Monday, December 30
Shadow

জাকাত ব্যবস্থাপনা : সংগ্রহ কৌশল ও বণ্টন প্রক্রিয়া

এ প্রবন্ধের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হলো জাকাতের ধর্মতাত্ত্বিক ও অর্থনৈতিক বিশ্লেষণ। ইসলামের অন্যতম পঞ্চ স্তম্ভ জাকাতকে একটি এবাদত হিসেবে বিবেচনার পাশাপাশি উন্নয়ন অর্থনীতি ও বৈষম্যহীন সমাজ নির্মাণের নিয়ামক হিসেবে একে ব্যাখ্যা করা প্রয়োজন। একটি অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে জাকাতের অর্থ সংগ্রহ, এর প্রাতিষ্ঠানিক স্থাপনা ও নীতি ব্যবস্থাপনা এবং সর্বোপরি জাকাতলব্ধ অর্থ বিতরণ প্রক্রিয়া বর্তমান প্রবন্ধের মূল প্রতিপাদ্য বিষয়।

 

আল কুরআনের অসংখ্য আয়াতে নামাজের পাশাপাশি জাকাত আদায়ের জন্য আদেশ করা হয়েছে। আল্লাহ বলেন: ‘তোমরা নামাজ প্রতিষ্ঠিত করো এবং জাকাত প্রদান করো।’ (আল্ কুরআন, ..:)। বুখারী শরীফে বর্ণিত আছে: ‘ইসলামের ভিত্তি ৫টি বিষয়ের উপর প্রতিষ্ঠিত।’ (আল্ বুখারী, কিতাবুল ঈমান)। এ দীর্ঘ হাদিসে জাকাতকে তৃতীয় স্তম্ভ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। অতীব দুঃখের বিষয় হলো, মুসলিম সমাজ একে নিছক একটি ধর্মীয় উপাসনা হিসেবে পালন করে থাকে এবং জাকাত প্রদানের মাধ্যমে নিজেকে দানবীর হিসেবে কল্পনা করে অহমিকায় নিমজ্জিত হয়ে পড়ে। আবার কেউ কেউ জাকাত ব্যয়ের সঠিক খাতে তা ব্যবহার করেন না, কেউবা কর ফাঁকির ন্যায় জাকাত প্রদানে চরম অনীহা প্রকাশ করেন এবং এজন্য কৌশল অবলম্বন করেন। জাকাতের মর্মার্থ ও স্বরূপ কি? জাকাত কেন প্রদান করতে হবে? এর আর্থসামাজিক গুরুত্ব কতটুকু? দারিদ্র্যমুক্ত সমাজ গঠনে জাকাতের ভূমিকা কি? জাকাত অর্থ সংগ্রহ ও তা বণ্টন প্রক্রিয়ার রীতিনীতি কি? এসকল মৌলিক প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে এ প্রবন্ধের অবতারণা।

 

২. জাকাত: অর্থ ও ধারণা: আবিধানিক অর্থে জাকাত হলো পরিশুদ্ধকরণ। ধর্মতত্ত্বের দিক থেকে জাকাত হলো সম্পদের (বিধষঃয) পরিশুদ্ধতার লক্ষ্যে জাকাতযোগ্য দ্রব্যের (অংংবঃং) উপর করারোপ করা। আগনাইদের মতে জাকাতের অর্থ হলো প্রবৃদ্ধি এবং যাকাত শব্দটিকে এ নামে অভিহিত করার কারণ হলো জাকাত প্রদানের পুরস্কার হিসেবে পৃথিবীতে সম্পদ বৃদ্ধি পায় এবং পরকালেও নিরন্তর সম্মান ও পূণ্য অর্জিত হয় (আগনাইদ: ২০৭) ইসলামী শরিয়া মতে জাকাতের অন্তঃদর্শন ও অন্তর্নিহিত তাৎপর্য সুদূরপ্রসারী। মহান আল্লাহ্র সন্তুষ্টির লক্ষ্যে জাকাত প্রাপ্য ব্যক্তি ও ব্যক্তিবর্গের কাছে জাকাতযোগ্য সম্পদের মালিকানা ও অধিকার হস্তান্তর প্রক্রিয়ার নামই হলো জাকাত (আল লুবাব: ১৩৯)। বিখ্যাত তানভীর গ্রন্থেও জাকাতের একইরকম অর্থ লিপিবদ্ধ হয়েছে (আততানভীর: ২-৪)।

ইমতিয়াযী (১৯৮৯:১৫৮) আর্থ-সামাজিক ও সমাজ হিতৈষীমূলক এ ব্যবস্থার একটি ব্যাপক মর্মার্থ প্রদান করেছেন। জাকাত অর্থ পরিচ্ছন্নকরণ কারণ তা জাকাত প্রদানকারীর আÍা, হৃদয় ও চেতনাকে সম্পদ আঁকড়ে রাখার অপরাধ থেকে বিরত রাখে, জাকাত গ্রহণকারীর হৃদয় ও চেতনাকে সম্পদ কেন্দ্রিক স্বার্থপরতা পরশ্রীকাতরতা ও ঘৃণা থেকে মুক্ত রাখে এবং সর্বোপরি সামাজিক অসমতা ও বৈষম্য দূর করে সমাজের আÍা চেতনাকে পরিচ্ছন্ন রাখে।

 

সাধারণ অনুদান বা দান এবং জাকাত সমার্থক বা সমমর্যাদাপূর্ণ নয়। দান বা অনুদান সংক্রান্ত ইসলামী মূলনীতিসমূহ হলো সাদাকাহ (দান), ইনফাক (খরচ), আতা (প্রদান) ইত্যাদি প্রক্রিয়াসমূহ সম্পন্ন করা। কিন্তু ধর্মীয় ও সামাজিক আনুষ্ঠানিকতা ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা হিসেবে জাকাত সমাজ-কাঠামোর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তিমূল, যার উপর শান্তিপূর্ণ, সুখী-সমৃদ্ধশালী ও বৈষম্যমুক্ত সমাজ নির্মাণ দাঁড়িয়ে থাকে। দরিদ্র ও অভাবী মানুষের অর্থনৈতিক দুরবস্থা দূর করে সামাজিক নিরাপত্তা বিধানের উদ্দেশ্যে আল্ কুরআনে ধনীদের সম্পদে দরিদ্রদের অধিকার নির্ধারিত রাখা হয়েছে (আল্ কুরআন, ৫১:১৯)।

উপরোক্ত তাৎপর্য ও গুরুত্বের কারণে আল ্কুরআনের অসংখ্য আয়াতে সালাতের আদেশের পাশাপাশি জাকাতের আদেশও সংযুক্ত করা হয়েছে। জাকাত যে শুধু বর্তমানে মুসলিম উম্মাহ্র উপর অবধারিত করা হয়েছে তা নয়; বরং পূর্ববর্তী মুসলিম জাতিসমূহের উপরও তা অবধারিত ছিল। জাকাত খাত হতে সংগৃহীত অর্থের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে একটি সুনিপুণ গণতহবিল গঠন করা সম্ভব এবং এর দ্বারা বৈষম্যমুক্ত সমাজ গঠনের সকল সমাজকল্যাণমূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করা সম্ভব।

 

 

৩. জাকাত-সংগ্রহ প্রক্রিয়া: জাকাত-অর্থ সংগ্রহ প্রক্রিয়া সম্যকতাকে অনুধাবনের পূর্বে জাকাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কিছু বিষয় সম্পর্কে অবগত হওয়া প্রয়োজন। এ বিষয়গুলো নিম্নে আলোচনা করা হলো:

নিসাব: ইসলামী চিন্তাবিদরা এ ব্যাপারে মোটামুটি একমত যে, মদিনা নগরীতে হিজরতের পূর্বেই মক্কাতে অবস্থানকালে জাকাত প্রদান অবধারিত করা হয়। (তকী উসমানী, ১৯৮৩: ৩৯৫)। তবে ইসলামী আইনবিশারদদের মতে হিজরতের পরই নিসাব নির্ধারণ করা হয়, যদিও প্রকৃত তারিখ সম্পর্কে মতভেদ রয়েছে। আল্লামা নববীর মতে দ্বিতীয় হিজরি সনে নিসাব নির্ধারিত হয় (ফাতহুল বারী:২১১)। কিন্তু ইবনে হাসরসহ অন্য পণ্ডিতরা দ্বিমত পোষণ করেন (উসমানী, ১৯৮৩: ৩৯৭)। ইবনে আছিরের বক্তব্য হলো হিজরি নবম সনে নিসাব ঘোষণা করা হয় (ফাতহুল বারী: ২১১)।

 

 

৩.১.১. নিসাব নির্ধারণ

নিসাব-এর শাব্দিক অর্থ হলো কিছু নগদ অর্থ বা কতক সম্পদের মালিক হওয়া। ইসলামী শরীয়া মতে, অর্থ বা সম্পদের এমন একটি পরিষদ বা সীমা নির্ধারণকে নিসাব বলে যা অতিক্রম করলে যাকাত প্রদান অবধারিত হয় এবং এ পরিমাণ অর্থ বা সম্পদ অর্জিত না থাকলে যাকাত প্রদানের বাধ্যবাধকতা থাকে না।

