Friday, January 3
Shadow

চলতি পথে নারীর নিরাপত্তা: দুর্নিবার সংকট

একবিংশ শতাব্দীতে নারীরা সব ক্ষেত্রেই নিজেদের অবদান রাখছে। কিন্তু পথচলার এই অগ্রযাত্রায় তাদের জন্য কতটা নিরাপদ আমাদের সমাজ? রাস্তাঘাট, গণপরিবহন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, কিংবা কর্মক্ষেত্র—প্রতিদিনের অনিরাপদ অভিজ্ঞতাগুলো যেন নিত্য সঙ্গী। শারীরিক, মানসিক, ও যৌন হয়রানির ক্রমবর্ধমান চিত্র উদ্বেগজনক মাত্রায় পৌঁছেছে। এই সমস্যার গভীরতা, কারণ ও প্রতিকারের উপায় নিয়ে কথা বলেছেন বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের নারী শিক্ষার্থীরা। লিখেছেন- সানজিদা জান্নাত পিংকি

নারী সামাজিক ভাবে অনিরাপদ

একুশ শতকে এসে নারীরা কতটা নিরাপদ তা দৈনন্দিন পত্রিকার পাতা উল্টালেই বুঝা যায়। পত্রিকা ছাড়াও শত শত দৃষ্টান্ত আমাদের অগোচরেই রয়ে যায়। যার প্রধান কারণ নারীর সামাজিক নিরাপত্তাহীনতা। পুরুষের সাথে তাল মিলিয়ে নারীও বর্তমান প্রতিটা ক্ষেত্রেই অবদান রাখলেও চলার পথে রাস্তাঘাট, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, অফিস আদালত কিম্বা বাস, ট্রেন, অটোরিকশা, দোকানপাট প্রতিটা সেক্টরে নারী কি নিরাপদ? নারীকে প্রতিটা ক্ষেত্রেই বিভিন্ন অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে পড়তে হয়। কখনো ইভটিজিং এর শিকার কখনো বা সংবেদনশীল স্থানে স্পর্শ আর কখনো ধর্ষনের মতো ঘৃন্য কর্মকাণ্ডের বলি হতে হয়।ফলশ্রুতিতে নারী মানুষিকভাবে ভেঙে পড়ে এবং এই অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা প্রতিনিয়ত তাকে তাড়া করে বেড়ায়। যার ফলে সকল পুরুষ সমাজের প্রতি তার বিরূপ মনোভাব তৈরি হয় এবং যেটা তাকে তার মানসিক বিকাশে বাধাগ্রস্ত করে। নারীর নিরাপত্তাহীনতা মোকাবিলায় যা
প্রথমত, নারীর প্রতি পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনের জন্য ছোটবেলা থেকেই নৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলতে হবে। দ্বিতীয়ত, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও গণমাধ্যমে ইভটিজিং এর নেতিবাচক দিক তুলে ধরতে হবে। তৃতীয়ত, ধর্ষণ এবং ইভটিজিং এর মতো কর্মকাণ্ডের জন্য আইনের শাসন ও যোগ্য শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। চতুর্থত, নারী ও পুরুষের বৈষম্য দূর করে নারীর নিরাপত্তা বিধানে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। সর্বোপরি, নারীকেও তার আত্মরক্ষার জন্য বিভিন্ন প্রশিক্ষণ গ্রহণ ও প্রতিবাদি হতে হবে।

শারমিন আক্তার
দর্শন বিভাগ,
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।

নারীদের নিশ্চুপ থাকাই অপরাধ বাড়িয়ে দেয়

যুগের সাথে তাল মিলিয়ে প্রতিনিয়তই নারীকে তার কর্মক্ষেত্র কিংবা বিভিন্ন কাজে বের হতে হচ্ছে।  সে সাথে বাড়ছে পথে-ঘাটে নারীদের ও নিরাপত্তা, যৌন হয়রানি, নির্যাতন।  আমাদের সংবিধান নারী পুরুষের সমান অধিকারের কথা বললেও নিশ্চিত করতে পারেনি স্বাধীনতা-নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারেনি। প্রতিনিয়তই যানবাহনে পথে-ঘাটে নারীরা অপ্রত্যাশিত ঘটনার শিকার হচ্ছে। এদের মধ্যে ৫৩ শতাংশ নারী পরিবহন সংশ্লিষ্টদের মাধ্যমে যৌন হয়রানি শিকার। কেউ কেউ আবার ধর্ষণ এবং খুনেরও শিকার। গণপরিবহনের সামনে সারিতে নারী, শিশু, বৃদ্ধ, বিশেষ চাহিদা সম্পন্নদের জন্য আসন বরাদ্দ থাকলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায় সেসব আসন্ন পুরুষের দখলে থাকে। গণপরিবহনের অতিরিক্ত ভিড় এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উদাসীনতায় এর মূল কারণ। এর আরো একটি কারণ হলো নারীদের নিশ্চুপ থাকা। গবেষণা দেখা গেছে, যৌন হয়রানির শিকার ৮১ শতাংশ নারীই নিশ্চুপ থাকে। নারীকে যৌন হয়রানি বন্ধে সবার আগে প্রয়োজন মানসিকতার পরিবর্তন। এছাড়া প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত পরিবহন শ্রমিক এবং  আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সামর্থ্য বৃদ্ধি ও প্রয়োজন। সেই সাথে গণপরিবহন ও পথেঘাটে নারীর প্রতি সংবেদনশীল আচরণই হতে পারে নারীদের পথে ঘাটে যৌন হয়রানি ও অনিরাপত্তা মোকাবেলায় মূল হাতিয়ার।

সুরাইয়া ইসলাম স্বর্ণা
মার্কেটিং বিভাগ,
বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়।

সাহসিকতার সাথে পরিস্থিতি মোকাবিলা জরুরি

নারীদের জন্য চলার পথে, বিশেষত রাস্তা-ঘাট ও পাবলিক ট্রান্সপোর্টে নিরাপত্তা একটি বড় উদ্বেগের বিষয়। নারীরা প্রায়ই ইভ টিজিং, যৌন হয়রানি, এবং বুলিংয়ের শিকার হন।  ভিড়ের সুযোগে ইচ্ছাকৃতভাবে শরীরের সংবেদনশীল স্থানে স্পর্শ করার মতো নিকৃষ্ট আচরণও ঘটে, যা একজন নারীর  মানসিক ও শারীরিক নিরাপত্তাকে চরমভাবে ব্যাহত করে। এর ফলে নারীরা প্রতিনিয়ত এক ধরনের ভয় ও উদ্বেগের মধ্যে চলাচল করতে বাধ্য হন। নারীদের ক্ষেত্রে এই ঘটনা প্রতিনিয়ত ঘটে, এসব ন্যাক্কারজনক ঘটনা থেকে মেয়ে শিশু থেকে শুরু করে বৃদ্ধ মহিলা কেউই রেহাই পান না।  এই অনিরাপদ পরিস্থিতি মোকাবিলায়  কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া জরুরি। পাবলিক ট্রান্সপোর্টে সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপন এবং নিরাপত্তা জোরদার করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এতে অপরাধীরা মনস্তাত্ত্বিকভাবে সতর্ক থাকবে এবং প্রয়োজনে প্রমাণ সংগ্রহ করা সহজ হবে।দ্রুত হেল্পলাইন বা মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে সাহায্য পাওয়ার সুবিধা থাকা উচিত, যা নারীরা সহজে ব্যবহার করতে পারবেন। আত্মরক্ষার কৌশল শেখা নারীদের জন্য অপরিহার্য। সমাজের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে নারীদের প্রতি সম্মানজনক আচরণ নিশ্চিত করতে হবে। এর জন্য স্কুল, কলেজ এবং কর্মস্থলে সচেতনতামূলক কার্যক্রম চালানো দরকার। প্রশাসনিক ব্যবস্থাকে আরও শক্তিশালী করতে হবে, যাতে নারীরা হয়রানির শিকার হলে সহজে অভিযোগ করতে পারেন এবং সুষ্ঠু বিচার পান। অপরাধীদের দ্রুত শাস্তির আওতায় আনা উচিত। নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সাহসিকতা ও সচেতনতা নারীদের জন্য অত্যন্ত জরুরি। পাশাপাশি, সমাজের প্রত্যেকেরই দায়িত্ব একটি নিরাপদ পরিবেশ তৈরি করা, যেখানে নারীরা স্বাধীনভাবে ও নিশ্চিন্তে চলাচল করতে পারেন।

