রাস্তায় জটলা দেখলেই বুক চিতিয়ে জায়গা করে নেন আলমগীর মিন্টু। লম্বায় ছফুট, শক্তসমর্থ, জিম করা পেটা শরীর। নিজের শারীরিক শক্তি দেখানোর জন্য ‘দেখি তো’ ‘সরে দাঁড়ান’ বলারও প্রয়োজন বোধ করেন না। লোকে তাকে দেখে এমনিতেই জায়গা করে দেয়। বয়স পঞ্চাশ পার হয়েছে। বেসরকারি কোম্পানির সেলসে আছেন। মুখে আয়েশি হাসি লেপ্টে থাকে সবসময়। দশাসই শরীরের কারণে তার মনে হয় একদিন না একদিন সুযোগ আসবে। কীসের সুযোগ? সেটা মিন্টুর কাছে পরিষ্কার নয়। হয়ত কারো সঙ্গে তুমুল হাতাহাতি কিংবা রাস্তায় কোনো ছিনতাইকারীকে ধরে বেদম পেটাবেন। তা না হলে এমন শরীর বানিয়ে লাভ কী!
‘ভাইসব। এখন যে জাদুটা দেখাইব তাতে আপনেরা মজা পাইবেন একশ টাকার, খরচ হইব দশ টেকা। আগে দশ টেকা কইরা দেন, তারপর দেখাই।’
রাত দশটার মতো বাজে। রাজধানীতে বিশেষ রাত নয়। তবে ঈদের পর পর হওয়ায় পথঘাট সুনসান। এর মাঝে মিরপুরের মাজার রোডের এক গলির ভেতর থেকে কথাটা শুনে এগিয়ে গেলেন মিন্টু। উঁকি দিতেই চোখে পড়লো টেকো মাথার বড় বড় চোখওয়ালা বিচিত্র দর্শন লোকটাকে। জাদু দেখাচ্ছে। ‘শালার ভণ্ডামি বের করতে হবে!’ বিড়বিড় করলেন মিন্টু।
‘কেউ একজন আমারে দশ টেকা দেন। এই যে ভাই, দেন, আপনের টেকা আপনেরে ফেরত দেওয়া হইব। নো টেনশন। দেখেন ভাইসব, এইটা কত টেকার নোট? দশ? আপনি বলেন কত টেকা?’
অদ্ভুত ব্যাপার! মিন্টু স্পষ্ট দেখলেন জাদুকরের হাতে বিশ টাকার নোট। কিন্তু ভিড়ের মধ্যে কেউ সেটাকে বলছে দশ টাকা, কেউ বলছে একশ টাকা।
‘এইবার বলেন, এই নোটটা বিশ টেকা দিয়া কে কে কিনতে চান? কে কে বিশ টেকা দিয়া একশ টেকার মালিক হইবার চান?’
অনেকেই হাত বাড়াল। একজন বিশ টাকা এগিয়ে দিতেই জাদুকর তার দিকে বাড়িয়ে ধরলো নোটটা। এবার মিন্টু স্পষ্ট দেখলেন জাদুকর লোকটা বিশ টাকা নিয়ে লোকটাকে একটা দশ টাকার নোট গছিয়ে দিচ্ছে।
‘আজ যাবি কোথায়! ব্যাটা ভণ্ড!’
