class="post-template-default single single-post postid-17813 single-format-standard wp-custom-logo group-blog vl-boxed aa-prefix-matin-">
Shadow

সহবাস : আন্দালিব রাশদী

সহবাস

সহবাস : আন্দালিব রাশদী

সহবাস শুনেই রতিক্রিয়ার দৃশ্য কল্পনা করে আস্তাগফিরুল্লাহ বলে জিবে কামড় বসাবেন না। সহবাসের আরো মানে আছে : পতি-পত্নীরূপে বাস। একসঙ্গে বসবাস।

আপনি বলবেন, মানলাম পতি-পত্নীরূপে বাস। কিন্তু পতি-পত্নী কি পরস্পরের বুড়ো আঙুল চোষে?

সম্ভবত নবদম্পতির হ্যাংওভার থেকে এখনো বেরোতে পারেননি। কিছুটা সময় যেতে দিন। দেখবেন সহবাসকালে পরস্পরের বুড়ো আঙুল কেন, নিজের বুড়ো আঙুলও কেউ চোষে না। তাদের বিছানাটা ভালো করে দেখবেন ঠিক মাঝখান বরাবর চীনের প্রাচীর দাঁড়িয়ে গেছে।

সহবাস : আন্দালিব রাশদী

একই ছাদের নিচে একই কক্ষে স্ত্রী ও স্বামী চীনের প্রাচীরে এপারে ও ওপারে বসবাস করছেন, একে কি সহবাস বলবেন না?

আপনি বলবেন, দূর, কিসের চীনের দেয়াল, মাঝবরাবর একটা সুতাও নেই।

তাহলে শুনুন, এটাই হচ্ছে দাম্পত্যজাদু। এ জাদুর জন্য হুডিনি হতে হয় না, পিসি সরকার কী জুয়েল আইচ হতে হয় না। দেয়ালকে অদৃশ্য করে রাখার জাদুজ্ঞানটা জন্মসূত্রেই পেয়ে থাকে, নতুন শিখতে হয় না, যেমন শিখতে হয় না রতিকর্ম।

৩৩ বছর রাশনা খান মজলিসের সঙ্গে সহবাস করার পর (শেষ আট বছর সম্পূর্ণ রতিসম্পর্ক বিবর্জিত) সৈয়দ আলতাফুর রহমান দুজনের মাঝখানের কোলবালিশটা আর সহ্য করতে না পেরে চাদর-বালিশ আর পাতলা তোশক নিয়ে বেডরুম থেকে বেরোচ্ছেন; বগলদাবা করে বালিশ, চাদর ও তোশক নিয়ে বেরোনোর সময় বড় ও মেজো মেয়ে বাধা দিয়েছে। বড় মেয়ে নাইয়ার সুলতানা বলেছে, বাবা, ভালো হচ্ছে না কিন্তু। তুমি এ রুম থেকে বেরোবে না। আমার শ্বশুরবাড়ির লোকজনের কানে গেলে খুব কেলেঙ্কারি হবে।

নিগার বলেছে, বাবা, তুমি অবশ্যই যাবে, কিন্তু তার আগে আমার বিয়েটা হয়ে যাক।

নাইয়ার এবার শান্ত স্বরে বলল, বাবা, তুমি তো বয়সে বড়, মা ছোট। ছোটদের পাগলামি তো একটু সহ্য করতেই হয়।

বাবা বলল, রাশনা পাগল হলে তো কোনো সমস্যাই ছিল না, কিন্তু তোর মা আস্ত সিয়ানা। যথেষ্ট হয়েছে। এ কয়টা দিন শান্তিতে ঘুমাতে চাই।

ছোট মেয়ে রিফাত সুলতানা বলেছে, আমিও তোমার সঙ্গে যাচ্ছি। মায়ের খান মজলিসি ক্যাট ক্যাট আমারও আর সহ্য হয় না।

একমাত্র ছেলে ওসামা বলেছে, এত জিনিস নিয়ে উঠতে তোমার অসুবিধা হবে, তোশকটা আমার হাতে দাও, পৌঁছে দিয়ে আসছি।

