রাষ্ট্রীয় আইনানুযায়ী বাজারে যে কোনো ধরণের খাদ্যপণ্য কিংবা সম্পূরক খাদ্যপণ্য বিক্রি করতে হলে নিয়ন্ত্রণ সংস্থার অনুমোদন নিতে হয়। কিন্তু এক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণ সংস্থা বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস এন্ড টেস্টিং ইন্সটিটিউশনের (বিএসটিআই) অনুমোদন নেয়ার তোয়াক্কাও করেনি হরলিক্স প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান গ্লাসকো স্মিথক্লাইন (জিএসকে) এবং বাজারজাতকারী মিউচুয়াল ফুড প্রোডাক্টস লিমিটেড। আর আইন না মানার কারণে ঠকছেন পণ্যটির ক্রেতারাও।
২০১৩ সালের শিশুখাদ্য বিপণন নিয়ন্ত্রণ আইন ও ২০১৭ সালের মোড়কবদ্ধ খাদ্য লেবেলিং প্রবিধানমালার একাধিক ধারা লঙ্ঘন করে বাজারে এখনও দেদারসে বিক্রি হচ্ছে হরলিক্স। পণ্যটির বিক্রি বাড়াতে নানা সময়ে প্রচার করা হয়েছে মিথ্যা বিজ্ঞাপন। সম্প্রতি দেশের বিশুদ্ধ খাদ্য আদালত হরলিক্সের লাগাম টেনে ধরতে পণ্যটির প্রস্তুতকারী ও বাজারজাতকারী দুই প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছে।
মামলার এজাহার অনুযায়ী, হরলিক্স বিশ্বের কোন উন্নত দেশ কর্তৃক স্বীকৃত? অথবা অনুমোদিত? তা খুঁজে পাওয়া যায়নি। এছাড়া হরলিক্সের বিজ্ঞাপন প্রচারের মাধ্যমে গ্রাহকের সঙ্গে প্রতারণার অভিযোগ আনা হয়েছে।
উল্লেখিত মামলার বাদি ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) প্রসিকিউটিং অফিসার কামরুল হাসান জানান, হরলিক্স নিয়ে মারাত্মক অনিয়ম লক্ষ্য করা গেছে। হরলিক্স বাজারজাতকারীরা ২০১৩ সালের শিশুখাদ্য বিপণন নিয়ন্ত্রণ আইনের বেশ কয়েকটি ধারা সুস্পষ্ট লঙ্ঘন করেছে। পণ্যটি ২০১৭ সালের মোড়কবদ্ধ খাদ্য লেবেলিং প্রবিধানমালাও মানে নাই। এর মোড়কের কোনোটিতে প্রস্তুতকারী হিসেবে গ্লাসকো স্মিথক্লাইন (জিএসকে) আবার কোনোটির মোড়কে মিউচুয়াল ফুড প্রোডাক্টসের নাম পাওয়া গেছে। তাহলে প্রশ্ন হলো হরলিক্স তৈরি করছে কারা? একইসাথে প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে, সম্পূরক খাদ্যপণ্য হিসেবে এটি কতটা নিরাপদ? আর এটি নিয়ন্ত্রণের দায় কি সিটি করপোরেশনের নাকি অন্য কোনো সংস্থার?
তিনি বলেন, হরলিক্স বিপণনে ২০১৩ সালের শিশুখাদ্য বিপণন নিয়ন্ত্রণ আইনের ধারা ৩১, ৩২ (খ), ৪২ এর সুস্পষ্ট লঙ্ঘন করা হয়েছে। এক্ষেত্রে তদারকি সংস্থা কার্যকর না হলে সাধারণ ক্রেতারা ঠকবেন।
বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদের (বিসিএসআইআর) প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা (এনালাইটিক্যাল সার্ভিস সেল) ড. হোসনে আরা বেগম জুমবাংলাকে বলেন, মাস দু’য়েক আগে জনৈক ব্যক্তি হরলিক্সের মান যাচাই করতে (স্বপ্রণোদিত) বিসিএসআইআর-এ আসেন। ওই পরীক্ষায় জানা গেছে, হরলিক্সের মোড়কে লেখা নানা উপাদানের কথাগুলো স্রেফ ছেলেভোলানো গল্প।
এ বিষয়ে বিস্তারিত জানতে যোগাযোগ করা হলো বিসিএসআইআর’এর খাদ্য বিজ্ঞান প্রযুক্তি ইনস্টিটিউটের পরিচালক ড.বরুন কান্তি সাহার সাথে। তিনি জানান, হরলিক্সের মোড়কে ডিএইচএ উপাদান থাকার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। গবেষণায় সে উপাদানের উপস্থিতি পাওয়া যায় নাই।
হরলিক্সের বিজ্ঞাপন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বিজ্ঞাপনগুলো ক্রেতা আকৃষ্ট করার মিথ্যা বিজ্ঞাপনী ভাষা। বিজ্ঞাপনগুলো দেখে আপনার মনে হতে পারে ভিটামিন এবং মিনারেল খুবই দুর্লভ বস্তু এবং আপনাকে এই ভিটামিন এবং মিনারেল বিশাল পরিমানে ফুড সাপ্লিমেন্ট (খাবারের সম্পূরক) আকারে নিতে হবে। তথ্য গুলো ভুল। আসলে ভিটামিন মিনারেল আমাদের চারপাশে নানান ধরণের প্রাকৃতিক খাবারে বিদ্যমান।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ডিএইচএ একটি ওমেগা-৩ প্রাইমারি অ্যামিনো এসিড। এটি মানুষের মস্তিষ্ক, ত্বক এবং চোখের রেটিনা গঠনের অন্যতম উপাদান।
হরলিক্সের মতো সহস্রাধিক পণ্য মিথ্যা প্রচারণার মাধ্যমে বিপণন চালাচ্ছে বলে দাবি করছে বিএসটিআই। সংস্থাটির উর্দ্ধতন এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জুমবাংলাকে বলেন, এসব পণ্য ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে বিএসটিআই’য়ের কাছে নথি থাকলেও জনবল সংকটসহ নানা প্রতিকূলতার কারণে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। তাছাড়া আইনের ফাঁকফোকর তো রয়েছেই।
যেমন হরলিক্সের মতো পণ্যগুলো হলো পরিপূরক খাদ্য (ফুড সাপ্লিমেন্ট)। বিএসটিআই এ ধরণের খাদ্যপণ্যের অনুমোদন দেয়না বলেই জানালেন ওই কর্মকর্তা।
বিএসটিআই’য়ের দায়সারা গোছের উত্তরে খুশি নন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি ও খাদ্যবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের শিক্ষক প্রফেসর ড. খালেদা ইসলাম। এগুলোর বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে বাংলাদেশে একটি কার্যকর সংস্থা জরুরি হয়ে পড়েছে বলে মনে করেন তিনি।
উল্লেখ্য, চলতি মাসের ৩১ তারিখ হরলিক্সের মামলাটির পরবর্তী তারিখ নির্ধারণ করা হয়েছে। বিশুদ্ধ খাদ্য আদালতের বিচারক মেহেদী পাভেল সুইটের আদালতে এ মামলা চলমান রয়েছে।