তাঁকে জেলে যেতে হয় কয়েক দফা। এই ছাড়া পান তো আবার বন্দি। কখনো দিন কাটে হাজারো কয়েদির সঙ্গে-গল্পকথায়, রাজনীতিতে। আবার কখনো দিন-রাত্রি মিলেমিশে এক হয় অন্ধকার কুঠুরিতে। সময়কাল ১৯৬৬-১৯৬৯ সাল। বন্দিদশায় থেকেও এ মহামানব তাঁর মমতার ডালি মেলে ধরেছিলেন প্রকৃতির প্রতি। কারাবন্দি জীবনে প্রকৃতির সঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের যে একাত্মতা ছিল, সেই আলোকছটা নিয়েই এ আয়োজন-
জুন ১৯৬৬। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের রাজবন্দী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। মাসের শুরুর দিকে জেলখানায় ছিল না কথা বলার মতো সঙ্গী। সময়ও কাটত না। মাটির প্রতি যাঁর অগাধ টান, তাঁর সখ্যতা তো মাটির সঙ্গেই হবে। ‘লাউয়ের দানা লাগাইয়াছিলাম, গাছ হয়েছে। ঝিংগার গাছও বেড়ে উঠেছে। ফুলের বাগানটিকে নতুন করে সাজাইয়া গোছাইয়া করতে শুরু করেছি… নতুন জীবন পেয়েছে ফুলের গাছগুলি।’
জেলখানার ওয়ার্ডে ছিল ছোট ছোট মাঠ। বঙ্গবন্ধু উদ্যোগ নিয়ে সেখানে লাগালেন দূর্বা। সেখানে আনমনে দেখতেন মোরগ-মুরগির চরে বেড়ানো, খাবার খাওয়া। নিজেও খাওয়াতেন তাদের।
সিলেটের বন্যা, পূর্ব পাকিস্তানের মোটা অঙ্কের ঘাটতি বাজেট, ইন্দোনেশিয়াকে পাকিস্তান সরকারের ঋণ প্রদানের সম্মতি; এতসবের ভিড়ে ওয়ার্ডের সেই মোরগ যে অসুস্থ হয়ে পড়েছিল, সেটাও চোখ এড়ায়নি তাঁর। বাবুর্চি বলল, মোরগটা জবাই দিয়ে ফেলি। বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘না দরকার নাই। ও বেশ বাগান দিয়ে বুক ফুলিয়ে বেড়ায়। ওর চলাফেরার ভঙ্গিমা দেখে আমার ভাল লাগে।’
জেলখানার বাবুর্চির একটা ছোট্ট কবুতরের ছানা ছিল। বঙ্গবন্ধুর কোলেই বড় হয়েছিল ওটা। ছোট একটা থলে বানিয়ে তাতে ভেজা চাল রেখে ফুটো করে দিয়েছিলেন তিনি, যাতে ছানাটার খেতে সুবিধা হয়।
বই-পত্রিকা পড়ে সময় কিছুটা কাটত। দেশের মানুষের জন্য মন যে আকুপাকু করত এটা তো সবাই জানে। কিন্তু ১৯৬৬ সালে এসেও বঙ্গবন্ধু ভুলে যাননি আট বছর আগের দুটি হলদে পাখির কথা! পাখিপ্রেমী মন ইতিউতি সারাক্ষণ খুঁজেছে জোড়াটাকে। নিখোঁজ পাখির জন্য তার যে হাহাকার, তাতে কঠিন অপরাধীও বিষণ্ন হতে বাধ্য।
‘বহুদিন পর্যন্ত দুটি হলদে পাখিকে আমি খোঁজ করছি। ১৯৫৮-৫৯ সালে যখন ছিলাম এই জায়গাটিতে তখন প্রায়ই ১০টা/১১টার সময় আসত, আর আমগাছের এক শাখা হতে অন্য শাখায় ঘুরে বেড়াত। মাঝে মাঝে পোকা ধরে খেত। আজ ৪০ দিন এই জায়গায় আমি আছি, কিন্তু হলদে পাখি দুটি আসল না। আর আসবে না। ওদের জন্য আমার খুব দুঃখই হলো। যখন ১৬ মাস এই ঘরটিতে একাকী থাকতাম তখন রোজই সকাল বেলা লেখপড়া বন্ধ করে বাইরে যেয়ে বসতাম ওদের দেখার জন্য। মনে হলো ওরা আমার উপর অভিমান করে চলে গেছে।’
রাজনীতির ‘পরগাছা’দের যেমন ঘৃণা করতেন, তেমন নিজের হাতে গড়া বাগানেও সহ্য করতে পারতেন না আগাছার অত্যাচার। সুযোগ পেলেই কয়েকজনকে সঙ্গী করে নেমে পড়তেন পরিষ্কার করার কাজে। পরিপাটি সবুজ বাগানে তার প্রিয় মোরগ, মোরগের দুটি ছানা ও সেই কবুতরটার ওড়াওড়ি উপভোগ করতেন। ঘরের দরজায় থাকা কামিনী ও শেফালী ফুলের গন্ধে হতেন মাতোয়ারা। ‘বৃষ্টি পেয়ে গাছের সবুজ পাতাগুলি যেন আরও সবুজ আরো সুন্দর হয়ে দাঁড়িয়ে আছে… মাঠটা সবুজ দূর্বায় ভরে উঠেছে… দেখলাম এদের প্রাণ ভরে। মনে হলো যেন নতুন রূপ নিয়েছে। মোরগ মুরগির বাচ্চা ও কবুতরটা মাঠটা ভরে ঘুরে বেড়াচ্ছে।’
পাখির প্রতি বঙ্গবন্ধুর ছিল মাটির মতো কড়া টান। না খেয়ে খাবারের টাকা জমিয়েছিলেন একবার। সেই টাকা দিয়ে জুনের ২৬ তারিখ কিনে ফেললেন দুটো মুরগি। সূর্য অস্ত গেলে নিজের সেলে ঢোকার আগে মুরগিগুলোকে পরম মমতায় রেখে দিতেন খাঁচায়, আর বলতেন, ‘আরামে থাক, চোর ডাকাতের ভয় নাই। পাহারা রাখলাম।’
২৮ তারিখেই ডিম পেড়েছিল একটা মুরগি। খবরটা শুনেই বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, খুব ভাল, রেখে দেও, মুরগিকে বাচ্চা দেওয়াব। ডিম কিন্তু খাওয়া চলবে না।
জুলাইয়ের শেষের দিকে এসে তিনটে মুরগি হয়ে গেল বঙ্গবন্ধুর। তাদের যত্নআত্তিতে তিনি ছিলেন অন্তপ্রাণ। পশুপাখি নিয়ে তাঁর জানাশোনার কমতিও ছিল না। জানতেন টুকটাক চিকিৎসাও। ২২ জুলাই রাতে ঘুম হচ্ছিল না। উঠে যান মুরগিগুলোর কাছে। দেখেন তিনটার মধ্যে একটা অসুস্থ। অসুস্থ মুরগিটা যে আবার কয়েকদিনের মধ্যে ডিম পাড়বে, সেটাও ধরে ফেলেন তিনি। অসুস্থ ছিল বলে ওটাকে নিজের হাতেই খাবার দিতেন বঙ্গবন্ধু। ওষুধ বানিয়েও খাওয়াতেন। মুরগিগুলোকে কতটা ভালবাসতেন বঙ্গবন্ধু তা বোঝা যায় তাঁর কথাতেই-‘প্রথমে পিঁয়াজের রস, তারপর রসুনের, যে যাহা বলে তাহাই খাওয়াইতে থাকি। দেখলাম, এত অত্যাচার করলে ও শেষ হয়ে যাবে। মাঝে মাঝে পানি, কিছু খাবার খেতে দেই ও মাথা ধোয়াইয়া দেই।’
কিন্তু যত্নের শিকল ছিঁড়ে পরদিনই মারা যায় সেই মুরগি। ওটার মৃত্যুতে বেশ ব্যথিত হন বঙ্গবন্ধু-‘বেচারার খুব কষ্ট হতেছিল, ভালই হলো। আমার একটু কষ্ট হলো। মুরগিটাকে আমার খুব ভাল লাগত। ওর হাঁটাচলার মধ্যে একটা গাম্ভীর্য ছিল।’
হলদে পাখি দুটোর কথা মনে আছে? ১৯৬৭ সালের এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়ে যখন কারাগারে কিছুটা অসহনীয় সময় পার করছিলেন বঙ্গবন্ধু, তখন ওরা আবার ফিরে আসে! তবে আগের দুটি নয়। এবারের হলদে জোড়াটা ছিল ছোট। কিন্তু তাতে কী! ওদের পেয়েই মহাখুশি পাখিপাগল মানুষটা। মজার বিষয়, নতুন হলদে জোড়াটাও রোজ ১০-১১টার দিকে আসত আম গাছে। ‘ওদের খেলা আমি দেখি। ওদের আমি ভালবেসে ফেলেছি মনে হয়। ১৯৫৮ সালে দুইটা হলদে পাখি আসত। তাদের চেহারা আজও আমার মনে আছে। সেই দুইটা পাখির পরিবর্তে আর দুইটা পাখি আসে। পূর্বের দুইটার চেয়ে একটু ছোট মনে হয়…মনে হয় ওদেরই বংশধর ওরা..১০-১১টার দিকে ওদের কথা আমার এমনি ভাবেই মনে এসে যায়। চক্ষু দুইটা অমনি গাছের ভিতর নিয়া ওদের খুঁজতে থাকি। কয়েকদিন ওদের দেখতে পাই না। রোজই আমি ওদের খুঁজি। তারা কি আমার উপর রাগ করে চলে গেল?’
