কলকাতায় নেমেই ট্যাক্সি নিয়েছি। রওনা দিয়েছি নিউ মার্কেট থেকে। পর্যটক দেখেই হাজী মুহম্মদ মুহসীনের ইমামবাড়ার গল্পটা শুরু করলেন ট্যাক্সিচালক যোগেন দাস। হুগলিতে যাওয়ার আগে পার হতে হয় হুগলি ব্রিজ। এর পর দেড় ঘণ্টার মধ্যেই হুগলি শহরে পৌঁছাই।
ঢাকা থেকে শ্যামলী পরিবহনে কলকাতা। কলকাতা থেকে হুগলি যাওয়া-আসার জন্য ট্যাক্সি ভাড়া করতে পারেন। সারা দিনের জন্য খরচ হবে দুই থেকে আড়াই হাজার টাকা। দূরত্ব ৫৫ কিলোমিটারের মতো। এক থেকে দেড় ঘণ্টা লাগবে।
হুগলিতে এলে প্রথমেই যেতে হয় ব্যান্ডেল চার্চে। শত শত মানুষ। সবাই চুপচাপ। চার্চে ঢুকছে মাথা নিচু করে। ভারতের ঐতিহ্যবাহী চার্চটি গঙ্গার তীর ঘেঁষে। এটা বানিয়েছিল পর্তুগিজরা। ১৫৯৯ সালে।
চার্চের প্রবেশপথেই নজর পড়ে গ্রিসের ডোরিক স্থাপনাশৈলীর কারুকার্য খচিত সামনের অংশ। সেখানে মাতা মেরির মূর্তি। ভেতরে ঢুকেই চোখ জুড়িয়ে গেল। সবুজে ছাওয়া মাঠ। পাশে স্রোতস্বীনি গঙ্গা।
সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠতে থাকি। দেয়ালজুড়ে নানান চিত্রকর্ম। এর মধ্যে যিশু ও তার সঙ্গীরা আছেন। কাচের ঘর থেকে যিশুকে কোলে নিয়ে তৃপ্তিমুখে তাকিয়ে আছেন মেরি।
সিঁড়ি বেয়ে তিনতলায় উঠতেই মাতা মেরির আরেকটি ভাস্কর্য। তাঁর সামনে রাখা টেবিলে জ্বলছে কয়েক শ মোমবাতি। আমিও একটি মোমবাতিতে আগুন দিলাম। সেখান থেকে বের হয়ে নিচে এসেই পেলাম স্যুভেনির শপ। কিনে ফেললাম যিশুর একটি ক্রুশবিদ্ধ প্রতিকৃতি। দাম পড়ল ১২০ টাকা।
ঐতিহাসিক ইমামবাড়ার দুই কিলোমিটারের মতো দূরে। ট্যাক্সি করে যেতে হয়। ইমামবাড়া বিরাট এক জায়গা বটে। বিশালাকার সব দরজা। দরজার ওপরে ইয়া বড় প্রাচীন ঘড়ি।
১০ টাকার টিকিট কিনতে হয় ইমামবাড়ায় ঢুকতে। ঢুকতেই পয়সা উশুল। মনোমুগ্ধকর ফুলের বাগান। চারদিকে দালানকোঠা। এগিয়ে গিয়ে প্রার্থনাকক্ষে ঢুকি। আমাদের সঙ্গে থাকা গাইড মুন্না ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখান মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.), কন্যা হজরত ফাতেমা (রা.), জামাতা হজরত আলী (রা.), নাতি হাসান-হোসেনের সমাধিসৌধের রেপ্লিকা। ওপরের ঝুলতে থাকা ঝাড়বাতিগুলো দেখে প্রাচীন রাজদরবারের কথা মনে পড়ে গেল। দেয়ালে ক্যালিগ্রাফি করে কোরআনের আয়াত লেখা। এর পাশে দুলদুল ঘোড়া, পঙ্খিরাজ ঘোড়া। রুপার বড় একটি তাজিয়া। গাইড জানালেন, ১৮৪১ সালে ইমামবাড়ার নির্মাণকাজ শুরু হয়। শেষ হয় ১৮৬১ সালে। ইঞ্জিনিয়ারের নাম কেরামত আলী। ৪২ বিঘা জমির ওপর নির্মিত ইমামবাড়াটি তৈরি করতে খরচ হয়েছিল ওই আমলের দুই লাখ টাকারও বেশি।