এরপর বিড়বিড় করে আরো গোটা দশেক গালি দিয়ে ভিড়টাকে দুহাতে ঠেলে এগিয়ে গেলেন মিন্টু। কিছু বুঝে উঠার আগেই হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে আসলেন জাদুকরকে। ঝামেলা দেখে আশপাশের অনেকেই দশ টাকার মায়া ত্যাগ করে কেটে পড়ল দ্রুত। কেউ কেউ তাকিয়ে দেখলেও কাছে ঘেঁষছে না। বেশিরভাগই পরিবহন শ্রমিক না হয় গতরখাটা লোক। সারাদিনের কাজ শেষে ক্লান্ত সবাই। শুধু শুধু এমন এক তাগড়া লোকের সঙ্গে যুঝতে যাবে কে। তাদের চোখে মুখে উপচে পড়ছে বিস্ময়।
প্রথমেই বেমক্কা ঘুষি। চোয়াল ফেটে গেল জাদুকরের। চকিতে আত্মবিশ্বাসের পুলক টের পেলেন মিন্টু। বলার মতো একটা উদাহরণ যেন এসে গেল তার জীবনে। ‘এক ঘুষিতে চোয়াল ফাটিয়েছি শালার!’ মনে মনে বললেন কথাটা। এরপর ক্রমাগত ঘুষি বাগাতে লাগলেন। শক্ত হাতের গিঁটে যতক্ষণ না রক্ত লেপ্টে যেতে লাগল ততক্ষণ চলল। ‘খেক খেক খেক’। অশ্রাব্য ঠেকল হাসিটা। খানিকটা চমকেও উঠলেন মিন্টু। ‘ব্যাটার হাসি বাইর করতাসি!’ পিত্তি জ্বলে গেল যেন। লোকটাকে টেনেহিঁচড়ে রাস্তায় শোয়ালেন। এবড়োখেবড়ো খানাখন্দওয়ালা রাস্তা। নিজের প্যান্টে কাদা লাগছে লাগুক। আগে প্রাণভরে পেটানো চাই।
‘হেহেহে। কী করতাছিস তুই! মহা অনিষ্ট! মহা অনিষ্ট! ঝুপ ঝুপ কালি, তোর মুখে কালির শাপ! তোর চোখে কালির আন্ধার হ্রিং হ্রিং হ্রিরিংস্বা…।’
শব্দগুলো মিন্টুর কানে বিষধর সাপের মতো হিসহিস করে বেজে উঠলো যেন। এদিকে মার খেয়ে প্রায় অচেতন জাদুকর। ঠোঁট নড়ছে না মোটেও। তবে গালাগাল থামছে না বেজন্মাটার। মারতে মারতে নিজেও গালি দিয়ে চলেছেন মিন্টু।
‘চুপ! ব্যাটা! ভণ্ডের বাচ্চা। দশ টাকা দিয়ে বিশ টাকা নিচ্ছিস!’
‘হা হা হা! আমাকে মারতে পারবি না বোকা! তুই মরবি। তুই তোকে মারছিস! ক্রি.. ক্রি.. ক্রিহহহ।’
বিচিত্র সব শব্দ ভাসতে লাগল মিন্টুর কানের কাছে। এরপর অশ্রাব্য গালির তুবড়ি বাজতে শুরু করল মিন্টুর কানে। গালিগুলো অভিশাপের মতো শোনাচ্ছে। ব্রহ্মতালু জ্বলে উঠলো মিন্টুর। জাদুকরের রক্তাক্ত মুখের একটা পেশীও নড়ছে না। কিন্তু থামছে না অপার্থিব হাসিটাও। মাঝে মাঝে গোঙ্গানীর মতো শব্দ। তার ভেতর থেকে মন্ত্রের মতো কিছু শব্দ উগড়ে আসছে। নিজেকে সামলাতে পারলেন না মিন্টু। বেড়ে গেল ঘুষির বেগ। উঠে দাঁড়ালেন। লাথি বসাতে লাগলেন নির্দয়ের মতো। থেমে থেমে উবু হয়ে চেপে ধরছেন গলা। আশপাশে যারা কাছাকাছি ছিল, তারা সরে দাঁড়াল নিরাপদ দূরত্বে। শুরু হলো ঝুম বৃষ্টি। ধুয়ে যাচ্ছে জাদুকরের মুখের রক্ত। পানিতে মুখটা ধুয়ে যেতে না যেতেই ফিনকি দিয়ে ফের ছিটকে আসা রক্ত আবার লাল করে দিচ্ছে মুখটা। মিন্টুর মনে হলো যেভাবে হোক মৃত্যু নিশ্চিত করা চাই। হাতের কাছে ধারালো কিছু নেই। অগত্যা চেপে ধরলেন গলা। লোহার মতো আঙুল। তবে অসাঢ় শরীরটা থেকে কোনো বাধাও এলো না। মরেই গেছে।
