়ই কোনো না কোনো বুথ পাওয়া যাবে।
সন্ধ্যা নাগাদ সাজ সাজ পড়ে গেল পুরো বাড়িতে। আশপাশের সব বাড়িতে খবর হয়ে গেছে। উঠানে দাঁড়ানোর জায়গা নেই। আমাকেও ধাক্কা টাক্কা দিয়ে কয়েকজন চলে গেল গরুর মাংসের ডেকচির কাছে। রান্নার অবস্থা দেখছে। আর চুলায় অহেতুক লাকড়ি দিচ্ছে।
আমাকে কয়েকজন চিনতে পেরেছে। আমার ধারণা ছিল না এ গ্রামে এত মানুষ গল্পের বই পড়ে এবং তারা আমার কাছ থেকে অটোগ্রাফও নেবে। অটোগ্রাফ নিয়ে তারা কী করবে জানি না, তবে আমি যেখানে পেরেছি দিয়েছি। কেউ খাতায় নিল, কেউ টুকরো কাগজ নিয়ে এলো। একপাশে অটোগ্রাফ, অন্যপাশে মুদি বাজারের তালিকা।
রাতের খাবার হলো ব্যাচে ব্যাচে। আমিও এক ব্যাচে খেয়ে নিলাম। জামাই বলে আলাদা কোনো খাতির যতœ নেই। সবাই সবার মতো হই হুল্লোড় করে খেয়ে বিদায় নিচ্ছে। এক ফাঁকে ভেতরে ঢুকে দেখে নিলাম কৃকে। বউ সেজে বসে আছে একটা খাটে। তাকে খাইয়ে দেওয়া হচ্ছে। আমার পরনে একটা ধোয়া পাঞ্জাবি আর পাজামা। পাজামার ফিতা টাইট দিতে পারছি না ঠিকমতো। মহা মুশকিল। কৃকে কখন কাছে পাব সেই চিন্তায় অস্থির। আমাদের বাসর ঘরও সাজানো হয়েছে। ফুলের গন্ধ পাচ্ছি। ওদিকে উঠোনে আবার নাচানাচি শুরু হয়েছে। বাঁজখাই এক পুরুষ আবার চিৎকারও করছে, ‘তোরা এইটা কী নাচস, আমি এর চাইতে ভালা নাচি। দেখবি!’
ওই লোকের নাচ দেখার ইচ্ছে হলো না। ইচ্ছে হলো শুধু কৃকে দেখি। একবারও মনে হলো ঠিক এ সাজে রেশমাকেও দেখেছিলাম। কিন্তু সেটা যেন সুদূর এক অতীত। যে অতীত ক্রমে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। আমি কি খারাপ মানুুষ হয়ে যাচ্ছি? আমার কি অপরাধবোধ জাগা উচিৎ? উফফ, এত ভালো খারাপের প্রশ্নই বা আসছে কোথা থেকে? এ এক অন্য মুহূর্ত। এমনই থাকুক না।
বাসর ঘরে ঢুকতে পারলাম অবশেষে। হাজারখানেক টাকা ছিল পকেটে। ওটা দিতেই পথ ছাড়ল কিশোরীর দল। টাকার ভাগ-বাটোয়ারা নিয়ে মহা ব্যস্ত তারা। কী সুন্দর দৃশ্য!
রোমান্টিক উপন্যাস
আচমকা শুরু হলো তুমুল বর্ষণ। বাইরে দৌড়াদৌড়ি আর এটা ওটা পড়ে যাওয়ার শব্দ পেলাম। আম কুড়োনোর জন্য ছুটলো কয়েকজন। আমারও খুব ইচ্ছে হলো। কিন্তু কৃর ভয়ে পারলাম না।
দরজার ছিটকিনি আটকে এগিয়ে গেলাম কৃর দিকে। কী নির্বিকার ও! যেন সত্যিই আজ আমাদের বিয়ে হওয়ার কথা ছিল এবং দারুণ এ বৃষ্টিতে অজানা অচেনা এক গ্রামে অপরিচিত মানুষগুলোর বাড়িতে আমাদের বাসর সাজানো হয়েছে। এটা তো গল্পও নয়। বাস্তব কি এতটাই অদ্ভুতুড়ে হতে পারে?
