Friday, March 29
Shadow

ক্ষতিগ্রস্তদের পাশে দাঁড়াতে ইসলামের বিধান

যে ব্যক্তি শুধু প্রথাগত ইবাদত করে কিন্তু আল্লাহর রাস্তায়, বিপদগ্রস্ত ও আর্তমানবতার কল্যাণের জন্য দান-খয়রাত, জাকাত সাদকা ত্যাগ-তিতিক্ষা ও সাহায্য-সহযোগিতায় এগিয়ে আসে না, সমাজের অসহায়, দুর্গত, ক্ষতিগ্রস্ত গরিব-দুঃখী মানুষের অভাব দূরীকরণ, চরম ক্ষুধা নিবারণ ও দারিদ্র্য বিমোচনে দানের হাত সম্প্রসারণ করে তাদের পাশে দাঁড়ায় না, ত্রাণ ও পুনর্বাসনের কাজে অংশগ্রহণ করে না, সে আল্লাহ ও তার রাসুল (সা.)-এর কাছে কখনোই প্রিয়ভাজন হতে পারবে না

সম্প্রতি রাজধানীর বঙ্গবাজারে ভয়াবহ অগ্নিদুর্ঘটনায় ছাই হয়ে গেছে ছয়টি মার্কেটের পাঁচ থেকে ছয় হাজার দোকান। সর্বস্ব হারিয়ে নিঃস্ব হয়েছে দোকান মালিকসহ প্রায় ৫০ হাজার পরিবার। দেশের অর্থনীতিতে অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে। অগ্নিদুর্ঘটনাসহ সব ধরনের বিপর্যয় সৃষ্টির অন্যতম কারণ মানুষের কৃতকর্ম। পবিত্র কোরআনে বর্ণিত হয়েছে, ‘স্থলে ও জলে মানুষের কৃতকর্মের দরুন বিপর্যয় ছড়িয়ে পড়েছে। আল্লাহ তাদের কর্মের শাস্তি আস্বাদন করাতে চান, যাতে তারা ফিরে আসে।’ (সুরা রুম : ৪১)। আসলে এমন কোনো অন্যায় অপরাধ ও পাপাচার নেই যা মানুষ থেকে সংঘটিত হচ্ছে না। এ অবস্থায় আমাদের পাপাচার পরিত্যাগ করে আল্লাহর দিকে ফিরে যাওয়ার বিকল্প নেই। অনেক সময় এসব দুর্ঘটনা দ্বারা মানুষকে পরীক্ষা করা হয়। পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ বলেন, ‘আর আমি অবশ্যই তোমাদের পরীক্ষা করব কিছু ভয়, ক্ষুধা এবং জানমাল ও ফলফলাদির স্বল্পতার মাধ্যমে। আর তুমি ধৈর্যশীলদের সুসংবাদ দাও। যারা তাদের যখন বিপদ আক্রান্ত করে তখন বলে, নিশ্চয়ই আমরা আল্লাহর জন্য এবং নিশ্চয়ই আমরা তার দিকে প্রত্যাবর্তনকারী। তাদের ওপরই রয়েছে তাদের রবের পক্ষ থেকে মাগফিরাত ও রহমত এবং তারাই হিদায়াতপ্রাপ্ত।’ (সুরা বাকারা : ১৫৫-১৫৭)। তাই এ ভয়াবহ দুর্ঘটনায় ভেঙে না পড়ে আল্লাহর ওপর ভরসা রেখে এ ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার সর্বাত্মক চেষ্টা করা উচিত।

