অলস দুপুর কিংবা মন খারাপের রাতে যদি মনের সুরখানা টুং টাং করে বাজিয়ে নিতে পারো, তবেই খুলে যাবে আনন্দের ঝাঁপি। কারো পছন্দ তারের ঝংকার, আবার কি-বোর্ড, হারমোনিয়ামে কারো আঙুল খেলা করে প্রজাপতির ছন্দে। তোমাদের পছন্দের বাদ্যযন্ত্র নিয়ে লিখেছেন মুসাররাত আবির জাহিন
দেশীয় বাদ্যযন্ত্রের পাশাপাশি কিশোর-কিশোরীদের আজকাল আধুনিক বাদ্যযন্ত্রও দেখা যাচ্ছে। কে কোন বাদ্যযন্ত্র বাজাচ্ছে, আর কেনই বা বাজাচ্ছে, সেটা তোমাদের জানাতেই আজকের এ আয়োজন।
ক্লাস এইটে থাকতে শখের বশে গিটার কেনে নাশিতা তাহসিন খান। এখন সে ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের দ্বাদশ শ্রেণিতে পড়ে। প্রথমে নিজে নিজে বাজানোর চেষ্টা করত। গিটার কেনার প্রায় আড়াই বছর পর, বন্ধুবান্ধবদের কাছ থেকে আজিমপুরের হিমু ভাইয়ার নাম শুনে তাঁর কাছে তালিম নিতে শুরু করে নাশিতা। কর্ড শিখে গান বাজাতে পারলেও গিটারে ‘প্লাকিং’ আর ‘সলো’ যুক্ত করতে পারলে সৌন্দর্য অনেকখানি বেড়ে যায়।
গিটার বাজাতে গিয়ে মজার অভিজ্ঞতাও হয়েছিল তার। কদিন আগে কলেজের নবীনবরণের অনুষ্ঠানে নাশিতা ও তার কিছু বান্ধবী মিলে গান গেয়েছিল। কিন্তু কেউই অনুশীলন করার সময় পায়নি। সবাই মঞ্চে ওঠার পাঁচ মিনিট আগে তাড়াহুড়ো করে একসঙ্গে গানটা তুলে নেয় ওরা। মঞ্চে দাঁড়ানোর আধাঘণ্টা আগে নাশিতা যখন ব্যাকস্টেজে বসে বসে গিটার অনুশীলন করছিল, তখনই পরপর তিনটা তার ছিঁড়ে যায়! মহা ফাসাদে পড়ে যায় নাশিতা! এর আগে কখনোই নিজে নিজে গিটারের তার ঠিক করেনি। চটজলদি ইউটিউব ঘেঁটে কিভাবে গিটারের তার ঠিক করতে হয়, সেটা দেখে নিল। এরপর মাথা খাটিয়ে কোনো রকমে তার ঠিক করে স্টেজে উঠে পড়ে। সেদিনের তাড়াহুড়ো আর টেনশনটা সে নাকি জীবনেও ভুলবে না।
গিটার বাজিয়ে নাশিতা প্রথম পারফর্ম করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আয়োজিত ঢাকা ইউনিভার্সিটি মডেল ইউনাইটেড নেশনস ২০১৮-এর গালা নাইটে। এরপর বুয়েট টিচার্স ক্যাম্পাসের পৌষ সন্ধ্যায়ও গিটার বাজিয়েছিল সে।
গিটারের পাশাপাশি নাশিতা উকুলেলে ও কি-বোর্ডেও পারদর্শী। উকুলেলে গিটার থেকে একটু আলাদা। ছোটখাটো মিষ্টি একটা বাদ্যযন্ত্র। গিটারে ছয়টা তার, উকুলেলেতে চারটা। ইউটিউবে দেখেই ওটা শিখেছে নাশিতা।
গিটার আর উকুলেলে কেন? নাশিতা বলল, ‘গিটার বেশ বৈচিত্র্যময়। যেকোনো গানের সঙ্গে এটা শুনতে ভালো লাগে। রবীন্দ্রসংগীত কিংবা আধুনিক, গিটার হলে আড্ডা জমে যায়। আর উকুলেলে থেকে বেশ মিষ্টি সুর বের হয়। লোকগীতির সঙ্গে বেশ খাপ খায়।’
ইউটিউবে কিন্তু নাশিতার একটা চ্যানেলও আছে। ইংরেজিতে ‘নাশিতা তাহসিন খান’ লিখে সার্চ দিলেই চলে আসবে। প্রায়ই সে তার চ্যানেলে বিভিন্ন গানের কভার আপলোড করে।
ফেসবুকের ভালো দিকগুলোর এক অন্যতম দিক হলো, এর মাধ্যমে নানা ধরনের প্রতিভাবান মানুষদের খোঁজ পাওয়া যায়। শহীদ বুদ্ধিজীবী মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজের নবম শ্রেণির ছাত্রী ইন্নিমা রশ্মির খোঁজ পাই ফেসবুকেই। নিউজফিড স্ক্রল করতে হঠাৎ একটা ভিডিওতে চোখ আটকে যায়। একটা মেয়ে এত সুন্দর করে কিভাবে ভায়োলিন বাজায়! ভাবছিলাম আর মুগ্ধ হয়ে ভিডিওটা দেখছিলাম।
কিভাবে বেহালা শিখলে—জিজ্ঞেস করতেই রশ্মি তার গল্পের ঝাঁপি খুলে বসল।
‘বাসায় আগে থেকে দু-তিনটি বেহালা পড়ে থাকলেও কেন জানি ওগুলো বাজানোর ইচ্ছা কখনোই মনে জাগেনি। যখন দেখলাম, আমার বাবা খুব মনোযোগ দিয়ে বেহালাচর্চা শুরু করেছেন, তখনই মনে হলো, বাবার আবার কী হলো? খুব বেহালা বাজাচ্ছেন যে!