জাকাত গণনার বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পূর্বেই অগ্রিম জাকাত প্রদান করলে জাকাতের বাধ্যবাধকতা আর থাকবে না অর্থাৎ জাকাত প্রদান সম্পন্ন হয়ে যাবে। প্রথম সারির ফিক্হ বিশারদ যথা ইমাম আবু হানিফা, ইমাম শাফেয়ী, ইমাম আহমাদ, ইমাম ইসহাক প্রমুখ এ মত পোষণ করেন (আল আইনী : ৪৭)। তাদের মতের সমর্থনে নিুোক্ত হাদিস উপস্থাপন করা হয়:

‘ইবনে আব্বাস (রা.) জাকাতের বছর পেরিয়ে যাবার পূর্বেই যাকাত প্রদানের ব্যাপারে রাসুল (স.) কে জিজ্ঞেস করলে তিনি এ ব্যাপারে অনুমতি প্রদান করেন।’ (তিরমিযী: আবওয়াবুথ যাকাহ্)। উসমানী উল্লেখ করেন যে, ইমাম সুফিয়ান সাওরী এবং ইমাম মালিক এ ব্যাপারে ভিন্নমত পোষণ করেন (উসমানী, ১৯৮৩:৫০৯-৫০৯)।

 

 

এ ব্যাপারে দ্বিতীয় মত হলো, এক বছর পর্যন্ত কোনো সম্পদের মালিকানা বিরাজ করলে সে সম্পদের জন্য নির্ধারিত জাকাত প্রদান অপরিহার্য। এ সংক্রান্ত তৃতীয় মত হলো, কোনো ব্যক্তি এখন যদি নিসাব পরিমাণ সম্পদের অধিকারী হলো, তাহলে তাকে এখনি যাকাত দিতে হবে যেমন, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়াসহ পৃথিবীর অনেক দেশের মুসলমানরা মাসের বেতন পাবার সঙ্গে সঙ্গে যাকাত প্রদান করে থাকেন এবং এ হিসেবে ১২ মাসে তারা ১২ বার যাকাত প্রদান করেন। অধিকাংশ ইসলামী চিন্তাবিদের মতে, বছরের প্রথমে ও শেষে যদি নিসাব পরিমাণ অর্থ বা সম্পদ থাকে, তাহলে যাকাত প্রদান অপরিহার্য। এ ব্যবস্থাকে অর্জিত সম্পদের যাকাত হিসেবে অভিহিত করা হয় (মান্নান, ১৯৮৯:২১৩)।

 

 

৩.১.২. সমুদয় সম্পদ একত্রিতকরণের মাধ্যমে নিসাবপুননির্ধারণ যাকাত যোগ অর্থ বা দ্রব্য যেমন, স্বর্ণ, রৌপ্য নিসাব পরিমাণ না হওয়া পর্যন্ত যাকাত অবধারিত হয় না- এ ব্যাপারে, ‘ইজমা’ (ঐকমত) প্রতিষ্ঠিত হওয়ার কারণে কোনো ব্যক্তর সমুদয়, সম্পদ একত্রিতকরণের মাধ্যমে নিসাব পুননির্ধারণ প্রক্রিয়া প্রয়োজনীয় গ্রহণযোগ্যতা পাচ্ছে না। কিন্তু পরিবর্তিত বিশ্বের রাজনৈতিক অর্থনীতির প্রেক্ষিতে বিষয়টির গুরুত্ব অনস্বীকার্য।

আধুনিককালের ইসলামী অর্থনীতিবিদগণ এ ব্যাপারে দুধারায় বিভক্ত। প্রথমধারার চিন্তাবীদরা প্রতিষ্ঠিত ইজমা বিরোধী কোনো পুন:নির্ধারিত নিসাব প্রক্রিয়া সমর্থন করেন না (আহমাদ, ১৯৮৯:৫৫)। এ ধারার পক্ষে খুব কম সংখ্যক চিন্তাবীদ রয়েছেন। অসাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে দ্বিতীয় ধারার চিন্তাবীদরা মনে করেন, সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার, সুষম বণ্টন, ধনী-দরিদ্রের সৌহার্দপূর্ণ ও মমতাময় সহাবস্থান এবং সর্বোপরি প্রাচুর্যময় সাবলিল সমাজ প্রবাহ সৃষ্টির লক্ষ্যে সকল সম্পদ একত্রে মিশিয়ে নিসাব পুন:নির্ধারণ যুগ, সময় ও বিবেকের দাবি। তাদের মতে, কোনো ব্যক্তির অর্থ ও সম্পদ পৃথকভাবে যদি যাকাতযোগ্য না হয়। তাহলে একত্রিত করে স্বর্ণ বা রৌপ্যের নিসাবের মূল্য পরিমাণ হলে সে সম্পদের উপর যাকাত অবধারিত। তারা মনে করেন, সম্পদের আনুভূমিক মূল্যায়নের পরিবর্তে উল্লম্বিক পুনর্বিন্যাস অপরিহার্য (মান্নান, ১৯৮৯:৩৪-৩৫)। উল্লম্বিক মূল্যায়নের ফলে সম্পদের সকল প্রকার বা আন্ত:প্রকার একত্রিত করে নিসাব নির্ধারণ শরীয়তসম্মত বলে অধিকাংশ ইসলামিক চিন্তাবীদ অভিমত ব্যক্ত করেন।

মওদুদী বলেন, কোনো ব্যক্তির স্বর্ণ বা রৌপ্য যদি আনুভূমিক মূল্যায়নের কারণে পৃথকভাবে নিসাব পরিমাণ না হয়, তাহলে উল্লম্বিকভাবে মূল্যায়নপূর্বক দুটি পণ্যের একত্রিত মূল্য যদি নিসাব পরিমাণ হয়, তাহলে সেভাবে যাকাত প্রদান অপরিহার্য (মওদুদী: ১৮২-১৯০)। এ বক্তব্যের সমর্থনে নিম্নে বর্ণিত হাদীস উদ্ধৃত করা হয় (জাফরী, ও আমীন, …..: ৪২)।

‘হযরত উমর (রা.) তাঁর বন্ধুদের সাথে পরামর্শপূর্বক ৫% হারে ঘোড়ার উপর যাকাত অবধারিত করেন।’

 

৩.২. জাকাতযোগ্য সম্পদ এবং জাকাত-হার

নিম্নে অংকিত তিনটি অনুচিত্রের সাহায্যে আমরা জাকাতযোগ্য সম্পদ এবং তাতে প্রদেয় জাকাতের হার সম্পর্কে স্পষ্ট জ্ঞান লাভ করতে পারি। ইসলামী আইনবিশারদবৃন্দের সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামতের ভিত্তিতে এ ডায়াগ্রাম প্রস্তুত করা হয়েছে, যদিও এ বিশেষএদর মধ্যে পরিমাণ নির্ধারণকে একটি শর্ত হিসেবে বিবেচনা করা হবে কিনা-এ বিষয়ে বেশ মতানৈক্য রয়েছে (আলহিদায়া:৪৪)।

আব্দুল আযীয শেখ রচিত ‘যাকাতের ধারণা’ (পড়হপবঢ়ঃ ড়ভ ষধশধয) শীর্ষক প্রবন্ধের আলোকে অনুচিত্র-১ অংকন করা হয়েছে।

 

অনুচিত্র ১: সম্পদ ও জাকাত-হার

সংখ্যা      জাকাতযোগ্য সম্পদ   জাকাত-হার

১            নগদ টাকায় পরিণত করা যায় এমন সম্পদ    ২.৫%

২            খনিজ ও সঞ্চিত সম্পদ       ২০% (আবু হানিফ)

৩            সেচকৃত জমির উৎপাদন     ৫%

৪            সেচবিহীন উৎপাদন    ১০%

৫            পশু-প্রাণী (গরু, ছাগল, উট ইত্যাদি) ভিন্ন ভিন্ন হার

 

উৎস: এম,আর, জামান (সম্পদ), আসপেক্টস অব দি ইকনোমিক্স অব জাকাহ্, আমেরিকান ট্রাস্ট পাবলিকেশন্স, ইন্ডিয়ানা, পৃ. ১৮-১৯

উপরিউক্ত টেবিল থেকে আমরা সহজেই বুঝতে পারি। ব্যাংকে সঞ্চিত টাকা পয়সা, নগদ টাকা বা সম্পদ অথবা নগদ টাকায় পরিণত করা যায় এমন সম্পদ, খণিজ দ্রব্য, সঞ্চিত সম্পদ, কৃষিক্ষেত্র, ফলফুল বাগানের উৎপাদন এবং গৃহপালিত পশুপাখির উপর নির্দিষ্ট হারে জাকাত প্রদান অপরিহার্য।