আগুন আমাদের জীবনে অনিবার্য প্রয়োজন। আগুনের নানাবিধ ব্যবহারে সচল থাকে আমাদের জীবনযাত্রা। তবে জীবনের অপরিহার্য এই আগুন কখনো কখনো আমাদের জীবনে সীমাহীন বিপর্যয় ও দুর্ভোগ ডেকে আনে। ঘরবাড়ি, মার্কেট-শপিং মল আগুনের ভয়াল তাণ্ডবে লন্ডভন্ড হয়ে যায়। আগুন তার দানবীয় রূপ ধারণ করার ক্ষেত্রে অনেক সময় আমাদের অবহেলা আর গাফিলতি কারণ হিসেবে দেখা দেয়। বিশেষত রাতের বেলায় অগ্নিকাণ্ড বেশি ঘটে। কারণ রাতের বেলায় আগুন, বিদ্যুৎ এগুলো বেশি ব্যবহৃত হয়। তাই রাতের বেলায় আগুন ব্যবহারে সতর্কতার বিকল্প নেই। রাসুলুল্লাহ (সা.) এ বিষয়ে সতর্ক করেছেন। তিনি রাতে ঘুমানোর আগে এমন জিনিসগুলোকে সতর্কতার সঙ্গে সামলে রাখার নির্দেশ দিয়েছেন, যেগুলো রাতের বেলায় অগ্নিদুর্ঘটনার সূত্রপাত ঘটাতে পারে। সাহাবি জাবের (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘রাতে ঘুমের আগে তোমরা দরজা বন্ধ করবে, পানির পাত্রের মুখ বাঁধবে, পাত্রগুলো উল্টে রাখবে কিংবা পাত্রগুলো ঢেকে রাখবে, বাতি নিভিয়ে দেবে। কেননা শয়তান বন্ধ দুয়ার খুলতে পারে না, মশকের গিঁট খুলতে পারে না, পাত্রের মুখও অনাবৃত করতে পারে না। (বাতি নিভিয়ে দেবে) কেননা দুষ্ট ইঁদুরগুলো লোকদের ঘরে আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে দেয়।’ (তিরমিজি : ১৮১৯)। নবীজীর আদর্শ ও নির্দেশনা অনুসরণ করলে রাত্রিকালীন অনেক দুর্ঘটনা থেকে নিরাপদ হওয়া সহজ হয়ে যায়। বর্তমান যুগেও রাতে ঘুমানোর আগে আমাদের ঘরের যেসব জিনিস রাতের বেলা বিপদের কারণ হতে পারে, সেগুলো সামলে ঘুমানো উচিত।

কোথাও আগুন লাগলে হতাশ না হয়ে আগুন নেভানোর ক্ষেত্রে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করার পাশাপাশি কিছু দোয়া ও আমলের শিক্ষা দেয় ইসলাম। সাহাবি আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) বলেন, নবীজী (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা যখন কোথাও আগুন লাগতে দেখো, তখন তোমরা তাকবির দাও। কারণ তাকবির আগুন নিভিয়ে দেয়। (তাবরানি : ১/৩০৭)। তাকবির হলো—আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার। অর্থ, আল্লাহ মহান, আল্লাহ মহান। ইমাম ইবনে তাইমিয়া (রহ.) বলেন, ‘আগুন যত প্রলয়ংকরী হোক; তাকবিরের মাধ্যমে তা নিভে যায়। আর আজানের মাধ্যমে শয়তান পলায়ন করে।’ (আল-ফাতাওয়া আল-কুবরা : ৫/১৮৮)। পবিত্র কোরআনের একটি আয়াত রয়েছে, যেটি পড়লে আগুন নেভাতে প্রভাব রাখে এবং আগুনের ক্রিয়া নিস্তেজ হয়ে যায়। হজরত ইবরাহিম (আ.)-কে আগুন যেন স্পর্শ না করে, সে নির্দেশ দিয়েছিলেন মহান আল্লাহতায়ালা। পবিত্র কোরআনে আল্লাহতায়ালা ইরশাদ হয়েছে, ‘ইয়া নারু, কু-নি বারদান ওয়া সালামান আলা ইবরাহিম। অর্থ, ‘হে আগুন! তুমি ইবরাহিমের জন্য শীতল ও নিরাপদ হয়ে যাও।’ (সুরা আম্বিয়া : ৬৯)। এ ছাড়া আগুন লাগলে বিভিন্ন বর্ণনায় আজান দেওয়ার কথা উল্লেখ রয়েছে।

এ ধরনের বিপদে বিপদগ্রস্তদের সাহায্যে এগিয়ে আসা মানবতার দাবি এবং সর্বোত্তম ইবাদত বলে বিবেচিত। তাই প্রত্যেক মুমিন মুসলমানকে নামাজ, রোজা, হজ, জাকাতসহ অন্যান্য ইবাদতের সঙ্গে বিপদগ্রস্ত মানুষের সহায়তায় এগিয়ে আসার মতো মানবিক ও নৈতিক গুণাবলি অর্জন জরুরি। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ ঘোষণা করেছেন, ‘পূর্ব ও পশ্চিম দিকে তোমাদের মুখ ফেরানোয় কোনো পুণ্য নেই। কিন্তু পুণ্য আছে কেউ আল্লাহ, পরকাল, ফেরেশতারা, সব কিতাব এবং নবীদের প্রতি ইমান আনয়ন করলে এবং আল্লাহ-প্রেমে আত্মীয়স্বজন, এতিম, মিসকিন, পর্যটক, সাহায্য প্রার্থীদের এবং দাস মুক্তির জন্য অর্থদান করলে, নামাজ প্রতিষ্ঠা করলে ও জাকাত প্রদান করলে এবং প্রতিশ্রুতি দিয়ে তা পূর্ণ করলে, অর্থ সংকটে, দুঃখ ক্লেশে ও সংগ্রাম-সংকটে ধৈর্য ধারণ করলে। এরাই তারা যারা সত্যপরায়ণ এবং তারাই মুত্তাকি।’ (সুরা বাকারা : ১৭৭)।

ইসলামের শিক্ষা অনুযায়ী মানুষ যখন ক্ষতিগ্রস্ত ও বিপদগ্রস্ত হয়, তখন তার ধর্মের ভাই অন্য মানুষকে বিপদ-আপদ থেকে মুক্তির জন্য পাশে দাঁড়াতে হয়। অসহায় মানুষের দুর্দিনে তাদের সর্বপ্রকার আর্থিক সহায়তা, ত্রাণ ও পুনর্বাসন, চিকিৎসাসেবায় এগিয়ে আসা ইমানের দাবি। ইসলামে পারস্পরিক উপকারের চেষ্টা এবং যার যা কিছু সামর্থ্য আছে তদনুসারে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষকে সাহায্য-সহযোগিতা করতে তাগিদ দেওয়া হয়েছে, যাতে দুর্দশাগ্রস্ত মানুষের দুঃখ-কষ্ট কিছুটা লাঘব হয়। নবী করিম (সা.) বলেছেন, ‘একটি খেজুরের অর্ধাংশ দিয়ে হলেও দোজখ থেকে বাঁচবে। আর তা যদি না থাকে, তাহলে অসহায়, অভাবী ও হতদরিদ্রদের সঙ্গে মিষ্টি কথা বলবে, ভালো ব্যবহার করবে, যাতে পরকালে তোমার নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়।’ ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সাহায্যার্থে মোটা অঙ্কের অর্থ দান করতে হবে, এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। সাহায্য করতে শুধু টাকা-পয়সা দিয়েই নয়, বিপদগ্রস্ত মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে সহমর্মিতা ও আন্তরিকতার সঙ্গে সেবা করেও মানুষকে সহযোগিতা করা যায়। ইসলাম মানবিক কারণে সামান্য পরিমাপ সহায়তাও খাটো করে দেখে না। সে জন্য অতিশয় নগণ্য পরিমাপ দানকেও উৎসাহিত করা হয়েছে। রাসুলুল্লাহ (সা) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি দান-সাদকা দেয়, তা একটি খেজুর পরিমাপও হোক না কেন, আল্লাহ তা নিজ হাতে গ্রহণ করেন। তবে শর্ত এই যে, তা বৈধপথে উপার্জিত হতে হবে, কেননা আল্লাহ এ বস্তুকেই পছন্দ করেন এবং তা বৃদ্ধি করে নেন আর তা এতটাই যে, এ খেজুর এক পাহাড় পরিমাপ হয়ে যায়।’ (বুখারি ও মুসলিম) এ প্রসঙ্গে পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘হে মুমিনগণ! আমি তোমাদের যে জীবনের উপকরণ দিয়েছি, তা থেকে তোমরা ব্যয় কর সেদিন আসার আগেই যেদিন কোনো বেচাকেনা বন্ধুত্ব এবং সুপারিশ থাকবে না।’ (সুরা বাকারা : ২৫৪)

