আইয়ুব বাচ্চুর মরদেহ পৌঁছানোর আগে ভক্তরা পৌঁছে গিয়েছিলেন কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে। দূর–দূরান্ত থেকে শোকাহত ভক্তরা এসেছিলেন প্রিয় শিল্পীকে শেষ বিদায় জানাতে। শ্রদ্ধা নিবেদনের বেদি থেকে ভক্তদের সারি চলে গিয়েছিল ঢাকা মেডিকেল কলেজের প্রধান ফটক ছাড়িয়ে আরও খানিকটা দূরে। সারিতে দাঁড়ানো মেহেরুন চোখ মুছছিলেন বারবার। বন্ধুরা বলছিল, ‘এত লোকের সামনে কাঁদতে লজ্জা করে না?’ তাঁর হাতে একটা লাল গোলাপ। কেন কাঁদছিলেন? জানতে চাইলে ভেতরে আটকে রাখা বাকি কান্নাটুকু মুক্ত করে দেন তিনি। কান্নার ওপারে কান পাতলে শোনা গেল, ‘এবির গান শুনেই আমরা বড় হয়েছি। তিনি আমাদের যে গানগুলো দিয়ে গেছেন, সেগুলো শুনলেই এখন থেকে কান্না পাবে।’
তাঁর গান শুনতে লাইন ধরে কনসার্টস্থলে ঢুকতেন ভক্তরা। গিটারের মূর্ছনায় যেন হারিয়ে যেতেন শ্রোতারা। আজ যাঁরা এসেছিলেন, কোনো গান না শুনেই ফিরে গেছেন তাঁরা। এমনকি ছয় তারের গিটারে এতটুকু টুংটাং শব্দও বাজেনি। বাজবে না, জানা ছিল সবার। হাতে ফুল, চোখে জল নিয়ে তাঁরা এসেছিলেন নীরবতা বিনিময় করতে। কাঠের কফিনের ওপর হয়তো রেখে গেছেন একটি আধফোটা গোলাপ। আজ বোঝা গিয়েছিল তাঁর গানের বাণী ‘হারায়ে বুঝেছি তুমি কী ছিলে আমার’।
তিন তরুণকে দেখা যায়, একটি মোটর সাইকেলের গায়ে হেলান দিয়ে কথা বলছেন। কাছেই একজনকে জড়িয়ে ধরে শিশুর মতো অসহায় ভঙ্গিতে কাঁদছিলেন গীতিকবি সাজ্জাদ হুসাইন। আইয়ুব বাচ্চুর গাওয়া ‘সাবিত্র রায়’ গানটি তাঁর লেখা। শিল্পীর ‘যুদ্ধ’ ও ‘স্পর্শ’ অ্যালবামের গানগুলিও। তাঁর বাণী বাঙালির কাছে পৌঁছে দিয়েছেন আইয়ুব বাচ্চু। তাঁর চলে যাওয়া এই গীতিকবির ভ্রাতৃবিয়োগের সমান, কিংবা তারও চেয়ে বেশি।
ভিড়ের ভেতর কালো পাঞ্জাবি পরা নকিব খানকে ঘিরে রেখেছিলেন কয়েকজন ‘ইউটিউবার’। রেনেসাঁ ব্যান্ডে তাঁরাই নিয়েছিলেন আইয়ুব বাচ্চুকে। তারপর পশ্চিমা ও মেলোডির মেলবন্ধনে দারুণ সব কাজ উপহার দিয়েছিলেন তিনি। নকিব খান রেনেসাঁ ছাড়ার পর বাচ্চু দলটির হয়ে দুটো অ্যালবামের কাজ করেছেন। তাঁর বিদায়ে ব্যথিত নকিব খান বললেন, ‘বাচ্চু মাত্র ১০ বছর ছিল আমাদের দলে। তারপর নিজের ব্যান্ড নিয়ে কাজ শুরু করে সে। তাকে দেখে নতুন প্রজন্মের শেখা উচিত, ডেডিকেশন থাকলে অল্প সময়ে মানুষ কোথায় পৌঁছে যেতে পারে।’
আইয়ুব বাচ্চুকে স্মরণীয় করে রাখতে কোনো সাংগঠনিক উদ্যোগ কি নেবে বাংলাদেশ মিউজিক্যাল ব্যান্ড অ্যাসোসিয়েশন (বামবা)? গিটারিস্ট লাবু রহমান বললেন, ‘হয়তো নেবে। তাঁর গান আর্কাইভিংয়ের কোনো একটা উদ্যোগ বা এই ধরনের কিছু। কিন্তু কোটি কোটি বাঙালির হৃদয় হচ্ছে তাঁর গানের আর্কাইভ।’ মঞ্চের পেছনে দাঁড়িয়ে ছিলেন জনপ্রিয় ব্যান্ড তারকা তুহিন। বাচ্চু ভাই তাঁদের কাছে কেমন ছিলেন? তিনি জানালেন, ‘বাচ্চু ভাই সব সময় তরুণ ছিল। সে জন্য তরুণেরা তাঁর গান পছন্দ করে। ছোটবেলা থেকে তাঁর গান শুনে বড় হয়েছি আমরা। তাঁর গান শুনেই আমরা গান করার সাহস ও প্রেরণা পেয়েছি।’
‘যুবরাজ’ নামের একটি ধারাবাহিক করেছিলেন কথাসাহিত্যিক ইমদাদুল হক মিলন। আইয়ুব বাচ্চুকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে এসে বললেন, ‘ওই নাটকের আবহসংগীত করে দিয়েছিল বাচ্চু। এই তো সেদিন, ভারতীয় চ্যানেলে সা রে গা মা পা দেখছিলাম। উপস্থাপক যীশু সেনগুপ্ত বাংলাদেশের প্রতিযোগী নোবেলকে বলল, “সেই তুমি” গানটি গেয়ে শোনাতে, তখন গর্বে আমার বুকটা ভরে গিয়েছিল। বাচ্চুকে ওপার বাংলার মানুষেরাও কত শ্রদ্ধা করে!’
সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সঙ্গে শিল্পী আইয়ুব বাচ্চুকে শেষ শ্রদ্ধা জানানোর আয়োজনে উদ্যোগী ভূমিকা নিয়েছিলেন নাট্যজন নাসির উদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু। ভিড় ঠেলে বেরিয়ে এসে তিনি বললেন, ‘বাচ্চু তরুণদের জন্য সংগীতের ভাষা তৈরি করে গেছেন। সে জন্য আজ তাঁকে শ্রদ্ধা ও শোক নিয়ে স্মরণ করছে তরুণেরা। তিনি বাংলা সংগীতভুবনে অমর হয়ে থাকবেন।’
এক তরুণীর দেখা মিলল, দূরে দাঁড়িয়ে যিনি চোখ মুছছিলেন। মনে হলো আত্মীয়দের কেউ? তিনি জানান, ‘হ্যাঁ, পরম আত্মীয়।’ তিনি আইয়ুব বাচ্চুকে শৈশব থেকে চেনেন–জানেন। তিনি আইয়ুব বাচ্চুকে ভালোবাসেন। শিল্পী তাঁকে মগবাজারের স্টুডিওতে আমন্ত্রণ জানাতেন প্রায়ই, সব সময় সদুপদেশ দিতেন। একবার ছোট ভাইয়ের লিভার সিরোসিস হলে সেই সংকটের কথা ভাগাভাগি করেছিলেন। আইয়ুব বাচ্চু বলেছিলেন, ‘একটা কনসার্টের আয়োজন করো। আমি ও আমার বন্ধুরা মিলে গান করব। টাকা নেব না। সেই কনসার্ট থেকে তোলা টাকায় তোমার ভাইয়ের লিভার বদল করা হবে।’
সবাই বলছে, মাত্র ৬০০ টাকা নিয়ে আইয়ুব বাচ্চু ঢাকায় এসেছিলেন। কেউ বলছে না, একজন শিল্পী হয়ে ওঠার জন্য এক বুক স্বপ্ন নিয়ে আইয়ুব বাচ্চু ঢাকায় এসেছিলেন। কেউ বলছে না, অভাবনীয় মেধা ও প্রতিভা সঙ্গে নিয়ে আইয়ুব বাচ্চু ঢাকায় এসেছিলেন। বাংলা ভাষা–সাহিত্য–সংস্কৃতিকে ছড়িয়ে দেওয়ার কেন্দ্রস্থল ‘ঢাকা’য় আইয়ুব বাচ্চু এসেছিলেন তাঁর নিয়ে আসা আলো ছড়িয়ে দিতে। আলো ছড়ানো শেষ। আলো ছড়ানোর জন্য পুড়ে পুড়ে মোমকে গলতে হয়। তাতে হয়তো কিছুটা যন্ত্রণা থাকে। আইয়ুব বাচ্চু কিছুটা যন্ত্রণা নিয়ে চলে গেলেন। বলে রেখেছিলেন, ‘এই বুকে যন্ত্রণা, বেশি সইতে পারি না/ আরো বেশি কাঁদালে উড়াল দেব আকাশে।’
তিনি উড়াল দিয়েছেন পৃথিবী ছেড়ে। আনুষ্ঠানিকভাবে ঢাকা তাঁকে বিদায় জানিয়েছে। কাল তিনি যাবেন মাতৃভূমিতে। আবার মায়ের কোলে ফিরবেন বাংলার রকস্টার।