‘অ্যানিমেশন’ যাঁরা করেন, তাঁরা কী করেন? অথবা অ্যানিমেশনে কেরিয়ার কী? এককথায় বলতে গেলে, কোনও নিষ্প্রাণ বস্তু, দ্বিমাত্রিক (টু-ডি) বা ত্রিমাত্রিক (থ্রি-ডি) যা-ই হোক না কেন, প্রযুক্তির ব্যবহারে তাকে প্রাণবন্ত করে তোলেন। এটাই অ্যানিমেশন শিল্প। এই কাজটিকেই লাতিন ভাষায় বলে ‘অ্যানিমা’। এই শব্দ থেকেই অ্যানিমেশন শব্দটির উদ্ভব।
যেসব টম অ্যান্ড জেরি, লায়ন কিং বা মিকি মাউস আমরা দেখি, কোথাও তাদের চলাফেরা, কাজকর্ম বা এক্সপ্রেশন অস্বাভাবিক মনে হয় কি? হয় না, কারণ সেটাই অ্যানিমেটরদের কাজ। তাই শুধু প্রযুক্তির জ্ঞান বা শুধু সৃজনশীলতা নয়, দুইয়ের সঠিক মিশেলই হল ভাল আ্যনিমেটর হিসেবে পরিচিতি পাওয়ার চাবিকাঠি। একই চরিত্রের বিভিন্ন ভঙ্গির একটি সিরিজ় তৈরি করে, তাকে খুব দ্রুত চালনা করে চরিত্রটির মুভমেন্টের একটি ইলিউশন তৈরি করাই আ্যনিমেটরদের প্রধান কাজ।
বর্তমানে অ্যানিমেশন, মিডিয়ার একটি বিশেষ ধরন হিসেবে ক্রমশ জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। দ্বিমাত্রিক থেকে ত্রিমাত্রিক, প্রযুক্তির ক্রমোন্নতির সঙ্গে-সঙ্গে বেড়ে চলেছে অ্যানিমেশন নিয়ে পূর্ণদৈর্ঘ্যের ছবি তৈরির ভাবনাচিন্তা এবং তা তৈরিও হচ্ছে সফলভাবে। সেইভাবেই আয়তনে এবং কাজের ব্যাপ্তিতে ক্রমশ বড় হয়ে উঠছে অ্যানিমেশন ইন্ডাস্ট্রি।
যেহেতু অ্যানিমেশনে কাজের সুযোগ এবং অন্যান্য সুবিধে বাড়ছে, তাই তরুণ প্রজন্মের আরও অনেকেই আগ্রহী হয়ে উঠছে এই পেশায় আসার জন্য। তবে শুধু সুযোগ-সুবিধে, পরিচিতি পাওয়া বা ভাল পে-প্যাকেজ দেখেই এই পেশায় আসতে চাইলে কিন্তু ভুল হতে পারে। মনে রাখতে হবে, অ্যানিমেশন অত্যন্ত পরিশ্রম এবং ধৈর্যের কাজ। অ্যানিমেশন ফিল্মের এক-একটি দৃশ্য তৈরি করতেই কখনও সময় লেগে যেতে পারে বেশ কয়েকদিন, সুতরাং ধৈর্য ধরতে পারা এই পেশার অন্যতম চাহিদা। বর্তমানে বহু আন্তর্জাতিক স্তরে বিখ্যাত অ্যানিমেশন সংস্থা ভারতে প্রচুর অর্থ বিনিয়োগ করেছে, যেখানে ভারতীয়দের প্রতিভা প্রমাণ করার যথেষ্ট সুযোগ থাকছে।
কাজের ধরন
অ্যানিমেশন হল এককথায় একটি নির্দিষ্ট সৃজনশীল পরিকল্পনাকে ভিত্তি করে গড়ে ওঠা একটি টিমওয়র্ক। সকলে মিলে কাজ করে একটি পরিকল্পনার উপর, কিন্তু একটি থ্রি ডি ফিল্মেই অনেক ধরনের কাজ থাকে। সেই কারণে একটি থ্রি ডি ফিল্মের সঙ্গে যুক্ত থাকেন অনেকরকম ডেজ়িগনেশনের পেশাদার মানুষ। একটি থ্রি ডি অ্যানিমেশন ফিল্ম তৈরির অনেকগুলো পর্যায় থাকে, যেমন, স্টোরি, স্টোরি বোর্ডিং, ক্যারেক্টার স্কেচ, কনসেপ্ট ক্রিয়েশন, মডেলিং, এনভায়রনমেন্ট, ক্যারেক্টার ও মেকানিক্যাল অ্যানিমেশন, স্টোরিবোর্ড অ্যানিমেশন, লাইটিং, টেক্সচারিং, ডায়নামিক্স, ভয়েস রেকর্ডিং, ডিজিটাল এডিটিং, ভিএফএক্স ইত্যাদি। সুতরাং একটি থ্রি ডি অ্যানিমেশন তৈরির জন্য যে-যে পেশাদারদের দরকার হয়, তাঁরা হলেন মডেলার, লে-আউট শিল্পী, ক্লিন আপ শিল্পী, স্ক্যানার অপারেটর, ডিজিটাল ইংক ও পেন্ট শিল্পী, কম্পোজ়িটর, কি ফ্রেম অ্যানিমেটর, ব্যাকগ্রাউন্ড শিল্পী, ইনবিটুইন আ্যনিমেটর প্রমুখ। এঁদের প্রত্যেকের সমবেত কুশলতাই একটি অ্যানিমেশন প্রজেক্টের সাফল্যের জন্য অপরিহার্য।
ভাল অ্যানিমেটর হতে গেলে যে-যে গুণ থাকতে হয়
এই পেশায় আসতে গেলে প্রধানত কাজের উপর আগ্রহ থাকতে হবে এবং কাজটাকে ভালবাসতে হবে। ভাল অ্যানিমেটর হওয়ার জন্য অনেকগুলো গুণ থাকা খুব জরুরি। অনেকে মনে করেন ভাল আঁকতে পারলেই ভাল অ্যানিমেটর হতে সুবিধে হয়। ভাল আঁকতে পারার সঙ্গে-সঙ্গে চাই দর্শকদের বয়স এবং পছন্দ অনুসারে ভাবনাচিন্তা করার দক্ষতা, নতুন চরিত্র ভিসুয়ালাইজ় করার দক্ষতা, অভিনয় বিষয়ে কিছুটা জ্ঞান এবং সেন্স অফ হিউমার। সবচেয়ে বড় কথা হল, বিষয়টির প্রতি প্যাশন না থাকলে কখনও দীর্ঘসময় ধৈর্য ও মনোযোগ ধরে রেখে কাজ করার মানসিকতা তৈরি হয় না।
পেশাদার কোর্স এবং স্পেশ্যালাইজ়েশন
অ্যানিমেশন এবং মাল্টিমিডিয়ার আওতায় বিভিন্ন ধরনের ডিপ্লোমা এবং ডিগ্রি কোর্স আছে, এই কোর্সগুলোয় কোনও শিক্ষার্থীকে অ্যানিমেশনের নানারকম স্টাইল ও টেকনিক শেখানো হয়ে থাকে। এরকম কোর্সগুলো হল—
ট্র্যাডিশনাল অ্যানিমেশন,
স্টপ মোশন অ্যানিমেশন,
রোটোস্কোপিং,
কম্পিউটার জেনারেটেড থ্রি ডি এবং টু ডি অ্যানিমেশন,
ক্লে-মেশন,
ফোটোশপ,
হিউম্যান অ্যানাটমি,
ড্রয়িং ইত্যাদি।
পাশাপাশি এই কোর্সগুলো করার পর বেশ কিছু ক্ষেত্রে স্পেশ্যালাইজ়েশনেরও সুযোগ থাকে। থ্রি ডি বা টু ডি মডেলার, স্পেশ্যাল এফ এক্স ক্রিয়েটর, অ্যানিমেটর, ক্যারেক্টার ডিজ়াইনার, গেম্স ডিজ়াইনার, ইন্টার-অ্যাকশন ডিজ়াইনার এইসব বিষয়ে স্পেশ্যালাইজ় করা সম্ভব।
