ছয় জগতের ছয়জন মানুষ। আচমকা একদিন আটকা পড়েছেন একটি ঘরে। সেখানে বেজে চলেছে একটি রেকর্ডিং। বদ্ধ সেই ঘরে নেই কোনো খাবার। আছে শুধু ছয়টি পানির বোতল। ভেতরের ছয়জনকে খেলতে হবে একটি খেলা। যে খেলার ফল ঠিক করে দেবে ছয়জনের মধ্যে কারা শেষ পর্যন্ত বেঁচে থাকবে। গল্পটি লিখেছেন জনপ্রিয় গল্পকার ধ্রুব নীল
এই লেখকের সমস্ত বই পাবেন এই লিংকে
পর্ব-১
কাবাডি
‘আসুন আমরা একটা খেলা খেলি। খেলার নাম কাবাডি। নিয়মটা হলো…।’
‘কে!’
যে চেঁচিয়ে উঠল তার ঘুম ভেঙেছিল সবার আগে। টিমটিমে একটা টিউবলাইটের আলোয় চোখ সয়ে আসার পর কোটের ধুলো ঝাড়তে ঝাড়তে পুরোনো ঘরটার মলিন আসবাব ও ছুড়ে ফেলা জামাকাপড়ের মতো দলা পাকিয়ে থাকা বাকি দেহগুলোও তার নজরে আসে। শুনতে পায় রেডিওর অনুষ্ঠানে বিরতিতে বেজে ওঠা স্টিংগারের মতো মিউজিক। এরপর রেকর্ড করা কণ্ঠ- ‘আসুন আমরা একটা খেলা খেলি…।’
‘কে কথা বলে! বেরিয়ে আসেন। এই যে! কে আপনি!’
রেকর্ড করা কণ্ঠের ভ্রƒক্ষেপ নেই। ওতে বাজছে, ‘আপনাদের ছয়জনের জন্য ছয়টা…
ধীরে ধীরে নড়ে উঠল আরেকজন। শার্ট-প্যান্ট পরা লোকটার বয়স ও পোশাক দেখে প্রথমজন আঁচ করে নিল লোকটা হয়তো মাঝারি আকারের ডিপার্টমেন্টাল স্টোরের ম্যানেজার কিংবা বড় কোনো অফিসের কেরানি। ঝটপট কয়েক কদম হেঁটে নিল প্রথমজন।
সোফার পেছনে দলা পাকিয়ে অদ্ভুত কায়দায় শুয়ে আছে এক তরুণী। টিশার্ট পরা তরুণ উপুড় হয়ে আছে দরজার কাছে। মধ্যবয়সী আরেক লোক ঘরের এক কোণে হালকা নড়াচড়া করছে।
‘সবাই মরে গেছে নাকি?’
‘জানি না।’
জেগে ওঠা দ্বিতীয় লোকটা গায়ের ধুলো ঝাড়ল না। হাই তুলতে গিয়ে পেট ধরে বসে পড়লেন একটা চেয়ারে। কোথায় কিংবা আশপাশে কারা শুয়ে আছে এসব জানতে না চেয়ে সে বলল, ‘ভাই বাথরুমটা কোনদিকে?’
‘আমি কী করে বলবো! আজব তো। এটা আমার ঘর নাকি!’
রেকর্ড করা কণ্ঠটা ওদিকে বলছে, ‘শর্ত হলো এই ঘর থেকে বের হতে চাইলে আপনাদের পানিটা…।’
‘কে কথা বলছে বলুন তো? অ্যাই কে তুই! বেরিয়ে আয় হারামজাদা!’
হা করে রইল দ্বিতীয়জন।
‘ওটা তো মনে হয় রেকর্ড করা গলা, আপনার কথার জবাব দেবে না।’
‘আপনি জানলেন কী করে?’
‘শুনেই তো বুঝা যায়। আমি রশিদ। ঢাকা সুপেরিয়র কলেজের টিচার। সায়েন্স পড়াই। আমিও জানি না ভাই এখানে কী করে এলাম। পানি হবে আপনার কাছে? আশপাশে তো জগ টগ দেখছি না। বেসিনও দেখছি না।’
‘পানি! পানি নিয়ে কী যেন বলছিল লোকটা। মানে ওই রেকর্ড করা কণ্ঠটা।’
‘আপনার পরিচয়?’
প্রথম জেগে ওঠা লোকটা সাবধানে একটা সোফায় বসল। কিছু বলার আগেই খসখসে গলায় ধমক, ‘থু থু। যাহ। ছু ছু। কসম কইতাসি!’
অস্ফূট শব্দগুলো শুনে জেগে থাকা দুজন চমকে উঠলেও ক্লান্তিজনিত কারণে সহসা নড়তে পারল না। জেগে ওঠা তৃতীয় সদস্য মধ্যবয়সী পুরুষ। গালে খোঁচা দাড়ি। পরনে কড়া রঙের একটা শার্ট আর মলিন জিন্স। তড়াক করে উঠেই অগ্নিঝরা চোখে তাকাল দুজনের দিকে।
‘আফনেরা কিডা?’
‘বসুন। শান্ত হয়ে বসুন। দুস্বপ্ন দেখছিলেন আপনি।’
‘এখনও স্বপ্নই দেখতাসি?’
