Monday, December 23
Shadow

আমার পুরনো কলকাতা : শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়

তখন আমি তিন বা চার। কলকাতার সঙ্গে আমার প্রথম দেখা সেই গুটিগুটি বয়সে। সেটা হয়তো বা উনচল্লিশ বা চল্লিশ সাল। কে জানে আটত্রিশও হতে পারে। সেই বয়সেও কলকাতার যা মুগ্ধ করত আমাকে, তা হল ঘাসের সবুজ গালিচায় ডুবে থাকা ট্রামলাইন। নিঃশব্দে মসৃণ গতিতে যখন ট্রাম যেত তখন মনে হত যেন ঘাসের ওপর দিয়েই বয়ে যাচ্ছে কবিতার মতো। মনোহরপুকুরে আমাদের বাসার সামনেই ছিল একটা ঘোলা জলের পুকুর, তার চারপাশে অনেকগুলো ঢ্যাঙা তালগাছ।

কলকাতা নিয়ে শীর্ষেন্দুর লেখা

সারাদিন বেশ কয়েকটা মোষ জলেকাদায় শরীর ডুবিয়ে বসে থাকত। গাছ ছিল অনেক। আর মনে পড়ে খুব চিল আর শকুনের বাসা ছিল আশেপাশে বড়সড় গাছগাছালিতে। অবারিত আকাশে ছিল চতুর চিলের ধীরগতি মতলববাজ চংক্রমণ। দোকান থেকে শালপাতার ঠোঙায় খাবার আনা ছিল ভারী শক্ত, চিল ছোঁ দেবে কি দেবেই! কতবার যে আমার হাত থেকে তেলেভাজা বা মিষ্টির ঠোঙা কেড়ে নিয়ে গেছে তার হিসেব নেই।

চৌরঙ্গি ছিল সাহেবপাড়া এবং সত্যিকারেরই সাহেবপাড়া। মশমশ করে চকচকে জুতোর শব্দ তুলে রাঙা সাহেবরা আর টকাটক হাইহিলের শব্দ তুলে গোলাপি মেমরা কী অহংকারের সঙ্গেই না হেঁটে যেত। হাঁ করে দেখার মতোই! ওরা তো আর আমাদের মতো নয়। ইংরেজিতে কথা কয়, এঁটোকাঁটা মানে না, শুনেছি হেগে ছোঁচায়ও না। তবু তাদের সবাই ভারী খাতির করে, ভয়ও পায়। না, সবাই না, শুনতে পেতাম সুভাষ বোস আর গাঁধীজি ওদের ভয় পায় না। আর চৌরঙ্গিতে তখন কত যে গাছপালা ছিল!

আর ছিল সেই রাশভারী দোকান হোয়াইটওয়ে লেড্‌ল। ডাকাবুকো ছাড়া সেখানে ঢুকতে পারে না কেউ। আর একটা গেরামভারী দোকানের খুব নাম শুনতাম, ওয়াচেল মোল্লা। নাম শুনতাম সাঙ্গুভ্যালি রেস্টুরেন্টের৷ ভীম নাগ আর দ্বারিকের মিষ্টি ছিল বিখ্যাত, আর বাগবাজারের রসগোল্লা। নাম শুনতাম গোল্ডফ্লেক সিগারেটের, খুব নাকি দামি জিনিস। মাঝেমাঝে বাড়িতে আসত ফারপোর পাউরুটি আর পলসনের মাখন। পাউরুটির ওপর একটা ছোট্ট বিস্কুট লাগানো থাকত, আমি সেটা খুঁটে তুলে খেয়ে ফেলতাম।

জল ছেড়ে রাস্তা ধোয়াত, কিন্তু হাতের পাতা দিয়ে এমন ভাবে সামাল দিত। কী যে এক্সপার্ট ছিল কর্পোরেশনের জলকুলিরা! হোসপাইপ দিয়ে তোড়ে যে, কখনও কারও গায়ে জলের ছিটে লাগত না। রাস্তা ধোয়ানোর এই আর্ট। হতে হবে বলে ঠিকও করে ফেলেছিলাম।