‘গাধার মতো চিন্তা করবে না বুঝলে?’
‘কী করবো এখন?’
‘এখন আমাদের বাসর হবে। বাসর রাতে কী করে মনে নেই? রেশমার সঙ্গে বাসর হয়নি তোমার?’
‘ভুলে গেছি।’
‘ন্যাকামি আমার একদম পছন্দ না। ন্যাকামি করলে বাইরে তুফানের মধ্যে আধমাইল দূরে ফেলে আসব!’
‘আমি আরো ন্যাকামি করবো। বাইরে ফেলে আসলে বাইরেই থাকবো। তোমার কি ধারণা আবার পথ চিনে চিনে চলে আসবো?’
‘আর তোমার ধারণা তোমাকে উদ্ধার করতে আমি এই শাড়িটাড়িসহ রাত বিরাতে ছুটে যাব? দুই ঘণ্টা লেগেছে এমন করে সাজতে।’
‘দরকার হলে এভাবেই যাবে। সঙ্গে একটা হারিকেন নেবে। আর ওই কিশোরী মেয়েটা সঙ্গে থাকবে। ওর অনেক সাহস।’
‘হুঁহ।’
আমি কৃর মুখের দিকে তাকালাম। চেহারাটা দেখার লোভ সামলাতে পারছিলাম না কিছুতেই।
‘খবরদার, নাটক সিনেমার মতো কিছু করবে না। তোমার যেটা মন চায় করো, কিন্তু দেখে দেখে শেখা কিছু করবে তো..।’
কৃর কথা শেষ হবার আগেই আমি চুমু খেলাম। এবার সরাসরি ঠোঁটে। এবার একদম মানুষের ঠোঁট। কোনো অনুভূতির কণা-টনা ঢুকলো না। কৃ হাসল।
‘তোমার ঠোঁটে লিপস্টিক লেগে গেছে। ধরো টিসু। মুছে নাও।’
‘লাগলে লাগুক।’
আবার আমার বেড়াল স্বভাব মাথাচাড়া দিয়ে উঠল। মাথাটা ওর কোলে রাখতে যাব তার আগেই চুলর মুঠি ধরে সোজা করে দিল কৃ।
‘এইসব সিনেমা চলবে না বাছা।’
কিছুই হয়নি ভাব দেখিয়ে ভদ্রলোকের মতো বসে লম্বা একটা হাই তুললাম।
‘সুন্দর মতো শুয়ে পড়ো। সকালে ভাগতে হবে।’
কৃর আদেশ অমান্য করা যাবে না। কৃ হলো আমার ‘শি’। যাকে মানতেই হবে। মনে মনে দুলাইন কবিতা বানালাম। কবিতা না, শের হবে হয়তো। গালিব ভর করেছে এই ব্যাঙ ডাকা বর্ষণের রাতে। বিড় বিড় করে আওড়ে গেলাম।
‘ওরে ঘোর বরষা, ফোঁটায় ফোঁটায় কত লিখে চলেছো রাতলিপি
প্রেমিকার গোপন হাহাকার লিখতে চাও?
দমকা বাতাস হয়ে আমার কাছ থেকে নিয়ে যাও জলকণা ভাষা।’
রোমান্টিক উপন্যাস
হাহাকারের আশাবরী বেজে উঠলো। তবে প্রেমিকার নয়, নিজের বুকে। কিন্তু রাগের আলাপ বিস্তার বেশিদূর এগুলো না।
কেমন একটা অনুভূতি হলো। কিছু একটা টের পেলাম। ভালো কিছুর নয় এটা নিশ্চিত। অনেক ঘটনা দ্রুত ঘটে যাওয়াতেই বোধকরি এমনটা মনে হচ্ছে। কোনো একটা বড় গড়বড় হতে চলেছে?