অনুচিত্র-২ স্পষ্টভাবে স্বর্ণ-রৌপ্য, উট, গরু, ছাগল এবং ব্যবসা-পণ্যের যাকাত সম্পর্কে ধারণা প্রদান করে। উপমহাদেশের প্রখ্যাত ইসলামি চিন্তাবিদ সাইয়েদ আবুল আলো মওদুদীর পুস্তক অবলম্বনে অনুচিত্র-২ তৈরি করা হয়েছে।

 

 

অনুচিত্র ২: নির্দিষ্ট সম্পদের নিসাব

সংখ্যা      জাকাতযোগ্য সম্পদ   নিসাব

১            স্বর্ণ   ৭.৫ তোলা (৩০৩ং)

২            রৌপ্য       ৫২.৫ তোলা

৩            উষ্ট্র   ৫টি

৪            গরু  ৩০টি

৫            ঘোড়া       ৪০টি

৬            ব্যবসা-পণ্য       ৫২.৫ তোলা রৌপ্য মূল্যের সমান

উৎস: সাইয়েদ আবুল আলা মওদুদী, ফান্ডামেন্টাল্স অব ইসলাম, ইসলামিক পাবলিকেশন্স, লাহোর, পৃ. ১৮২-১৯০ আমরা দৈনন্দিন জীবনে এমন সব জিনিসপত্র ব্যবহার করি, যাতে জাকাত দিতে হবে কিনা- এ ব্যাপারে প্রায়শই আমরা সন্দিহান হয়ে থাকি। অনুচিত্র-৩ এর সাহায্যে আমরা এ বিষয় সম্পর্কে অবহিত হতে পারি।

 

অনুচিত্র-৩: যাকাত যোগ্য নয় এমন সম্পদ

সংখ্যা             দ্রব্য যা জিনিসের বিবরণ

১            বাস্তুভিটা বা বসবাসের ঘর-বাড়ি

২            পরিধেয় পোশাক-পরিচ্ছদ

৩            গৃহের আসবাবপত্র যেমন, ফ্রিজ, এসি, টিভি, কম্পিউটার

৪            বাহনের ঘোড়া, উট এবং অন্যান্য পশু

৫            ব্যবহারের অস্ত্র-শস্ত্র

৬            খাদ্য ও পানীয়

৭            স্বর্ণ

৮            বইপত্র, খাতাকলম

৯            মণি, জহরত, দামী পাথর

১০          কৃষিতে ব্যবহারের পশুপ্রাণী

১১          উৎপাদনের সামগ্রী

 

উৎস: যাকাতের উপর লিখিত বিভিন্ন প্রবন্ধ ও পুঁথি-পুস্তক থেকে সংগৃহীত।

অনুচিত্র-৩ এ উল্লিখিত বস্তু বা দ্রব্য যদি ব্যবসা-বাণিজ্য ব্যবহার করা হয়, তখন তা বাণিজ্যিক অস্তিত্ব লাভ করে এবং তা জাকাতযোগ্য হয়ে থাকে। এখানে আরো একটি বিষয় উল্লেখযোগ্য যে, উপরিউক্ত অনুচিত্রসমূহ যদিও সংখ্যাগরিষ্ঠ উলামাবৃন্দের মতামতের ভিত্তিতে চিত্রিত করা হয়েছে। তবুও সময় ও কালের পরিবর্তিত বাস্তবতায় উপরিউক্ত বস্তু বা বস্তুসমূহের সংজ্ঞা এবং তার জাকাতের হার বিষয়ে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের জন্য ইজতিহাদের উন্মুক্ত দরজা সবসময়ই অবারিত থাকবে এবং পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ইজতিহাদ-লব্ধ বিশ্লেষণ ও নতুন মতামতের প্রায়োগিতা ইসলামের প্রশস্ততার প্রমাণ হিসেবে কালের সংকীর্ণতা অতিক্রম করবে।

৩.২.১ যৌথ-ব্যবসায়ের (ঔড়রহঃ ঝঃড়পশ ঈড়সঢ়ধহু) যাকাত

হানাফী মাযহাব অনুযায়ী যৌথসংঘ কোম্পানির মূলধনের উপর জাকাত ধার্য হয় না, বরং প্রত্যেক শেয়ার হোল্ডারের পূঁজি নিসাব অতিক্রম করলে তার উপর জাকাত অবধারিত হয়। অধিকন্তু ব্যক্তির শেয়ারের যে অংশ জাকাতযোগ্য উদ্যোগ যথা ব্যবসা ইত্যাদি ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়, শুধুমাত্র সেই অংশের উপর জাকাত দিতে হয়। নিসাব নির্ধারণের ক্ষেত্রে শেয়ারের বর্তমান বাজারমূল্য বিবেচনা করতে হয়। অন্যদিকে শাফেয়ী ও হানাবিলী মাযহাব এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ ভিন্নমত পোষণ করে। তাদের মতে, ব্যক্তি নয়, বরং কোম্পানির মূলধনের উপর জাকাত ধার্য করা হয়। তবে শর্ত হলো, সকল শেয়ারহোল্ডারকে মুসলমান হতে হবে। যদি মুসলিম ও অমুসলিম সমন্বয়ে কোনো কোম্পানি পরিচালিত হয়, তাহলে শুধু মুসলমান শেয়ার হোল্ডারদের উপর ব্যক্তিগতভাবে যাকাত অর্পিত হয়। বর্তমানে মুসলিম বিশ্বের প্রায় সবদেশের যৌথ ব্যবসায় কোম্পানি বা করপোরেট ব্যবসায়, আইনগত ব্যক্তি (ঔঁৎরফরপধষ ঢ়বৎংড়হ) হিসেবে বিবেচিত হয় (আমীন ও জাফরী, ৪৫)।

 

 

৩.২.২. যৌথ সম্পদের জাকাত

অধিকাংশ ফকীহ যথা ইমাম শাফেয়ী, ইমাম মালিক ও ইমাম আহমাদ মনে করেন যে, দুজন ব্যক্তি যদি কোনো জাকাতযোগ্য দ্রব্যের মালিকানা প্রাপ্ত হয়, তাহলে সম্পূর্ণ সম্পদের উপর জাকাত ধার্য করা হবে, যদি তা নিসাব উত্তীর্ণ হয়।

 

৩.২.৩. উৎপাদনহীন সম্পদের যাকাত

অনুচিত্র-৩ অনুযায়ী জাকাত ধার্য করা হবে না এমন এগারটি খাতের কথা আমরা অবগত হয়েছি। সম্প্রতিকালে এ সম্পদসমূহ উৎপাদন বান্ধব কি না, বা উৎপাদনের উপযোগী ও সহায়ক কিনা, অথবা উৎপাদন বিরোধী বা উৎপাদনহীন কিনা এসব বিতর্ককে সামনে রেখে ইসলামী চিন্তাবীদগণের কাছে নতুন নতুন ব্যাখ্যা, বিশ্লেষণ উপস্থাপিত হচ্ছে এবং তাদের মধ্যে বেশ মতপার্থক্য পরিলক্ষিত হচ্ছে। বিতর্কের একটি ধারামতে, কেউ যদি স্বেচ্ছায় এসব সম্পদের উপর যাকাত দিতে চান, তাহলে তা ধর্তব্য হবে। তাদের যুক্তি হলো, তথাকথিত উৎপাদন বিমুখ সম্পদসমূহ গচ্ছিত বা পূঞ্জিভূত (মুদ্দাখার) সম্পদ হিসেবে বিরাজিত, যেখানে যাকাত গ্রহণের ইসলামী আইনের বিস্তৃত প্রশস্ততা বিদ্যমান।

 

ধরা যাক, কেউ কৌশলে যাকাত প্রদান এড়িয়ে চলতে তার উৎপাদনমুখী বা উৎপাদনযোগ্য সম্পদরাজি বিভিন্ন স্থানে বসতবাড়ি বা এপার্টমেন্ট তৈরিতে নিয়োজিত করতে উৎসাহিত হতে পারে এবং ইসলামী আইনের প্রশস্ততার সুযোগ গ্রহণে প্রকৃত উদ্দীপিত হতে পারে। কেউবা আবার উৎপাদনযোগ্য সম্পদ দিয়ে রেডিও, টিভি, দামী কম্পিউটার বা আকাশছোঁয়া বিলাস দ্রব্য ক্রয় করতে প্রবৃত্ত হতে পারে আবার কেউ বা তার সকল স্বর্ণ-রৌপ্য রূপান্তরিত করে নীলকান্তমনি (ংধঢ়ঢ়যরৎব), হিরক (ফরধসড়হফ) বা প্লাটিনামের (ঢ়ষধঃরহঁস) এর মতো মূল্যবান ধাতু ক্রয় করে রাখতে পারে। আর এসকল অবস্থায় যাকাত তহবিল হতে দরিদ্র-অসহায় মানবগোষ্ঠী চিরবঞ্চিত রয়ে যাবে।

 