দেখতে দেখতে আমি মোহিত হয়ে যেতাম। বড় হয়ে আমাকে জলকুলিই কাছেই কালীঘাট পার্ক, গাছপালা, ফুলের বেড, বসবার বেঞ্চ, স্লিপ, দোলনায় সাজানো। বিকেলে তখনকার আমার বয়সি ছেলেমেয়েদের গাদি লেগে যেত। ট্রামডিপো আর পার্কের মাঝখানের নিরিবিলি রাস্তাটা তখনও মলমূত্রত্যাগের মুক্তভূমি হয়ে যায়নি। বুড়োমানুষেরা বসে থাকত বেঞ্চে। আর পার্কে সর্বদা সজাগ এক পাহারাদারও থাকত, দেখেছি। তাকে বেশ ভয় লাগত আমার, যদি বকে দেয়! পাশেই সতীশ মুখার্জি রোডে পার্কের উলটো দিকেই আমার বড়পিসিমার বাসা। সরু একটা তিনতলা বাড়ির একতলায়। সেই বাড়ির ভাড়া ছিল মাসে ত্রিশ টাকা। দু’খানা বড়বড় ঘর, কলতলা, বারান্দা। এক চিলতে উঠোনও ছিল, আর রান্নাঘর, পটিঘর।

বাবা শিয়ালদায় রেলের ক্রু ইন চার্জ। সকালবেলায় বেরিয়ে যেতেন কাজে, আমার দু’বছরের বড় দিদি যেত কর্পোরেশনের স্কুলে পড়তে, আর আমি ঘরের লাল মেঝের ওপর তিন চাকার দাগ আঁকতে আঁকতে ক্রমাগত ট্রাইসাইকেল চালিয়ে যেতাম। আর দুরন্ত ছেলেকে সামলাতে আমার শান্ত প্রকৃতির মা দুপুরে খাওয়ার পর মেঝেতে মাদুর পেতে আমাকে পাশে নিয়ে শুয়ে রবীন্দ্রনাথের কবিতা পড়ে শোনাতেন। ‘ঝর্না, তোমার স্ফটিকজলের/স্বচ্ছ ধারা,/ তাহারি মাঝারে দেখে আপনারে/ সূর্য তারা।/ তারি এক ধারে আমার ছায়ারে/ আনি মাঝে মাঝে, দুলায়ো তাহারে,/ তারি সাথে তুমি হাসিয়া মিলায়ো/ কলধ্বনি—/ দিয়ো তারে বাণী যে বাণী তোমার/ চিরন্তনী।

ফোঁটাফোঁটা জলবিন্দুর মতো কবিতার আশ্চর্য ছন্দ আমার ভিতরটা গভীর সিঞ্চনে ভরিয়ে দিত। তখন কলকাতা ছাড়িয়ে কোন অচেনা দুরে অদেখা এক ঝর্নার কাছে চলে যেতাম আমি, মায়ের বুক ঘেঁষে শুয়ে রবীন্দ্রনাথের আশ্চর্য সম্মোহনে ঘুমিয়ে পড়তাম।

তখন রবীন্দ্রনাথ আছেন। শুনতাম, শান্তিনিকেতন নামের এক আশ্চর্য জায়গায় তিনি কেন। জোড়াসাঁকো নামে এক অদ্ভুত জমিদারবাড়ির মানুষ তিনি। কলকাতায় কত যে রূপকথা লুকিয়ে আছে!

দূর পুববাংলার ময়মনসিংহের যৌথ পরিবার থেকে উপড়ে আনা আমি কলকাতায় প্রথমে সোয়াস্তি পাইনি। কিন্তু শিশুদের একটা জিনিস আছে, টপ করে নতুনের সঙ্গে মানিয়ে নেয়। ময়মনসিংহে অনেক প্রিয় মানুষের ভিড়ে মাকে তেমন খুঁজে পেতাম না, কলকাতায় এসে মাকে তো পেয়ে গেলাম। আর তখন থেকেই আজীবন আমি মায়ের নেইআঁকড়া।

দোতলা থেকে একা টুকটুক করে নেমে নির্জন দুপুরে আলায়বালায় ঘুরে বেড়াতাম। কয়েকজন সমবয়সি বন্ধুও জুটে গেল। তখন কলকাতা বলতে আমাদের নির্জন পাড়াটুকু। ময়মনসিংহে ছিল আমার দাদুময় জীবন। সেই দাদুই একদিন কলকাতায় এসে হাজির, আমি আনন্দে তখন সপ্তম স্বর্গে। তখন কিছুদিন দাদু আর আমি একদম লেপ্টে আছি। বিকেলবেলায় দাদুর হাত ধরে খুটখুট করে হেঁটে যেতাম বড়পিসিমার বাড়িতে। তখন অক্ষরজ্ঞান নেই।

দোকান দেখলেই সাইনবোর্ডের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে পড়তাম। দাদু সাইনবোর্ড পড়ে দিতেন, অমুক স্টোর, তমুক ভাণ্ডার। কলকাতায় কত যে দোকান!