সৈয়দ আলতাফুর রহমান তোশক-বালিশ বগলদাবা অবস্থায় নিজের সিদ্ধান্তে যখন দোদুল্যমান, রাশনা খান মজলিস তাঁকে ত্বরিত সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করলেন। তিনি চিত্কার করে বললেন, দরজায় দাঁড়িয়ে আছ কেন? কোন জাহান্নামে যাবে তাড়াতাড়ি যাও। খান মজলিস টাওয়ারের কোনো অ্যাপার্টমেন্টে তোমার আর জায়গা নেই, বেইসমেন্টে থাকবে, না ছাদের ওপর, সে তোমার ব্যাপার। তবে শুনে রেখো তোমার হুরপরি, যা নামার তা যেন সরাসরি আকাশ থেকে নামে। সিঁড়ি কিংবা লিফট দিয়ে যদি কোনো মহিলার ছাদে যাওয়ার খবর পাই, আমি নিজের হাতে হাঁটু থেকে তার পা দুটি আলগা করে ফেলব।

আলতাফুর রহমানের টার্গেট ওই ছাদই। কোনো সন্দেহ নেই জায়গাটার মালিক ছিলেন ওয়ারেস খান মজলিস। একমাত্র পুত্র নঈম খান মজলিস অপারেশন ক্লিনহার্টের সময় ক্রসফায়ারে প্রাণ হারায়। জায়গার আরেকজন ভাগীদার হাসনা খান মজলিস ন্যায্য দাবি প্রতিষ্ঠা করতে না পারায় একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ রাশনারই।

রাজউকের লোকদের বাড়তি কিছু হাত খরচ দিয়ে খান মজলিস টাওয়ারের ১৩ তলার ছাদের ওপর একপাশে পাঁচ ইঞ্চি ইটের একটি মাঝারি গোছের রুম, সঙ্গে একটি টয়লেট, ওপরে টিনের ছাউনি দাঁড় করানো হয়েছে। এই বাড়তি খরচ আলতাফুর রহমানের পেনশনের টাকায়।

প্রতিটি তলায় চারটি অ্যাপার্টমেন্ট পাঁচতলায় ফাইভ এ, বি, সি, ডি। ১৩ তলায় থার্টিন এ, বি, সি, ডি। পাঁচতলার এ ও সি সংযুক্ত, এখানেই নাইয়ারদের বসবাস। মর্যাদা বাড়াতে আলতাফুর রহমান তাঁর চিলেকোঠার নাম দিয়েছেন ফর্টিন এক্স। এই অ্যাপার্টমেন্টটি তাকে হাতছানি দিচ্ছিল।

শেষ পর্যন্ত তিনি ছাদে উঠলেন, চোখ ঘুরিয়ে বাইরের খোলা আকাশের দিকে তাকালেন, নিঃশ্বাস নিলেন। তাঁর মনে হলো রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতার চেয়ে ব্যক্তিগত স্বাধীনতা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ছাদের ছোট ঘরটিতে উঠতে পারার যে স্বাধীনতা, তার দাম অনেক বেশি।

স্ত্রীর সঙ্গে সাহেবের সম্পর্কটা যে তিতকুটে এটা কেয়ারটেকার নবী হোসেন জানে।

এই নবী হোসেনের সামনেই রাশনা বলেছেন, সেগুনবাগিচার এই জায়গাটা আব্বাজানের। এখন আমিই মালিক। তোমাদের সাহেবের তো এমনকি জয়দেবপুরেও আড়াই কাঠার একটি প্লট কেনার মুরোদ হলো না।

এটুকু ঠিকই ছিল। গতকাল রাশনা বড্ড বাড়াবাড়ি করে ফেলেছেন। নবী হোসেনকে সৈয়দ আলতাফুর রহমানের সামনে ডাকিয়ে এনে হুকুম দিয়েছেন, সামনে যেকোনো দিন তিন ঘণ্টার নোটিশে তোমাদের সাহেবকে মজলিস টাওয়ার থেকে বের করে দেব। তারপর যদি তাকে এই টাওয়ারের কোথাও দেখি, তোমার আর দারোয়ানের চাকরি নট। একেবারে নট।

স্বাধীন আলতাফুর রহমান রান্নার ঝামেলায় যাবেন না। ইচ্ছা হলে রেস্তোরাঁয় বসে খাবেন, না হলে হোম ডেলিভারিতে খাবার আসবে।

নির্বিঘ্নে প্রথম রাতটা কেটেছে। শেষ রাতে একটি পূর্ণাঙ্গ স্বপ্নের একাংশ মাত্র দেখেছেন। আরবীয় হিজাবে ঢাকা তরুণী হারমোনিয়াম বাজিয়ে তাঁকে নজরুলের গান শুনিয়েছে—লাইলি তোমার এসেছে ফিরিয়া মজনু গো আঁখি খোলো।