শুরুতে জাদুকরের চেহারাটা কেমন ছিল মনে করার চেষ্টা করলেন মিন্টু। পঞ্চাশোর্ধ টেকো মাথার একটা চেহারা হওয়ার কথা। স্পষ্ট মনে পড়ছে না। আশপাশের মানুষজন ছুটে পালাল। বৃষ্টির গতি বেড়েছে। বজ্রপাতের শব্দে সম্বিত ফিরলো মিন্টুর। হাত জ্বালা করছে। কয়েকটা গিঁট থেঁতলে গেছে। পাত্তা দিলেন না মিন্টু। বুঝতে পারলেন সটকে পড়তে হবে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। উঠে কিছুদূর গিয়ে আবার পিছু ফিরলেন। রাস্তার ল্যাম্পপোস্টগুলো নিভে গেছে আগেই। বজ্রপাতে জাদুকরের চেহারা দেখা যাচ্ছে হুট হাট। ভ্রু কুঁচকে গেল মিন্টুর। তাকিয়ে রইলেন বোবার মতো।
অচেনা ঠেকছে লাশের চেহারাটা। মাথাভর্তি চুল। বড় বড় চোখগুলোও এখন স্বাভাবিক দেখাচ্ছে। সারা মুখ ফেটে একাকার। কিন্তু দেখে যেকেউ দিব্যি দিয়ে বলবে এর বয়স পঞ্চাশ নয়, বড়জোর পঁয়ত্রিশ কি ত্রিশ। বৃষ্টিতে রক্তের সঙ্গে ধুয়ে যাচ্ছে মুখের আবরণটাও। চোখের ভুল? হতে পারে। প্রতিবারের বজ্রপাতেই যেন একটু একটু করে কমছে বয়স। এ যুবক! পরনের জামা-কাপড়ও বদলে গেল ভোজবাজীর মতো। মিন্টুর নিজেকে এখন দুর্বল মনে হচ্ছে। এত বৃষ্টি! একটু পানি খেতে পারলে ভালো হতো। গলা শুকিয়ে কাঠ। কাছে এগিয়ে গেলেন দুর্বল পায়ে। আরেকটা বজ্রপাতের আশায় ঠায় তাকিয়ে আছেন যেখানে লাশটা ছিল।
ঝিলিক দিয়ে উঠল আলো। কয়েক সেকেন্ড। বয়স আরো খানিকটা কমে গেল লাশটার! নাহ, বড়জোর বছর বিশেকের কিশোর হবে! ঘুষির আঘাতে নাক-মুখ ফেটে গেলেও যে কেউ বলবে এ ছোকড়ার জাদু দেখাতে পারার কথা নয়। এ বড়জোর কোনো বাসের হেলপার কিংবা আড়তের কর্মচারী। আঁধার সয়ে এসেছে চোখে। জ্বলে উঠেছে আশপাশের কিছু জেনারেটরে চলা বাতির আলো। বৃষ্টিতে ভিজে জবজবে হয়ে ভ‚তের মতো ঠায় দাঁড়িয়ে মিন্টু। হা করে তাকিয়ে আছেন নিজের হাতে খুন করা লাশটার দিকে। কোমল একটা মুখ। মনে পড়েছে চেহারাটা। ভিড়ের মধ্যেই ছিল। দশ টাকা বাড়িয়ে দিয়েছিল জাদুকরের দিকে। বিশ টাকা পাওয়ার আশায়। মুখের ক্ষত থেকে রক্ত চুইয়ে পড়ছে এখনো। গলার দিকটা লাল হয়ে আছে। অপার্থিব ভয় গ্রাস করলো মিন্টুকে। শরীরে বিন্দুমাত্র শক্তি নেই আর। কোথাও বড় একটা ভুল হয়েছে।
আচমকা দূরে একটা হিসহিসে গলা শোনা গেল। সেই বিশ্রিরকম খে খে হাসি। ‘তুই খুনি! তুই খুনি!’ ‘না! এটা ভুল! চোখের ভুল!’ মিন্টু পরিষ্কার জাদুকরের গলা শুনতে পেলেন। একবার মনে হলো অনেক দূর থেকে আসছে, আরেকবার মনে হলো কানের কাছেই ফিসফিস করে বলল। কিন্তু দুটোই অসম্ভব। কিন্তু জাদুকরের কাছে সবই সম্ভব। মিন্টু আবার মাথা চাপড়ে মনে করার চেষ্টা করলেন। জাদুকরের কলার টেনে হিড়হিড় করে নিয়ে এসেছিলেন। আচ্ছা, জামার কলার ছিল কি? নাকি ঘাড় ধরেছিলেন? তারপর যখন ঘুষি মারতে থাকেন তখনো সে মধ্যবয়সী জাদুকরই ছিল। কিন্তু এর মাঝে নির্ঘাৎ সে কাউকে ধোকা দিয়ে সামনে এনে দাঁড় করিয়েছে। আর কোনোভাবে.. নাহ মিন্টু আর ভাবতে পারছেন না। চুল চেপে ধরেই ঝেড়ে দৌড় লাগালেন। তার বাসা মিরপুর দশ নম্বরের দিকে। কিন্তু তিনি দৌড়াচ্ছেন উল্টোদিকে। অবচেতন মন সতর্ক করে দিয়েছে। উল্টোপথে গেলে কেউ সহজে তার আসল ঠিকানা বলতে পারবে না। অনেকে তাকে দেখে ফেলেছে। আগামী এক সপ্তাহ বা এক মাস এ পথ আর মাড়ানো যাবে না।
