class="post-template-default single single-post postid-2665 single-format-standard wp-custom-logo group-blog vl-boxed aa-prefix-matin-">
Shadow

প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য মনোদৈহিক গল্প : নব্বই মিনিট

১৮+ গল্পচলমান বর্ষা ও ফুটবলের মৌসুমে সারা দিনে একবার করে হলেও যে কথাটা সোহাগ দেওয়ান মনে মনে আওড়ায় সেটা হলো- আমাদের জীবনে ফুটবল খেলাটা একটা চক্রের মতো, চক্র গোল, বলও গোল, আর বল খেলাটাও শুরু হয় মধ্য রাতে, মানুষে মানুষে খেলা, আরে খেলাই তো! এরপর চিন্তাটা খেই হারিয়ে ফেলতে শুরু করলে সোহাগ দেওয়ান মনস্থির করে বিশ্বকাপ ফুটবল নিয়ে তার ২০ বছর আগের গল্পটা আবার নতুন করে বলার সময় হয়েছে, কারণ গত বিশ্বকাপের সময় গল্পটার বলার মতো ফুরসৎ তার হাতে ছিল না, আর এবারের মৌসুমে যে সকল নতুন বন্ধু যোগ হয়েছে, তারা আসলে বেশিরভাগই কলিগ এবং তাদের হাতে এ ধরনের গল্প শোনার মতো যথেষ্ট অবসর থাকে, ‘চুরানব্বইর বিশ্বকাপের পর আমার কাছে ফুটবল জিনিসটাই একেবারে অন্যরকম লাগে। ফুটবল আসলে একটা খেলা না, এইটার একটা হিসাব আছে, লেজার ব্যালেন্সের মতো দুই সাইডে মিল থাকতে হয়, নইলে নব্বই মিনিট কাটবে কেমনে?’ সোহাগ দেওয়ান চেষ্টা করে গল্পে সাসপেন্স তৈরি করার, কিন্তু সরকারি ব্যাংকের অফিসার হওয়ায় তার আর লেখালেখির ধাঁচ গড়ে ওঠে না, তাই সে তার নিজের মতো করেই একটা জাঁকালো শুরু দেওয়ার চেষ্টা করে। কেন কেন? ‘আরে ওই বিশ্বকাপে আমার বয়স ছিল ষোলো কি সতের, খাড়ান ক্যালকুলেটরে বাইর করি, না আঠারো, একেবারে কাটায় কাটায়, অর্থাৎ গল্পটার শুরুতেই সোহাগ দেওয়ানের রহস্যময় হয়ে ওঠার বয়সটাও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে জুড়ে বসে এবং দুয়েকজনের দৃশ্যপটে ভেসে ওঠে ছোঁক ছোঁক করা এক কিশোরের ছবি, যে কিনা একটু পরই বইখাতা টেবিলে রেখে খেলা দেখার জন্য প্রতিবেশীর টিভিতে উঁকি দেবে, তা গভীর রাত ছাড়া বিশ্বকাপটা তখন জমতো না এবং তুমুল বর্ষাও বাধা হয়ে দাঁড়াতো না পাড়ার মুরুব্বিদের জন্য, তারা ছাতা মাথায় দিয়ে হলেও পাশের বাসার ভাড়াটিয়ার নতুন কেনা নিপ্পন সাদাকালো টিভিতে খেলা শুরুর পাঁচ দশ মিনিট আগেই হাজির হবে। জালাল মঞ্জিল নামের মহল্লার পশ্চিম প্রান্তে পর পর চারটি বেড়ার ঘর এবং এর মাঝেরটিতে থাকতো সোহাগ দেওয়ানরা। তার কথা মতো, ‘আমার সামনে ম্যাট্রিক পরীক্ষা, তারপরও ধরেন বৃষ্টি আসলে মন কেমন জানি করতো, বইখাতা বাদ দিয়া বাইরে যাইতে মন চাইতো, ঘন জঙ্গলে ঝুম বৃষ্টি, তখন ধরেন বয়সকাল, পাশের বাসার দিদি ভাবীদের শাড়ির ফাঁকে পেটের দিকে চোখ যাওয়ার বয়স,’ গল্পসভায় প্রশংসা উঠে গেল, আরে মিয়া আপনে তো কবি মানুষ দেখি! ‘আরে আমারে বলতে দেন ঘটনাটা। সেদিনও পুরা ঝড়বাদলার রাইত, বাড়ির সামনে একতাল পানি, আব্বা তারপরও বাইর হইল, আম্মার বকাবকি শুনলোই না।’ সবাই জানে এসব হলো গল্পের আগাছা কিংবা গ্লাস থেকে ছলকে পড়া পানির দলা, যেটা গড়াতে গড়াতে আসল জায়গায় গিয়ে মিশে যাবে। ‘আব্বা যাওয়ার সময় পাশের বাসার হুদা কাকারেও ডাক দেয়। হুদা কাকার ঘরে তখন যুবতী বউ, তার নাম জানি না, জানলেও ভুলে গেছি এতদিনে।’ এই বলে হাফটাইমের বিরতি দেওয়া রেফারির বাঁশির মতো করে শিস বাজায় সোহাগ দেওয়ান, তারপর হা করে থাকা মুখগুলোর সামনে আবার কিছু অহেতুক শব্দের ড্রিবলিং করে এই বলে “উনাকে আমার কখনই আন্টি বলে ডাকতে ইচ্ছে করে না, আর আপনারা শুনলে হাসবেন যে আমি উনাকে মাঝে মাঝে ভাবী বলেও ডাইকা ফেলসি, বয়সের দোষ আর কি, অবশ্য না, বয়সের দোষ ক্যান দিব শুধু শুধু! হুদা কাকা বয়স্ক লোক, উনি বিয়া করতে গেল এক কলেজ পড়া মাইয়ারে, আই মিন আন্টিরে। তারউপর ধরেন হুদা কাকার ছোট ভাইয়েরও তখন বিয়ার বয়স চলতেসে।” নতুন চরিত্রের গন্ধ পেয়ে সবাই নড়েচড়ে বসলেও তারা হুট করে ধরতে পারে না যে নতুন এই চরিত্রের এন্ট্রিটা আচমকা বোর্ড উঁচিয়ে প্লেয়ার পাল্টানোর মতো ঘটনা, যেন কেউ একগাদা ইঙ্গিত মিশিয়ে বলল, ‘এইবার নতুন পেলেয়ার আসছে’। এই সব কথায় কান না দিয়ে বলটাকে খানিকক্ষণ নাড়াচাড়া করে সোহাগ দেওয়ান, কারণ পাস দেওয়ার লোক নাই, তাই নিজেই আবার ইতিউতি লাথি মারে, “বৃষ্টির মধ্যে শুনতে পাইলাম থপাথপ করে চলে গেল দুই জন। হুদা কাকার গলা শুনলাম। এরপর মিয়া, আপনারা শুনলে তো মাইন্ড করতে পারেন, তবে আমি কিন্তুক আগেই বলসি, বয়স আমার তখন ষোলো, আর আমি একটু বেশি ইয়ে.. মানে.. যাই হোক, ঘটনায় আসি। অনেকক্ষণ হইল আকাশে গুড়ুম গাড়ুম শব্দ নাই। ধুমধুমাইয়া বৃষ্টিই হইতেসে। বইখাতা রাইখা আমি সোজা গেলাম বেড়ার দেওয়ালে। ফুটায় চোখ রাখলাম, সাইজে ছোট হইলেও সব পরিষ্কার, এক মাস ধইরা খুঁচাইয়া খুঁচাইয়া বানাইসি, কারেন্ট তো অনেক আগেই নাই, অইপাশে টিমটিমা হারিকেন জ্বলে। আমার চোখ বেড়ার ফুটায়, কানে আসে খেলার কমেন্ট্রি।” বিরতিহীন শুনে গেল সহকর্মীগুলো, শুধু দুয়েকজন কান খাড়া করে রাখতে রাখতে হিসাবের খাতায় কতগুলো সংখ্যা তুলে নিল। তারা আচমকা নিজেদেরকে সোহাগ দেওয়ানের জায়গায় নিজেকে কল্পনা করে শিহরিতও হলো। একইসঙ্গে মনে করলো যে ওই দিন আসলে আর্জেন্টিনা আর গ্রিসের খেলা হয়েছিল।

প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য মনোদৈহিক গল্প : দর্শক

পাশের এক সহকর্মী সোহাগ দেওয়ানের দেওয়া রগরগে বর্ণনার ওপর ভিত্তি করে একটা দৃশ্যপট তৈরির কাজে হাত দিল। হাতে খতিয়ানের খাতা। মনেও একটা খাতা। তাতে লিখে চলেছে বৃষ্টিময় সেই রহস্যরাতের গল্প। যে গল্পের শব্দগুলো দারুণ বিক্ষিপ্তভাবে কাঁপছিল ফুটবলের মাঠে। গলে পড়ছিল বেড়ার ফুটো দিয়েও। ক্যানিজিয়া-ম্যারাডোনা-বাতিস্তুতা! বেড়ার ফুটোর ওপাশে বিছানায় একা তরুণী। চোখ ঈষৎ খোলা। সিলিং ফ্যানের দিকে তাকিয়ে। বাতিস্তুতার প্রথম গোল! বৃষ্টির তেজ কম, দুয়েকজন হই হই করে ওঠায় তরুণীর ধ্যান ভাঙে। পাশ বালিশ আঁকড়ে ধরে। শ্যামলা লম্বাটে মুখটা না দেখতে পেয়ে খানিকটা বিচলিত কিশোর সোহাগ দেওয়ান। হাল ছাড়ে না তবু। হারিকেনের আলো আর কতটুক্ইু বা। মনে মনে গাল দেয় কিশোর, বিশ্বকাপটা চার বছর পর পর