চট করে উত্তর দিতে পারল না কেউ। গলায় পেঁচানো টাইটা খুলতে খুলতে প্রথমজন একটা কিছু বলার প্রস্তুতি নিল।
‘আমি দীপঙ্কর। ভিঞ্চি গ্রুপের মালিক। যতদূর মনে পড়ে, আমি আমার ধানমণ্ডির ডুপ্লেক্স বাড়িটার দিকে যাচ্ছিলাম। পথে সম্ভবত কোনো অ্যাকসিডেন্ট, নাহ.. অ্যাকসিডেন্ট না।’
ভাবনায় তলিয়ে গেল দীপঙ্কর। সর্বশেষ কী হয়েছিল মনে করতে পারছে না। কতদিন আগের কথা বলছিল সেটাও বুঝতে পারল না। যেদিনের কথা মনে পড়েছিল সেদিন তো ঠিকঠাক বাড়ি ফিরেছে সে। তারপর ফোন করে জানতে পারল স্ত্রী ড. মালতী দেবীর ফিরতে দেরি হবে। সে ছিল একটা কনফারেন্স নাকি কীসে। এর পরদিন বা আগেরদিন সম্ভবত একটা সুপারশপে ঢুকেছিল দীপঙ্কর। মাঝে কোনো এক ফাঁকে ভোরবেলায় জগিং করেছে। এর মধ্যে সর্বশেষ স্মৃতি কোনটা?
‘আমি ভাই রশিদ খন্দকার। সুপেরিয়র কলেজের টিচার। বাড়ি কুষ্টিয়া। আপনার নাম?’
তৃতীয়জনের ঘুম কাটলেও সন্দেহ কাটেনি। সাবধানে প্যান্টের পকেট ও কোমরে হাত বোলাল। যেটা খুঁজছিল সেটা নেই।
‘কী খুঁজছেন? অস্ত্র নাকি! দেখেই বুঝেছি আপনি সন্ত্রাসী।’ কথাগুলো বলে ফের মিইয়ে গেল দীপঙ্কর। সন্ত্রাসীকে সন্ত্রাসী বলায় যদি এখন তাকে খুন করতে আসে। আশপাশ দেখল ব্যবসায়ী। অনেক কিছু থাকার পরও মনে হলো কিছু নেই ঘরটায়।
‘আপনেরা কী চান! আমারে ধইরা আনসেন ক্যান!’
হেসে উঠল রশিদ। তৃতীয় লোকটার কথায় দীপঙ্করও কিছুটা স্বস্তি পেল। কিছু বলল না। দুজনেরই মনে হলো তারা কাউকে কোনো উত্তর দিতে বাধ্য নয়।
মিনিটখানেকের মধ্যেই জেগে উঠল বিচিত্র কায়দায় শুয়ে থাকা তরুণী, উপুড় হয়ে পড়ে থাকা যুবক। পাশে রাখা চশমাটা কাঁপা হাতে হাতড়ে পরে নিল। বয়স বিশ-বাইশ হবে। খানিক বাদে পাশের আরেকটা ঘরের দরজা খুলে টলতে টলতে এসে দাঁড়াল এক নারী। বয়স ষাটের কোটায় হলেও বেশ শক্তসমর্থ মনে হলো তাকে। তবে চোখের দৃষ্টি বলে দেয়, স্মৃতিবিভ্রমজনিত সমস্যায় সে আগে থেকেই ভুগছে।
ওদিকে রেকর্ড করা কণ্ঠটা বলছে, ‘….আপনাদের সামনে দুটো অপশন। অপশন এক। একসঙ্গে সবাই যার যার বোতলের পানি খেয়ে ফেলতে পারেন…।’
‘ওহ… মনে পড়েছে।’
বৃদ্ধার কথায় নড়েচড়ে বসলো বাকিরা। এই বুঝি পরিষ্কার হবে ঘটনা।
‘কী মনে পড়েছে? আমরা কোথায় আছি? কে ধরে এনেছে এসব?’
‘আমি রাজশাহী গিয়েছিলাম বোনের বাড়ি। তারপর.. মল্লিকের বিয়ে হলো। সেটা তো টু থাউজেন্ড টোয়েন্টি.. না.. টোয়েন্টি ওয়ান। এখন যেন কত চলছে?’
বাকিরা আবার যার যার পরিচয়পর্বে মন দিল।
বছর পঁচিশেক হবে নুসরাত নামের তরুণীর। ঘরের তাপমাত্রায় মানাতে পারছিল না। শীত লাগছিল তার। আশপাশে কিছু না পেয়ে কোথা থেকে একটা চাদর যোগাড় করে পেঁচাল গায়ে। তাচ্ছিল্যের হাসি হাসল মন্টু নামের তৃতীয় লোকটা। যদিও সে মাঝে একবার তার নাম বলেছে সাগর বা সঞ্জয়। সম্ভবত মন্টুও তার নকল নাম। বৃদ্ধা স্বপ্রণোদিত হয়ে তার পরিচয়টা দিল ধীরেসুস্থে। যেন বড়সড় একটা গল্পের ভূমিকা দিয়েছে।
‘তো নাসরিন আফরোজা, আপনি কি ঢাকায় থাকেন নাকি পাবনায় গ্রামের বাড়িতে?’
‘নাহ। আমি থাকি…। গুলশানে। আমার ফ্ল্যাট। সজলকে বলেছিলাম আমার বিড়ালটাকে খাবার দিতে। ও কি আছে কিনা। আজ কত তারিখ যেন?’