অ্যানিমেশনে ডিপ্লোমা বা ব্যাচেলর ডিগ্রি পেতে হলে যে-কোনও স্বীকৃত বোর্ড বা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে উচ্চ মাধ্যমিক বা সমতুল পরীক্ষায় অন্তত ৪৫ শতাংশ নম্বর নিয়ে পাশ করতে হবে। আ্যনিমেশনে পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ডিগ্রি পাওয়ার জন্য যে-কোনও বিষয়ে স্নাতক হলেই চলে, তবে আর্টসের ছাত্রছাত্রীরাই এ ব্যাপারে অগ্রাধিকার পায়। তবে ছাত্রছাত্রীদের কম্পিউটার এবং প্রযুক্তি বিষয়েও কিছু প্রাথমিক জ্ঞান থাকা আবশ্যক।
তবে কিছু ক্ষেত্রে কোনও-কোনও প্রশিক্ষণকেন্দ্র বা অ্যানিমেশন-সংস্থা, যেমন, ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডিজ়াইন সেন্টার (আইডিসি), ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ ডিজ়াইন (এনআইডি) বা ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি (আইআইটি), এরা পোস্ট গ্র্যাজুয়েট কোর্সের জন্য শুধুমাত্র আর্কিটেকচার, টেকনোলজি, ফাইন আর্টস এবং ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ছাত্রছাত্রীদেরই প্রশিক্ষণের আওতায় নিয়ে থাকে।
কেরিয়ারের সুযোগসুবিধে
বর্তমানে ভারতে গেমিং ইন্ডাস্ট্রি (কম্পিউটার গেম্স এবং মোবাইল গেম্স) যেভাবে দ্রুত উন্নত এবং বিস্তৃত হচ্ছে, তাতে দেখা যাচ্ছে যে, আগামী কয়েকবছরের মধ্যে এই ইন্ডাস্ট্রিতে বহু লক্ষ কাজের সুযোগ তৈরি হবে, যা ভবিষ্যত অ্যানিমেটরদের পক্ষে খুবই আশার কথা। অ্যানিমেটরদের কাজ ছড়িয়ে পড়ছে নতুন প্ল্যাটফর্ম অ্যান্ড্রয়েড অপারেটিং সিস্টেমের সর্বত্রই। তৈরি হচ্ছে নতুন-নতুন কাজের ক্ষেত্র এবং সুযোগ। অ্যানিমেশন বা মাল্টিমিডিয়ার কাজকর্ম শিখে যেসব জায়গায় কাজ করা যায়, সেগুলো হল, বিনোদন (মুভি ও টেলিভিশন), ব্যবসাবাণিজ্য (প্রোডাক্ট প্রোমোশন এবং মার্কেটিং ডেমো), সেল্স (প্রেজ়েন্টেশন), শিক্ষা (কম্পিউটার-ভিত্তিক বা ওয়েব-ভিত্তিক টিউটোরিয়াল), প্রকাশনা (গ্রাফিক্স এবং প্রিন্টিং), ওয়েব ডিজ়াইনিং, ইঞ্জিনিয়ারিং, বিজ্ঞাপন (কমার্শিয়াল ও প্রিন্ট অ্যাড), ফ্যাশন এবং ইন্টিরিয়র ডিজ়াইনিং, কম্পিউটার এবং মোবাইল গেম ডিজ়াইন, স্টুডিয়ো এবং ট্রেনিং ইনস্টিটিউট-এ প্রশিক্ষণ দেওয়া ইত্যাদি।