তিলের তেলের উপকার অনেক। এর আছে অনেক গুণ। অকালে চুল পেকে যাওয়ার সমাধান দিতে পারে এই তেল। তিলের তেলে আছে ভিটামিন, মিনারেলস আর অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট উপাদান শরীরের পাশাপাশি চুল আর ত্বকের যত্নেও এর নানা উপকারিতা রয়েছে। বিশেষ করে শীতের রূপচর্চায় তিলের তেলকে করে করে নিন নিত্যসঙ্গী।
ভারতীয় উপমহাদেশের বিভিন্ন খাবারে উপকরণ হিসেবে তিলের বীজ ব্যবহার করা হয়। বিশেষত পিঠায় এর ব্যবহার দেখা যায়। আবার বিভিন্ন রান্নায় তিলের তেল ব্যবহারের চল রয়েছে।
খাবার সাজাতে অনেকসময় এই বীজ ব্যবহৃত হয়। মূলত ফাস্টফুড, পাউরুটিতে এর ব্যবহার বেশি। এই বীজ পুষ্টিগুণেও সেরা।
তিলের তেলের উপকার গুলো জেনে নিই ঝটপট
তিলের তেলে আছে—শর্করা, চিনি, খাদ্য আঁশ, স্নেহ পদার্থ, প্রোটিন, ট্রিপ্টোফ্যান, থ্রিয়েনিন, আইসুলেসিন, লুসিন, লাইসিন, মেথাইনিন, সিস্টাই, ফিনাইনলালনিন, টাইরোসিন, ভ্যালিন, আরজানাইন, হিস্টিডিন, অ্যালানিন, অ্যাস্পার্টিক অ্যাসিড, গ্লুটামিক অ্যাসিড, গ্লাইসিন, প্রোলিন, সেরিন, হাইড্রক্সিফোলাইন, ভিটামিন সি, ই, বি কমপ্লেক্স, ডি, ক্যালসিয়াম, লৌহ, ম্যাগনেসিয়াম, ফসফরাস, পটাসিয়াম, সোডিয়াম, জিংক।
ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করে
ছোট থেকে বড়, সব বয়সীদের মধ্যেই ডায়াবেটিসের ঝুঁকি এখন অনেক বেশি। ডায়াবেটিক রোগীদের স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত উপকারী সাদা তিল।
রক্তচাপ কমায় তিলের তেল
উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখতেও সাদা তিলের জুড়ি মেলা ভার। এই তিলে রয়েছে ম্যাগনেশিয়াম, যা উচ্চ রক্তচাপ কমাতে সাহায্য করে। তাই রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখতেও এই তেলে রান্না করা ভালো?
ক্যানসারের ঝুঁকি কমায়
সাদা তিলের তেলে একাধিক প্রয়োজনীয় ভিটামিন এবং খনিজ রয়েছে। তাই প্রতিদিনের খাবারে এই তেল ব্যবহার করলে শরীরে ক্যানসারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে। যাদের কেমোথেরাপি নিতে হয়, তাদের খাদ্যতালিকায় এই তেল রাখার কথা বলেন পুষ্টিবিদরা।
গাঁটের ব্যথা উপশম করে তিলের তেল
এই তেল হাড়কে মজবুত করে। তিলের তেলে রয়েছে তামা, যা গাঁটের ব্যথা, পা ফুলে যাওয়া, পেশিতে ব্যথা কিংবা বাতের ব্যথার উপশমে খুবই কার্যকর। যাদের আর্থারাইটিসের সমস্যা আছে তারাও তিলের তেল দিয়ে রান্না করতে পারেন, উপকার পাবেন।
কোষ্ঠকাঠিন্য সমস্যা কমায়
তিলের বীজে রয়েছে স্বাস্থ্যকর প্রোটিন। আর প্রোটিন সমৃদ্ধ এই তিলবীজ রক্তের কোলেস্টেরলের মাত্রা ঠিক রাখতে সাহায্য করে। এর আরও একটি গুণ রয়েছে। কোষ্ঠকাঠিন্য সমস্যা কমাতে সাহায্য করে এটি।
লিভার ভালো রাখে
লিভার বা যকৃতের কার্যকারিতা ঠিক থাকলে শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়া ঠিক থাকে। তিলের বীজে রয়েছে Methionine ও Tryptophan নামের দুটি পদার্থ। এই উপাদানগুলো লিভারকে সুস্থ রাখতে সাহায্য করে। ঘুমের সমস্যাও দূর করে। তাই যারা অনিদ্রা সমস্যায় ভুগছেন তাদের জন্য তিলবীজ উপকারি।
