ধ্রুব নীল: মহাকাশের সময় সীমার সাপেক্ষে মানুষের জীবন মারাত্মক রকমের ক্ষণস্থায়ী। মহাবিশ্বের বয়সের তুলনায় আমাদের সভ্যতা চোখের পলকের চেয়েও ছোট।
তবে একটা কথা আছে। একটা কচ্ছপ সাড়ে ৩০০ বছর বাঁচলেও সেটা মানুষের একদিনের সমান হবে?
আবার ধরুন অনেক শক্তিশালী মহাকাশের ব্ল্যাক হোল কিংবা প্রাণহীন কোন দুর্দান্ত গতির নিউট্রন স্টার, তারা কি একটি মানুষের একটি দিনের সমান গুরুত্বপূর্ণ? জীবনের ব্যাপার স্যাপারই আলাদা। একটি জীবনের কাছে একটি নিস্প্রাণ গ্যালাক্সি কিছুই না। প্রাণ ছাড়া গোটা মহাবিশ্বটাই অর্থহীন। আর আমরা সেই প্রাণের মহা বুদ্ধিমান ধারক হয়েও অযথা, অকর্মণ্য এবং অর্থহীন সব কাজে সময় নষ্ট করেই যাচ্ছি। আবার আমাদের হাতেই কিনা আছে এমন ক্ষমতা যাতে একদিনেই গোটা বিশ্বের সব সংঘাত, সব টেনশন দূর করে ফেলার।
এই যেমন ধরুন কাল যদি আমরা এক কোটি মানুষ ঠিক করি একটি করে গাছ লাগাবো গোটা বাংলাদেশ আবার টসটসা সবুজ হয়ে যাবে। যত ব্যক্তিগত গাড়ির মালিক আছে সবাই যদি ঠিক করে সপ্তাহে দুই দিন গাড়ি চালাব না, তাহলে চিন্তা করুন ঢাকার বাতাস কতটা নির্মল হবে? বিশ্বের অনেক দেশই এ ভাবে চিন্তা করে, আমরা করি না। এর একটাই কারণ, আমরা প্রত্যেকে আলাদা করে অনেক কিছু করতে চাইলেও আবার দেখা যায়, আরেকজন করে না দেখেই আরেকজন করে না। মনের মাঝে অপূর্ণতা নিয়েই দিন চলে যায়।
অথচ এক মুহূর্তে আমরা একজোট হয়ে চাইলে সব সমস্যার সমাধান করে ফেলতে পারি। এর জন্য বাধাটা কোথায়, এবং ঠিক কী করা দরকার সেটা নিয়ে আমরা একটু যদি ভাবি তাতেও কাজ হবে।

এখন তো যোগাযোগের টুলস এর কোন অভাব নেই। কি সুন্দর সামাজিক যোগাযোগ ব্যবস্থা ব্যবহার করে সবাই একজোট হয়ে একটি আস্ত সরকারের পতন করে দিল। ঠিক এভাবে চাইলে কিন্তু ধরেন বাদবাকি সব সমস্যার সমাধান করা যাবে।
শুধু ছোট্ট কয়েকটি উদাহরণ দিতে চাই। আমরা যারা কিছুটা নিম্ন মধ্যবিত্ত তাদেরও প্রত্যেকের বাসায় দেখা যাবে একবেলার কোন না কোন খাবার নষ্ট হচ্ছে। সেটা নষ্ট হওয়ার আগেই আমরা যদি প্যাকেট করে বাইরে নিয়ে এসে অন্য কাউকে খেতে দেই তার এক বেলার খাবার খরচ বেঁচে যায়। আর এইভাবে যদি অনেকেই কাজটা শুরু করে তবে দেখা যাবে যে কিনা একবেলা খাবারের জন্য অপরাধ করা চিন্তা করছে সে তখন আর করবে না।
আবার আমরা একসঙ্গে ২০-২৫ জন একজোট হয়ে নিয়মিত একদিন সাপ্তাহিক মিটিং এর আয়োজন করলেও দেখা যাবে একটি এলাকার অপরাধীরা সুবিধা করতে পারবে না। সেই সঙ্গে বেরিয়ে আসবে অনেকের অনেক সমস্যা সমাধান। প্রতিটি পাড়া মহল্লা ও গ্রামের ৩০-৪০ জন জোট বেঁধে যদি একটি সিজনে ১০০টি ফলের গাছ লাগাই তাহলে সেখান থেকে মানুষ তো খাবেই, পাখিরাও খেয়ে শেষ করতে পারবে না।
আমরা আসলে জানি না যে আমাদের হাতে কত ক্ষমতা আছে এবং আমরা সেটাকে দিয়ে কতটা ভালো কিছু করতে পারি। দরকার শুধু শুরুটা করার। উবার আর পাঠাওয়ের মতো এ ধরনের কাজ শুরু করার জন্যও অ্যাপ দরকার। আর দরকার শুধু কয়েকজনের একসঙ্গে হয়ে শুরু করা এবং বাকিদের সেখানে সমর্থন দেওয়া।
তো আপাতত শুরুটা করা যায় কি করে?