‘আ.. আ.. আমার মনে হয় রেকর্ডিংটা আমাদের শোনা উচিত। আমার মনে হয়।’
ঘরের ভেতরেই শব্দ করে থুথু ফেলল মন্টু।
‘ওই মিয়া। আপনে বইলা দিবেন কী উচিত আর কী উচিত না?’
‘আমার মনে হয়।’ তরুণ মাথা নিচু করে ফেলল। সে বুঝতে পেরেছে একটা কিছু। রশিদ উঠে গিয়ে ছোট রুমটায় ঢুকতেই বুঝতে পারল নাসরিন আফরোজা যে ঘর থেকে বেরিয়েছে ওটা মূলত বাথরুম। রশিদ ঢুকে আবার দরজাটা ফাঁক করে জানতে চাইল, ‘ফ্লাশে পানি নেই। বেসিন, হ্যান্ড শাওয়ার কোনোটাতেই নেই। ভাগ্য ভালো যে টিস্যু আছে।’
‘কারও কাছে পানি হবে?’
বৃদ্ধার অনুরোধে তরুণী যেন একটা কাজ খুঁজে পেল। এদিক ওদিক খুঁজে না পেয়ে চোখ পড়ল শোকেসে। পাশাপাশি ছটা হাফ লিটারের বোতল রাখা। সবকটায় পানি আছে। একটা চেয়ার টেনে তাতে উঠে একটা বোতল ধরতে যাবে, তার আগেই চেঁচিয়ে উঠল তরুণ-
‘না না! ওটা খাওয়া যাবে না!’
‘ওই মিয়া, তুমি কেমনে জানো খাওয়া যাবে না? এইসব তোমার কাম? কী ধান্ধা কও দেখি! তিনটা কাম সারসি বুঝলা? তুমি কি আমার চাইর নম্বর হইতে চাও?’
‘তিনটা কাম মানে!’ চেঁচিয়ে উঠল দীপঙ্কর। আবার ভয় চেপে ধরেছে।
ইশারায় নিজের গলার কাছে আঙুল বুলিয়ে মন্টু বুঝিয়ে দিল সে তিনজনকে হত্যা করেছে।
তরুণ ঝেড়েকেশে বলল, ‘আমি চিনি না আপনাদের কাউকে। কিন্তু বুঝতে পারছি ঘটনাটা কী।’
‘তোমার নামটা কী বললে?’
ঘুম জড়ানো গলা বৃদ্ধার।
‘আমি নিপু। বুয়েট মেকাট্রনিক্স সেকেন্ড ইয়ার।’
‘ওহ। আমার বড় বোনের মেয়েটাও চান্স পেয়েছিল। পরে অবশ্য সে মেডিক্যালে..।’
বাধা দিল দীপঙ্কর। ‘আহা, থামুন তো। জরুরি আলাপ চলছে।’
নিপু বলল, ‘আপনারা দয়া করে একবার.. মনযোগ দিয়ে ওই স্পিকারে কী বলছে শুনবেন কি?’
চেয়ার ছেড়ে নিপুর পাশে বসল নুসরাত। ছেলেটাকে শান্তশিষ্ট মনে হয়েছে তার। ভরসা করা যায় আপাতত একেই।
সংবাদ শুরুর সময় যেমন মিউজিক বাজে, তেমনটা শোনা গেল আবার। তারপর…
‘আসুন আমরা একটা খেলা খেলি। খেলার নাম কাবাডি। নিয়মটা হলো, আপনাদের ছয়জনের জন্য ছয়টা বোতল রাখা আছে। এর মধ্যে পাঁচটি বোতলে আছে বিশুদ্ধ পানি। একটি বোতলে মেশানো আছে বিষাক্ত সায়ানাইড। শর্ত হলো এই ঘর থেকে বের হতে পারবেন শুধু পাঁচজন। আপনাদের সামনে দুটো অপশন। অপশন এক- একসঙ্গে সবাই যার যার বোতলের পানি খেয়ে ফেলতে পারেন। একজন মারা যাবেন। বাকিদের জন্য খুলে যাবে দরজা। পাবেন মুক্ত বাতাস ও প্রত্যেকে পাঁচ লক্ষ টাকা। অপশন দুই- কেউ ব্যক্তিগতভাবে মরে যাওয়ার ঝুঁকি নিতে না চাইলে তিনি অপেক্ষা করতে পারেন। যখন প্রচণ্ড তৃষ্ণায় কাতর হয়ে কেউ একজন পানি পান করবে আর তাতে যদি তিনি মারা যান, তাতেও আপনার জন্য খুলে যাবে দরজা। ধন্যবাদ। শুভ কামনা।’
খানিকক্ষণ মিউজিক বাজার পর আবার শুরু হলো একই কথা।
‘এবার বুঝতে পারলেন তো?’