ঘটনার পরদিন প্রায় সবকটা পত্রিকা কিনেছেন আলমগীর মিন্টু। নাহ কোথাও কোনো খুনের খবর নেই। মানে যে দুচারটে আছে সেগুলো ঢাকার নয়। তারমানে আশপাশের সবাই বিষয়টা বেমালুম চেপে গেছে। আর লাশটাও হয়তো বৃষ্টিতে ধুয়ে গেছে। বা পরিবারের কেউ এসে নিয়ে গেছে হয়তো। পুলিশে খবর দিয়ে আর ঝামেলা পাকাতে চায়নি। তারা হয়তো ধরেই নিয়েছে ট্রান্সপোর্ট লাইনে টুকটাক খুনখারাবি প্রতিদিনকার ঘটনা। কে আচমকা সন্দেহ করবে যে একটা প্রাইভেট কোম্পানির সেলস ম্যানেজার গিয়ে কোনো কারণ ছাড়াই একটা হেলপার ছোকড়াকে কিলঘুষি মেরে খুন করবে। খুন! কত সহজ শব্দ মনে হচ্ছে এখন। সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে মিন্টুর মনটা একটু পর আবার ফুরফুরে হয়ে আসল। তবে আগের মতো শরীরে আর শক্তিটা বোধ করলেন না। স্ত্রীর সঙ্গেও বেশ মিনমিন করে কথাবার্তা চালালেন।
‘অফিস যাবে না?’
‘নাহ। শরীর ভাল না।’
এরপর আর বিশেষ কথা হয়নি। মিন্টু তার নিজেকে ও পুরো পরিবার নিয়ে ভাবতে বসলেন। তিন রুমের ফ্ল্যাট। একটা রুম ফাঁকাই থাকে। এক রুমে মিন্টুর ছোটভাই থাকে। সন্তান নেই। স্ত্রীর এ নিয়ে আক্ষেপও নেই। কেমন যেন চুপচাপ জিনাত চৌধুরী। মিন্টু কোনোকালেই চুপচাপ ছিলেন না। তবে আজকের কথা আলাদা। কয়েকবার চেষ্টা করলেন প্রতিদিনকার মতো হেঁড়ে গলায় হাঁক ছাড়তে। কিন্তু ছোট ভাই সেলটুকে ডাকতে গিয়ে দেখলেন গলা দিয়ে স্বরই বের হচ্ছে না। এমন সময় কলিং বেল বেজে উঠতেই মনে হলো পায়ের নিচে ধস নেমেছে। মিন্টু পড়ে গেলেন ভয়ের অতল নদীতে।
‘কে! কে!’
‘এভাবে ধমকাচ্ছো কেন! আমি দেখছি কে।’
কী-হোলে চোখ রেখে তারপর দরজা খুললেন জিনাত চৌধুরী।
‘আজ্ঞে আমার নাম শংক্রাংচু ভদ্র। মিন্টু সাহেব আমার পরিচিত।’ কথাটা পরিষ্কার শুনতে পেলেন মিন্টু। কিন্তু বিচিত্র এ নাম শুনেও কিছু বললেন না জিনাত। তিনি চলে গেলেন রান্নাঘরের দিকে।
গলাটা শুনে চেনা চেনা মনে হয়েছিল মিন্টুর। এগিয়ে এসে দরজার কাছে দাঁড়াতেই জমে গেলেন। গতরাতের সেই জাদুকর!
‘কে! কে! তুই!’
‘হে হে আজ্ঞে আমি। শংক্রাংচু। গতরাতে আপনার সঙ্গে দেখা হয়েছিল। সাহেবের শরীর ভালো? হাতের ব্যথা কমেছে?’
প্রথম ঘুষিটা মেরেই ব্যথায় মুখ কুঁচকে গেলেন মিন্টু। হাতের আঙুল ছিলে গিয়েছিল ভালোই। না, তিনি বাসায় ধরে আনেননি জাদুকরকে। কেউ দেখার আগেই কলার টেনে ধরে হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে গেছেন ছাদে। সেখানেই শুরু করেছেন মার আর গালাগাল ছুটছে অবিরাম।
‘হারামজাদা, ওইদিন ফাঁকি দিয়েছিস। আজ আর না। আজ তোকে আগে মারবো এরপর ছাদ থেকে ফেলে দেব। সবাই মনে করবে তুই আত্মহত্যা করেছিস। হা হা হা।’
‘ক্রিং হ্রি হ্রি। শাপ! শাপ! তুই মরবি! তোকে মারতে এসেছি আমি! হ্রিংরিরস্বার অভিশাপ তোর গায়ে লেগেছে। হ্রিংরিরিস্বা! ক্রিহা!’
‘তোর এসব মন্ত্র ছোটাচ্ছি আমি!’
ছাদের দরজা বন্ধ করে দিয়েছেন ভেতর থেকে। জাদুকর ব্যাটাকে আজ আর পিটিয়ে মারবেন না ঠিক করেছেন। সাত তলার ওপর বাসা। ছাদ থেকে ফেলে দিলে বাঁচার সুযোগ নাই। তবে তার আগে ঘুষি আর লাথি মেরে দুর্বল করে নিলেন লোকটাকে। তারপর পাঁজাকোলা করে তুলে নিয়ে গেলেন ছাদের কিনারায়। নিচে রাস্তায় এখানে সেখানে জটলা থাকলেও ছাদ বরাবর কংক্রিটের রাস্তাটা খালি। আলতো করে ছেড়ে দিয়েই পিছু হটলেন মিন্টু। এরপর কোনোরকম নিজের শরীরটাকে টেনে নিয়ে গেলেন ছাদ থেকে। দরজা খোলাই ছিল। সেখান দিয়ে ঢুকতেই মুখোমুখি জিনাত চৌধুরী। তার হাতে একটা বাটি।
‘কী ব্যাপার, এভাবে হাঁপাচ্ছো কেন?’
‘নাহ… একটু.. কিছু না। বাদ দাও।’
‘দুধওয়ালা ছেলেটা গেল কোথায় দেখেছো? বাটি আনতে না আনতেই হাওয়া।’
বজ্রাহতের মতো দাঁড়িয়ে গেলেন মিন্টু। ধাতস্থ হতে সময় নিলেন বেশ ক’ সেকেন্ড। তারপর ড্রয়িং রুমের পত্রিকা হাতড়ানো শুরু করলেন।
‘কে জানে। চলে গেছে বোধহয়। পাগলের মতো বিড়বিড় করতে দেখলাম একবার।’
রাস্তার নিচের চিৎকার চেঁচামেচি তার কানে এলো না।
কয়েকদিন চুপচাপ অফিস করেছেন আলমগীর মিন্টু। টুকটাক ক্রেতাও যোগাতে পেরেছেন। কোনো ঝামেলাই পোহাতে হয়নি। শুধু তিনি কেন, দুধওয়ালাকে কেউ খুন করেছে এমন সন্দেহই করলো না কেউ। ময়নাতদন্তে গলায় আঘাতের হয়তো কোনো রিপোর্ট এসেছিল। তবে সাততলা থেকে থেঁতলে যাওয়া শরীরের কাছে ওই কারণটা ধোপে টেকার কথা নয়। সবচেয়ে বড় কথা, ছেলেটা খুন হয়েছে এমনটাই তো সন্দেহ করছে না কেউ। সেখানে আলাদা করে আলমগীর মিন্টুকে সন্দেহ করার প্রশ্নই আসে না।
দ্বিতীয় খুনের এক মাস পরের কথা। একটা সেলসের মিটিং সেরে রাস্তায় বের হয়েছেন মিন্টু। মিটিং সফল। পাঁচ লাখ টাকার প্রডাক্ট বিক্রি কনফার্ম। খিদে না থাকলেও মিন্টুর ইচ্ছে হলো আশপাশের ভাল কোনো রেস্তরাঁয় গিয়ে কাচ্চি খাবেন। ঢুকেও পড়লেন একটা অভিজাত রেস্তরাঁয়। পুরো রেস্তরাঁ লোকে গিজগিজ করলেও মাঝের দিকের একটা টেবিল বলতে গেলে ফাঁকা। একজন মাত্র বসে আছে। মিন্টু গিয়ে তার মুখোমুখি বসলেন। মুহূর্তে খিদেটা উবে গেল। দাঁতমুখ খিঁচিয়ে বললেন, ‘হারামজাদা তুই এখনো মরিসনি!’
জাদুকর কথা না বলে চায়ের কাপে শব্দ করে চুমুক দিল। যেন শুনতেই পায়নি মিন্টুর কথা। এরপর মিন্টুকে চেনেই না এমন একটা ভাব নিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে ধীরেসুস্থে বলল, ‘আমার দরকার এক লাখ টেকা। টেকাটা দে আমি তরে ছাইড়া দিমু। শংক্রাংচু ভদ্রের কসম।’
‘তুই আমারে ছাড়বি? শালা! তোকে আমি ছাড়বো না! তোকে মেরেই ছাড়ব!’
জাদুকরের মুখে তুই সম্বোধন শুনেই মাথায় রক্ত চড়ে গেল আলমগীর মিন্টুর।
‘লাভ নাই। দেখসস কী হয়। কারে মারতে কারে মারবি আবার।’
‘এবার আর ভুল হবে না শূওর কোথাকার!’
‘রেস্টুরেন্টে এত মানুষ। এর মইদ্যে মারবি কেমনে তুই? তার চাইতে পকেটে যে অ্যাডভান্সের ক্যাশ চেকটা আছে ওইটা আমারে দিয়া দে। আমি চইলা যাই। তোর খুনখারাবির কথাও কেউ জানবো না।’
‘আমি চাইলে তোকে এই মুহূর্তে মেরে ফেলতে পারি। কেউ কিছু বলার আগেই আমি হাওয়া হয়ে যাব। কেউ আমাকে চিনবেও না। বুঝলি কুত্তারবাচ্চা!’
মিন্টু বুঝতে পারছেন তার গলার জোর অনেকটা কমে এসেছে। সত্যিটা হলো জাদুকর চলে গেলেই তিনি বাঁচেন। হ্যাংলা রোগা-পাতলা লোকটাকে যে তিনি দারুণ ভয় পাচ্ছেন সেটা বুঝতে দিতে চাচ্ছেন না। তবে স্পষ্ট ধরা পড়ছে বারবার।
‘চেকটা দে। চইলা যাই।’
চেকের কথা শুনেই আবার তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলেন মিন্টু। ভেতর থেকে উপচে পড়ল ভয়ানক সেই রাগ। এ রাগ নিয়ে মনে মনে গর্বও করেন তিনি। কারণ তীব্র এ রাগ অনেকটা মাদকের কাজ করে। মিন্টু তখন কোনো কিছুর পরোয়া করেন না। ডান হাতে এতক্ষণে শক্ত করে চেপে ধরেছেন কাটাচামচ। জাদুকরের নজর নেই সেদিকে। তার মুখে একদলা থুতু। মিন্টুকে পুরোপুরি হতভম্ব করে দিয়ে থু করে সেটা ছুড়ে দিল মিন্টুর মুখ বরাবর। এরপর ঘটনা ঘটল খুব দ্রুত। ঘটনার আকস্মিকতায় রেস্তরাঁর অন্যরাও বিশেষ টের পেল না কী ঘটেছে বা তাদের কী করা উচিৎ। মিন্টু ধাঁই করে কাটাচামচটা ঢুকিয়ে দিয়েছেন জাদুকরের গলায়। শ্বাসনালী ভেদ করে ঢুকে গেছে ওটা। ফিনকি দিয়ে ছিটকে বের হওয়া রক্ত গিয়ে পড়ল কোনো একজনের খাবারের প্লেটে। তৈরি ছিলেন মিন্টু। ঝটকা মেরে চেয়ার ছেড়ে উঠেই এক দৌড়ে রাস্তায়। এরপর সামনে যে বাসটা ছিল চড়ে বসলেন তাতে। ঘণ্টাখানেকের মধ্যে নিরাপদ দূরত্বে।
আরো কয়েক মাস পরের কথা। চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন আলমগীর মিন্টু। অফিসে গেলে রেস্তরাঁর আশপাশের কেউ যদি তাকে চিনে ফেলে এই ভয়ে। ওই দিনের পর আর পত্রিকাও পড়া হয়নি। তবে তিনি নিশ্চিত ওই জাদুকর ব্যাটা মরেনি। ‘শালা এত সহজে মরবে না। শালা একটা বিলাই।’ বিশেষ এক কারণে কোনো ধরনের অপরাধবোধেও ভুগছেন না মিন্টু। বরং শত্রুকে বার বার হত্যা করার মধ্যেও যে এক ধরনের আনন্দ থাকতে পারে সেটা টের পাচ্ছেন। তার ধারণা এই অন্যরকম আনন্দ তিনি নিজেই প্রথম টের পাচ্ছেন। কারণ এর আগে কাউকে এমন জাদুকরের পাল্লায় পড়তে হয়নি।