এর উচ্চতা ৩৩ ফুট। একসময় সাড়ে আট মণ রুপা ও সাড়ে ১৭ কেজি সোনা দিয়ে ইমামবাড়া সাজানো ছিল। তবে এখন আর সেসব নেই।
ইমামবাড়ার পেছনের গেট দিয়ে ২০ গজ এগিয়ে পেলাম সূর্যঘড়ির দেখা। সূর্যের ছায়ায় তখন বলছে একটা বেজে বিশ মিনিট। হাতঘড়ির দিকে তাকালাম। মিলে গেল সময়! সূর্যঘড়ি থেকে ইমামবাড়ার অন্যতম আকর্ষণ ভারতবর্ষের সবচেয়ে বড় ঘড়ি দেখার জন্য ১৫২টি সিঁড়ি ভেঙে উঠি ক্লক টাওয়ারে। পিতলের বিশাল ঘণ্টা। আধা ঘণ্টা পরপর বাজছে ঢং ঢং। ১৮৫২ সালে লন্ডন থেকে কেনা হয়েছিল ঘড়িটি। এখনো সচল।
দুজন লোক ২০ কেজি ওজনের চাবি দিয়ে সপ্তাহে এক দিন ঘড়িতে দম দেন। প্রতিবছর এক লাখ ৫০ হাজার টাকা খরচ হয় ঘড়িটির রক্ষণাবেক্ষণে। ঘণ্টা শুনে বের হয়ে আসি। ইমামবাড়ার রক্ষণাবেক্ষণকর্মী আনোয়ার হোসেন জানালেন, এটি এখন হেরিটেজ বিল্ডিং। ট্রাস্টি বোর্ড ইমামবাড়ার দেখভালের দায়িত্ব পালন করছে। ইমামবাড়া দেখতে দেখতে দুপুর যায় গড়িয়ে।
এবার রওনা হই বাংলা সাহিত্যের অন্যতম দিকপাল শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যেয়ের স্মৃতিঘেরা দেবানন্দপুর গ্রামের উদ্দেশে। পাঁচ-ছয় কিলোমিটার পরই শুরু হয় জঙ্গলঘেরা গ্রাম দেবানন্দপুর। বড় বড় বাঁশঝাড় আর গভীর অরণ্য গ্রামটিকে একরকম অন্ধকার করে রেখেছে। শরৎচন্দ্রের সেই গড়ের জঙ্গলের কথা মনে পড়ে যায়। নিউরনে উঁকি দেয় প্যারি পণ্ডিতের পাঠশালাও। একসময় শরৎচন্দ্র স্মৃতি মন্দিরে এসে পৌঁছাই। সাদা ধবধবে শরৎবাবুর ভাস্কর্যের সামনে গিয়ে দাঁড়াই। ১৯৪৯ সালের ২৬ জুলাইয়ে এই মন্দিরটির উদ্বোধন করেছিলেন ভারতীয় কেন্দ্রীয় মন্ত্রী বি ভি কেশরার। মন্দিরসংলগ্ন লাইব্রেরি আর শরৎ সংগ্রহশালা দেখে মুগ্ধ হই।
কিছুটা সামনে নির্জন এক বাড়ি। শরৎচন্দ্রের বাড়ি! এখানেই ১৮৭৬ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর জšে§ছিলেন শরৎচন্দ্র। ছোট্ট একটি লোহার গেট। গেটের ওপরে লেখা, ‘শরৎ বাবু বাড়ি নেই। গেট নিজ দায়িত্বে বন্ধ রাখুন।’ গেট দিয়ে বাড়ির ভেতরে ঢুকি। পৃথক দুই কামরার দুটি ভবন। বাড়িতে কেউ নেই।