‘কী ভাবছো? টেনশন?’
কৃ নিজেও বুঝতে পারছে না।
‘ভালো লাগছে না কৃ।’
‘ভয় নেই। কিছু হবে না। চুপ করে শোও। সকাল হলে চলে যাব। সারা রাত একটুও জ্বালাবো না তোমাকে।’
‘না। তা না। যেভাবে দ্রুত সব হলো তাতে।’
‘মানুষগুলো খুব ভালো বুঝলে। এত ভালো হওয়াটা অবশ্য ঠিক না। অতি ভালোর গলায় দড়ি।’
বৃষ্টি আবার হুট করে থেমে গেল। দূর আকাশে গম গম শব্দ হচ্ছে খানিক পর পর। কিন্তু আর কোনো সাড়া নেই। সবাই ঘুমিয়ে পড়ল নাকি?
‘কাছে এসো। ভয় পাচ্ছো কেন? তোমার হার্টবিট দেখি বাড়ছে।’ কৃ আমার বুকে মাথা রেখে শুয়ে আছে।
‘আমিও বুঝতে পারছি না।’
আমি কৃর মাথাটা আরো জোরে চেপে ধরলাম। ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বারবার ঝামেলা পাকাচ্ছে। হয়ত এমন ঘটনা দেখে অভ্যস্ত নয় বলে।
ততক্ষণে কৃ আমার কপালে একটা চুমুও দিল। আমি শক্ত করে কৃর হাত ধরলাম।
‘কৃ, শোনো। আমার মনে হয় আমাদের এখুনি চলে যাওয়া উচিৎ। শুধু কৃ না, মানুষেরও কিছু ক্ষমতা আছে। আগাম বিপদের গন্ধ পায়। আমার কেন যেন মনে হচ্ছে..।’
এমন সময় দরজায় মৃদু টোকা। চমকে উঠলাম। কৃ উঠে দাঁড়াতে যাবে। বাধা দিলাম। আমিই এগিয়ে গেলাম। গ্রামের দরজায় কী-হোল নেই। খুলবো কিনা বুঝতে পারছি না। আবারো মৃদু টোকা। কিশোরীর কঠিন গলা, ‘দরজা খোলেন।’
দরজা খুলতেই গালভর্তি দাড়িওয়ালা মোটাসোটা ছ ফুট লম্বা এক লোক। পর্বতের মতো পথ আটকে দাঁড়িয়ে আছে। মুখটা ফ্যাকাসে রকমের সাদা। ক্ষেতে খামারে খেটে খাওয়া মানুষ নয়। খেয়ে খেয়ে মোটাতাজা হওয়া মানুষ।
‘কে আপনি?’
রোমান্টিক উপন্যাস
‘সাইডে যান। না হয় বাইরে আসেন।’
আদেশের সুর। আমি দরজাতেই দাঁড়িয়ে। হাত-পা কেমন অবশ লাগছে। লোকটার মুখে প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাসের হাসি। মনে হচ্ছে সে সব জানে এবং জেনেই এসেছে।
‘কই মিয়া, সরেন। আপনে মানুষ ভালা। লেখক মানুষ। ইজ্জত আছে। আপনারে ফালাইসে ঘোরের মইধ্যে। আমি কালিপ্রসন্ন। তিন গ্রামের ওঝা। সাপে কাটার ওঝা না। অন্যরকম ওঝা। আপনে সরেন।’
পেছনে সরে এলাম। সোজা চলে গেলাম কৃর কাছে। কৃ ততক্ষণে উঠে দাঁড়িয়েছে। তার মাথা থেকে ঘোমটাও পড়ে গেছে। কালিপ্রসন্ন লোকটা বিশ্রীরকম হাসি হেসে কৃর দিকে তাকাল। তারপর বিড়বিড় করে বলল, ‘তোর জারিজুরি এখানেই খতম মায়াবিনী। এবার তোরে বন্দি করনের পালা।