পরে জানতে পারলাম, আমার বাবা ভায়োলিন একাডেমিতে ভর্তি হয়েছেন এবং তাঁর মতো আরো অনেকেই সেখানে বাদ্যযন্ত্র বাজানো শিখছেন। তো আমি কি আর বসে থাকতে পারি! আমিও আগ্রহী হয়ে গেলাম এবং গোপনে বাসায় বাজানো শুরু করলাম। মা-বাবা কেউ কিন্তু জানত না। একাডেমিতে শেখার আগেই দেখা গেল, আমি বেহালায় কয়েকটা গান তুলে ফেলেছি। মা-বাবা যখন জানতে পারলেন যে আমি বাজাই, তখন তাঁরা আমাকে ওই একাডেমিতে ভর্তি করিয়ে দিলেন। সেদিন কী যে ভালো লাগছিল!
রশ্মির ভায়োলিন শেখা শুরু হয় ওস্তাদ শাহীন আলীর তত্ত্বাবধানে মিরপুর-১-এর ‘ভূপালী সংগীত একাডেমি’তে। ছোট্ট প্রতিষ্ঠান হলেও প্রচুর ছাত্র-ছাত্রী। ২০১৪ বা ২০১৫ সালে ভর্তি হওয়ার পর প্রায় তিন-চার বছর সেখানে শিখেছে রশ্মি। সবার ছোট হলেও ওস্তাদের সবচেয়ে প্রিয় ছাত্রী ছিল সে। সা-রে-গা-মা থেকে ধীরে ধীরে রাগ-উচ্চাঙ্গসংগীতও তুলতে শুরু করল বেহালায়।
বেহালা নিয়ে মজার কোনো গল্প আছে কি না জানতে চাইলে সে বলল, ‘একদিন এক মঞ্চে বাজাতে গিয়ে হঠাৎ দেখি, হারমোনিয়াম আর বেহালার স্কেল মিলছে না। কিন্তু যে হারমোনিয়াম বাজাচ্ছিল, সে তা টের পাচ্ছে না। আমি বাজানো বাদ দিয়ে ফিক করে হেসে ফেললাম। আরো অনেক মজাই করতাম একাডেমিতে। একাডেমিটা নিজের ঘরের মতো ছিল।
বয়সে ছোট হলে কী হবে, রশ্মি কিন্তু এখনই চার-পাঁচটা অনুষ্ঠানে নিজের প্রতিভার কারিশমা সবাইকে দেখিয়ে দিয়েছে! মানিকগঞ্জে তাদের বাড়িতেই একটা মেলা হয়, সেখানেও সে বেহালা বাজিয়ে প্রশংসা কুড়িয়েছে।
ভায়োলিনই কেন? রশ্মির মতে, বেহালার সুরে একটা অন্য রকম মায়া, অনুভূতি, আবেগ থাকে। যা সে আর কোনো বাদ্যযন্ত্রে পায়নি। ভায়োলিনের সুর মন নরম করে দেয়।
বেসবাবাখ্যাত সুমনের বড় ভক্ত নটর ডেম কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির তাহজিন মুনির অর্ক। একবার অর্থহীন ব্যান্ডের কনসার্টে গিয়ে এপিটাফ গানে গিটার বাজাতে দেখে তারও গিটারে গানটা তোলার ইচ্ছা জাগে। গিটার কেনার প্রথম চার মাস সে ইউটিউবে নানা ভিডিও ঘেঁটেঘুঁটে বেসিক জিনিসগুলো শিখে নেয়। তারপর সাদি আল মুক্তাফির কাছে অর্কর প্রাতিষ্ঠানিক হাতেখড়ি। মুক্তাফি পেশায় একজন ডাক্তার হলেও ব্যান্ডদল ‘ক্রাল’-এর গিটারিস্ট তিনি। দেড় বছর হয়ে গেল, তার কাছ থেকে এখনো গিটার বাজানো শিখছে অর্ক।
যখন নতুন নতুন গিটার বাজানো শিখছিল, তখন হঠাৎ করেই অর্কর গিটারের স্ট্রিং ছিঁড়ে যায়! ভয়ের কারণে পাঁচ দিন গিটার ধরেইনি সে! পরে জানতে পারল, গিটার বাজাতে গেলে তার ছিঁড়ে যাওয়াটা মামুলি ব্যাপার!
ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির তাসনিম কবির বৃষ্টি। বৃষ্টিকে কখনো দুবার বলতে হয় না যে গান গাও। তার মতে, যে গান ভালোবাসে, গান করতে তার কখনোই আপত্তি থাকবে না।
বৃষ্টি যখন একেবারে ছোট্ট, তখন থেকেই তার নানা ধরনের বাদ্যযন্ত্র বাজানোর শখ। তার বয়স যখন পাঁচ, তখনই তার মা বৃষ্টির হাতে হারমোনিয়াম তুলে দেন। মায়ের কাছ থেকেই বৃষ্টির সা-রে-গা-মা-পার হাতেখড়ি। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই বৃষ্টি হারমোনিয়াম বাজানো রপ্ত করে ফেলে। আস্তে আস্তে স্কুল-কলেজের অনুষ্ঠানে তার গান গাওয়া শুরু হয়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গানের অনুষ্ঠান মানেই বৃষ্টিকে সবার চাই-ই চাই!
এরপর ‘জলের গান’ ব্যান্ডের জার্নাল ভাইকে দেখে অনুপ্রাণিত হয় বৃষ্টি ঝটপট একটা শেকার কেনে। নিজের ঝুমুর আর শেকার দিয়ে নিজেই একটা অন্য রকম বাদ্যযন্ত্র বানিয়ে বসে! আর মজার ব্যাপার হলো, নিজের তৈরি বাদ্যযন্ত্রটা দিয়ে সে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা কনসার্টে গানও গেয়েছে! বৃষ্টি কিন্তু বেশ ভালো কি-বোর্ডও বাজায়।
গত বছর বৃষ্টিও একটা উকুলেলে কিনেছে। কিন্তু সে যেহেতু বাঁহাতি, তাই ওটা বাজাতে বেশ অসুবিধা হতো। এরপর সে তার উকুলেলেতে লেফটি সেটিং করিয়ে সমস্যাটা দূর করে ফেলে। ইউটিউব দেখেই উকুলেলের ওপর দখল এনেছে বৃষ্টি। এটাই এখন তার অবসরের সঙ্গী।
সিদ্ধেশ্বরী গার্লস কলেজের একাদশ শ্রেণির ছাত্রী সাইয়ারা কবির অতসী। সে আবার সব্যসাচী। একসঙ্গে অনেক কিছু বাজায়। ঘরের তৈজসপত্র দিয়েও মাঝেমধ্যে বাদ্যযন্ত্র বানিয়ে চমকে দেয়! কয়েক দিন আগে সে নাকি গিটার আর চামচ দিয়ে একটা গান গেয়ে সবাইকে মুগ্ধ করে দিল! তবে অতসীর মূল ভালো লাগা দোতারা। শুরুতে অন্য অনেকের মতো বাধ্যতামূলকভাবে হারমোনিয়াম শিখতে হয়েছিল বটে। তবে অতসীর ইচ্ছা ছিল নানা ধরনের বাদ্যযন্ত্র নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করার। কিছুদিন তবলাও শিখেছিল। ক্লাস ফাইভে থাকতে দোতারা নিয়ে একটি প্রতিবেদন তার চোখে পড়ে। তখন থেকেই দোতরার সুর ভাঁজতে থাকে মনে মনে। জেএসসির পর ইউটিউব ঘেঁটে বেশ কিছু টিউটরিয়ালও আবিষ্কার করে। দোতারা দেখতে সহজ-সরল মনে হলেও এটা শিখতে অতসীর প্রায় এক বছরের মতো লেগেছে। দোতারা নিয়ে সে একবার একটি অনুষ্ঠানেও গিয়েছিল। সেদিনকার কষ্টদায়ক ব্যাপার হলো, গানের মাঝে দোতারার তারটা হঠাৎ করেই ছিঁড়ে গিয়েছিল।
অতসী জানাল, ‘বাদ্যযন্ত্র এমন এক বস্তু, যেটা সমুদ্রের পাশে কিংবা রুমের এক কোণে বসে বাজাতেও ভালো লাগবে। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, পুনর্মিলনী, বিশেষ দিবসসহ আরো অনেক জায়গায় বাজানো হলেও মূলত নিজের মনের শান্তির জন্যই বাজাই।
দোতারা আর বাঁশির প্রতি তার আকর্ষণ বেশি। অতসী জানাল, ‘দোতারা বাজালে মনে হয় দেশের সঙ্গে মিশে গেছি, নদীর সঙ্গে মিশে গেছি। তবে এখনো অনেক শেখা বাকি।’