তবে সাহায্যকারীর এ দান যাতে কোনোভাবেই লোক দেখানো না হয় সে ব্যাপারে ইসলামে বারবার সতর্ক করা হয়েছে। হাদিস শরিফে বর্ণিত আছে, ‘রোজ কিয়ামতের দিন মানুষ বর্ণনাতীত ক্ষুধা-পিপাসা নিয়ে উলঙ্গ অবস্থায় উত্থিত হবে। যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য দুনিয়াতে মানুষকে খাদ্য দান করেছে, সেদিন তাকে খাদ্য দান করা হবে। যে আল্লাহকে খুশি করার জন্য মানুষকে পানি পান করিয়েছে, তাকে সেদিন পানি পান করিয়ে তার পিপাসা দূর করা হবে। যে মানুষকে বস্ত্র দান করেছে, তাকে সেদিন বস্ত্র পরিধান করিয়ে তার লজ্জা নিবারণ করা হবে।’ অন্য হাদিসে উল্লেখ আছে, হাশরের ময়দানে বিচার শেষ না হওয়া পর্যন্ত দানশীল লোকেরা তাদের দানের ছায়ার নিচে অবস্থান করবে।’ (মেশকাত)

রাসুলুল্লাহ (সা.) সবসময় অন্যের বিপদ-আপদ ও দুঃখ-কষ্ট মাথায় রেখে উম্মতদের জীবনযাপনের পরামর্শ দিয়েছেন। তিনি নিজেও বিপদে-আপদে রুগ্‌ণ মানুষের সেবা করেছেন, অন্যদের দান-সাদকা ও বিভিন্নভাবে সাহায্য-সহযোগিতা করার ব্যাপারে উৎসাহিত করে বলেছেন, ‘তোমরা দান-সাদকা কর। এতে আল্লাহ খুব খুশি হন ও দানকারীর সম্পদ বাড়িয়ে দেন। যে ব্যক্তি শুধু প্রথাগত ইবাদত করে কিন্তু আল্লাহর রাস্তায়, বিপদগ্রস্ত ও আর্তমানবতার কল্যাণের জন্য দান-খয়রাত, জাকাত সাদকা ত্যাগ-তিতিক্ষা ও সাহায্য-সহযোগিতায় এগিয়ে আসে না, সমাজের অসহায়, দুর্গত, ক্ষতিগ্রস্ত গরিব-দুঃখী মানুষের অভাব দূরীকরণ, চরম ক্ষুধা নিবারণ ও দারিদ্র্য বিমোচনে দানের হাত সম্প্রসারণ করে তাদের পাশে দাঁড়ায় না, ত্রাণ ও পুনর্বাসনের কাজে অংশগ্রহণ করে না, সে আল্লাহ ও তার রাসুল (সা.)-এর কাছে কখনোই প্রিয়ভাজন হতে পারবে না।’ (মেশকাত)। আল্লাহ সবাইকে বোঝার ও আমল করার তাওফিক দান করুন।

মানবিক বিপর্যয় ও দুর্যোগ মোকাবিলায় বিপদাপন্ন মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে আর্তের সেবায় প্রত্যাশিত ভূমিকা রেখে অসহায় মানুষকে বাঁচানোর এখনই সময়। মানুষ দাঁড়াবে বিপদগ্রস্ত মানুষের পাশে এটাই ইসলামের বিধান। পবিত্র কোরআনে আল্লাহতায়ালা ঘোষণা করেছেন, ‘পৃথিবীর ওপর যা কিছু আছে আমি সেগুলোকে এর শোভা করেছি, মানুষকে এ পরীক্ষা করার জন্য যে, তাদের মধ্যে কর্মে কে শ্রেষ্ঠ।’ (সুরা আল কাহফ, আয়াত : ৭)।

লেখক : মুফতি আরিফ খান সাদ , ইসলামী চিন্তাবিদ ও গবেষক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Please disable your adblocker or whitelist this site!

error: Content is protected !!