নিপু পায়চারি করছে। কিছু মনে করার চেষ্টা করছে।
‘আমার তিয়াস লাগে নাই। কারও লাগলে সে এই পানি খাইতে পারে। হে হে হে।’
কেউ পাত্তা দিল না মন্টুর কথা। নিপু বুঝল, পরিস্থিতির গুরুত্ব ঘরের কেউই বুঝতে পারেনি।
এবার রশিদ উঠে দাঁড়ালেন। চেয়ারে দাঁড়িয়ে নামিয়ে আনলেন বোতলগুলো। কাছ থেকে দেখে বোঝার চেষ্টা করলেন কোনটার মধ্যে বিষাক্ত বস্তু মেশানো থাকতে পারে।
থ্রিলার গল্প: পোর্ট্রেট
আধা ঘণ্টা পর। এসিটা কাজ করছে না। চাদর ছুড়ে ফেলল নুসরাত। বাকিরাও ঘামতে শুরু করেছে। রুমে ফ্যান নেই। এর মাঝে নিপু ছাড়া প্রত্যেকেই ধাক্কা-টাক্কা দিয়ে ভাঙার চেষ্টা করেছে দরজাটা। কাজ হয়নি। উল্টো ক্লান্তি আরও চেপে বসেছে।
‘গলাটা শুকিয়ে যাচ্ছে। আমি পানি খাব।’
শুনেই লাফিয়ে উঠল মন্টু- ‘নেন নেন! কোন বোতল থেইকা খাইবেন বলেন। আমি খুইলা দিতেসি।’
বাধা দিল নুসরাত, ‘আন্টি, একটা বোতলে বিষ। কোনটায় আছে জানি না। বিষ মেশানো পানি খেলে সঙ্গে সঙ্গে মারা যাবেন।’
‘আর যদি না মরে তবে আমরা সবাই ওই বোতল থেকে একটু খেতে পারব। আমারও গলা শুকিয়ে…।’
দীপঙ্করের যুক্তি শুনেই ফেটে পড়ল নিপু।
‘তারপর! তারপর পাঁচটা বোতল থাকবে, তাও মাত্র হাফ লিটার করে। সেটা থেকে পরে কে চেখে দেখবে? আপনি? পানি খাওয়াটা এখানে সমাধান না। এই দরজা খুলবে পাঁচজনের জন্য। বুঝলেন?’
প্রতিটি বোতলের ঢাকনা খুলে ঘ্রাণ নিচ্ছেন রশিদ। সবকটা থেকেই কাঠবাদামের মতো একটা গন্ধ আসছে। সায়ানাইড মেশানো হলে এমন গন্ধই থাকবে। আড়ালের মানুষটা সেটা জানে। তাই বাকি বোতলগুলোতেও একই এসেন্স দিয়ে রেখেছে।
চার ঘণ্টার পর। সবাই যার যার মতো করে শুয়ে বসে আছে। ঘরটা তন্ন তন্ন করে খোঁজা শেষ। কিছু নেই। নিরেট দেয়ালের ওপাশে হয়ত এমন কিছু আছে যার কারণে তাদের চিৎকারও কেউ শোনেনি। আপাতত অস্থিরতার নামে কেউ আর তৃষ্ণা বাড়াতে রাজি নয়।
একটা বোতল হাতে বসে আছে মন্টু। বাকিগুলো সাজিয়ে রেখেছে রশিদ। ঘুমানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ নুসরাত। এতক্ষণ ঘুমিয়েই তো ছিল। টেনশন করছে না, কারণ তাকে নিয়ে টেনশন করার মতো কেউ নেই এ শহরে। চাকরি করে, একাই থাকে। কেউ জানবেই না যে সে হারিয়ে গেছে। দীপঙ্কর পায়চারি করছে আর ভাব দেখাচ্ছে যেন সব ভাবনা একাই ভাবছে।
উশখুস করছে নিপু। সে অনেক কিছু বলতে গিয়েও পারছে না। তার কথা ঠিকঠাক বোঝার মতো কেউ নেই বলেই কি।
‘তুমি কী যেন বলতে চাইছিলে?’ নুসরাতের কথায় উপলক্ষ পেল নিপু।
‘ইয়ে। এই যে ব্যাপারটা। মানে এই যে ঘর, পানির বোতল, বিষ, একজনকে মরতে হবে। এসব হলো এক ধরনের খেলা। সিনেমা, টিভি সিরিজে আছে এমনটা।’
‘তারমানে, এটা একটা ধাঁধা?’
মনোযোগ অন্যদিকে দেওয়ার ভাণ করে গুন গুন করছে মন্টু। তার কান নিপু আর নুসরাতের কথোপকথনে। মাথায় আসতে শুরু করেছে একটা প্ল্যান। রিভলবারটা সাথে থাকলে কবেই সে এই খেলার রাজা বনে যেত।
চুপচাপ রশিদ। নড়াচড়া একদমই করবে না ঠিক করেছে। শ্বাসও নিচ্ছে মেপে মেপে। তবে শার্টটা খুলেও ঘাম আটকাতে পারছে না। এভাবে ঘামতে থাকলে তিন দিন লাগবে না, দুদিনেই ডিহাইড্রেশনে মরবে।
রেকর্ড করা গলার শেষ কথাটা বারবার উঁকি দিচ্ছে রশিদের মনে। পাঁচ লাখ টাকা সমান কয় মাসের বেতন? মাসে পঁচিশ হাজার আর তিনটা ব্যাচ। আহারে মেয়েটা…। মনে পড়ল স্কুলপড়ুয়া লাবনীর কথা। তার স্ত্রী-কন্যা কি থানায় গেছে? পুলিশ তো ধরে নেবে রশিদ খন্দকার পালিয়েছে। তাকে কিডন্যাপ করার কোনো মোটিভই থাকার কথা না কারও।
জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে দীপঙ্কর। নিজেকে প্রবোধ দিতে ব্যাংকে কত কোটি আছে সেটা মনে করার চেষ্টা করল একবার। একটা একাউন্টেই আছে সাড়ে চারশ কোটি। এই ঘরের প্রত্যেককে কয়েক দফায় পাঁচ লাখ করে দিতে পারবে। কিন্তু কী এক উটকো ঝামেলায় পড়েছে যে এক ফোঁটা পানিও খেতে পারছে না। তার খোঁজে সহজে কেউ থানায়ও যাবে না। ভাববে জরুরি কাজে বিদেশে গেছে। আর এ অপহরণকারী তো মনে হয় না মুক্তিপণ চেয়ে ফোন করবে কাউকে। কী এক বিচ্ছিরি খেলা শুরু করেছে। বের হয়েই সবার আগে নিজের সিকিউরিটি বাড়াবে ঠিক করেছে দীপঙ্কর।
আরও ঘণ্টাখানেক পর। শরীরের ভেতরকার ঘড়িটা উল্টোপাল্টা আচরণ শুরু করেছে। দিন না রাতের হিসাব নেই কারও কাছে।
‘হাতে সময় নেই।’
নিপুর কথায় সবাই ফের সচকিত। যেন এখনই সে একটা বোতল খুলে ঢকঢক করে নিজের গলায় ঢালবে।
‘কেন সময় নেই?’