মিন্টু টের পাচ্ছেন তার ভেতর এক ধরনের তাগাদা তৈরি হচ্ছে। জাদুকরকে আরো একবার হত্যা করা চাই। দিনে দিনে ওটা যখন নেশার মতো চড়ে গেল তখন মিন্টু ঠিক করলেন ‘ব্যাটাকে খুঁজে বার করতে হবে’।
এর মধ্যে কয়েকবার মিরপুর মাজার রোডের সেই রোডে গিয়েছেন। জাদুকরকে দেখবেন এই আশায়। কিন্তু এতদিন না পেলেও আজ রাতে ঠিকই পেলেন। সেই টেকো মাথার বড় বড় চোখের লোকটা। ঘিরে আছে একটা জটলা। আলমগীর মিন্টুকে অবশ্য চিনতে পারল না কেউ। তারপরও সাবধান তিনি। মাথায় অদ্ভুত একটা হ্যাট পরেছেন। আগের চেয়ে রোগা-পাতলা হয়ে যাওয়ায় শার্টটাও ঢিলেঢালা।
‘ভাইসব আজ দেইখবেন মোবাইলের জাদু। আপনাদের কমদামি মোবাইল হয়ে যাবে আইফোন। তবে এ জাদু ফ্রি না। দুইশ টেকা করে দেবেন।’
অন্য অনেকের সঙ্গে এবার চুপিসারে নিজের মোবাইলফোনটাও বাড়িয়ে দিলেন মিন্টু। জাদুকরের সঙ্গে চোখাচোখি হলো। জাদুকর নির্বিকার। যেন চিনতেই পারেনি। বিষয়টা অভিনয় মনে হলো না মিন্টুর কাছে। মনে হলো আসলেই চিনতে পারেনি।
‘হা হা হা। আমাকে চিনেছো তুমি?’
‘হ তোরে চিনবো না কেন? তুই আমারে তিনবার খুন করছস। তবে এবার আমি তোরে গায়েব কইরা দিবো। হ্রিংরিরিস্বার সংকেত পাইসি। তুই তৈরি হ।’
এটা বলেই জাদুকর আবার সবার মনোযোগ আকর্ষণ করলো। ‘ভাইসব আপনারা দুইশ টাকায় নতুন আইফোন পাইবেন। তবে ফোনে আগের কোনো ছবি, নম্বর কিছু থাকবে না। আপনারা রাজি?’
সবাই হ্যাঁ বলল।
জাদুকরের কথায় বিশেষ পাত্তা না দিলেও মিন্টু তার শরীরে খুব একটা জোর পেলেন না। চট করে রেগেও যেতে পারলেন না। নিজেকে বেশ দুর্বল মনে হচ্ছে। রাগ ছাড়া তিনি তার শক্তিও ফিরে পাবেন না। জাদু শুরু হয়েছে। সবার কাছ থেকে কমদামি ফিচারফোনগুলো নিয়ে প্যান্টের পকেটে ভরল জাদুকর। তারপর তেমন কোনো নাটকীয়তা ছাড়াই আবার ঝোলা থেকে দামি দামি ফোন বাড়িয়ে দিল সবার দিকে। সবাই কাড়াকাড়ি করে নিয়ে নিল নতুন ফোন। যারা প্রথম দফায় টাকা দিতে গড়িমসি করেছে তারাও এবার টাকা দিতে মরিয়া। মিন্টুর হাতেও উঠে এলো একটা দামি ফোন। পকেটে রাখলেন। খানিক পর বের করে আবার দেখলেন। তার আগের সেই সাধারণ ফোন। এবার ঠোঁট বাঁকিয়ে তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে চেঁচিয়ে উঠলেন মিন্টু, ‘ভাইসব আপনারা সবাই ফোনটা আবার চেক করেন! আপনাদের সঙ্গে ভণ্ডামি করা হইসে।’
‘আরে! তাই তো! আইফোন তো না। আমার আগেরটাই তো।’
‘হালায় আমার দুইশ টেকা খাইল!’