হলদে পাখি, চড়ুই আর কবুতররা ঠিকই চিনেছিল অনেক বড় ওই মানুষটাকে। তাই যে নির্জন প্রকোষ্ঠে বন্দি ছিলেন তিনি, সেখানেই ওরা এসে বাসা বানিয়েছিল। আর বঙ্গবন্ধু থাকতে তাদেরও ছিল না কোনো দুশ্চিন্তা-‘যে কয়েকটা কবুতর আমার বারান্দায় আশ্রয় নিয়েছে তারা এখানে বাচ্চা দেয়। কাউকেও আমি ওদের ধরতে দেই না। সিপাহি জমাদার সাহেবরাও ওদের কিছু বলে না। আর বাচ্চাদেরও ধরে নিয়ে খায় না। বড় হয়ে উড়ে যায়। কিছুদিন ওদের মা-বাবা মুখ দিয়ে খাওয়ায়। তারপর যখন আপন পায়ের উপর দাঁড়াতে শিখে এবং মা-পায়রার নতুন ডিম দেওয়ার সময় হয় তখন ওই বাচ্চাদের মেরে তাড়াইয়া দেয়। আমি অবাক হয়ে ওদের কীর্তিকলাপ দেখি।’
কাকগুলো ছিল পাজি। বেশ জ্বালাত বঙ্গবন্ধুকে। শখের বাগানটাকে নষ্ট করে দিত ওরা। ওদের তাড়াতে বঙ্গবন্ধু নিজের হাতে ধনুকও বানিয়েছিলেন। আবার কাকের বাসা বানানোর দক্ষতা দেখে মুগ্ধ না হয়েও থাকতে পারতেন না-‘লোহার তার কি সুন্দরভাবে গাছের সাথে পেঁচাইয়া ওরা বাসা করে। মনে হয় ওরা এক এক জন দক্ষ কারিগর, কোথা থেকে সব উপকরণ যোগাড় করে আনে আল্লাহ জানে!.. ওদের ধৈর্য ও অধ্যবসায় দেখে মনে মনে ওদের সাথে সন্ধি করতে বাধ্য হই। তিনটা গাছ ওদের ছেড়ে দিলাম-ওরা বাসা করল.. কাদেরকে (জেলের বাগানী) বললাম, ছেড়ে দাও। করুক ওরা বাসা। দিক ওরা ডিম। এখন ওদের ডিম দেওয়ার সময়-যাবে কোথায়?’
কদিনের মধ্যেই কাকগুলোর ওপর বেজায় খুশি হয়ে গেলেন তিনি। ওদের তাড়াতে গেলে ওরা জড়ো হয়ে প্রতিবাদ করত খুব-‘ওদের ঐক্যবদ্ধ প্রতিবাদকে আমি মনে মনে প্রশংসা করলাম। বাঙালিদের চেয়েও ওদের একতা বেশি।’
দাঁড়কাক আর ছোট কাকের যুদ্ধ দেখতেন সময় পেলে। দাঁড়কাক পারত না ছোটদের ঐক্যবদ্ধ আক্রমণের মুখে। তা দেখে বঙ্গবন্ধু লেখেন-‘বাঙালি একতাবদ্ধ হয়ে যদি দাঁড়কাকদের মতো শোষকদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াত তবে নিশ্চয়ই তারাও জয়লাভ করত’।
‘কিছুদিন পর্যন্ত কাকরা আমাকে দেখলেই চিৎকার করে প্রতিবাদ করত, ভাবত আমি বুজি ওদের ঘর ভাঙবো। এখন আর আমাকে দেখলে ওরা চিৎকার করে প্রতিবাদ করে না, আর নিন্দা প্রস্তাবও পাশ করে না।’ অর্থাৎ, আশপাশের অনেকে চিনতে না পারলেও, পর্বতসম মানুষটাকে চিনতে মোটেও দেরি হয়নি কাকেদের!