বৈশ্বিক অনিশ্চয়তার ডামাডোলে চীনা প্রবৃদ্ধির পাঁচ বছর - Mati News
Friday, December 5

বৈশ্বিক অনিশ্চয়তার ডামাডোলে চীনা প্রবৃদ্ধির পাঁচ বছর

ফয়সল আবদুল্লাহ

চলতি বছর শেষ হচ্ছে চীনের ১৪তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা। এই পরিকল্পনাই মূলত চীনের অগ্রগতির মূল রূপরেখা। এর মাধ্যমেই চীন বিশ্বজুড়ে চলমান অনিশ্চয়তার মধ্যেও ধরে রেখেছে উন্নয়ন, প্রবৃদ্ধির হার এবং উদ্ভাবনের নতুন ধারা।

ভূরাজনৈতিক সংঘাত, বৈশ্বিক মুদ্রাস্ফীতি এবং বাণিজ্য সুরক্ষাবাদের ডামাডোলে চীনের অর্থনীতি গত পাঁচ বছরে মোট ৩৫ ট্রিলিয়ন ইউয়ান (প্রায় ৪.৯ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার) বাড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে। প্রতিবছর বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধিতে যার প্রায় ৩০ শতাংশ অবদান রয়েছে।

সোমবার চীনা কমিউনিস্ট পার্টির ২০তম কেন্দ্রীয় কমিটির চতুর্থ পূর্ণাঙ্গ অধিবেশনে আলোচনা হয়েছে পরবর্তী ১৫তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার (২০২৬–২০৩০) খসড়া নিয়ে। এই প্রেক্ষাপটে আমার যদি চীনের অর্থনীতির দিকে ফিরে দেখি, তবে জানতে পারবো কীভাবে চীন তার উন্নয়নের পথ ধরে থেকে বৈশ্বিক অর্থনীতিতে নতুন শক্তির সঞ্চার করে চলেছে।

চীনের পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা মানেই অর্থনৈতিক লক্ষ্য নয়। প্রতিটি বছরের বাস্তবতার সঙ্গে খাপ খাইয়ে তবেই দেশের আধুনিকায়নের পথরেখা তৈরি করে এটি।

দারিদ্র্য বিমোচন ছিল আগের পরিকল্পনাগুলোর মূল স্তম্ভ। ১৯৭৮ সালে যেখানে চীনের গ্রামীণ দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ছিল ৭৭ কোটি, ২০১২ সালে তা কমে দাঁড়ায় ৯ কোটি ৮৯ লাখে। দারিদ্র্যের হার ৯৭.৫ শতাংশ থেকে কমে আসে ১০.২ শতাংশে।

১৩তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় চীন ফের লক্ষ্যভিত্তিক দারিদ্র্য বিমোচন কৌশল হাতে নেয়। ২০২০ সালে চরম দারিদ্র্য দূর করে এবং জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা নির্দিষ্ট সময়ের আগেই অর্জন করে।

১৪তম পরিকল্পনায় এসে চীন সেই অর্জনটিকে ধরে রাখতে মনোযোগ দেয় বেশি। এখন দেশটিতে দারিদ্র্যমুক্ত জনগোষ্ঠীর মধ্যে ৩ কোটিরও বেশি মানুষ কর্মসংস্থানে যুক্ত। এর মাঝে আবার ৬০ লাখ পরিবারকে সহায়তা দেওয়া হয়েছে, যেন তারা ফের দারিদ্র্যের ফাঁদে না পড়ে।

১৪তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার আরেকটি মূল দিক হলো উন্মুক্ততা। এর মাধ্যমে সারা বিশ্বে চীন তার অবদান বজায় রেখেছে, পশ্চিমা বাধা সত্ত্বেও।