এ ব্যাপারে দ্বিতীয় ধারার বক্তব্য হলো, যাকাত আল্লাহ্তায়ালার সুনির্দিষ্ট আদেশ, যা কোনোভাবেই বিকৃতির রঙ ও আবরণে কলুষিত করা উচিত নয়। কুরআন ও সুন্নাহ বর্ণিত নিয়মের বিপরীতে যাকাত অবধারিত নয় এমন সব উৎপাদনহীন সম্পদের উপর জাকাত আরোপ সমীচীন নয়। দরিদ্র, অভাবী ও দুস্থদের কল্যাণ ও পুনর্বাসনের অসংখ্য বিকল্প ইসলামী অর্থনীতিতে রয়েছে। ইসলাম ধর্মের প্রত্যাশা হলো ব্যক্তি সকল… প্রভাবের ঊর্ধ্বে থেকে ইসলাম ধর্মের আনুগত্যের অনুপ্রেরণায় দারিদ্র্যবিমোচনে তার প্রয়োজনের বাইরে যে উদ্বৃত্ত অর্থ আছে, তা থেকে সুনির্দিষ্ট অংশ এবং ইচ্ছে করলে স্বেচ্ছায় বিপুল অংশ বা সবটুকু দান করতে পারে (মাসুদ, ১৯৯৫:২৮)। আল্ কুরআনের নিম্নেবর্ণিত আয়াত এখানে প্রণিধানযোগ্য:

‘তারা তোমাকে জিজ্ঞেস করে কতটুকু তাদেরকে খরচ করতে হবে! তুমি বলে দাও, তাদের প্রয়োজন পূর্ণ করে যা থাকে তা সবটুকু তাদেরকে দিয়ে দিতে।’

(আল কুরআন, ২: ২১৯)।

 

উদ্ভূত বিতর্কের তৃতীয় ধারাটি বেশ গবেষণালব্ধ ও বৈপ্লবিক নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত। এ মতে, রাষ্ট্র আইন প্রণয়নের মাধ্যমে বিলাস দ্রব্যের উপর বিশেষ কর (ংঢ়বপরধষ ঃধী) আরোপ করতে পারে, যাতে দরিদ্র ও সুবিধাবঞ্চিত সর্বহারা শ্রেণীর জীবনাবসান উন্নত হতে পারে (আমীন ও জাফরী, …:৪৬)।

 

৩.৩. জাকাত সংগ্রহ পদ্ধতি

যাকাত সংগ্রহের মূলনীতি হলো, রাষ্ট্র বা রাষ্ট্রকর্তৃক নিয়োজিত ব্যক্তি বা সংস্থাসমূহ জাকাত-অর্থ সংগ্রহ, তার ব্যবস্থাপনা এবং যাকাত-অর্থ দ্বারা প্রতিষ্ঠিত তহবিল সংরক্ষণের দায়িত্বপ্রাপ্ত। অপর একটি মূলনীতি হলো- আধুনিক সরকার ব্যবস্থার নোংরা ব্যবস্থাপনা রাজনীতি হলো- আধুনিক সরকার ব্যবস্থার নোংরা ব্যবস্থাপনা রাজনীতি বা সংকীর্ণ দলীয় ও গোষ্ঠী স্বার্থের ঊর্ধ্বে থেকে দ্রুত, স্বচ্ছ, সহজ, সাবলীল এবং সুষ্ঠু পদ্ধতি অবলম্বন করা, যাতে জাকাত তহবিলের সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করা সম্ভব হয়।

যদি রাষ্ট্রের জাকাত ব্যবস্থাপনা বিশৃঙ্খল, দুর্নীতিপরায়ণ ও অপরাজনীতির শিকার হয়, অথবা রাষ্ট্র যদি এভাবে ইসলামী পদ্ধতির তোয়াক্কা না করে যাকাত ব্যবস্থাকে গুরুত্ব না দেয়, তাহলে ইসলামী সমাজের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ নিজেদের উদ্যোগে বিভিন্ন পেশার বিশ্বস্ত ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গ বা বিধ্বস্ত প্রতিষ্ঠানসমূহের উপর জাকাত-ব্যবস্থাপনার গুরুদায়িত্ব অর্পণ করতে পারে। এ প্রক্রিয়াও যদি দুর্ভাগ্যবশত ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়, যেমন আধুনিক পৃথিবীর অনেক মুসলিম দেশে জাকাত-ব্যবস্থা অকার্যকর এবং অবহেলিত, সে অবস্থায় মুসলিম ব্যক্তি তার নিজস্ব যাকাত নির্ধারিত খাতে প্রদান করতে পারে তবে, মনে রাখতে হবে জাকাত অর্থ সাংগঠনিক পদ্ধতিতে সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে শোষণ-বঞ্চনাহীন সমাজ বিনির্মাণে অবধারিত ঘোষণা করা হয়েছিল।

 

৪. জাকাত বিতরণ এবং জাকাত- অর্থের ব্যবহার জাকাতের সংগ্রহ কৌশল অবগত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এর বিতরণ ব্যবস্থা ও ব্যবস্থাপনা স্ট্রাটেজির আয়ত্ব করা অত্যাবশ্যক। এর সঙ্গে জাকাতের অর্থ ব্যবহারের খাতসমূহ অনুধাবন করা, জাকাতের বিতরণ প্রক্রিয়া আÍস্থ করা, জাকাত সংগ্রহ ও বিতরণের ভৌগলিকতা সম্পর্কে অবগত হওয়া, জাকাত অর্থের মালিকানা হস্তান্তর প্রক্রিয়ায় অকপটতা প্রদর্শন করা, জাকাত গ্রহণকারীর স্বাবলম্বী হওয়া নিশ্চিত করা, জাকাতের মাধ্যমে দীর্ঘস্থায়ী তহবিল গঠন করা এবং সর্বোপরি যাকাতের সুষ্ঠু বণ্টনের মাধ্যমে শোষণমুক্ত ও উন্নত সমাজকাঠামো নির্মাণ করা প্রভৃতি বিষয়গুলো ওতপ্রোতভাবে জড়িত।

 

 

৪.১. জাকাত-অর্থ ব্যবহারের খাতসমূহ

আলকুরআনে জাকাতের অর্থ ব্যবহারের আটটি খাত বর্ণনা করা হয়েছে (আল কুরআন, ৯:৬০)। যথা-

ক. অসহায় ও নিঃস্ব

খ. দরিদ্র

গ. জাকাত-অফিসের কর্মচারী কর্মকর্তারা

ঘ. টার্গেটকৃত কোমলমতিসম্পন্ন সাদা  মানুষগুলো যাদের ইসলাম গ্রহণের সম্ভাবনা রয়েছে

ঙ. দাসমুক্তির জন্য

চ. ঋণগ্রস্ত ব্যক্তির ঋণ মুক্তির জন্য

ছ. আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য

জ. পথিক

নওফীল (১৯৮১:১১১-১১৩) বলেন, জাকাত অর্থ খরচের ব্যাপারে দুটি মতো পরিলক্ষিত হয়। প্রথম মতানুযায়ী জাকাত প্রদানকারী উপরি বর্ণিত আটটি খাতের যে কোনো একটি খাতে তার জাকাত প্রদান করতে পারে। দ্বিতীয় অভিমত হলো- জাকাতের অর্থ আটটি খাতের প্রত্যেকটির জন্য ব্যয় করতে হবে। তৃতীয় এবং সপ্তম খাতটি ছাড়া অন্য খাতগুলোর প্রত্যেকটিই দুর্বল, অসহায়, দুঃস্থ, হতদরিদ্র এবং ঋণগ্রস্ত মানুষের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট, যাদের সাধারণ বৈশিষ্ট্য হলো দারিদ্র্য ও অভাবের ভারে তারা কালান্ত ও দিশেহারা। এ দিক থেকে বিবেচনা করলে জাকাতের মূল উদ্দেশ্য যে দারিদ্র্য বিমোচন করা, তা সহজেই অনুমিত হয়।

 

 

৪.২ বিতরণ (১৩) কৌশল

জাকাতের অর্থ সুষ্ঠুভাবে বিতরণের কৌশলের কতিপয় লক্ষণীয় দিক রয়েছে: ক) জাকাত বণ্টনের খাতের বাইরে কাউকে জাকাত দেয়া সমীচিন নয়;

খ) জাকাতের হকদার যে কোনোভাবেই যেন বঞ্চিত না হয়;

গ) যে এলাকা থেকে জাকাত সংগ্রহ করা হয়, সেখানেই তা বিরর্তন করা উচিত;

ঘ) জাকাত বণ্টন কৌশল এমন যথোপযুক্ত হওয়া উচিত, যাতে দরিদ্র ও অসহায় মানুষের জন্য তা চিরস্থায়ী অগ্রগতি লাভের উৎস হয়ে থাকে;

ঙ) জাকাত বিতরণের অন্যতম উদ্দেশ্য হওয়া উচিত দরিদ্র জনগোষ্ঠীর অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনে ভূমিকা রাখা;