কেন আসে! হারিকেনের আলোয় ক্রমে আরেকটা মুখ ভেসে ওঠে। অল্প আলোয় চোখ সয়ে আসে কিশোরের। আগন্তুককে সে আগে থেকেই চেনে। তবে ওই পরিস্থিতিতে অচেনা এবং একেবারে বাইরের কেউই মনে হয়। ক্যানিজিয়া থেকে ম্যারাডোনা, বল পায়ে একা ম্যারাডোনা মাঝ মাঠে। খাটের দিকে গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে আসে সেই আপাত অচেনা মানুষটা এবং কিশোর দেওয়ানের চোখের পাতা আরও টান টান হয়। ঘুমকাতুরে চোখ বেড়ার ফুটোর মাঝে ঝাপসা পর্দা তৈরি করে বারবার। হাত দিয়ে চোখ ঘষে একটা মুহূর্তও নষ্ট করতে রাজি নয় কিশোর। কিশোর সোহাগ দেওয়ান তার কিশোর মনে এক অন্য পার্টিগণিত কষার চেষ্টা করে। জ্যামিতি আর বীজগণিতে তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে বার বার। গোঁজামিল দেওয়া সমাধানটা হলো হুদা কাকার যুবক ভাইটা আসলে ফুটবল খেলা দেখে না, বা দেখতে চায় না। সে অন্যদের খেলার সুযোগ নেয়। বাতিস্তুতা! গোল! চমকে ওঠে যুবক। তরুণীর মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে। এর মানে হতে পারে, হাফটাইমের ঢের দেরি। প্রথম দিনের খেলায় একই দৃশ্য দেখেছিল কিশোর দেওয়ান। তাই অংকটা ভালোই শিখেছে। একটু পর তরুণীর দিকে উবু হয়ে ঝুঁকবে যুবক, চুমু খাবে। চুমু খেলোও। তারপর আরেকটা। বাতিস্তুতার দ্বিতীয় গোল! তরুণী বাধা দিল সামান্য, যুবকের মতো কিশোরের ভ্রূটাও ভাঁজ হলো যুগপৎ। যুবক আলগোছে উঠে পড়ে বিছানায়। তরুণী বালিশে হেলান দেয়। বসে পড়ে বিশেষ ভঙ্গিতে। এটাই প্রেম? হবে হয়ত। যুবকের চুল হাতড়াচ্ছে তরুণী, কী যেন বলল যুবক, ঘুম জড়ানো গলা। যুবক আবার মাথা তুলে তরুণীর কপালে চুমু দেয়। ঢোক গিলে কিশোর দেওয়ান। শোনা গেল হাফটাইমের বাঁশি! যুবক ধীরেসুস্থে সরে যায়? বেরিয়ে যায় রুম থেকে। তরুণী বসে থাকে চুপচাপ। ভয় নেই তার ভেতর। হুদা কাকা এখন ঘরে আসবে ঘরে চোরটোর ঢুকেছে কিনা দেখতে। তারপর গতরাতের মতো আজও তার কাছে সব ঠিক মনে হবে এবং পনের মিনিট পার হওয়ার আগেই তিনি আবার ছাতা হাতে হাঁটা ধরবেন। তবে আজ হুদা কাকা এলেন না। মিনিট কেটে গেল মিনিট পনের। খেলা শুরু হয়ে গেল। ফিরে এলো যুবক। এবার বীরদর্পে। তরুণীর চোখে টিমটিমে হারিকেনের প্রতিচ্ছবি দেখে কিশোরের অংক মেলে না, এ কেমন চোখ বাবা! এভাবে কী দেখে! ক্যানিজিয়া বাতিস্তুতার মাঝে বল পাস হয়, দর্শকের উত্তেজনা বাড়ে, তারা চূড়ান্ত কিছুর অপেক্ষায় থেকে হতাশ হয়, কান্ত হয়, হাই তোলে। এর মাঝে রেফারির বাঁশি কিশোরের কানে ঝাঁ ঝাঁ করে বাজতে থাকে। কিশোর সোহাগ দেওয়ানের সামনে অবারিত মাঠ। মাঠে ঝুম বৃষ্টি, আছে আকাশ থেকে চুইয়ে পড়া আধো আলো, আধো আঁধার। গ্যালারিতে একা দর্শক সে। বেড়ার ফুটোটা হয়ে গেছে আকাশের সমান চওড়া। মাঠে যুবক আর তরুণীর বিজয়োল্লাশ। দুজনের চোখেই জ্বলতে শুরু করে হারিকেনের সলতে। কিশোর সোহাগ দেওয়ান অংক সাজায়, নব্বই মিনিট বুঝি শেষ হতে চলল!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Please disable your adblocker or whitelist this site!