‘এখন কিছু ঘটবে?’
‘তোমার নামটা যেন কী ছেলে?’
প্রশ্নে কান নেই নিপুর। টেবিলে অদৃশ্য কাগজ বিছিয়ে কাল্পনিক আঁকিবুকি কেটে বোঝাতে শুরু করল।
‘আমরা আর বড়জোর… এখন যদি রাত হয় তবে বলতে পারি যে রাতটা টিকবো। এরপর আর কারও মাথা কাজ করবে না। তারপর কী হবে? তারপর কি আমাদের কেউ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পানি খাব? ধরে নিলাম, খেলাম আর বেঁচে গেলাম, তারপর? তারপর আবার সেই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হবে না?’
‘কিন্তু ধরো যে খাইল আর সে মইরা গেল, তাইলে?’
‘তা হলে মন্টু মিয়া আপনি বলুন, প্রথম পানিটা কে খাবে? আপনি?’
‘আমি আরও দুই দিন বাতাস খাইয়া থাকমু। বুঝলা মনুরা। আমি মরতাসি না এত সহজে।’
কথাটা বলে সোফা ছেড়ে বিশ্রি ভঙ্গিতে নাচার চেষ্টা করল মন্টু। ধপাস করে আছড়ে পড়ল ঝুলপড়া সোফার চেয়ারে। প্রচণ্ড শব্দে কয়েকটা হাঁচি দিয়ে শেষে আরও ক্লান্ত হয়ে পড়ল।
নিপু গলা খাদে নামিয়ে বলল, ‘আমি দেখেছি এসব। সিনেমায়। একদম সেইরকম একটা কিছু ঘটছে। কেউ একজন খেলছে। এখন সবাই শুনুন..।’
হাঁপিয়ে উঠছে নিপু। মন্টু উঠে বসল। একটা বোতল খুলে হাতে পানি ঢালতেই থেমে গেল সবাই। পিনপতন নীরবতা। শয়তানি হাসি হাসল না লোকটা। ইশারায় রশিদের কাছে জানতে চাইল পানিটা মাথায় ঢালা নিরাপদ কিনা। সম্মতি পেতেই সাবধানে চুল ভেজাল খানিকটা। দীপঙ্কর পানিটা ছোঁয়ার সাহস পেল না। বাকিরা ওই বোতল থেকেই হাত আর ঘাড়ে পানি ছিটিয়ে শরীরটাকে সান্ত¦না দিল যৎকিঞ্চিৎ।
‘এরপর.. মানে যদি, মানে ধরুন.. একে একে সব বলছি। ধরুন, পাঁচ বোতল পানি আমরা তিন দিনে শেষ করে দিলাম। তারপর শেষ বোতলটা থাকবে। আর আমাদের মধ্যে আছে ছয় জন। মরতে হবে একজনকে। তখন কে স্বেচ্ছায় ওই বোতল থেকে পানি খাবে বলুন? তা যদি না হয়, তবে এখনই তো আমরা সেটা ঠিক করতে পারি। ছয়জন ছয়টা বোতল হাতে একইসঙ্গে চুমুক দেব। যে মরার সে মরে যাবে, বাকিরা বেঁচে যাব।’
‘ইয়ে মন্দ বলোনি। সেটাই মনে হয়..।’
থেমে গেল দীপঙ্কর। ফ্যাকাসে স্বরটাকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে নুসরাত বলল, ‘তো, একসঙ্গে চুমুক দেবে সবাই? কী মনে হয়? আমরা কেউ রাজি আছি এতে?’
কিছু না বুঝেও হাত তুলল নাসরিন আফরোজা। সোফায় আধশোয়া হয়েই বৃদ্ধার দিকে ঢাকনা খোলা বোতলটা বাড়িয়ে দিল মন্টু। তাতে এখনো অর্ধেকটা পানি। বোতলটা নিয়ে ঢক ঢক করে পুরোটা গলায় চালান করে দিল বৃদ্ধা। তার মুখ দিয়ে বের হওয়া স্বস্তির শব্দটা সবার কানে আঘাত করল নীরব মিসাইলের মতো।
‘অ্যাঁ, মরেনি তো!’