হঠাৎ কী জানি কী একটা হল। শুনতে পাচ্ছি, যুদ্ধ লেগেছে। ভীষণ যুদ্ধ। ইংরেজদের সঙ্গে জার্মানি আর জাপানের। সেই যুদ্ধ ক্রমে ঘোরালো হচ্ছে। সবাই যুদ্ধ নিয়েই বলাবলি করে। তারপর একদিন শুনলাম, ব্ল্যাকআউট হবে। আমার দীর্ঘকায় বাবা ঘরের বাল্বে কাগজের ঠোঙা লাগিয়ে দিলেন। রাস্তার আলোতেও লোক এসে মই বেয়ে উঠে ধাতব ঠুলি পরিয়ে গেল।

সন্ধের পর কলকাতাটা কেমন যেন ভূতভূত, ছমছমে। সেকেন্ড ওয়ার্ল্ড ওয়ার কথাটা সেই প্রথম মুখস্থ হয়ে গেল। মানেও জানি, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। একদিন দুপুরে দিদি অসময়ে স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে এল। স্কুল ছুটি হয়ে গেছে। রবীন্দ্রনাথ মারা গেছেন। মারা যাওয়ার ব্যাপারটা তখনও ঠিক বুঝতে পারি না। তবে মারা যাওয়া যে খারাপ কিছু তা বুঝতে পারি। মা চোখে আঁচলচাপা দিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলেন। সন্ধেবেলা ঝোড়ো চেহারায় উস্কোখুস্কো চুলে বাড়ি ফিরে বাবার উচ্চস্বরে সে কী কান্না! আমি মুখ চুন করে এঘর ওঘর করতে লাগলাম। সাদা ধবধবে লম্বা দাড়িওয়ালা সন্তের মতো চেহারার লোকটা মারা গেল কেন? মারা যাওয়ার কি খুব দরকার ছিল? কাজটা একদম ঠিক হয়নি রবীন্দ্রনাথের! যেসব জায়গায় আমি খেলা করতাম, বাড়ির সামনেই সেইসব জায়গায়।

লোকজন এসে বড়বড় গর্ত খুঁড়ে ফেলল। লম্বাটে বেশ গভীর গর্ত। সেগুলো নাকি ট্রেঞ্চ। বোমা পড়লে ওখানে লুকিয়ে পড়তে হবে। বোমা পড়লও। খিদিরপুর আর দমদমে। আর তখন ঝাঁক বেঁধে এরোপ্লেন ওড়ে আকাশে। কী গম্ভীর আর করুণ শব্দ তার! আর বুক কাঁপিয়ে দেওয়া আর্তনাদের মতো শব্দে মাঝেমাঝে সাইরেন বেজে ওঠে। জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে, আর ব্ল্যাকমার্কেট বলে একটা কী যেন খারাপ জিনিস চালু হয়েছে। ভেজাল, চালে কাঁকর, আটায় তেঁতুলবিচি এসবও কানে আসে। আমি ট্রেঞ্চের গর্তে লাফ দিয়ে নামি, আবার উঠে আসি। বেশ একটা নতুন খেলা পেয়ে গেলাম যুদ্ধের কল্যাণে।

এই যুদ্ধের ডামাডোলেই খবর এল, বাবা রেলেই আর একটা বড় চাকরি পেয়েছেন, আমাদের কলকাতা ছেড়ে চলে যেতে হবে কাটিহারে। আমি, মা আর দিদি অবশ্য চলে গেলাম ময়মনসিংহে, বাবা একা গেলেন কাটিহারে। আমরা কিছুদিন পরে যাব।

কলকাতার সঙ্গে আমার সেই এক দীর্ঘ বিচ্ছেদ। একটু বড় হয়ে মাঝেমাঝে কলকাতায় আসতাম, আর দেখতাম, আমার শৈশবের কলকাতা একটু করে বিশ্রী হয়ে যাচ্ছে। ভিড় বাড়ছে, দোকান বাড়ছে, বিল্ডিং বাড়ছে, পার্কের মাটি ন্যাড়া হয়ে যাচ্ছে। দেশভাগের পর দেখতাম কলকাতা কত দ্রুত অধঃপাতে চলেছে। লক্ষ গাড়ি, কোটি লোক।

কী জানি কেন, বাইরে-বাইরে বড় হতে হতে মন বলত, আমি একদিন ঠিক কলকাতায় থাকব। বিহার, অসম, পুববাংলা যেখানেই থেকেছি সেখানেই টের পেয়েছি কলকাতার এক নির্ভুল টান। কলকাতা কেন আমাকে টানত, আমাকে তার কী দরকার কে জানে!

পাঁচের দশকের মাঝামাঝি ফের কলকাতা। বি এ পড়তে। রামমোহন রায় হোস্টেলে থাকি, উলটো দিকে মুচিপাড়া থানা, কোনাকুনি হৃষীকেশ পার্ক, পাশে লাহাদের বিশাল লাল দেয়াল ঘেরা বাড়ি। চারদিকে পুরনো কলকাতার গন্ধ। আমাকে বাংলার পাঠ দেন নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়, শঙ্করীপ্রসাদ বসু, বিভূতি চৌধুরী। কাছেই কর্নওয়ালিস স্ট্রিট, ঠনঠনে কালীবাড়ি, বীণা সিনেমা। একটু হেঁটে গেলেই কলেজ স্ট্রিট, গোলদিঘি, কফিহাউস। হৃষীকেশ পার্ক পেরিয়ে গলির মধ্যে বিদ্যাসাগরের বাড়ি।

আরও এগিয়ে গেলে আপার সার্কুলার রোডের ওপাশে ব্রাহ্ম বালিকা বিদ্যালয়, কাছাকাছি বিখ্যাত সায়েন্স কলেজ। বীণা সিনেমা হলে ওই সময়েই একদিন পথের পাঁচালী দেখে ঘোরের মধ্যে ফিরে এলাম হোস্টেলে।

অনেকদিন ঘোর কাটেনি। কিছুদিন পরেই অপরাজিত ছবির শুটিং করতে এক রবিবার আমাদের কলেজে এলেন সত্যজিৎ রায়। ছাত্রদের ভূমিকায় আমাদের থাকতে হবে বলে অধ্যাপক দেবুবাবু শুটিঙে হাজির থাকার আদেশ দিয়েছিলেন। আমরা সোৎসাহে হোস্টেল ঝেঁটিয়ে গিয়েওছিলাম। হাঁ করে ঢ্যাঙা আর হ্যান্ডসাম সত্যজিৎ রায়কে দেখেছিলাম। কী তীক্ষ্ণ চোখ! ক্লাসের দৃশ্যে আমি, অপু অর্থাৎ স্মরণ ঘোষালের ঠিক পিছনেই বসবার জায়গা পেয়ে যাই। কপালে থাকলে আজও ওই ঐতিহাসিক ছবিটায় আমাকে এক পলকের জন্য হলেও দেখা যেত! কিন্তু হল না। আমি বেজায় রোগা বলে একজন কর্মকর্তা এসে আমাকে তুলে দিয়ে একজন মোটাসোটা ছেলেকে বসিয়ে দিলেন। আমি লজ্জায় মুখ লুকনোর জায়গা পাই না।

অনেকদিন পরে যখন সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে আমার বেশ ভাবসাব হয়েছিল তখন আর তাঁকে ঘটনাটা বলিনি। ভারী লজ্জা হয়েছিল। হোস্টেলের জীবন ছিল ভারী মুক্ত, খুশিয়াল। দশ আনার লাইনে টিকিট কেটে ইংরেজি এবং বাংলা সিনেমা দেখা, বিকেলে কলেজ স্কোয়ারে একটু বেড়ানো, আর সস্তায় খাবারের দোকান খোঁজা এই ছিল কাজ। উত্তমকুমার আর সুচিত্রা সেনের তখন উত্থান ঘটছে। দু’টি সুন্দর মুখের টানে সিনেমায় টিকিট পাওয়াই মুশকিল। আর আড্ডা তো ছিলই। ঠনঠনে থেকে বাসে উঠলে এসপ্ল্যানেড যেতে ভাড়া লাগত দশ পয়সা, আর এক স্টপ হেঁটে এগিয়ে গেলে কলেজ স্ট্রিট থেকে লাগত দু’আনা। দু’পয়সা বাঁচাতে ওই একস্টপ হাঁটা ছিল আমার নিয়ম। রেলে প্রচুর ঘুষের ব্যাপার আছে বটে, কিন্তু আমার গোঁয়ার বাবা ঘুষকে গোমাংসতুল্য মনে করতেন বলে আমরা চিরকাল টানাটানির মধ্যে মানুষ।

খুব ইচ্ছে হত এই শহরেই বাস করি। এখানেই আমার স্থায়ী বসতি হোক। রহস্যময় এই শহরের বিখ্যাত দ্রষ্টব্যগুলিই শুধু নয়, এর গলির গলি তস্য গলির ভিতরেও যে কালপ্রাচীন রহস্যময়তা আছে তাও আমাকে সম্মোহক এক টানে বেঁধে ফেলেছিল। কিন্তু উপায় কী। পড়ছি আর্টস, চাকরিই হয়তো জুটবে না কলকাতায়

একা-একা আনমনে চেনা অচেনা অলিগলি ধরে উন্মাদ জীবনানন্দের মতো কত যে হেঁটে বেড়িয়েছি তার হিসেব নেই। শীতে, গ্রীষ্মে। মেট্রো সিনেমায় ঢুকতে গেলেই একজন অস্বাভাবিক লম্বা লোক হাত বাড়িয়ে টিকিট চাইত। অত লম্বা মানুষ কমই আছে। ফর্সা, সুন্দর চেহারা ছিল তাঁর। মনে হত সাহেব বা বিদেশি। পরে জেনেছি তিনি ছিলেন সরসীরঞ্জন চট্টোপাধ্যায়, নিকষ্যি বাঙালি। আর মেট্রোয় ছিল সেই বিখ্যাত কার্পেট, পা ফেললেই পা ডুবে যেত গভীরে। লাইটহাউসে ছিল আর এক চমক।

অন্য সব হলে পিছন থেকে ঢালু হয়ে সামনে নেমে যেত আসনের সারি, আর লাইটহাউসে ঠিক উলটোটা। সামনেটাই উঁচুতে, পিছনের দিকে ঢাল। ব্যাপারটা মজার ছিল। মেট্রোর গলি আর স্টার থিয়েটারের উলটো দিকে যে-দুটো তেলেভাজার দোকান ছিল তা কলকাতাবাসীর বড় আদরের। আমার গুরুদেব শ্রীশ্রীঠাকুর একটা কথা বলেছেন, জিহ্বার লাম্পট্য। কথাটা বড় খাঁটি। এইসব দোকান কলকাতাবাসীর জিহ্বাকে লাম্পট্যে প্ররোচিত করে আসছে বহু বছর ধরে।

ইস্টবেঙ্গল আর মোহনবাগান মাঠে খেলা দেখতে সবুজ গ্যালারির টিকিটের জন্য লাইন দিয়ে কী যে ধৈর্যের পরীক্ষা দিতে হত! ঠেলাগুঁতো, কোন প্রোব প্রবল শ্বাসবায় বা লেজের ঝাপটা সহ্য করতে করতে! ঢুকে যেতে পারলে একরকম শান্তি।

খেলার উন্মাদনার শেষে হেঁটে ফেরাও ছিল। না রুটিন। ইডেনে স্টেডিয়াম হবে শুনে সে কী উত্তেজনা আমার! শুরুও হয়েছিল, টাকার অভাবে মাত্র একটা গ্যালারি হয়ে কাজ বন্ধ হয়ে গেল। বছরের পর বছর সেই ন্যাড়া একটামাত্র গ্যালারি কলকাতার লজ্জা হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। তবু ওই গ্যালারিতে বসেই জয়সিমার সেই ধৈর্যশীল ইনিংস, রামনাথ কেনির প্রথাসিদ্ধ বিজ্ঞ ব্যাটিং, পটৌড়ির ক্ষিপ্র ফিল্ডিং আর কানহাইয়ের সেঞ্চুরি, কত কী দেখেছি, চড়া রোদে বেগুনপোড়া হতে হতে।

ওইটেই ছিল সবচেয়ে সস্তার গ্যালারি। ইনডোর তখনও হয়নি বটে, কিন্তু ইনডোর স্টেডিয়ামের খোলা জায়গাটায় সারারাত জেগে শুনেছি আইপিটিএ-র অনুষ্ঠান, ভারী সস্তার টিকিটে। ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায়, তারাপদ চক্রবর্তীর রাগপ্রধান, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের রোদিয়া রাধিকামোহন মৈত্রের আহির ভৈরোঁ আজও যেন কানে লেগে আছে। মাত্র আট আনায়।

পৃথিবীর সব বড় শহরেরই পুরনো আর নতুন দুটো মহল্লা থাকে। পুরনো মহল্লা বছরের পর বছর একইরকম থেকে যায়, তেমন বদলায় না। কিন্তু বদলে যায়, গুমোরে মকমক করে ওঠে নতুন সাজুগুজু করে ওঠা মহল্লা। কিন্তু কলকাতার পোড়াকপাল, তার নতুন মহল্লা হয়ে উঠল পরিকল্পনাহীন, হঠাৎ গজিয়ে ওঠা উদ্বাস্তু কলোনিগুলি। শ্রীহীন, দারিদ্রের শিলমোহর মারা টিনের চালের ঘরদোর। বিধানপল্লি আর বিজয়গড়ে আমার দুই ভিটেহারা পিসি ওইভাবেই বসত পেতেছিলেন। আমার নিয়মিত গতায়াত ছিল ওই দুই জনপদে। তবে সান্ত্বনা এই যে, সেখানে জামরুল, পেয়ারা বা সুপুরির গাছ ছিল তখনও, ছিল পুকুরও। এখন আর তাও নেই। শুধু বিল্ডিং আর বিল্ডিং।

রাত দুটোয় ব্রুকলিন ব্রিজ থেকে ম্যানহাটানের স্কাইলাইনের দিকে অবাক চোখে চেয়ে ভেবেছিলাম, একটা নেশন দেখো, বিল্ডিং দেখিয়েও কত রোজগার করে! ম্যানহাটানের বিল্ডিং দেখার জন্য দুনিয়ার লাখোলাখো মানুষ হন্যে হয়ে সারাবছর ছুটেছুটে আসে এখানে, রাতভোর ঘুরে বেড়ায়। টাইম স্কোয়ারে। আর এই থেকে কোটি কোটি ডলার হাতবদল হয়ে যায়, স্যামখুড়োর বিল বাড়ে। কলকাতার বিল্ডিং দেখতে কে আসবে? তবে কলকাতা কেন শুধুশুধু পুকুর বুজিয়ে, মাঠঘাট নষ্ট করে, গাছ মুড়িয়ে, পরিসরকে হত্যা করে বিল্ডিঙের পর বিল্ডিং বানিয়ে যায়! কেন শহরকে রসাতলে পাঠানোর জন্য এত বহুতল! কলকাতার কপাল কি শেষে শুধু বারবনিতার মতো? তাকে ভোগ করবে সবাই, কিন্তু ভালবাসবে না? হ্যাঁ, সত্য বটে, গত দশ বছরে কলকাতার কিছু পরিমার্জন হয়েছে।

রাস্তাঘাট পরিচ্ছন্নতর, হাসপাতালগুলি আর ততটা নরকের মতো নয়, যোধপুর পার্ক গার্লস স্কুলের পাশে কুখ্যাত দুর্গন্ধময় জীবাণুবিস্তারী ভ্যাট উধাও, নিউটাউন, রাজারহাট, লবণহ্রদ ভারী ঝকঝকে, বৃষ্টির জলের নিকাশি ব্যবস্থা অনেকটা ভাল। বিস্তর ফ্লাইওভার শহরকে অনেকটাই জ্যামমুক্ত করেছে। রাস্তাগুলোর নিয়মিত সংস্কার হয়। কিন্তু গাছের গোড়া বাঁধানো হয়। কেন? কেন রাস্তা বা ফুটপাথ আটকে মন্দির বা দেবস্থান তৈরি হয়? এখনও কেন মাঠঘাট লোপাট করে প্রোমোটিং? প্রশংসনীয় কাজও কম হয়নি, যেমন রাইটার্স স্থানান্তরিত হয়েছে নবান্নে, বহু সরকারি দফতর সরে গেছে সল্ট লেক-এ। এই শহরের ভার কমাতে আরও একটা বা দুটো রাজধানীও তো হতে পারে শিলিগুড়ি, কল্যাণী, বর্ধমান বা পুরুলিয়ায়। যেমন উত্তরপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র বা অনেক রাজ্যে আছে। কলকাতা কল্লোলিনী হয়েছে ঠিকই, কিন্তু তিলোত্তমা হয়ে ওঠা তার বুঝি বরাতে নেই।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Please disable your adblocker or whitelist this site!