দ্বিতীয় সকালে সুপ্রভাত রেস্তোরাঁয় নাশতা সেরে ফেরার পথে আগের অ্যাপার্টমেন্টে ঢুকতেই রাশনা বেগম ক্রুদ্ধ চাহনিতে তাঁকে দেখে নেন। তিনি চুপচাপ একটি ট্রলি ব্যাগে কিছু কাপড়চোপড়, টেবিল ঘড়ি ভরে আবার ছাদে চলে এলেন।

বিকেলে ছোট মেয়ে রিফাত পাকা পেঁপের শরবত বানিয়ে নিয়ে এলো। বলল, মুখে যা-ই বলুক, মা কিন্তু তোমাকে ভালোবাসেন। সারা রাত ঘুমাননি, ছটফট করছেন।

আলতাফুর রহমান বললেন, ঘুমের ট্যাবলেট খাইয়ে দিলি না কেন?

মেয়ে বলল, দিয়েছিলাম, ধরেনি। খুব উত্তেজিত ছিলেন। মা আরেকটা কথা বলেছেন, সবটাই হাসনার ষড়যন্ত্র।

হাসনা বিধবা না হলেও তার স্বামীকে ফিরে পাওয়ার সম্ভাবনা আসলেই নেই। বাইট্টা হুসেনের আপিলও নামঞ্জুর হয়ে গেছে। অ্যাপিলেট ডিভিশনের সব কার্যক্রম শেষ হওয়ার পর বাকি থাকে শুধু রাষ্ট্রপতির ক্ষমা।

হাসনা খান মজলিসের মতো সুদর্শন ও চৌকস মেয়ে কেমন করে তার চেয়ে সাড়ে সাত ইঞ্চি খাটো হুসেন আলীর প্রেমে পড়ে ঘর ছাড়ল—এ প্রশ্ন অনেকেরই। হুসেন আলী মোটর গ্যারেজের মেকানিক হওয়ার কারণে খদ্দেরদের গাড়ির টেস্ট রান দিতে অনেকবারই স্টিয়ারিংয়ে বসেছে। সুদর্শন নারী আকৃষ্ট করতে গাড়ির কোনো ভূমিকা নেই। ওয়ারেস খান মজলিস হুসেন আলীর বিরুদ্ধে অপহরণ মামলা দেন। কিন্তু হাসনা খান মজলিস বিজ্ঞ ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে বাবাকে ভীষণ অপদস্ত করে। ক্ষিপ্ত ওয়ারেস খান মজলিস সেখানেই ঘোষণা করেন, মেয়েকে ত্যাজ্য করে আমার সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করলাম।

পরে কখনো মেয়ের প্রতি মন নরম হয়ে যেতে পারে এই আশঙ্কায় সেগুনবাগিচায় ডায়াবেটিক সেন্টারের উল্টো দিকের গলিতে পাঁচ কাঠার প্লটটি বড় মেয়ে রাশনার নামে উইল করে দিলেন। তিন মাসের মধ্যেই একদিন সন্ধ্যায় অফিস থেকে ফেরার পথে রিকশা থেকে মুখ থুবড়ে পড়ে গেলেন।

পথচারীদের একজন তাঁকে তুলে হাতের কবজির কাছে নাড়ি টিপলেন, নাকের কাছে আঙুল ছোঁয়ালেন এবং বললেন, হাসপাতালে নিয়ে লাভ নেই। খেইল খতম।

হার্ট অ্যাটাক হলেও রাশনা মনে করে বাবার মৃত্যুর জন্য তার বোন হাসনা খান মজলিসই দায়ী।

বাবার চল্লিশার পর হাসনা যখন সম্পত্তির হিস্যা চাইতে এলো, রাশনা বলে দিল, বাবার কোনো সম্পত্তি নেই।

ব্যাপারটা সৈয়দ আলতাফুর রহমানের জন্য লাভজনক হলেও তিনি স্ত্রীকে বললেন, তোমরা অন্যায় করছ। ছেলে-মেয়ে ত্যাজ্য করার কোনো লিগ্যাল বেসিস নেই। অর্ধেকটা তার পাওনা।

রাশনা খান মজলিস বললেন, পুরুষ মানুষের চরিত্র আমার জানা আছে। শালির জন্য এত দরদ!