খিক খিক করে হাসতে গিয়ে কাশতে শুরু করল মন্টু। বৃদ্ধা হেলান দিয়ে চোখ বুঁজল। বাকিরা ক্ষুব্ধ চোখে তাকিয়ে আছে বাকি পাঁচটা বোতলের দিকে।
‘আমি কই কি, এই বুড়িরে ধইরা সব বোতলের পানি খাওয়ানো হোক। হে হে হে।’
কথাটা হাতুড়ির বাড়ির মতো লাগল সবার মাথায়। একটা চেয়ার ভেঙে আগেই সেটার পায়া হাতে নিয়ে ঘুরছিল দীপঙ্কর। সেটা আরও শক্ত করে আঁকড়ে ধরল। বিশালদেহী রশিদের দিকে বিড়বিড় করে বলল, ‘আমার তো মনে হয় কাকে দিয়ে টেস্ট করাতে হবে সেটা আমরা জানি।’
মন্টু এবার চুপ। থ মেরে বসে রইল। বৃদ্ধা ছাড়া বাকিরা একটা বড় সোফায় পাশাপাশি চেপে বসল। কী ঘটতে চলেছে সেটা আঁচ করার প্রাণান্তকর চেষ্টা চালাচ্ছে মন্টু।
নিপু ফিসফিস করে উঠল, ‘একজনকে, একজনকে মরতেই হবে। অপশনগুলো হলো..।’
‘কী বলছো বাবা! কে মরবে?’ বলেই আবার কাত হয়ে চোখ বুঁজল বৃদ্ধা।
বলতে শুরু করল নুসরাত, ‘পরিস্থিতি মূলত তিনটা। প্রথমত আমরা যার যার বোতল নিয়ে পানি খেয়ে ফেলবো।’
‘ওহ না। না! আমি পারব না!’ প্রতিবাদ জানাল দীপঙ্কর।
‘দ্বিতীয়ত, আমরা বসে থাকবো, তৃষ্ণা আমাদের বাধ্য করবে সিদ্ধান্ত নিতে।’
‘কীয়ের সিদ্ধান্ত! আমি এর মধ্যে নাই। আমি কোনো পানি টানি খামু না। বুড়ি এক বোতল খাইয়া ফেলসে। মরে নাই। সে বাকি বোতলও খাইব।’
‘না না। আমি এত স্বার্থপর নই। আমি আর খাব না। আমার তৃষ্ণা নেই।’
‘চোপ! চোপ কইতাসি! ভকভকাইয়া পানিডা খাইয়া ফেলসে একা। ওই বোতল থিকা তো এক চুমুক দিতে পারতি আমগোরে!’
‘মন্টু! আমরা এখানে চারজন আছি!’
শাসাল নুসরাত। তার গলার বদলে যাওয়া স্বরে ভরসা পেল নিপু। সরাসরি এতক্ষণ মন্টুর চোখের দিকে তাকাতে পারছিল না।
‘তা নিপু, বাবা তুমিই বলো দেখি। এখন কী করবো?’
রশিদের কথায় মাথা চেপে আবার মানসাংক শুরু করে দিল নিপু। খানিক পর সবেগে উঠে দাঁড়াল। দুহাত বুকের কাছে ভাঁজ করে চেপে ধরল নিজেকে।
‘আর চব্বিশ ঘণ্টা পর কী ঘটবে জানি না। সত্যিই জানি না। আমরা পাগলের মতো আচরণ শুরু করে দিতে পারি। ঘরের তাপমাত্রা ক্রমাগত বাড়ছে। পানি ছাড়া তিন দিন বাঁচার কথা হলেও আমরা তত সময় পাচ্ছি না। আমাদের এখুনি সিদ্ধান্তটা নিতে হবে। বলুন তো, এই খেলার নাম কাবাডি কেন বলছে?’
দীপঙ্কর চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘পাঁচ লাখ! আমি সবাইকে পাঁচ.. না না পঞ্চাশ লাখ দেব, যে.. মানে যে পানিগুলো পরীক্ষা করবে তার পরিবার পাবে।’
‘তোর টেকায় আমি মুতি! আরেকটা কথা কবি তো তোরে গিলামু পানি।’
‘এক্সাক্টলি! এ কারণেই!’ চেঁচিয়ে উঠল নিপু।
দশ ঘণ্টা পর। পায়চারি করছে না কেউ। এতক্ষণ বিশেষ কিছু ঘটেনি। সবাই শক্তি সঞ্চয় করছে না হয় নিজের জীবনটাকে দেখার চেষ্টা করছে এক লহমায়।
নুসরাত এলোমেলো কিছু কথা বলেছে নিপুকে। সে নিজেও সেসব মনে করতে পারছে না। বার বার শুধু রশিদকে ছোট মামা বলে ডাকছে আর বলছে যেন তাকে নেত্রকোণার একটা টিকেট ম্যানেজ করে দেয়। রশিদ হা করে বাতাস গেলার চেষ্টা করছেন। ঘর্মাক্ত দীপঙ্কর ফ্লোরে প্রায় দিগম্বর হয়ে হাত-পা ছড়িয়ে আছেন।
নিপু চেয়ার বেয়ে শোকেসের উপরের অংশটা ভালো করে খুঁজল। কিছু না পেয়ে ছাদে লাগানো স্পিকারটা ধরার চেষ্টা করল। পারল না। সেখানে বেজেই চলেছে, আসুন আমরা একটা খেলা…।
‘পানি.. পানি।’
‘নেন। নেন এই বোতলটা একটু চুমুক দেন।’
‘হারামজাদা!’
ক্লান্ত হলেও এখনও মনোযোগ হারায়নি রশিদ। তার ধমকে সরে আসে মন্টুর হাত।
নুসরাত হাত বাড়িয়ে একটা বোতল নিতে যাচ্ছিল। থামিয়ে দিল নিপু। তার দুহাত আঁকড়ে বলল, ‘তুমি ভাবছো এক বোতল বিশুদ্ধ পানি খেয়ে তুমি বেঁচে যাবে? কয় ঘণ্টা? তারপর?’
নিপুর কথাটা বোঝার চেষ্টা করল নুসরাত। তারপর তার কাঁধে মাথা রেখে দিল ধপ করে।
দীপঙ্করের শরীরে শক্তি জমেছে কিছুটা। বাকিটা ইচ্ছাশক্তি। সবটুকু এক করে উঠে দাঁড়াল।
‘ইনাফ! রশিদ, নিপু, নুসরাত তোমরা আমার সঙ্গে আছো? ওকে… ওই যে ওই শয়তানটাকে আমরা পানি খাওয়াবো। আমার সঙ্গে যারা আছো তারা এদিকে… হ্যাঁ এ পাশে থাকো। ওই মাস্তান, ভাড়াটে খুনির বেঁচে থাকার কোনো অধিকার নাই। তোমরা শুধু হেল্প করো, প্রত্যেককে আমি দেব দশ লাখ.. না না বিশ লাখ করে। কড়কড়ে বিশ লাখ টাকা।’
‘ঠিক ঠিক।’ রশিদ মাথা ঝাঁকিয়ে চোখের ঝাপসা দৃষ্টি পরিষ্কার করার চেষ্টা করল। বেঁচে থাকার একটা শেষ আলো দেখে নড়ে বসল বৃদ্ধাও। নিপু ইতস্তত। নুসরাত মাথাটা কাত করে সোফায় দিয়ে রেখেছে। কারও সঙ্গে লড়াই করার শক্তি নেই আপাতত।
‘ওই! ওই মাদার..।’ গালিটা দিয়ে তেড়ে আসতে চেয়েছিল মন্টু। হুড়মুড়িয়ে পড়ে গেল।
‘আ.. আমি জানি না। তবে আমাদের হাতে সময় নেই।’ পানির অভাবে মাথা কাজ করছে না, বুঝতে পারল নিপু।
‘না না! অন্যায়!’ নিজের কানেই কথাটা হাস্যকর শোনাল বৃদ্ধার। ওদিকে নুসরাত কী বলল কেউ শুনতে পেল না। শুধু বৃদ্ধা আফরোজা নাসরিনের মগজ তখনও পানির জন্য উল্টোপাল্টা আচরণ শুরু করেনি। উঠে দাঁড়াল সে। শূন্য চোখে সামনে তাকিয়ে ভাবছে আকাশ-পাতাল।
দীপঙ্করের শরীরে অসূর ভর করল। বেঁচে থাকার আকুতির সঙ্গে যোগ হয়েছে অন্যের সমর্থন। সব মিলিয়ে আবার ফিরে পেয়েছে হারানো শক্তি। মন্টু পেরে উঠল না। সাঁড়াশির মতো পা দুটো আঁকড়ে আছে ধনকুবের ব্যবসায়ী।
নিপু এগিয়ে এসে হাত দুটো চেপে ধরল। একবার ধরে আবার ছেড়েও দিল। বাধা দিচ্ছে না মন্টু। নিজের মগজ প্রতিবাদ জানাল। আবার চেপে ধরল মন্টুর হাত।
আরেকটা পানির বোতল খুলল রশিদ। চকচকে হীরার টুকরার মতো বোতল ভরা পানিটা ঠিকরে উঠতে লাগল মন্টুর চোখের সামনে। ক্রমে আরও দুর্বল হয়ে এলো প্রতিরোধ।
রশিদ বোতলের মুখটা মন্টুর মুখের সামনে ধরে আছে। ঢেলে দিচ্ছে না। সে চায় মন্টু নিজেই পানি খেয়ে মরে যাক। দীপঙ্কর বিড় বিড় করে নিজেকে বলছে, ‘এতদূর এসেছি আমি। এত টাকা.. আমার এত টাকা। আমি কেন মরবো। আমি মরবো না রে!’
রশিদ বোতলের মুখটা ঢালু করতেই দুম করে সময়টা স্থির হয়ে গেল। দ্বিধায় পড়ে গেল মন্টু। মৃত্যুকে অবধারিত ভেবে শেষ চুমুকটা দেওয়ার হাহাকার ছাপিয়ে বড় হয়ে দেখা দিল বেঁচে থাকার আকুতি। মনে হলো বহুদূর থেকে নুসরাত চিৎকার করে উঠল, ‘না! না!’