চ) জাকাত প্রদানের অনুভূতিতে জাকাত অর্থের মালিকানা পূর্ণভাবে যাতে জাকাত গ্রহণকারীর জন্য প্রতিষ্ঠিত হয়, সেদিকে লক্ষ্য রাখা;

ছ) বিতরণ প্রক্রিয়ার দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য হলো সমাজ থেকে দারিদ্রমুক্ত করা।

 

এখন আমরা জাকাতের বণ্টন প্রক্রিয়ায় কেওশল নির্ধারণে কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের ওপর আলোকপাত করবো।

 

৪.৩. জাকাত প্রদানে ভৌগলিকতা আবু উবাঈদ তার ‘আল আমওয়াল’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে, যে স্থান বা ভৌগলিক এলাকা থেকে জাকাত সংগ্রহ করা হয়, সেখানকার দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মাঝে তা বিতরণ করা উচিত। (আবু উবাঈদ, ১৩৫৩:৫৯৮)। কারজাঈ (১৯৮২:৪৮৮) এর ব্যাখ্যায় বলেছেন যে, সুন্নাহর উদ্দেশেও এটা এবং এ কারণে ঐ সমাজের মধ্যেই জাকাত বিতরণ করতে হবে যাতে প্রতিবেশীর অধিকার সংরক্ষণ করা যায়, বিদ্যমান সমাজটি অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি দান করে সুখী ও শান্তিময় করে গড়ে তোলা যায় এবং দারিদ্র্য দূর করে শোষণমুক্ত সমাজ উপহার দেয়া যায়।

 

এ সংক্রান্ত ফিক্হ বিশারদরা একমত হতে পারেননি। ইমাম শাফেয়ী মনে করেন যে, জাকাত সংগ্রহস্থল হতে জাকাত অর্থ স্থানান্তর করে অন্যত্র বণ্টন করা যায়, যদি ঐ সমাজে কোনো জাকাত গ্রহণের যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তি বা গোষ্ঠী বসবাস না করে। ইমাম মালিক বলেন, জাকাত ব্যবস্থাপনা পরিষদ সুষ্ঠু নীতি ও পরিকল্পনা প্রণয়নের মাধ্যমে সর্বোত্তম ব্যবহারের মাধ্যমে সার্বজনীন সমাজ কল্যাণের নিমিত্তে যে কোনো স্থানে তা বণ্টন করতে পারে। হানাফী মাযহাব অনুযায়ী এক স্থানের জাকাত অন্যস্থানে বণ্টন করা অন্যায় নয়, তবে সংগৃহীত অর্থ ঐ সমাজের দরিদ্র্য ও অসহায় শ্রেণীর মধ্যে বিতরণ করা শ্রেয়। যদি অন্য কোনো সমাজে অধিকতর করুণ ও বেশি দরিদ্র গোষ্ঠী বাস করে, তাহলে জাকাত অর্থ সংগ্রহ স্থানের বাইরেও সেই দুঃস্থদের মধ্যে বিতরণ করা অধিকতর যুক্তিযুক্ত। অধিকন্তু জাকাত প্রদানকারীর নিকটস্থ ব্যক্তি বা আÍীয়-স্বজন যদি তার এলাকার বাইরে অন্যত্র বসবাস করে, তবে সেই আÍীয়-স্বজনের মধ্যে তা বিতরণ করা উচিত।

 

আল্লামা ইউসুফ কারযাভী (১৯৮০:৮১৬) বলেন, জাকাতের ভৌগলিকতায় গুরুত্বের অনুশীলন এজন্য দরকার যাতে দারিদ্র্য দূর করে সমৃদ্ধিশালী সমাজ গঠন করা যায়, প্রত্যেক এলাকাকে আÍনির্ভরশীলতার শিক্ষা-দীক্ষায় আলোকিত করা যায় এবং নিজস্ব এলাকার সমস্যা সমাধানে ভূমিকা রাখা সম্ভব হয়। উপরন্তু, জাকাত-উত্তোলনের স্থানীয় বাসিন্দাদের প্রত্যাশা থাকে যে, ঐ স্থানের দারিদ্র ও অসহায় মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থায় উন্নতি হোক। আল্লামা কারযাভী মনে করেন যদি ঐ স্থানের জনগণের মধ্যে তেমন দরিদ্র ব্যক্তি বা গোষ্ঠী বসবাস না করে তাহলে এ মূলনীতি অনুসরণ না করলে তাতে দোষের কিছু নেই। স্থানীয় নেতারা এবং জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তিরা আলোচনার ভিত্তিতে এ ব্যাপারে যৌক্তিক সিদ্ধান্ত নিতে পারেন।

 

৪.৪. যাকাত-অর্থের মালিকানা হস্তান্তর

কোথায় সম্পদ পূঞ্জিভূত থাকা ইসলামের মূলনীতির পরিপন্থী, এবং এ কারণে মুষ্টিমেয় বুর্জোয়া শ্রেণীর পকেট থেকে যেন অর্থ অন্যত্র বণ্টন করা যায় তার ব্যবস্থা করতে ইসরামী অর্থনীতির নিজস্ব নীতিমালা নির্ধারিত রয়েছে। এ ক্ষেত্রে যাকাত-অর্থের মালিকানা স্থানান্তরের মাধ্যমে ‘সম্পদের সুষ্ঠু বণ্টন ব্যবস্থা গড়ে তোলার পন্থা সর্বোৎকৃষ্ট। এখানে মনে রাখা দরকার যে, সম্পদের প্রকৃত মালিকানা তো আল্লাহ্রই, মানুষ তার প্রতিনিধি হিসেবে তারই প্রদত্ত সম্পদ রক্ষণাবেক্ষণের মাধ্যমে কৃত্রিম মালিকানা প্রাপ্ত হয়। আল্কুরআনের নিম্নে বর্ণিত আয়াত এখানে প্রণিধানযোগ্য:

‘আল্লাহ তোমাকে যে সম্পদ দিয়েছেন, তা থেকে তুমি তাদেরকে নির্ধারিত অংশ দিয়ে দাও।’

(আল কুরআন, ২৪:৩৩)

 

মুফতী শফী (১৯৮৩:৫) এর ব্যাখ্যায় বলেন, মানুষের মালিকানা নিরংকুশ, খামখেয়ালী ও নিরন্তর নয়, মানুষের মালিকানা অনেক সীমাবদ্ধতা ও শর্তাবলীতে গ্রন্থীত। কাজেই বিধাতার সম্পদ তারই আদেশে অন্যদের নির্দিষ্ট অংশ দিকহীনচিত্তে প্রদান করার বিধান বিচারসোহাগী ও কল্যাণমুখী।

 

যাকাত প্রদানের ক্ষেত্রে সতর্ক থাকতে হবে যেন যাকাত দানের পর ধনী লোকেরা যেন গর্ববোধ না করে। বা অহংকারের দোষে আক্রান্ত হয়ে না পড়ে। সেতো কেবল প্রভুর দেয়া আমানত তার নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছে দিয়েছে মাত্র। কুরআনের এ আয়াতটি তার উজ্জ্বল প্রমাণ:

‘তাদের (ধনীদের) সম্পত্তিতে দুঃস্থ, দরিদ্রদের সুনির্দিষ্ট অধিকার রয়েছে’ (আল্ কুরআন, ৭০ : ২৪-২৫)।

 

 

৪.৫. যাকাত গ্রহণকারীর আÍনির্ভরশীলতা

ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা উমর (রা.) বলেন, ‘তুমি যদি যাকাত দাও তাহলে যাকাত গ্রহণকারীকে ধনীমানুষে পরিণত কর’ (উবাঈদ, ১৩৫৩ : ৫৬৫)। কারযাভী আÍনির্ভরশীলতার দুটি ধারণা উপস্থাপন করেছেন। ইমাম মালিক ও ইমাম আহমাদ সারাবছর ব্যাপী আÍনির্ভরশীলতার শর্ত দিয়েছেন। কিন্তু ইমাম শাফেয়ী চিরস্থায়ীভাবে আÍনির্ভরশীলতা অর্জনের অগ্রাধিকার যাকাত-কর্তৃপক্ষের নীতিনির্ধারনীতে অন্তর্ভুক্তির কথা বলেছেন। উমর (রা.) এর উপদেশ এক্ষেত্রে উল্লেখ করা যেতে পারে। কোনো ব্যক্তি যদি কোনো কারিগর বা কারুশিল্পীকে যাকাত দিতে চায়, তাহলে যেন তার কারুশিল্প উন্নয়নে প্রয়োজনীয় অর্থ সরবরাহ করে। এভাবে কৃষককে যাকাত প্রদান নীতিতে কৃষিজ দ্রব্যাদি, কৃষির যন্ত্র বা যন্ত্রাংশ, সার, বীজ ইত্যাদি অন্তর্ভুক্তি থাকা উচিৎ। (আমীন ও জাফরী, … : ৫০)।

 