যুথী রানী
লোক প্রশাসন বিভাগ,
বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়।

কর্মসংস্থান-চলতি পথে অনিরাপত্তা সবখানে

বর্তমান সময়ে বেশির ভাগ নারী বহির্মুখী।প্রতিদিনই তারা যাতায়াত করছেন স্কুল, কলেজ, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন কর্মক্ষেত্রে। এছাড়াও দেশের নারী গোষ্ঠীর একটা বড় অংশ যুক্ত আছে গার্মেন্টস শিল্পের সঙ্গে। গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে চাকরিজীবী নারীর সংখ্যা প্রায় আড়াই কোটি এবং ক্রমে এ সংখ্যায় যুক্ত হচ্ছে আরো নারী। নারী চাকরিজীবী হোক, গৃহিণী হোক কিংবা শিক্ষার্থী, প্রতিদিনই তাদের ব্যবহার করতে হচ্ছে গণপরিবহন এবং শিকার হতে হচ্ছে শারীরিক-মানসিক-মৌখিক লাঞ্ছনার। অন্যদিকে কে কি বলবে ভেবে প্রতিবাদের ভাষাটাই ভুলেছে সবাই। একশন এইড বাংলাদেশ সাম্প্রতিক এক জরীপে বলছে, ৮৭ শতাংশ নারী বাস টার্মিনাল বা ট্রেন স্টেশনের মতো যায়গায় হয়রানির শিকার হয়েছেন বলে জানিয়েছেন। রাস্তায় আশি শতাংশ আর স্কুল কলেজের বাইরে প্রায় ৭০ শতাংশ নারী। পরিবহনে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন কর্মজীবী নারী।অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নিপীড়িত নারীরা বাড়তি সম্মানহানির ভয়ে মূক থাকেন অথবা ঘটনাস্থান থেকে সরে যান। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোতে দু-একটি ঘটনা সামনে এলেও তা উলুবনে মুক্তা ছড়ানোর মতোই। প্রতিদিন কর্মস্থলে যথাসময়ে পৌঁছানোর জন্য রীতিমতো পুরুষের সঙ্গে যুদ্ধ করে বাস বা ট্রেনে উঠতে হয় নারীদের। পরিবহনে তোলার ছলে অনাকাঙ্ক্ষিত স্পর্শের অভিযোগ রয়েছে গাড়ির সহকারীদের বিরুদ্ধে। গণপরিবহনে একাকী যাতায়াত নারীদের কাছে আজ অস্বস্তিকর ও অনিরাপদ এক ব্যবস্থা। এমন বিরূপ পরিস্থিতিতে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগ গ্রহণের পাশাপাশি আমজনতার মাঝে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। নৈতিক সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে সেমিনার, সিম্পোজিয়ামের আয়োজন সক্রিয় ভূমিকা রাখতে পারে। গণপরিবহন নারীর একাকী পথচলায় অন্তরায় নয়, বরং হোক এগিয়ে চলার সহায়ক এই আমাদের কাম্য।

ইমপিয়াত জাহান হাজারী ইফতি
শিক্ষার্থী, ফার্মেসি বিভাগ।
গণ বিশ্ববিদ্যালয়।

লেখা: শিক্ষার্থী ও সংবাদকর্মী, গণ বিশ্ববিদ্যালয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Please disable your adblocker or whitelist this site!