ডায়াবেটিস নির্ণয়ের প্রচলিত পরীক্ষাগুলো সম্পর্কে আমাদের মোটামুটি জানা হয়েছে। চিকিৎসকেরা প্রয়োজনমতো সকালে নাশতার আগে, নাশতার দুই ঘণ্টা পর বা দিনের যেকোনো সময় এবং বিশেষ বিশেষ প্রয়োজনে ৭৫ গ্রাম গ্লুকোজ ২০০-৩০০ মিলিলিটার পর্যন্ত পানিতে মিশিয়ে পান করানো এবং এর আগে ও দুই ঘণ্টা পরে রক্ত নিয়ে তাতে গ্লুকোজের (শর্করা) পরিমাণ দেখে কোনো লোকের ডায়াবেটিস আছে কি না তা দেখেন। একই সাথে প্রস্রাবে গ্লুকোজ যায় কি না তা-ও দেখা হয়। একসময় প্রস্রাবে গ্লুকোজ যাচ্ছে কি না তা দেখেই সিদ্ধান্ত নেয়া হতো। আজ তা গুরুত্ব হারিয়েছে। এসব পরীক্ষা করে কোনো লোকের ডায়াবেটিসের লক্ষণ ওই বিশেষ সময়টাতে আছে কি না তা জানা যায়। কিন্তু নিকট অতীতে তার রক্তের গ্লুকোজ সঠিক মাত্রায় ছিল কি না বা রোগীদের ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে ছিল কি না তা জানা যায় না। সাম্প্রতিককালে নতুন একটি পরীক্ষা পদ্ধতি প্রচলিত হয়েছে, যার মাধ্যমে সর্বোচ্চ গত চার মাসের নিয়ন্ত্রণের হিসাব পাওয়া যাবে। এ টেস্টটির নাম গ্লাইকোসিলেটেড হিমো-গ্লোবিন বা হিমোগ্লোবিন এ১সি। চিকিৎসা ক্ষেত্রে এ পরীক্ষাটি ব্যাপকভাবে সমাদৃত হচ্ছে। আমাদের দেশের অনেক ল্যাবরেটরিতে এ পরীক্ষাটি হচ্ছে।
গ্লাইকোসিলেটেড হিমোগ্লোবিন (HbA1C) কী?
মানুষের রক্তের লোহিত কণিকার অন্যতম গাঠনিক উপাদান হলো হিমোগ্লোবিন। এ হিমোগ্লোবিনের জন্য রক্ত লাল এবং এটি দেহের ভেতরে অক্সিজেন পরিবহনের খুব গুরুত্বপূর্ণ বাহক। এ হিমোগ্লোবিনের সাথে গ্লুকোজ লেগে থাকতে পারে এবং এর জন্য কোনো এনজাইমের প্রায়োজন পড়ে না। এরূপ গ্লুকোজ লেগে থাকা হিমোগ্লোবিনকে গ্লাইকোসিলেটেড হিমোগ্লোবিন (HbA1C) বলে। রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ যত বেশি হবে গ্লাইকোসিলেটেড হিমোগ্লোবিনের পরিমাণও তত বেশি হবে। হিমোগ্লোবিনের সাথে লেগে থাকা গ্লুকোজ ওই লোহিত কণিকা যত দিন বেঁচে থাকে তত দিনই লেগে থাকবে। যেহেতু লোহিত কণিকা প্রায় ১২০ দিন (চার মাস) বেঁচে থাকে তাই এ পরীক্ষটি করে আমরা ডায়াবেটিস রোগীর গত প্রায় চার মাসের ডায়াবেটিসের অবস্থার (রক্তে গ্লুকোজের পরিমাপের) হিসাব পাবো। আর এ গ্লাইকোসিলেটেড হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ সাময়িক অন্যান্য সমস্যা যেমন মানসিক অবস্থা, খাওয়া দাওয়া, শারীরিক শ্রম বা অন্যান্য ওষুধের প্রভাবে পরিবর্তিত হয় না।
গ্লাইকোসিলেটেড হিমোগ্লোবিন পরীক্ষার উপকারিতা