স্মৃতিশক্তি বাড়ায় তিলের তেল
স্মৃতিশক্তি ঠিক রাখতেও তিল উপকারি একটি উপাদান। তিলে রয়েছে Lecithin নামক উপাদান। এটি স্মৃতিশক্তি বাড়াতে সাহায্য করে। এছাড়া মাতৃদুগ্ধের মান ভাল করতে সাহায্য করে তিল। বাজারে সাধারণত লাল, কালো ও সাদা তিল পাওয়া যায়। কালো ও লাল তিল আয়রন সমৃদ্ধ। অন্যদিকে সাদা তিলে রয়েছে ক্যালসিয়াম। তাই, তিলবীজ অ্যানিমিয়া রোধ করতেও সাহায্য করে।
চুলের জন্য তিলের তেল
- তিলের তেলের ফ্যাটি অ্যাসিড চুলের রুক্ষভাব কমিয়ে আনে। সপ্তাহে তিন দিন রাতে শোবার আগে সমপরিমাণ নারিকেল ও তিলের তেল হালকা গরম করে মাথায় ও চুলে লাগান। সকালে শ্যাম্পু করে ফেলুন। শুষ্ক ও নিষ্প্রাণ চুলে জেল্লা ফিরে আসবে।
- অকালপক্বতা রোধে সমপরিমাণ নারিকেল তেলের সঙ্গে তিলের তেল মিশিয়ে হালকা গরম করে মাথায় ম্যাসাজ করুন। সকালে শ্যাম্পু করুন। এতে চুল ঝরে পড়ার হারও কমে যাবে উল্লেখযোগ্যভাবে।
- খুশকির সমস্যায় তিলের তেল কার্যকর। সপ্তাহে এক দিন তিলের তেল ও নিম তেল মিশিয়ে চুলের গোড়ায় লাগান। গরম পানিতে তোয়ালে ভিজিয়ে মাথায় পেঁচিয়ে রাখুন ১০ মিনিট। তারপর শ্যাম্পু করুন। খুশকি কমে যাবে।
- ২ টেবিল চামচ তিলের তেল নিবেন, এর সাথে নরমাল হেয়ার-এর জন্য একটা ডিম (অয়েলি হেয়ার-এর জন্য দুটো ডিমের সাদা অংশ এবং শুষ্ক চুলের জন্য দুটো ডিমের কুসুম) মিশিয়ে নিয়ে পুরো চুলে লাগিয়ে নিন। ত্রিশ মিনিট রেখে ঠাণ্ডা পানি দিয়ে শ্যাম্পু করে নেবেন। সপ্তাহে দুইবার করলেই দেখবেন, মাস খানেকের মধ্যেই চুল সুন্দর হয়ে যাবে।
তিলের তেলের উপকার : ত্বকের যত্নে তিলের তেল
- প্রতিদিন রাতে শোবার আগে ত্বক পরিষ্কার করে কয়েক ফোঁটা তিলের তেল লাগান মুখে। শুষ্ক ত্বক হলে কয়েক মিনিট অপেক্ষা করে আলাদা করে ময়েশ্চারাইজার লাগান। এটি ত্বককে ময়েশ্চারাইজড রাখার পাশাপাশি রোদে পোড়া দাগ ও বলিরেখা কমাতে সাহায্য করবে।
- নিয়মিত ব্যবহারে তিলের তেলের অ্যান্টি-ব্যাকটেরিয়াল উপাদান ব্রণ সারিয়ে তুলবে। রাতে শোবার আগে অ্যালোভেরা জেলের সঙ্গে কয়েক ফোঁটা তিলের তেল মিশিয়ে ত্বকে লাগান। নিয়মিত ব্যবহারে ব্রণ মিলিয়ে যাবে।
- অন্য তেলের তুলনায় বেশিক্ষণ ত্বকের আর্দ্রতা ধরে রাখে তিলের তেল। তাই বডি ম্যাসাজ অয়েল হিসেবে দারুণ কাজ করে। নিয়মিত তিলের তেল লাগালে বলিরেখা ও মেছতা দূরে থাকবে।
- সপ্তাহে এক দিন গোসলের আগে সারা শরীরে তিলের তেল ম্যাসাজ করুন। এতে শরীরে রক্ত চলাচল বৃদ্ধির পাশাপাশি ত্বক কোমল ও আর্দ্র থাকবে দীর্ঘক্ষণ।
- হাত ও পায়ের ত্বকে ভেজা অবস্থায় বডি লোশনের সঙ্গে কয়েক ফোঁটা তিলের তেল মিশিয়ে নিলে স্কিন সফট থাকবে দিনভর।