‘ব্যাটারে ধোলাই দেওন লাগবো। তাই তো কই, দুইশ টেকায় আবার আইফোন। হে হে।’
ফুলকিটা ধরিয়ে দিলেন মিন্টু স্বয়ং। ‘ধর শালারে! মার!’ চিৎকারটা দিয়েই তৈরি হলেন দর্শক হিসেবে।
জাদুকর শংক্রাংচু ঠায় তার দিকে তাকিয়ে আছে। যেন একটা পাথরের মূর্তি। যে দৃষ্টি ভেদ করে যাচ্ছে পেটা শরীরের মিন্টুর চোখের নালী, একেবারে ভেতরেও! মিন্টু চাইলেও চোখ সরাতে পারছেন না। জ্বর জ্বর লাগছে খুব। শরীরটা কাঁপছে। একটা কাঁথা পেলে শান্তি পেতেন। এর মধ্যে জাদুকরের ওপর উত্তম-মধ্যম পড়তে শুরু করেছে। গণধোলাই সংক্রামক। মারছে তো মারছেই। এক পর্যায়ে জটলার লোকগুলোর মনে হলো এই ভণ্ড জাদুকরকে বাঁচিয়ে রাখলে সে আরো লোক ঠকাবে। একে মেরে ফেলা চাই। ভিড়ের মধ্যে কেউ একজন চেঁচিয়ে বলল, ‘বাঁইচা রাখলে হালায় পরে বাণ মারবো আমগোরে। মাইরা ফালা! মাইরা ফালা!’ কিন্তু কী দিয়ে মারবে? আশপাশে লাঠিসোটা আর ইটের টুকরো আছে কিছু। সেগুলোই কুড়িয়ে নিলো কেউ কেউ।
মিন্টু মাথা চাপড়ে বসে পড়েছেন। শরীরে অসহ্য ব্যথা। মনে হচ্ছে যেন ভেতরের প্রতিটা পেশী বিদ্রোহ ঘোষণা করেছে। শরীরটা যেন নিজেকে আর সহ্য করতে পারছে না। মাথার ভেতর থেকে একটা দলার মতো বের হয়ে আসতে চাইছে। পুরো শরীরটা যেন বমি করতে চাইছে। জটলার ফাঁক গলে মাঝে মাঝে জাদুকরের সঙ্গে চোখাচোখি হচ্ছে তার। চুপচাপ মার খাচ্ছে লোকটা। চোখ মুখ ফেটে যাচ্ছে। রাস্তায় গড়াগড়ি খাচ্ছে। অথচ টুঁ শব্দ করছে না। মিন্টু নিজেও শুয়ে পড়লেন। লোকে হাতের কাছে যে যা পাচ্ছে তা দিয়ে জাদুকরকে পেটাচ্ছে নির্দয়ের মতো। মিন্টু ধরতে পারলেন জাদুটা। মার খাচ্ছে জাদুকর, আর ব্যথা পাচ্ছেন তিনি। মরতে বেশি সময় নিল না লোকটা। দম ফুরোতেই জটলার লোকগুলো নিমেষে গায়েব। মিন্টু কোনোরকম এটা ওটা ধরে সোজা হয়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলেন। পারলেন না। পড়ে গেলেন উপুড় হয়ে। ফের শুরু হলো বজ্রসহ বৃষ্টি। মাথার ভেতরকার দলাটা আরো পাকিয়ে উঠল। হড়হড় করে বমি করলেন মিন্টু। নিজেকে ভীষণ অচেনা লাগছে তার। যা ভাবতে চাচ্ছেন তা ভাবতে পারছেন না। একবার মনে হলো তিনি একজন জমিদার। তার এখন খাজনার হিসাব নেওয়ার সময়। আরেকবার নিজেকে মনে হলো চাষা। তারপর আরো অনেক কিছু মনে হওয়ার পর নিজেকে একটা বাসের হেলপার ভাবতে লাগলেন মিন্টু। আহা! বাড়িতে টাকা পাঠানো হয়নি। পরক্ষণেই আবার মনে পড়ল অনেকগুলো বাসায় দুধের বিল বাকি পড়েছে। তারপর? মিন্টু আবার মিন্টু হলেন। চেহারায় শেষবারের মতো ফুটে উঠল ভীষণ এক অপার্থিব ভয়। আস্তে আস্তে হারিয়ে যেতে লাগলেন মিন্টু। চোয়ালটা নড়ছে। নড়ছে ভেতরের সমস্ত কিছু। মিন্টুর মনে হলো তিনি তার নিজের শরীরের ভেতর হারিয়ে যাচ্ছেন। আটকা পড়ে যাচ্ছেন ভেতরে। ঝুপ করে নেমে এলো একরাশ অন্ধকার।
এক পর্যায়ে স্বাভাবিক হলো আগন্তুকের শরীরটা। উঠে দাঁড়াল রাস্তা থেকে। পাশেই একটা মরদেহ পড়ে আছে। পঞ্চাশোর্ধ এক লোকের। লোকজনের গুঞ্জন শুনতে পাচ্ছেন আগন্তুক।
‘হায়! হায়! কারে মারতে গিয়া কারে মারলাম!’
‘ভালা হইসে মরসে। হালায় কালা জাদু করে। মরুক।’
আগন্তুক এগিয়ে এসে মরদেহের পকেট থেকে মোবাইল ফোন আর একশ টাকার নোটগুলো নিয়ে চুপচাপ সরে গেল। কেউ বাধা দিল না জাদুকরকে।