ডায়াবেটিস একটি ব্যাপক ক্ষতিকারক রোগ। এ ডায়াবেটিস দেহের প্রায় প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকেই ক্ষতিগ্রস্ত করে। এ ক্ষতির পরিমাণ যাদের ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে নেই তাদের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি। আবার যাদের রক্তের গ্লুকোজের পরিমাণ ঘন ঘন কম-বেশি হয়, তারাও ক্ষতির শিকার হয়। এ পরীক্ষা করে আমরা ডায়াবেটিস রোগীর গত চার মাসের ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের নির্ভরযোগ্য তথ্য পাই। অনেক ডায়াবেটিস রোগী চিকিৎসককে বিভ্রান্ত করেন। তিনি রক্তের গ্লুকোজ পরীক্ষার দু-এক দিন আগে থেকে তার জন্য নিয়ম-কানুন ও খাদ্যাভ্যাসগুলো পালন করতে থাকেন। প্রচলিত পরীক্ষার সাথে এ পরীক্ষা করে আমরা এ রোগীর বর্তমান ও আগের ডায়াবেটিসের নিয়ন্ত্রণ-অবস্থা বুঝতে পারি। আবার ডায়াবেটিসের চিকিৎসার সঠিক পরিকল্পনাতেও এ রিপোর্টটি আমাদের সহায়তা করে।
গ্লাইকোসিলেটেড হিমোগ্লোবিনের মান : গ্লাইকোসিলেটেড হিমোগ্লোবিনের মান শতকরা হিসেবে প্রকাশ করা হয়।
স্বাভাবিক মান- ৪%-৬%
নিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস- ৭%-এর নিচে
ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ মোটামুটি ৭%-৮%
ডায়াবেটিস কন্ট্রোল খুবই খারাপ ৯% ওপরে
সাধারণভাবে গ্লাইকোসিলেটেড হিমোগ্লোবিন ১% বেড়ে গেলে রক্তের গ্লুকোজ ২ মি.মোল/লিটার বেড়েছে বলে ধরে নেয়া হয়।
কখন ও কতবার গ্লাইকোসিলেটেড হিমোগ্লোবিন পরীক্ষা করানো উচিত?
শুধু ডায়াবেটিসে রোগীরাই এ পরীক্ষা করাবেন। এটি নির্ণয়ের কোনো পরীক্ষা নয়। এটির মাধ্যমে আমরা ডায়াবেটিসকে নিয়ন্ত্রণের অবস্থা বুঝতে পারব। কিন্তু ডায়াবেটিসকে নির্ণয়ের জন্য কখনোই পরীক্ষাটি ব্যবহার করা হয় না। তাই শুধু নির্ণীত ডায়াবেটিসের রোগীরাই এ পরীক্ষা করাবেন। ডায়াবেটিস রোগীরা বছরে অন্তত দু’বার এ পরীক্ষা করাবেন। যদি কারো ঘন ঘন রক্তের গ্লুকোজ ওঠা-নামা করে বা চিকিৎসাপদ্ধতি পাল্টানো হয়, তবে তার ক্ষেত্রে তিনবার পরীক্ষা করা দরকার।
ডায়াবেটিসের রোগটি নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারলে একজন ডায়াবেটিসের রোগীও আর ১০ জন মানুষের মতো জীবনের অনেক কাজই করে যেতে পারেন। কিন্তু ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ ডায়াবেটিস রোগীর কিডনি থেকে শুরু করে চোখ, হৃৎপিণ্ড, মস্তিষ্ক, ত্বক, অস্থিসন্ধি, পাসহ এমন কোনো অঙ্গ-প্রতঙ্গ নেই যা ক্ষতিগ্রস্ত হবে না। তাই এই রোগীদের সুদূরপ্রসারী ক্ষতি কমাতে হলে তার ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের মান অর্থাৎ গ্লাইকোসিলেটেড হিমোগ্লোবিনের মান জানা জরুরি। এর প্রাপ্ত মান থেকে আমরা চিকিৎসাপদ্ধতির বা জীবনযাত্রার পরিবর্তন প্রয়োজন হলে তা-ও করার চিন্তা করতে পারি।