- তিলের তেলে অ্যান্টি-ব্যাকটেরিয়াল এবং অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি উপাদান থাকায়, যাদের প্যাচি স্কিন বা ত্বকে দাগ ছোপ আছে, তারা দিনে দুই বার এই অয়েল হালকা করে ম্যাসাজ করে ১৫ মিনিট রেখে দিয়ে, গরম পানিতে ভেজানো তোয়ালে দিয়ে মুছে নিলে, স্কিনটোন অনেকটাই ইভেন হয়ে যাবে।
- বয়স বিশের পরে তিলের তেল ব্যবহার শুরু করা উচিত। এই তেলে প্রচুর অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট থাকে বলে এটি অ্যান্টি-এজিং এর কাজ করে। মুখ ভালোভাবে পরিষ্কার করে নিয়ে এই তেল কয়েক ফোঁটা ভালোভাবে অ্যান্টিক্লক ওয়াইজ ম্যাসাজ করবেন। এরপরে গরম পানিতে ভেজানো তোয়ালে মুখের ওপর এক মিনিট পেতে রেখে মুছে ফেলুন।
- অ্যান্টি-ব্যাকটেরিয়াল উপাদান থাকায় তিলের তেল একনে সমস্যাতেও দারুণ কাজ দেয়। একটা কথা মনে রাখবেন- যেকোনো তেলই কিন্তু বিভিন্নভাবে আমাদের উপকার করে, কিন্তু তেল লাগিয়ে মুখে কখনোই রেখে দেয়া ঠিক না, কেননা তেল ধুলাবালি টেনে নেয়, তাই প্রয়োজনমত ব্যবহার করে মুছে ফেলতে হবে। তিলের তেল অ্যালভেরা জেলের সাথে মিশিয়ে ব্যবহার করলে বেশ ভালো রেজাল্ট পাবেন। ১৫ মিনিট রেখে ধুয়ে ফেলবেন।
- এই তেল একটি অসাধারণ ময়েশচারাইজার। পাশাপাশি এতে ডিটক্সিফাইং উপাদান থাকায় শুষ্ক ডেড সেল দূর করে ত্বককে সফট ও হাইড্রেটেড করে তোলে। রাতে ঘুমানোর আগে দু ফোঁটা তিলের তেল যেকোনো ক্রিমের সাথে মিশিয়ে ফেইসে অ্যাপ্লাই করবেন। চাইলে এই তেল আপনি আপনার পছন্দের ফেইস প্যাকেও লাগাতে পারেন, তবে খুব বেশি না, দুই থেকে তিন ফোঁটা পরিমাণে।
- সানবার্ন দূর করতে গোসলের আগে ভালোভাবে তিলের তেল সারা শরীরে, যেমন হাত, পা, মুখ, গলা, ঘাড় ভালোভাবে মালিশ করে গরম পানি দিয়ে গোসল করে নিন। এভাবে কয়েকদিন করলে ভালো উপকার পাবেন। এ ছাড়াও যারা নিয়মিত সুইমিং পুলে যান, তাদেরও ক্লোরিন পানিতে স্কিন-এর বেশ সমস্যা হয়। তাই সুইমিং পুলে নামার আগে তিলের তেল মেখে নিলে ক্লোরিন আপনার ত্বকের কোন ক্ষতিই করতে পারবে না।
উকুন দূর করতে পারে তিলের তেল
উকুন দূর করতে অনেকেই বিশেষ সাবান বা শ্যাম্পু ব্যবহার করেন যেগুলো উকুন দূর করার পাশাপাশি চুলকে ফ্রি-ভাবে রুক্ষ করে দেয়। ঘরোয়া রেমেডি হিসেবে, প্রয়োজন অনুযায়ী তিলের তেলের মধ্যে নিম পাতা নিয়ে, একটু মাইক্রোওভেন এ গরম করে স্ক্যাল্প এ লাগান। পুরো চুলে ভালো করে লাগাতে হবে নইলে উকুন দূর হবে না। দু ঘণ্টা পরে শ্যাম্পু করে ফেলুন। নিয়মিত ব্যবহারে উকুন দূর হবে প্লাস চুলে শাইন আসবে।
কীভাবে খাবেন তিল?
- প্রথমে একটি প্যানে কিছু তিলের বীজ ভেজে নিন। তারপর তা দুধে বা পানিতে মিশিয়ে খেতে পারেন। চাইলে সালাদ ও স্মুদিতে রোস্টেড তিলবীজ মিশিয়ে দিতে পারেন, তাতেও উপকার মিলবে।
- আবার রোস্টেড বা ভাজা তিল এমনিও খাওয়া যায়। তাতে কিছুটা গুড়ও মিশিয়ে নিতে পারেন। বাজারে তিলের তেল পাওয়া যায়। কিছু কিছু রান্না তিলের তেলে করতে পারেন।
- তিলের বীজের সঙ্গে রসুন, লেবুর রস, লবণ মিশিয়ে পেস্ট তৈরি করুন। এই মিশ্রণ রান্নায় ব্যবহার করতে পারেন। সস হিসেবেও তিল খাওয়া যায়।