৪.৬. যাকাত এবং সম্পদ বৃদ্ধিকরণ/আহরণ

দারিদ্র্য বিমোচনে অগ্রণী ভূমিকা পালনের নিমিত্তে যাকাতলব্ধ অর্থ এমনভাবে সংগৃহীত করতে হবে, যাতে প্রয়োজনীয় তহবিল গঠন করা যায়। আমীন ও খান (১৯৯৭ : ২১৫) বলেন, যাকাত-লব্ধ অর্থ যদি সুষ্ঠু সাংগঠনিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পরিচালনা করা যায়, তাহলে দারিদ্র্য নিরসনে প্রয়োজনীয় তহবিল গঠন করা সম্ভব। একটি পরিসংখ্যান হতে জানা যায় ২য় বাংলাদেশের মতো একটি নিু আয়ের দেশ হতে শুধুমাত্র কৃষিখাত থেকে ২৫০০ মিলিয়ন টাকা যাকাত হিসেবে উত্তোলন করা সম্ভব (গাজালী, ১৯৯০ : ৯৫)। বাংলাদেশের অহহঁধষ উবাবষড়ঢ়সবহঃ চৎড়মৎধসসব এর এক হিসাব অনুযায়ী দেখা যায়। ১৯৮৮-৮৯ অর্থবছরে কৃষি উন্নয়নের লক্ষ্যে দেশী ও বিদেশী উৎস থেকে মাত্র ৩৬৬৭.৫ মিলিয়ন টাকা বরাদ্দ করা হয (অউচ, ১৯৮৮-৮৯ : ১০)। স্পষ্টত: কৃষি উন্নতির জন্য বরাদ্দকৃত এ অর্থের প্রায় ৭০ ভাগ যাকাত-তহবিল হতে বরাদ্দ দেয়া যায় (আমীন ও জাফরী, ….. : ৫১)। গবেষণার মাধ্যমে প্রমাণ করা সম্ভব যে, বাংলাদেশের ধনীকশ্রেণীর সম্পদের উপর নির্ধারিত যাকাত যদি রাষ্ট্রীয় তত্ত্বাবধানে সংগ্রহ করা যায়। এবং এ পদ্ধতিতে যদি সকল উৎপাদনশীল সম্পদের উপর যাকাত ধার্য করা যায়, তাহলে সম্পদ ভোগ-দখলে সীমাহীন বৈষম্য লক্ষ্যনীয় মাত্রায় হ্রাস করে অত দ্রুত সময়ের মধ্রে একটি সুখী-সমৃদ্ধিশালী বাংলাদেশ গড়ে তোলা সম্ভব।

 

 

৪.৭. উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে জাকাতের ভূমিকা

জাকাতলব্ধ সম্পদ বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে যেমন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, জন-নিরাপত্তা, সামাজিক অবকাঠামো ইত্যাদি ক্ষেত্রে ব্যবহার করা সমীচীন। এক্ষেত্রে আধুনিক ইসলামী অর্থনীতিবিদগণের মধ্যে যথেষ্ট মতবিরোধ রয়েছে।

 

কিছু সংখ্যক বিদ্বান মনে করেন, জনস্বার্থ এবং জনসেবার ক্ষেত্রে জাকাত-অর্থ ব্যবহার করা যায়। তাদের যুক্তি হলো, আল্-কুরআনে বর্ণিত আটটি খাত জাকাত ব্যবস্থাপনা পরিষদকে উদার ও নমনীয় নীতি গ্রহণের প্রসারতা প্রদান করেছে এবং আল্ কুরআনের এ প্রশস্ত নীতির নিরীখেই জনসেবার যাকাত-অর্থ ব্যয় করা যেতে পারে (মান্নান, ১৯৮৯:৪৩)। সম্পূর্ণ উল্টো মতটি হলো, জনসেবার খাতটি আল্ কুরআনে বর্ণিত আটটি খাতের অন্তর্ভুক্ত নয় এবং রাসুল (সা.) ও খোলাফায়ে রাশেদীনের সময় এ খাতে যাকাত-লব্ধ অর্থ ব্যবহারের কোনো নজির নেই। যদিও কোনো কোনো বিদ্যান মনে করেন, সমাজ-কল্যাণমূলক কর্মকাণ্ড আল্ কুরআনে বর্ণিত সপ্তম খাতের অন্তর্ভুক্ত, তবে তা ইসলামী চিন্তাবীদদের মধ্যে সাধারণ গ্রহণযোগ্যতা পায়নি।

 

দ্বিতীয়ত: উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডের ফলাফল শুধু যে গরিব-দুঃখী মানুষগুলো ভাগ করবে এর তো কোনো নিশ্চয়তা নেই। তৃতীয়ত: সমাজ-কল্যাণ-মূলক কার্যাবলী ব্যবস্থাপনার সঙ্গে জড়িত উচ্চমাত্রার খরচনীতি জাকাত ব্যবস্থাপনার মূলনীতির সঙ্গে সংগঠিত। এ সমস্ত উদ্যোগ ও সংশয় দূর করে জাকাত বণ্টন প্রক্রিয়া ঐ সমস্ত আর্থসামাজিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত করা যায়, যা কেবলমাত্র দরিদ্ররা ভোগ করতে পারে। বিধবার জন্য সেলাই মেশিন ক্রয় প্রোজেক্ট, রিকশা চালকদের জন্য রিকশা প্রজেক্ট, এতিম, দুস্থ ও দরিদ্রদের জন্য শিক্ষা প্রোগ্রাম ইত্যাদি জনস্বার্থমূলক উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে নিঃসন্দেহে জাকাত-অর্থ ব্যবহার করা যায়। অধুনা বিদেশী এনজিওর খপ্পরে পড়ে দরিদ্র নগোষ্ঠী তাদের বিশ্বাসের বিনিময়ে… ও তথাকথিত ক্ষুদ্র ঋণ গ্রহণ করে চক্রবৃদ্ধি সুদ গ্রহণে দিক চক্রবালে হারিয়ে যাচ্ছে। এ বিশ্বাসীদেরকে জাতীয় পাপ থেকে বাঁচানোর জন্য অনতিবিলম্বে মুসলিম দেশের সরকারি বা বেসরকারি সংস্থাসমূহকে এগিয়ে আসতে হবে এবং সংগৃহীত জাকাত-অর্থ ব্যবহার করে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য বিভিন্ন সেবামূলক কাজে তা বিনিয়োগ করতে হবে।

 

 

 

৫। জাকাত ব্যবস্থাপনা

যে কোনো অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের সুষ্ঠু পরিচালনার ক্ষেত্রে সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা দরকার এবং এক্ষেত্রে একদল সৎ ও যোগ্য ব্যক্তিরা, সর্বনিু প্রশাসনিক ব্যয়, সুষ্ঠু হিসাব-নিকাশ, নিয়মিত অডিট, গবেষণা ও মূল্যায়ন ইত্যাদি সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে পরিগণিত।

 

৫.১. জাকাত ব্যবস্থাপনা বিভাগের কর্মকর্তা/কর্মচারীর নিয়োগ-শর্ত- জাকাত সংগ্রহ ও বণ্টন প্রক্রিয়ায় নিয়োগদানের পূর্বে কতিপয় বিবেচ্য বিষয় লক্ষ্য রাখতে হবে। এগুলো নিুরূপ:

ক. নিয়োগপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে মুসলিম হতে হবে

খ. জাকাত সংগ্রহ ও বণ্টনের ক্ষেত্রে তাকে পারদর্শী হতে হবে

ঘ. তাকে বিশ্বস্ত হতে হবে

ঙ. তাকে জবাবদিহিতার গুণাবলীসম্পন্ন হতে হবে

চ. দরিদ্র ও অসহায়দের কল্যাণে ব্রতী হতে হবে

 

আল্ কুরআনে নিয়োগের ক্ষেত্রে দুটি ব্যাপক অর্থবোধক মাপকাঠি উল্লিখিত হয়েছে। যখন মুসা (আ.) মাদাঈন গমন করেন, তখন তিনি দেখেন যে প্রত্যন্ত চারণভূমিতে দুটি মেয়ে তাদের পালিত ভেড়ার জন্য পানি সংগ্রহের চেষ্টা করে ব্যর্থ হলো। তিনি তখন এ কাজে তাদেরকে সাহায্য করলেন এবং ভেড়াগুলো পানি পান করতে পারলো। মেয়ে দুটি তাদের পিতাকে যা বলেছিলো, আল্কুরআনে তা এভাবে উদ্ধৃত হয়েছে:

‘আব্বু, এ ভদ্রলোককে তোমার কাজে নিয়োগ দাও। যে সমস্ত মানুষ শক্তিশালী (কর্মঠ) ও সৎ তাদেরকে নিয়োগ দেয়া সর্বোৎকৃষ্ট।’

(আল্ কুরআন, ২৮ : ২৬)

 

সততা ও কর্মঠতা এ দুটি গুণের মধ্যে মানুষের আরো অনেক গুণাবলী প্রচ্ছন্ন থাকে এবং উপরিউক্ত সকল নিয়োগের শর্তাবলী এর অন্তর্ভুক্ত। অধিকন্তু নিয়োগপ্রাপ্ত ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব ও দৃঢ়তা প্রমাণের জন্য নিম্নে বর্ণিত বিবেচনাসমূহ উল্লেখযোগ্য:

 

ক. ব্যক্তিকে মুসলমান হতে হবে, এবং ইসলামের সকল বিধিনিষেধ পালনকারী হতে হবে

খ. তাকে যাকাত-তহবিলের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার লক্ষ্যে হিসাববিজ্ঞান, ব্যবস্থাপনা, ও অর্থনীতির মৌলিক জ্ঞান থাকতে হবে

গ. দু’জন বিশিষ্ট ও ইসলামী ব্যক্তিত্বের কাছ থেকে তার চারিত্রিক সনদপত্র নিতে হবে।

 

ইমাম আবু ইউসুফ সে যুগের সর্ববৃহৎ রাষ্ট্রের খলিফা হারুন-উর-রশীদকে উপদেশ দিয়ে বলেছিলেন,’ হে বিশ্বাসীদের নেতা, জাকাত-অর্থ সংগ্রহ ও বণ্টনের লক্ষ্যে বিশ্বস্ত, জ্ঞানী, ধার্মিক, সৎ, বিনয়ী আপনার ও জনগণের প্রতি আনুগত্য পোষণকারী ব্যক্তিদেরকে সকল প্রদেশে জাকাতলব্ধ অর্থের মহাব্যবস্থাপক হিসেবে নিয়োগদান করুন এবং তাকে নির্দেশ করুন যাতে তিনিও একইভাবে সততা, দৃঢ়তা, ধার্মিকতা এবং যোগ্যতা সম্পন্ন মানুষদেরকে এ কাজে তাকে সহযোগিতার জন্য নিয়োগ দিতে পারেন।’ (আবু ইউসুফ, ১৩৫২ : ৩)।

 

৫.২. আর্থিক ব্যবস্থাপনা

অতি অল্প ব্যয়ে সর্বোচ্চ সুবিধা অর্জনের নীতি এ ক্ষেত্রে প্রয়োগযোগ্য। প্রথমত: বেশি বেতন দিয়ে এলাকার বাইরের যোগ্য লোকদেরকে নিয়োগ না দিয়ে যাকাত সংগ্রহের স্থান থেকে যোগ্য লোকদেরকে কম বেতনে নিয়োগ দিতে হবে। দ্বিতীয়ত: খণ্ডকালীন ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গের মাধ্যমেও অতি কম সম্মানী দিয়ে যাকাত ব্যবস্থাপনা কাজ করা যেতে পারে।

 

তৃতীয়ত: স্বেচ্ছাসেবক দল বা সংগঠনের মাধ্যমেও কাজটি সম্পন্ন করা যায়।

 

৫.৩. নগদ অর্থ বিতরণ বিতর্ক

যাকাত গ্রহণকারীকে নগদ অর্থ (পধংয) নাকি অন্য কোনো কিছু (শরহফ) দেয়া যাবে, এ ব্যাপারে চার ধরনের মতামত রয়েছে।

 

প্রথমত: নগদ অর্থ যথা টাকা, ডলার, পাউন্ড, ইয়েন, ইউরো ইত্যাদি যাকাত হিসেবে প্রদান করতে হবে।

 

দ্বিতীয়ত: নগদ অর্থ না দিয়ে সমমূল্যের অন্য কোনো দ্রব্য বা জিনিস ও দেয়া যেতে পারে।

 

তৃতীয়ত: নগদ অর্থ দেয়া শ্রেয়, তবে অন্য কিছু দিলে তা মাকরুহ হবে, তবে যাকাত প্রদানের আদেশ পালিত হয়ে যাবে।

 

চতুর্থত: কেবলমাত্র বিশেষ প্রয়োজনের প্রেক্ষিতে নগদমূল্যের বাইরে অন্য কিছু দেয়া যেতে পারে। হানাফী মাযহাবের অনুসারীরা সকল অবস্থায় নগদ অর্থের বাইরে অন্যকোনো দ্রব্য বা জিনিস প্রদানকে বৈধ মনে করেন। শাফেয়ী ও জাহিরিয়া মাযহাবের অনুসারীরা কেবল নগদ অর্থ দেয়াকে বাধ্যবাধকতা হিসেবে বিবেচনা করেন।

 

বিভিন্ন মতামত বিশ্লেষণ করলে আমরা বুঝতে পারি যে, বিভিন্ন সমাজের বিভিন্ন প্রেক্ষিতে নগদ অর্থ বা অন্যকিছু প্রদানের নজীর পাওয়া যায়। এ ব্যাপারে তাই মূলনীতি হলো যাকাত প্রদানকারী ও যাকাত গ্রহণকারীর সুবিধা অনুযায়ী যাকাত দেয়া যায়।

উদাহরণস্বরূপ, কৃষক তার শস্যের যাকাত দেয়ার সময় শস্য দিয়েই যাকাত দিতে পারেন। আবার একজন শহুরে ব্যবসায়ী তার দূরবর্তী কৃষিক্ষেতের শস্যের যাকাত প্রদানের জন্য শহরের প্রতিবেশীকে নগদ অর্থও প্রদান করতে পারেন। কারযাভী বলেন, নগদ অর্থের বদলে অন্য কিছুও যাকাত হিসেবে দেয়া যায়। ইমাম বায়হাকী ও ইমাম বুখারী নিুোক্ত হাদীস বর্ণনা করেন, যেখানে ইয়েমেনের বাসিন্দার প্রতি মুয়াজ (রা.) এর আদেশ উদ্ধৃত হয়েছে:

‘দান-অনুদানের পরিবর্তে আমাকে কাপড় দাও… এটা তোমাদের জন্য সুবিধাজনক এবং মুহাজিরদের জন্যও দরকারি’। (কারযাভী, ১৯৮২:৪০৪)।

 

 

৫.৩. হিসাব রক্ষণ

স্বীকৃত হিসাব নীতি অনুযায়ী যাকাত তহবিল সংরক্ষণ ব্যাহত হবে। এজন্য খতিয়ান ও হিসাবের কাগজপত্র তৈরি করতে হবে। স্বীকৃত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে হিসাব বিজ্ঞানে অধ্যয়নকৃত ব্যক্তিরা বা কোনো উল্লেখযোগ্য ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হিসাবশাখায় কর্ম-অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ব্যক্তি বা ব্যক্তিদেরকে এ দায়িত্ব অর্জন করা যায়।

 

 

৫.৪. অডিট

সকল আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মতো যাকাত-তহবিল ও আর্থিক নিয়ম-নীতি অনুযায়ী পরিচালিত হতে হবে। সেজন্য স্থানীয় অডিট অফিস এবং বাইরের অডিট কোম্পানিসমূহ দ্বারা যাকাত-লব্ধ সম্পদের অডিট সম্পন্ন করে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে।

 

 

৫.৫. গবেষণা, মূল্যায়ন ও রেকর্ড সংরক্ষণ

যাকাত ব্যবস্থাপনার সর্বশেষ কৌশল হলো, উন্নত গবেষণা, মূল্যায়ন ও যাকাতের কাগজপত্র সংরক্ষণের পদক্ষেপ গ্রহণ করা। গবেষণার মাধ্যমে কত বেশি সম্ভব যাকাত-অর্থ সংগ্রহ করা যায় এবং সমাজকল্যাণে ও দরিদ্র মানুষের জীবনমান উন্নয়নে গৃহীত প্রকল্পগুলো গ্রহণ করা যায়। বছরান্তে যাকাত সংগ্রহ কৌশল ও বিতরণ প্রক্রিয়ার মূল্যায়ন রিপোর্ট তৈরি করা যায়, যাতে কৃত ত্র“টি-বিচ্যুতি সংশোধন করে ভবিষ্যতে যাকাত-লব্ধ অর্থের আরো সুষ্ঠু ব্যবহার সম্ভব হয়।

 

৬. শেষ কথা

উপরিউক্ত আলোচনায় আমরা যাকাত সংগ্রহ কৌশল এবং তার বিতরণ প্রক্রিয়ার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নানাবিধ ইস্যু নিয়ে আলোচনা করার চেষ্টা করেছি। আলোচনায় আমরা কুরআন, সুন্নাহ, স্বীকৃত ফিক্হ গ্রন্থ, স্বীকৃত মাযহাব এবং সর্বোপরি গত ও বর্তমান শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ ইসলামী চিন্তাবিজ্ঞানের গবেষণা ও পুস্তক হতে উদ্ধৃত করে প্রতিটি বিষয় বিশ্লেষণের চেষ্টা করেছি। এ নিবন্ধের সর্বাংশ জুড়ে মূলত: তিটি বিষয় বিশ্লেষিত হয়েছে যাকাত-অর্থ সংগ্রহ কৌশল, তার বিতরণ ও ব্যবহার প্রক্রিয়া এবং এ অর্থের ব্যবস্থাপনা। আমরা যাকাতকে শুধুমাত্র একটি ঈবাদত হিসেবে পালন না করে একে একটি সামাজিক অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করেছি। অত্র প্রবন্ধে এমন কিছু বিষয় আলোচিত হয়েছে, রাসুল (সা.) ও খোলাফায়ে রাশেদার যুগে যেগুলোর কোনো অস্তিত্ব ছিল না।