ঝুঁকি কমানো ও সরবরাহ শৃঙ্খল নিরাপত্তার অজুহাতে কিছু দেশ বাড়িয়েছে শুল্ক। কঠোর করছে রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ এবং প্রযুক্তি বাণিজ্যে এনেছে নতুন প্রতিবন্ধকতা। এই অবস্থায় চীন বেল্ট অ্যান্ড রোড উদ্যোগ ও অন্যান্য বহুপাক্ষিক সহযোগিতার মাধ্যমে গ্লোবাল সাউথের দেশগুলোয় উন্নয়নের স্রোত অব্যাহত রাখতে একটুও কালক্ষেপণ করেনি।

২০২৫ সালের প্রথম চার মাসে, বেল্ট অ্যান্ড রোড অংশীদার দেশগুলোতে চীনা প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রকল্প থেকে প্রায় ৩৮ বিলিয়ন ডলার রাজস্ব এসেছে, যা আগের বছরের তুলনায় ৫.২ শতাংশ বেশি। একই সময়ে নতুন চুক্তির পরিমাণ ১৭.৪ শতাংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬৪.৫৪ বিলিয়ন ডলারে।

এ ছাড়া চীন ১৬০টির বেশি দেশে উন্নয়ন সহায়তা দিয়েছে—রেলপথ, বিদ্যুৎ গ্রিড, হাসপাতাল ও অর্থনৈতিক করিডর নির্মাণে, যা স্থানীয় অর্থনীতিতে এনেছে নতুন গতি।

রিজিওনাল কম্প্রিহেনসিভ ইকনোমিক পার্টনারশিপ-এর সক্রিয় সদস্য হিসেবে বৈশ্বিক বাণিজ্য সহজীকরণেও ভূমিকা রাখছে চীন। গত তিন বছরে এই জোটের আওতায় ৯০ শতাংশ পণ্যের ওপর শুল্ক কমানো বা বাতিল করা হয়েছে। সম্প্রতি এ সুবিধা পেয়েছে বাংলাদেশও।

চীনের প্রতিটি পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় বৈজ্ঞানিক উদ্ভাবনকে রাখা হয় একেবারে কেন্দ্রে। এটাকেই বিবেচনা করা হয় দেশটির মূল চালিকাশক্তি হিসেবে।

১৪তম পরিকল্পনার সময় চীন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই খাতে ব্যাপক অগ্রগতি অর্জন করেছে। ২০২৩ সালে চীনের মূল এআই শিল্পের বাজারমূল্য পৌঁছায় ৫৭৮.৭ বিলিয়ন ইউয়ানে (প্রায় ৮১.২ বিলিয়ন ডলার)।

এ ছাড়া চীন সফলভাবে চালু করেছে বিশ্বের প্রথম চতুর্থ প্রজন্মের পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র। সম্পন্ন করেছে থিয়ানকং মহাকাশ স্টেশন, এবং প্রথমবারের মতো চাঁদের অন্ধকার পৃষ্ঠ থেকে নিয়ে এসেছে মাটি।

বিশ্বের অনেক তথাকথিত উন্নত দেশ যখন অনিশ্চয়তার সাগরে ভাসছে দিশেহারা অবস্থায়, চীনের পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনাগুলো সেখানে দেখায় দিকনির্দেশনা ও আত্মবিশ্বাস। পরিকল্পিত উন্নয়ন, প্রযুক্তিগত সাহস, সবুজ রূপান্তর এবং বৈশ্বিক সহযোগিতার নদীগুলো যেন এসে মিশেছে চীনের মোহনায়।

আর তাই সাবেক কিরগিজ রাষ্ট্রদূত কানাইম বাকতিগুলোভা সিজিটিএনকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘চীনের এই অগ্রগতি শুধু দেশটির নয়—এটি বিশ্বের শৃঙ্খলা, বৈশ্বিক অর্থনীতি, প্রযুক্তি উদ্ভাবন এবং টেকসই উন্নয়নেও অনন্য প্রভাব ফেলছে।’

লেখক: সংবাদকর্মী, সিএমজি বাংলা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *