class="post-template-default single single-post postid-51967 single-format-standard wp-custom-logo group-blog vl-boxed aa-prefix-matin-">
Shadow

আশরাফ উদ্‌দীন আহ্‌মদের গল্প : স্বপ্নভূমি

স্বপ্নভূমি

আশরাফ উদ্‌দীন আহ্‌মদের গল্প । ভোর-ভোর থাকতেই, হাঁড়ির কোণে থাকা একটু পান্তা কাঁচা লঙ্কা আর লবণ চটকে খেয়ে নেয় আকালু…

ভোর-ভোর থাকতেই, হাঁড়ির কোণে থাকা একটু পান্তা কাঁচা লঙ্কা আর লবণ চটকে খেয়ে নেয় আকালু। তারপর সাইকেলে চেপে বাতাসের বেগে ছুটে যায় ইউনিয়ন পরিষদে। আগেভাগে ধরতে হবে, সময় বলে কথা, সময়ের কাজ সময়ে না করলে পস্তাতে হয়; কিন্তু আকালু তো জীবনভর পস্তেই যাচ্ছে, হয়তো ওর ভবিতব্য! ফজর নামাজ পড়েই মেম্বার পরিষদে আসে। প্রথম সাক্ষাতে মেম্বারকে জানাতে হবে। খাঁড়ির জমিটুকুর জন্য যে গত মাসের আগের মাসে খুনোখুনির মতো একটা কিছু ঘটে গেছে, তার মামলার দিন পড়েছে, তাকে সদরে যেতে হবে। মামলা-মোকদ্দমা বলে কথা! ওই জায়গায় কেউ কি নিজের ইচ্ছেয় যেতে চায়। তারপরও যেতে হয়, ঠেকায় পড়ে।

আকালু শেখ সাধারণত কারও সাতপাঁচে থাকে না বটে; কিন্তু বিপদ পিছু ছাড়ে না তার। সবকিছুতেই সে জড়িয়ে যায়। রহমতপুরের যাত্রাদলের ফ্যাসাদের মধ্যেও তাকে জড়ানো হলো। ছয় মাসের কারাবাস করতে হলো। যাত্রার সুন্দরী নায়িকা শর্মিলীকে হাইজ্যাকের মামলা।

নদের চাঁদের বাপ সেবার শহর থেকে কার-বা মোটরসাইকেল ধান্ধা করে আনল; কিন্তু সেই ছিনতাইয়ের মামলায় আকালুকেও জড়িয়ে থানা-পুলিশ হলো। গত বর্ষার আগের বছর ফজরালীর বাড়িতে ডাকাতি হলো, কীভাবে কেমনে যে আকালুও জড়িয়ে গেল। তারপর বিলমালোই-বিল এনায়েতপুরের জমি নিয়েও রক্তারক্তি কাণ্ডতেও আকালু ফেঁসে গেল বড় একটা ফ্যাক্টর হয়ে। এবার সত্য-সত্যিই খাঁড়ির জমিটা নিয়ে যে বিবাদ, তার ন্যায্য হিস্যা কিন্তু আকালুকেই দিতে হবে। ভালো ফসল ফলে, বছরান্তের খোরাকটা চলে যায়। ওদের পাশের জমি আকালুর চাচাতো ভাই নইমুদ্দীর। সে এখন দাবি করছে পুরো খাঁড়ির জমি তার। ওই জমির অধিকার আকালুদের নেই।

সাতপুরুষের জমি হাতছাড়া হবে সে তো সহ্য করতে পারবে না। আকালুর ভাই-ভাতিজারাও এমন ঔদ্ধত্য কথা মেনে নিতে পারেনি। নিজের জমির বোরো ধান তুলতে দেবে না। শড়কি-বহলম লাঠিসোঁটা নিয়ে খানিক যুদ্ধ মতো কাজিয়া চলে। রক্তারক্তি একটা ঘটনা ঘটে। খুন কেউই হয়নি, উভয়পক্ষের মধ্যে টানটান উত্তেজনা চলে। থানা পুলিশ হয়, মামলা চলে যায় সদরে। জামিনও হয়ে যায়; কিন্তু একটা দাগ রয়ে যায়, এভাবেই দাগগুলো জীবনে এসে জোটে। কারও সাধ্য নেই সেই দাগ থেকে পরিত্রাণের।

আশরাফ উদ্‌দীন আহ্‌মদের গল্প

ইউনিয়ন চেয়ারম্যান নওয়াব মুন্সী বয়সের ভারে জরাজীর্ণ মানুষ। চিরকালই ভালো মানুষ বলে সুখ্যাতি আছে এ তল্লাটে। সবার হাঁড়ির খবর তার নখদর্পণে।

আকালু সালাম দিয়ে কিছু বলতে যাবে অমনি চেয়ারম্যান বললেন, মেয়েমানুষ আর মাটি হলো পৃথিবীর মানুষের শত্রু। এ দুটোর অধিকার কেউ ছাড়তে চায় না। আমি তো জানি খাঁড়ির জমিটুকু তোমাদের; কিন্তু নইমুদ্দীর এখন কিছু টাকা হয়েছে বলেই সে মানতে চায় না…

আকালু সাইকেলটা ইউনিয়ন পরিষদের প্রাচীরে হেলান দিয়ে এখন মাথা নিচু করে দাঁড়ায়। কী বা বলবে সে, চাচাতো ভাইয়ের কীর্তির কথা তো সবাই জানে। সেই দিনের নইমুদ্দী এখন আঙুল ফুলে কলাগাছ বলেই কি সাপের পাঁচ পা দেখেছে। সাতগ্রামের কাঁচামাল সাপ্লাই দিত শহরে। প্রথম-প্রথম নিজে করত, তারপর লোক দিয়ে। সেই থেকেই একটা মস্ত সুযোগ পেয়ে যায়। এখন বস্তা ভরে টাকা আসে তার আড়তে। সেই টাকার গৌরবে মাটিতে পা পড়ে না। আত্মীয়-অনাত্মীয় ধার ধারে না, চোখেমুখে এখন তার ভিন্ন ভাষা। সেই ভাষায় কথা বলে। মানুষের বাড়-বাড়ন্ত হলে এমন হয় কে বা জানে; কিন্তু নইমুদ্দী এমনই মানুষ, মানুষ কী বলা চলে, কিন্তু কে মানুষ আর কে বা জানোয়ার বোঝা ভারী শক্ত।

চেয়ারম্যান চাচা আবার বলল, ওই জমি নিয়ে কতবার সালিশ হলো, আমিন নিয়ে মাপজোখ হলো, তারপরও নইমুদ্দী মানতে চায় না, কী দিনকাল এলো রে খোদা! ওর বাপ তো খুব ভালো মানুষ ছিল, বন্ধু বলে বলছি না, নেহাতই গোবেচারা মানুষ একজন…

আকালু শেখ জানতে চাইল, এখন তো মামলার দিনক্ষণ ঠিক, হাজিরা দিতে হবে…

হ্যাঁ, সদরে তো যেতে হবে, একটা নিষ্পত্তি হওয়া দরকার।

চাচা, আপনাকে বরাবরই শ্রদ্ধা করি, তাই বলছি, সালিশে যখন নিষ্পত্তি হলোই না, তখন দেখি সদরে কী হয়।

সদরে বলো আর সালিশে বলো—আসলে ওর মতলব তো জানি, যেভাবে হোক খাঁড়ির জমি সে বাগিয়ে নেবে, ওর শক্তি আছে, টাকা আছে…

আকালু শেখ আর কথা বলতে পারে না। রোদটা এখন মাথার ওপর চড়ে বসেছে। সময় নেই আর, সাইকেল ঘুরিয়ে নিয়ে বাড়ির দিকে ছুটতে থাকে। মাটি ফেলা সড়ক, এর মধ্যে অনেক জায়গার মাটি কোথায় উড়ে গেছে। খালপাড়ের দিক দিয়ে সাইকেল চড়ে যেতে গিয়ে খাঁড়ির জমির ওপর দৃষ্টি যায়। বড় কপালি জমি, নিচু জমি বলে বাবা কতবার বিক্রি বেচতে চেয়েছিল; কিন্তু আজ ওর ফসলে মন ভরে যায়। বছরে একবার বন্যা হলে খাঁড়ির জমির মাটি পরিবর্তন হয়। মাটি ধুয়ে সুন্দর হয় এবং যে পলিমাটি দিয়ে যায় তাতেই উর্বর হয় জমি। জমির উর্বরাশক্তি বেড়ে যায়, তার প্রভাব পড়ে ফসলে। দ্বিগুণ ফসলে ভরে ওঠে মন। সোনা সোনা ধানে সোনা যেন উগলে দেয় খাঁড়ির জমি। সাইকেল থেকে নেমে আকালু অনেকটা সময় তাকিয়ে থাকে। জমি তো নয় যেন সোনার হংস। এমন সোনার ডিম পাড়া রাজহংস সে কীভাবে হাতছাড়া করবে ভেবে পায় না। যদি মোমের প্রতিমা হতো, তাহলে হয়তো সে কোলে নিয়ে আদর করত। আদরে-আদরে ভরিয়ে দিতে আজও বড় সাধ হয়। কত সোহাগ ভরা মাটি। আহা! বুকের গভীরে কত যে সুখ, কীভাবে বোঝাবে সে জানে না।

নইমুদ্দী রাতারাতি কেমনে কীভাবে যেন বদলে গেল। রক্তের যে একটা সম্পর্ক, সে সম্পর্ককেও অস্বীকার করে এখন। মূল কারণ হলো, পরিজান, পরিজানকে ভালোবাসত নইমুদ্দী; কিন্তু সে কখনো পাত্তা দিত না। একটা ধোঁয়ার ভেতর দিয়ে ভালোবাসা কখনো সার্থকতা পায় না। অথচ নইমুদ্দী নাছোড়বান্দা প্রায়। শেষাবধি পরিজানের বিয়ে দেওয়া হলো কাশিমপুর বাজারের আড়তদার কোবিদ হাজির ছোট ছেলে মোকারমের সঙ্গে। সার ডিলার মোকারম বাপের মতোই দুটো পয়সা ঘরে তুলতে পেরেছে; কিন্তু নইমুদ্দী তখনো ভেবাগণ্ডা, কাজকামে মন নেই, হাটে-বাজারে মেলায় ঘুরে বেড়ায়। আর সব কী ছাইপাঁশ গেলে, আরও কী অকাম-কুকাম করে। সেই পরিজানকে না পাওয়ার পুরো রেশ এসে পড়ে কলতাবানুর ওপর। কারণ আকালুর বউয়ের ছোট বোন পরিজান, ঘটনা এতটা গাঢ় হবে আগে জানত না। সে আক্রোশ আকালুর ওপর এসে পড়ে। তারপর থেকে সম্পর্ক অবনতির দিকে যায়। রক্তারক্তি কাণ্ড এবং মামলা তারই জের। জমিটার দিকে তাকিয়ে মনটা পরক্ষণে কেমন হয়ে ওঠে।

কলতাবানুর বাপের অনেক টাকা, অনেক সম্পদ-সম্পত্তি। দু-চারটে থানা এলাকায় তাদের জমি। আর তাই পরিজানকে ভালো ঘর-বর দেখেই বিয়ে দিয়েছে, যৌতুকও দিতে চেয়েছে; কিন্তু কোবিদ হাজি নিতে চায়নি। কলতাবানু জানে তার স্বামী আকালুও তেমনি স্বভাবের মানুষ। ভাঙবে কিন্তু মচকাবে না। তাদের বিয়েটা ছিল ভালোবাসার, পরিবারের সম্মতির কোনো প্রয়োজন লাগেনি। রাতারাতি পালিয়ে বিয়ে যাকে বলে; কিন্তু বিয়েটাকে দীর্ঘসময় পর স্বীকৃতি দেয় কলতাবানুর পরিবার।

আকালুরা বরাবরই বুনিয়াদি গেরস্থ। ওর বাপ-দাদারা এ তল্লাটের শক্তিমান সামন্তশ্রেণির মানুষ; কিন্তু বিলাসিতা আর শরিকে-শরিকে ভাগবাটোয়ারায় সম্পদ-সম্পত্তি ছোট হতে-হতে আজ প্রায় নিঃস্ব; কিন্তু তাতে কি! আকালু ওসবে কোনো মাথা ঘামায় না। নিজের যেটুকু আছে তাতেই সে খুশি। শ্বশুরবাড়ির দিকে তাকানোর মানুষ নয়, তার শুধু একটাই চাওয়া—নিজের খাঁড়ির জমিটুকু হলে দিব্যি চলে যাবে বছর। আর গায়ে খেটে যা রোজগার করে তাতেই সোনায় সোহাগা। মানুষের জীবনে চাহিদা কি আরও আরও জমি সম্পদ অর্থকড়ি! কিন্তু আকালুর অত খাঁই নেই, যা আছে তাতেই বেশ। মামলায় জিতলে জমিটা তার হবে, তারই তো জমি। শুধু ফালতু কেন যে নইমুদ্দী তাকে এভাবে নাজেহাল করছে, আহা সে যদি আরেকটু চিন্তা করত, নিজের চাচাতো ভাই। ওভাবে কি পরম আত্মীয়ের সঙ্গে পায়ে পা তুলে বিবাদ করে কেউ; কিন্তু সে অত ভালো নয়। একটা হেস্তনেস্ত করে ছাড়বে, আর এ জন্যই আদাজল খেয়ে তার পেছনে লেগেছে।

রোমান্টিক বিরহের গল্প

শহর কোর্ট-কাচারি মানে তো বিশাল ব্যাপার! সবাই হাত পেতে রয়েছে, দাও-দাও আরও দাও…

কত কিসিমের লোক যে শহর নগরে ঘোরে, তাদের ফন্দি-ফিকির বোঝা কার সাধ্য; কিন্তু সবাই বেশ ঘোড়েল। টাকাটা বেশ বোঝে, টাকাটাই তাদের কাছে পরম পাওয়া। আকালু কোর্ট, মামলা-মোকদ্দমা জেল-হাজতবাস সবই বোঝে, জীবন মানে যদি বেঁচে থাকা হয়, তাহলে এগুলোও জীবনের সঙ্গে এঁটেসেঁটে থাকে। কোনোভাবে এগুলোকে বাদ দিয়ে জীবন সচল থাকে না। নিজের প্রাপ্য জমি নিয়ে অন্যায়ভাবে মামলা, কোনোভাবে মানতে না পারলেও বিপদটা চলে আসে।

কখনো-কখনো হয়তো কলতাবানুর বোন পরিজানের ওপর রাগটা গিয়ে পড়ে আকালুর; কিন্তু মুহূর্তে নিজেকে সামলে নেয়। অমন ফালতু একটা ছেলের সঙ্গে বিয়ে না হয়েই বরং ভালো হয়েছে। তারপরও মনের মধ্যে কেমন খচখচ করতে থাকে। আপন চাচার ছেলে। যে চাচার বুকে পিঠে চড়েই বড় হয়েছে সে। আর আজ কিনা সেই চাচার ছেলের সঙ্গে যুদ্ধ করতে শহরে যাচ্ছে মামলায় লড়তে। ভাবতেই মনটা কেমন বিমর্ষ হয়ে যায়। কাজটা কি সঠিক হচ্ছে, বাড়াবাড়ি নয়তো! পরিজানের প্রতিও একটা আক্রোশ বেড়ে ওঠে তার মধ্যে। ওই শালীকে না পেয়েই কিনা নইমুদ্দী আজ ক্ষেপা হয়ে উঠেছে; কিন্তু ক্ষেপা হলি তো হলি, তা নিজের চাচাতো ভাইয়ের প্রতি এত বিদ্বেষ কেন বাপু। শেষাবধি জমিটা কপাল থেকে খসে না যায়। হঠাৎ আকালু দিকভ্রান্ত হয়ে থেমে যায়। কী যে করবে ভেবে পায় না।

আরেকটু পরেই সকালের রোদটা চড়চড় করে বাড়বে। মাথার ওপর উঠে ডিগবাজি খেলবে। আকালু রোদের সঙ্গে বুক মিলিয়ে চলে যাবে শহরে। মামলায় তাকে জিততে হবে। ধানি জমি হোক তা এক ফসলি; কিন্তু সোনা ফসল ফলে। মন ভরিয়ে দেয়। খাঁড়ির জমির এত মূল্য কে তা আগে জানত। কলতাবানুর মতোই তার প্রিয় খাঁড়ি জমি বুক উজাড় করে দিতে জানে। ওর বোনকে না পেয়ে নইমুদ্দী আজ পাগলা ষাঁড়। তবে যতই হাঁকডাক করুক না কেন, সহজে অধিকার ছাড়বে না। কলতাবানুকে যেভাবে একদিন ছিনিয়ে নিয়েছে, তেমনি ভাবেই খাঁড়ির জমিও তার চ্যাঁটালো কপালে আসবে। সে তো মরতেই শিখেছে, মরে যাওয়া মানুষদের মৃত্যুকে ভয় দেখিয়ে লাভ নেই। নইমুদ্দী যদি ক্ষেপা শুয়োর হয়, তো সে অবশ্যই ক্ষেপা সিংহ। কোনো কথা শুনবে না মানবেও না।

আকালু শহরের উদ্দেশে ছুটে যায়। সকালের প্রথম বাসটা পেলে বেশ সুবিধা হয়। মাথার মধ্যে এখন আর অন্য কোনো চিন্তা আসে না। মামলায় জিততে হবে এবং কলতাবানুকে যেমন একেবারে নিজের করে পেয়েছে, তেমনি খাঁড়ি জমিটুকু তার চাই। চোখে তার স্বপ্নিল স্বপ্নেরা ছায়ায় মতো চেপে আছে, সামনের সড়ক খুলে খুলে দিচ্ছে তার জন্য। সেই সড়ক ধরে আকালু ছুটে চলছে রাজার মতো।

ধ্রুব নীলের পরাবাস্তব হরর গল্প : টোপ 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Please disable your adblocker or whitelist this site!