Saturday, April 27
Shadow

আড়ং : উৎসবের তিন দিন

চার দশক। যেকোনো প্রতিষ্ঠানের জন্য দীর্ঘ সময়ই বটে। দেশের মানুষের কাছের ও নির্ভরতার প্রতিষ্ঠান আড়ং ৪০ বছরের মাইলফলক ছুঁয়েছে এ বছর। ১৯৭৮ সালে গ্রামের সাধারণ মানুষদের আর্থিক নিশ্চয়তা দিতে যাত্রা শুরু করা আড়ং এখন দেশের সবচেয়ে বড় ফ্যাশন ও কারুপণ্যের প্রতিষ্ঠান। জোরালো দেশি ব্র্যান্ড। তার উদ্‌যাপনে উৎসব না করলে হয় নাকি!

তাই বাংলাদেশ আর্মি স্টেডিয়ামের বিশাল পরিসরে ২৫ থেকে ২৭ অক্টোবর আয়োজন করা হলো ‘আড়ং ফোরটি ইয়ারস ফেস্টিভ্যাল’। কী না ছিল সেই উৎসবে! পোশাক, তাঁতশিল্প, দারুশিল্প, রিকশাচিত্রের প্রদর্শনী, ফ্যাশন শো, খাবার, গান, পুরস্কার আর আজীবন সম্মাননায় জমজমাট এক আয়োজন। ২৫ অক্টোবর বিকেলে উৎসবের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে এসে ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা স্যার ফজলে হাসান আবেদ জানালেন, আড়ং শুরু করার পর ক্রেতাদের কাছে গ্রামের নারীদের তৈরি নানা রকম কারুপণ্যের সাড়া মিলল ভালো। বাড়তে শুরু করল আড়ংয়ের সংগ্রহ। তবে শুরু থেকেই মাথায় রাখা হয়েছে উৎপাদকদের আর্থিক সচ্ছলতার বিষয়টা। সবার ভালোবাসা নিয়েই আজ আড়ং এই পর্যায়ে এসেছে।

উৎসবের উদ্বোধন করেন স্যার ফজলে হাসান আবেদ (ডানে)সাজা নূর ও তামারা হাসান আউদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর ও ব্র্যাক এন্টারপ্রাইজেসের জ্যেষ্ঠ পরিচালক তামারা হাসান আবেদ।আড়ং

‘শুধু ৪০ নয়, আড়ং টিকে থাকুক ৪০০ বছর,’ সংস্কৃতিমন্ত্রীর এই বক্তব্যের পর মঞ্চের সামনে বসা সারা দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা উৎপাদক ও দর্শকেরা করতালি দিতে শুরু করেন। উদ্বোধনী দিন সন্ধ্যায় আড়ং তাদের ৬৫ হাজার উৎপাদকের মধ্য থেকে ৬টি বিভাগে মোট ৪০ জনকে পুরস্কৃত করে। ৬ জনকে দেওয়া হয় আজীবন সম্মাননা। পুরস্কার বিতরণের ফাঁকে গান শোনান লোকশিল্পী শাহজাহান মুনশি ও তাঁর দল। প্রথম দিনের অনুষ্ঠান শেষ হয় রুনা লায়লার গান দিয়ে।

;”>তাগার পোশাকে নকশার বৈচিত্র্যউৎসবের প্রতিদিনই দর্শকের ভিড় বেড়েছে। এক স্টল থেকে আরেক স্টলে গিয়ে তাঁরা নিয়েছেন অভিজ্ঞতা। দ্বিতীয় দিনের প্রধান আকর্ষণ ছিল ফ্যাশন শো। সন্ধ্যা সাতটার পর মঞ্চে এলেন তামারা হাসান আবেদ। সবাইকে স্বাগত জানিয়ে তিনি তুলে ধরেন আড়ংয়ের সহ-ব্র্যান্ড তাগা, তাগা ম্যান ও হার স্টোরির সংগ্রহের কথা।

বিশাল মঞ্চে আলো নিভে গেল। পেছন থেকে স্পটলাইটের আলো নিয়ে হেঁটে এলেন একজন ছেলে মডেল। তার পরনের টি-শার্টে নতুন ধারা। আড়ংয়ের প্রচলিত নকশার বাইরে পশ্চিমা ধাঁচের এই পোশাকের সংগ্রহ তাগা ম্যানের। এর বাইরে শার্ট, প্যান্ট, টি-শার্ট, শেরওয়ানি কাটের পাঞ্জাবি, জুতা ও নানা ধরনের ব্যাগের সংগ্রহ দেখানো হয়।

লম্বা কুচির আনারকলিদ্বিতীয় কিউতে তাগার সংগ্রহ তরুণীদের জন্য। যেখানে কামিজ, টপ, জ্যাকেট, পালাজ্জো ইত্যাদি দেখা যায় মঞ্চে। পরের কিউ ছিল হার স্টোরির সংগ্রহ নিয়ে। মূলত উচ্চ রুচিশীল নারীদের পোশাক তৈরি করে হার স্টোরি। চতুর্থ কিউয়ের নাম ছিল দ্য ডান্স অব পিকক। আড়ংয়ের এই সংগ্রহের বিষয় ময়ূর, যেখানে ময়ূরের নানা রং ও মোটিফ ব্যবহার করা শাড়ি, কামিজ আর লং ড্রেসে। শেষ কিউতে ছিল নানা ধরনের সংগ্রহ। বিয়ের পোশাক, গয়না, ব্যাগ ইত্যাদি দেখা যায় এই কিউতে। জামদানির বিশেষ সংগ্রহ তুলে ধরা হয় কনের সাজে। ছিল আড়ংয়ের নিজস্ব স্টাইলে তৈরি কাঁথার ফোঁড়ের নকশা। ফ্যাশন শোয়ের মডেলদের সাজিয়েছেন কানিজ আলমাস খান ও পারসোনা। কোরিওগ্রাফার ছিলেন আজরা মাহমুদ। ফ্যাশন শোর বিরতিতে গান পরিবেশন করেন এলিটা করিম। উৎসবের শেষ দিনে বিশেষ কনসার্টে দর্শক মাতান নগরবাউল জেমস, জলের গান, নেমেসিস ও মিনার।

তাগা ম্যানের পোশাক পরে মঞ্চে হাঁটেন মডেলরাব্র্যাকের আয়েশা আবেদ ফাউন্ডেশনের (এএএফ) মাধ্যমে ১৯৭৮ সালে মানিকগঞ্জের দরিদ্র নারীদের প্রশিক্ষণ দিয়ে নানা রকম পণ্য উৎপাদন শুরু হয়। নারীদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় রেশম পোকার গুটি থেকে কীভাবে সুতা সংগ্রহ করে সিল্কের কাপড় বানানো হয়, সে বিষয়ে। এরপর তা ঢাকায় এনে বিক্রি করা হতো বিভিন্ন দোকানে। তবে সেখান থেকে বিক্রির পর টাকা পেতে অনেক দেরি হতো গ্রামের দরিদ্র নারীদের। তাই এএএফ নিজেরাই উদ্যোগ নিল উৎপাদিত পণ্য বিক্রি করার। ধানমন্ডির মিরপুর রোডে খোলা হয় আড়ংয়ের প্রথম দোকান। প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে ছিলেন আয়েশা আবেদ ও মার্থা চেন। এরপর নানা ঘটনার ভেতর দিয়ে এগিয়ে চলা আড়ংয়ের বর্তমান শাখা ২১টি, যার মধ্যে ঢাকায় ১৩টি ছাড়াও চট্টগ্রাম, খুলনা, বগুড়া, নারায়ণগঞ্জ, সিলেট, কুমিল্লা ও ময়মনসিংহে রয়েছে আড়ংয়ের শাখা।

গান গাইছেন এলিটা করিমউৎসবের তিন দিন আয়োজন চলে বেলা ১১টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত। স্টেডিয়ামের সবুজ ঘাসের ওপর তৈরি করা হয় ১১টি বিশেষ স্টল, যেখানে ১১ ধরনের পণ্য প্রদর্শন করা হয় দর্শকদের সামনে। জামদানি তৈরি, রিকশাচিত্র আঁকা, কাঠ খোদাই করে নকশা, মৃৎশিল্প, গয়নার নকশা, বাঁশের তৈরি আসবাব, নকশিকাঁথার ফোঁড়, পোশাকে প্রাকৃতিক রঙের নকশা, ব্লকপ্রিন্ট, রেশম সুতা তৈরির বিভিন্ন পর্যায় ইত্যাদি। উৎসবের তিন দিনই বিভিন্ন সময়ে দর্শকদের জন্য আয়োজন করা হয় নানা রকম কর্মশালার, যেখানে শেখানো হয় গয়না তৈরি, পোশাকে প্রকৃতির রঙের ডাই, ব্লকপ্রিন্ট, কাঁথার ফোঁড় ইত্যাদি বিষয়ে।

এর বাইরে নানা স্বাদের খাবারের দোকান, শিশুদের বিনোদনের নানা উপকরণ, পারসোনা, আইপিডিসির আলাদা স্টল ছিল মাঠের নানা প্রান্তে। একদিকে প্রদর্শন করা হয় ১৯৮৮ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত আড়ংয়ের ফটোশুটের ছবি। উৎসব আয়োজন নিয়ে কথা হয় আড়ংয়ের প্রধান পরিচলন কর্মকর্তা মোহাম্মদ আশরাফুল আলম বলেন, ‘বাংলাদেশের প্রত্যেক মানুষের কাছের ব্র্যান্ড আড়ং। আর তাই আমরাও ক্রেতাদের একটি ধারণা দিতে চেষ্টা করেছি তাঁদের প্রিয় ব্র্যান্ড সম্বন্ধে। কীভাবে তাঁদের পোশাক তৈরি হয়, কারুপণ্যের নকশা করা হয়, গয়না থেকে, বাঁশ-বেতের আসবাব তৈরির কৌশল দেখানো হয়।’

উৎসবের শেষ ক্ষণে যখন মঞ্চে ওঠেন জেমস, আর্মি স্টেডিয়াম তখন কানায় কানায় পূর্ণ। হাজার হাজার দর্শকের চিৎকার আর উল্লাস যেন আড়ংকে আরও সামনে এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা দিল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Please disable your adblocker or whitelist this site!

error: Content is protected !!