ডিপফ্রিজে পাওয়া একটি কাটা মুণ্ডুর সূত্র ধরে বেরিয়ে আসে বাইট্টা হুসেন আলী কন্ট্রাক্ট কিলার। মামলার শুরুতেই কলকাতা চলে গিয়েছিল।

পুরনো একটি অপারেশনের পাওনা পাঁচ লাখ টাকা আদায় করতে ঢাকা আসে। চার লাখ টাকা মেয়ে নিশুর হাতে দিয়ে ফেরার পথে গ্রেপ্তার হয়।

জজকোর্টে স্বামীর ফাঁসির রায় হওয়ার পরদিনই ক্লাস টেনে পড়া মেয়ে ছোটখাটো গড়নের নিশুকে নিয়ে হাসনা আবার আসে। রাশনা আবারও খারাপ ব্যবহার করে এবং বলে, তুই আমার বোন না।

দুই.

তৃতীয় দিন সন্ধ্যায় রিফাত এক প্যাকেট টি-ব্যাগ, এক কৌটা কনডেন্সড মিল্ক, চিনি, দুটি কাপ, দুটি পিরিচ, কয়েকটা চা চামচ এবং একটি নতুন কেনা ইলেকট্রিক কেটলি নিয়ে ওপরে উঠে এলো, বলল, মা দুপুরের পর দরজা খোলেননি। বড় আপু বলেছে, ডেকে ঘুমটা নষ্ট করিস না, ঘুমাতে দে।

সকাল ৮টার দিকে ওপরে এসে রিফাত দেখল, বাবার দরজায় টিপ তালা। বাবার নম্বরে কল দেয়।

তিনি তখন শুধু নাশতার মেইন কোর্স শেষ করেছেন। ফোন ধরেই বললেন, শোন, খুশবু রেস্তোরাঁর মুরগির স্যুপটা ক্লাস ওয়ান। তোর জন্য স্যুপ ও রুটি নিয়ে আসব।

রিফাত বলল, আনতে হবে না, তুমি ছাদে না উঠে সোজা অ্যাপার্টমেন্টে চলে এসো। জরুরি।

তিনি বললেন, আমার কাজও আছে। শেভিং কিটস, শেভিং ফোম, আফটার শেইভ লোশন—এসব নিতে হবে।

রাশনার ইচ্ছা হয় খাক কিংবা না খাক তিনি তাকেও গুনলেন। চার সন্তান ও স্ত্রী পাঁচজনের জন্য ১০টি রুটি এবং পাঁচটি স্যুপ নিয়ে প্রায় ৪০ মিনিট পর যখন কলিংবেল টিপলেন, নির্বিকার কণ্ঠে রিফাত বলল, মায়ের শরীর ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। মনে হয় গতকালই ফ্যানের সঙ্গে ঝুলেছে।

সৈয়দ আলতাফুর রহমান দুই হাতে খাবার নিয়ে নিষ্পলক তাকিয়ে রইলেন ঝুলন্ত রাশনার দিকে।

বাকি ব্যবস্থা কেয়ারটেকার নবী হোসেন দক্ষতার সঙ্গেই করল। ফাঁসির ব্যাপারটা চেপে যাওয়ার পরামর্শ সে-ই দিল।

আলতাফুর রহমান আতঙ্কিত ছিলেন, ছেলে-মেয়েদের কেউ যদি বলে ফেলে, তুমিই দায়ী। ৩৩ বছর সংসার করে তুমি মাকে ডেজার্ট করেছ, এই কষ্ট সইতে না পেরেই তো…।

মেয়েদের সামনে মাথা নিচু করে বসেছিলেন।

রিফাত বলল, বাবা তোমার কি মাথা ধরেছে?

তিনি সম্ভবত মেয়ের কথা শোনেননি, বললেন, নিঃসঙ্গতার চেয়ে বড় কোনো ঘাতক নেই। ঝগড়া করার মতো কাউকে না পেয়ে রাশনা ভয়ংকর একা হয়ে গিয়েছিল। আমি জানি, সেটা সহ্য করতে পারছিল না বলেই…।

মেয়ে বাবাকে আর এগোতে না দিয়ে বলল, তোমার আর ওপরে যাওয়ার দরকার নেই।

আলতাফুর রহমান বেডরুমের দেয়ালে বহু বছর আগে থেকে ঝুলতে থাকা নিউ মার্কেটের আকসা স্টুডিওতে তোলা তার আর রাশনার বাঁধাই করা ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট ছবিরটার দিকে তাকিয়ে বললেন, আচ্ছা।

সহবাস : আন্দালিব রাশদী সহবাস : আন্দালিব রাশদী

 

https://www.youtube.com/watch?v=AoO_iZhlnGs

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Please disable your adblocker or whitelist this site!