আপনার অতিরিক্ত রান্না করা খাবারটুকু নিয়ে বের হয়ে যান, সেটা কাউকে দিয়ে দিন।
সামনে বৃষ্টির মৌসুম আসছে, এখন থেকে কয়েকজন মিলে ঠিক করুন অন্তত ৫০টা ফলের গাছ লাগাবেন। যে গাছের ফলের উপর আপনার কোন দাবী থাকবে না, সবাই খেতে পারবে।
এলাকায় সাপ্তাহে অন্তত দুজন ভাল মানুষের সঙ্গে পরিচিত হন। তার খোঁজখবর রাখুন। এখানে ধনী গরিব বাছতে যাবেন না। তাদের কাছ থেকে ইনফরমেশন নিন। তিনি যেন আপনার নিরাপত্তা দেন, আপনিও তার নিরাপত্তা দিবেন। তার বিপদ আপদে এগিয়ে আসুন।
এভাবে সামাজিকভাবে এক জোট হতে পারলে বাজারের নিয়ন্ত্রণও কিন্তু আপনাদের হাতে চলে আসবে। তখন একটি সামাজিক সংগঠন করে কৃষকের কাছ থেকে সরাসরি পণ্য কিনতে পারবেন।
নিরাপত্তা সংক্রান্ত তথ্য আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে দলবদ্ধভাবে শেয়ার করুন এবং নিয়মিত আপডেট রাখুন। থানায় গেলে ঝামেলা হবে এই চিন্তা ধরে ফেলুন। এখন আর এসব ঝামেলা হবে না আশা করি।
কারো বাড়িতে কৃষিজমি পড়ে থাকলে সেটা ফেলে রাখবেন না কাউকে বর্গা দিয়ে দিন। প্রয়োজনে আপনি কোন কিছু বিনিময় আশা করবেন না।
যতটা সম্ভব হাঁটার অভ্যাস করুন এবং পাবলিক পরিবহন ব্যবহার করুন। হাঁটার সময় সহযাত্রীর সঙ্গে আলাপ করতে করতে যান, তিন কিলোমিটার রাস্তা এক কিলোমিটার হয়ে যাবে।
ব্যক্তিগত গাড়ি সপ্তাহে দুই দিন বন্ধ রাখার চেষ্টা করুন। অন্য কাউকে চালাতে দেখলে তার প্রতি বিদ্বেষ রাখবেন না, মন ভালো থাকবে।
ধীরে ধীরে নয়, কাল থেকেই সমস্ত পলিথিন বর্জন করুন। ১০ টাকার একটা চটের ব্যাগ সঙ্গে রাখলেই বাজারের ঝামেলা চুকে যায়। দোকানদার পলিথিন দিতে চাইলে না করুন। অনেক অপচয় কমাতে পারেন, যদি সঙ্গে একটা কাঁধব্যাগ নিয়ে আপনি ঘুরতে পারেন। সেই ব্যাগে পানির বোতল রাখতে পারেন, টিফিন রাখতে পারেন।
সহজে কারো কথায় বিভ্রান্ত হবেন না, বিশেষ করে ফেসবুকে কিছু দেখেই বিশ্বাস করতে যাবেন না। আগে মানবতা পরে রাজনীতি, এই নীতি মেনে, জাগতিক ইগোকে না বলুন।
রাজনীতি হলো মানুষে মানুষে যোগাযোগ। রাজনীতি বোদ্ধা হতে চাইলে আগে সেটা করুন। কয়েকজন মিলে ঘন্টার পর ঘন্টা তর্ক বিতর্ক করা, ভালোমতো বিশ্লেষণ না করে অন্যের কাজের সমালোচনা, এসব রাজনীতি নয়। আপনি নিজে ভালো না হলে রাজনীতিবিদদের কিছুই করার থাকবে না।
অর্থনৈতিকভাবে ভালো থাকতে গেলে ভোগবাদি আচরণ সম্পূর্ণ বাদ দিন। ৩০০ টাকার কমলার চেয়ে ৮০ টাকার পেয়ারায় ভিটামিন সি বেশি থাকে। সকালের নাস্তায় মাখন এর চেয়ে পাকা পেঁপে বেশি মজার। বছরে আমরা তিন হাজার কোটি টাকার শুধু গ্যাস্ট্রিকের ওষুধ খাই। তেল মসলা কম খেয়ে আর টুকটাক কিছু ব্যায়াম করে এই টাকাটা বাঁচানো যায়।
মোবাইল ফোনটাকে রেখে প্রতিদিন দুই তিন পৃষ্ঠা করে হলেও গল্পের বই পড়ুন। এটা মস্তিষ্কের ব্যায়াম। এতে আপনার চিন্তার শক্তি বাড়বে। বিনোদনের মাধ্যমে নতুন কিছু শিখতে পারবেন। ভুলে যাওয়া রোগের হাত থেকেও বাঁচা যাবে।
দুই টাকা দামের ক্যান্ডি দিয়েও আত্মতৃত্তি কেনা যায়। কীভাবে? রিকশা ভাড়া, এক আটি শাক, কিংবা বাসের হেলপারকে ভাড়া দেয়ার পর সেই ক্যান্ডি তার হাতে দিয়ে বলুন এটা আপনার ছেলে বা মেয়েকে দিয়েন।
এলোমেলো কথাগুলোকে গুছিয়ে চিন্তা করার দরকার নেই। কারণ এই কথাগুলো আপনারও মনের কথা। তাই মনকে জিজ্ঞেস করুন, কী করা দরকার, উত্তর আপনাতেই পেয়ে যাবেন।