 

 

বর্তমান সময়ে উদ্ভূত এমন অনেক বিষয়কে আমরা কুরআন, সুন্নাহ, স্বীকৃত মাযহাব ও সাহাবী, তাবেঈ ও তাবে-তাবেঈনের কার্যাবলীর  আলোকে সমাধান দিতে চেষ্টা করেছি।

 

পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ সরকারের কাছে আমাদের সুপারিশ হলো:

 

ক. আল্লাহ্তায়ালার আদেশ হিসেবে রাষ্ট্র কর্তৃক সকল সক্ষম ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের উপর জাকাত প্রদান অবধারিত ঘোষণা করতে হবে।

 

খ. রাষ্ট্রকর্তৃক জাকাত-লব্ধ অর্থ ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব পালন করতে হবে। এ ক্ষেত্রে জাকাত-ভিত্তিক কর-ব্যবস্থার প্রবর্তন করা যেতে পারে এবং তা রক্ষণা-বেক্ষণের জন্যে জাকাত-মন্ত্রণালয় গঠন করা উচিৎ। এ মন্ত্রণালয় অন্যান্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় যথা সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়, অর্থ-মন্ত্রণালয় এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করে একটি দারিদ্র্যমুক্ত দেশ গঠনে ভূমিকা রাখতে পারে

 

গ. বিভিন্ন মুসলিম দেশ হতে এবং অমুসলিম দেশের মুসলমান নাগরিকদের কাছ থেকে জাকাত-অর্থ সংগ্রহের জন্য অর্থনৈতিক কূটনীতির অংশ হিসেবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বহুমুখী কর্মসূচি (উরাবৎংরভরবফ ংঃৎধঃরমরবং) হাতে নিতে পারে।

 

ঘ. স্বতন্ত্র গবেষণা এবং পরিকল্পনা বিভাগ জাকাত মন্ত্রণালয়ের অধীনে কাজ করলে জাকাত-অর্থ উত্তোলনের কৌশল নির্ধারণ তহবিল গঠন ও তা বিতরণ প্রক্রিয়া সহজতর হয়।

 

ঙ. সর্বোপরি, দেশ-বিদেশের শীর্ষস্থানীয় উলামা-মাশায়েখ, ইসলামী আইনবিশারদ, অর্থনীতিবিদ এবং নীতি বিশেষজ্ঞের সমন্বয়ে শরীয়া কাউন্সিল গঠন করা উচিত।  

 

উপরিউক্ত সুপারিশসমূহ বিবেচনা করে জাকাত-ভিত্তিক কর ব্যবস্থা প্রবর্তনের মাধ্যমে দরিদ্র ও দুস্থ নাগরিকদের দুঃখ-দুর্দশা লাঘব করা সম্ভব। জাকাত মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে দেশের ভেতরকার জাকাত-অর্থ এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে বহির্বিশ্বের জাকাত-লব্ধ অর্থের সুষ্ঠু ব্যবহার করা দারিদ্র্য বিমোচন করে সুখী-সমৃদ্ধময় বাংলাদেশ গড়ে তোলা সম্ভব। একজন স্বপ্নচারী মানুষ হিসেবে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের সীমারেখা ডিঙ্গিয়ে যেন উন্নত দেশের মানচিত্রে স্থান করে নিতে পারে, যাকাতের অবদান মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত হবে, নির্দ্ধিধায় তা বলা যায়।

 

উৎস: (১৯৯৫),

১. আগনাইদস্ মোহামেডান থিওরিজ অব ফাইনান্স, নিউইয়র্ক। ২. আল্ কুরআন, ৫১ : ১৯, ২৪ : ৩৩, ৩৬ : ৭১, ২৮ : ৭৭, ৭০ : ২৪-২৫, ২৮ : ২৬। ৩. অ্যানুয়াল ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম (১৯৮৮-৮৯), পরিকল্পনা কমিশন, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার, ৪. আল্ লুবাব, ১ম খণ্ড, ৫. আল আইনী, ১ম খণ্ড, ৫. আল আইনী, ৯ম খণ্ড, ৬. আহমাদ, জেড. আই. (১৯৮৯), ‘কমেন্টস’ ম্যানেজমেন্ট অব জাকাহ ইন মডার্ন মুসলিম সোসাইটি, আইডিবি, জেদ্দা, ৭. আহ্মাদ, জেড, আই (১৯৯১), ইসলাম, পভার্টি এন্ড ইনকাম ডিস্ট্রিবিউশান, দি ইসলামিক ফাউন্ডেশন, যুক্তরাজ্য। ৮. গাজালী, এ. (১৯৯০), জাকাত: এ্য কেস স্টাডি অব মালয়েশিয়া, কুয়ালালামপুর। ৯. হুসেঈন, এসএ (১৯৮৯), ‘কমোটস’ ম্যানেজমেন্ট অব যাকাহ্ ইন মডার্ন মুসলিম সোসাইটি, আইডিবি, জেদ্দা। ১০. ইমতিয়াজি, আইএ (১৯৮৯), ‘অর্গানাইজেশন অব যাকাহ: দি পাকিস্তান মডেল এন্ড এক্সপেরিয়েন্স’ ম্যানেজমেন্ট অব যাকাহ্ ইন মডার্ন মুসলিম সোসাইটি, আইডিবি জেদ্দা। ১১. আমীন, এমআর এন্ড খান, এ আর (১৯৯৭), ‘সোসাল ডেভেলপমেন্ট ইন বাংলাদেশ: স্টেট অব পভার্টি এ্যালেভিয়েশন’, সোস্যাল সাইন্স রিভিউ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ১৪ খণ্ড, ২য় সংখ্যা। ১২. মাওদুদী, এসএএ, ফান্ডামেন্টাল্স অব ইসলাম, ইসলামিক পাবলিকেশন্স, লাহোর। ১৩. মাসুদ, এমএফইউ (১৯৯৫), ‘ছাম ফিচারস্ অব দি ইকনোমিক সিস্টেম অব দি হোলি প্রোফেট’, দি গার্ডিায়ান, ঢাকা, আগস্ট সংখ্যা। ১৪. মান্নান, এমএ (১৯৮৯), ‘সাজেস্টড ইস্যুজ ফর ফার্দার রিসার্স’, ম্যানেজমেন্ট অব যাকাহ্ ইন মডার্ন মুসলিম সোসাইটি, আইডিবি, জেদ্দা। ১৫. মান্নান, এমএ (১৯৮৯), ‘ইফেক্টস অব যাকাহ অ্যাসেসমেন্ট এন্ড কালেকশন’, পূর্বোক্ত। ১৬. নববী, এ, ফাতহুল বারী, ৩য় খণ্ড। ১৭. নাওফীল, এস (১৯৮৯), ‘লাইছাতুয যাকাতু জারবিয়্যাহ’, আল ইকতেসাদুল ইসলামী, ৩য় সংখ্যা, ইসলামী ব্যাংক, দুবাই। ১৮. কারযাভী, ওয়াই (১৯৮২), ‘হুসনু তাওজিঈ হাসিলাতিয যাকাহ,’ আল ইকতিসাদুল ইসলামী, ব্যাংক দুবাই। ১৯. কারযাভী, ওয়াই (১৯৮০), ফিকহুস যাকাহ, ২য় খণ্ড, মুয়াসসাতুর রিসালাহ্, বৈরুত। ২০. কারযাভী, ওয়াই, (১৯৮২), ‘হুসনুল ইদারাহ’, প্রাগুক্ত। ২১. সিদ্দিকী, এমএল (১৯৮০), মুসলিম ইকনোমিক থিংকিং, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, যুক্তরাজ্য। ২২. মুফতি শফী (১৯৮৩), ডিসট্রিবিউশন অব ওয়েল্থ ইন ইসলাম, ইসলামী ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ। ২৩. তিরমিযী, আবওয়াবুয যাকাহ। ২৪. উসমানী এসএমটি (১৯৮৩), দারসে তিরমিযী, কুতুবখানা রশিদিয়া, ঢাকা। ২৫. উবায়েদ, এ (১৩৫৩ হিযরী), আল আম ওয়াল, আততিজারিয়া বুকশপ, কায়রো। ২৬. ইউসুফ আল কারযাভী (১৯৮২), ‘ইত্তিবাউ সিয়াসাতিল ইকনিয়া বিয যাকাহ’, ওয়াল ইকতিসাদুল ইসলামী, প্রাগুক্ত।

 

জাকাত ব্যবস্থাপনা নিয়ে নিবন্ধটি লিখেছেন শওকত আরা খানম।  প্রভাষক, ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগ, গ্রিন ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Please disable your adblocker or whitelist this site!