ক্ষণিকের জন্য রশিদের হাত কেঁপে উঠল। ছুড়ে ফেলে দিল বোতলটা। গড়িয়ে মেঝেতে পড়ছে টলমলে পানি। চেঁচিয়ে উঠল দীপঙ্কর, ‘কী করলে তুমি! মারো! এই হারামজাদাকে মারো! সবাইকে এক কোটি করে দেব আমি! মেরে ফেলো ওকে। দেখি রশিদ, তুমি পা-টা ধরো। আমি খাওয়াবো ওকে পানি।’
একদিকে দীপঙ্করের হুংকার, অন্যদিকে মগজের ভেতর বেঁচে থাকার সাইরেন। রশিদ আর নিপু দুজনেই মাথা নিচু করে বসে আছে। পরাজিত সৈনিকের মতো। দুপাশে পা দিয়ে মন্টুর বুকের ওপর চেপে বসেছে দীপঙ্কর। হাতে নিল আরেকটা বোতল। ঢাকনাসহই পুরে দিতে চাইল মন্টুর মুখে। এবার ঘোর প্রতিবাদ। ঠোঁটে পানি পড়তেই ফুসস করে সবটুকু ছড়িয়ে দিল দীপঙ্করের গালে। রাগে লাল ব্যবসায়ী। এক হাতে সজোরে চেপে ধরল মন্টুর গাল।
মন্টু বুঝল আর রক্ষে নেই। সেকেন্ড দূরত্বে দেখতে পাচ্ছে মৃত্যুর তরল রূপ। ঠিক তখনই…কটাশ! কঁকিয়ে উঠল একটা চেয়ারের পায়া। ভেঙে দু টুকরো হয়েছে ওটা। একটা অংশ ছিটকে গেল দূরে। বাকি অংশ হাতে নির্বিকার দাঁড়িয়ে আফরোজা নাসরিন। দ্বিতীয় বাড়িটা দেওয়ার প্রয়োজন হলো না। হেলে পড়া ভাস্কর্যের মতো মেঝেতে লুটিয়ে পড়ল দীপঙ্করের নিথর দেহ। ফাটা মাথা থেকে গলগলিয়ে রক্তধারা দেখে বাকি সবার একটাই শব্দ মাথায় এলো, আহা! তরল!
বৃদ্ধা উবু হয়ে দীপঙ্করের গলার কাছে হাত রেখে নাড়ি চেক করল। মৃত্যু নিশ্চিত করতে পর পর আরও কয়েকবার আঘাত করল মাথায়। ছিটকে আসা রক্তের হাত থেকে নিজেদের বাঁচানোর চেষ্টা করল না কেউ। নিপু চিত হয়ে শুয়ে তাকিয়ে আছে স্পিকারটার দিকে। কয়েক মিনিট এভাবেই কেটে গেল। থেমে গেল ধারাবর্ণনা। নতুন একটা মিউজিক বাজল এবার। ওটা থামতেই শোনা গেল নতুন ঘোষণা।
‘খেলাটা শেষ করার জন্য আপনাদের ধন্যবাদ। অনুগ্রহ করে মৃতদেহটিকে ধরে টয়লেটের সিটে বসিয়ে আপনারা বাইরে বসুন। মৃত্যু নিশ্চিত করতে টয়লেটের ঠিক ওপরে থাকা ইনসিনারেটর নজল থেকে বের হবে আগুন। এর জন্য সময় পাবেন পাঁচ মিনিট। এরপর খুলে যাবে দরজা।’
এবার আর ঘোষণা রিপিট হলো না। নিপু ছাড়া বাকিরা সেটা বুঝতে পেরেছে বলেও মনে হলো না। সে যখন দীপঙ্করের রক্তাক্ত দেহটা টেনে বাথরুমে ঢোকানোর চেষ্টা করছে, বাকিরা অবাক হয়ে তাকিয়েই রইল। নুসরাতকে ইশারা করলে সে টলতে টলতে এসে ধরল। তাতে বিশেষ উপকার হলো না। মন্টুর দিকে চোখ পড়তেই চোখ সরাল নিপু। তেড়ে এলো না লোকটা। সে এসে ধরল দীপঙ্করের একটা পা। তবু পারছে না ভারী দেহটাকে নিয়ে যেতে।
বাথরুমের কাছে আসতেই পানিতে পিছলে হুড়মুড়িয়ে পড়ল সবাই। সহসা আর উঠে দাঁড়াতে পারল না কেউ। বিড় বিড় করে কিছু বলছে নিপু। রশিদ এসে ঝুঁকতেই তাকে বুঝিয়ে দিল কী করতে হবে। হাতে আছে আর মিনিট তিনেক।
তারপর যা ঘটল তাতে এক মিনিটও বোধহয় লাগল না। ঘর কাঁপিয়ে উন্মাদের চিৎকার করে নিথর দেহটা তুলে সোজা বসিয়ে দিল টয়লেটের ওপর। যেন পড়ে না যায় সেজন্য মাথাটা চেপে ধরে টাইটাও বেঁধে দিল ফ্লাশের হাতলের সঙ্গে। হামাগুড়ি দিয়ে বেরিয়ে আসতেই কানে এলো আগুনের শব্দ। পোড়া গন্ধটা নাকে আসতেই উপুড় হয়ে গোঙ্গাতে লাগল রশিদ। তাকে টেনে ধরে সোফার কাছে নিয়ে এলো কেউ একজন। এরপর কানে এলো নুসরাতের গলা, ‘মামা! দরজা খুলে গেছে! ও মামা!’
ড্রয়িং রুমের মতো একটা ঘর। টেবিলের ওপর বড় দুটো পানির বোতল। ‘কমপ্লিমেন্টারি’ লেখা স্লিপ ঝুলছে তাতে। দুটো বোতলের তলানিতে লেগে আছে সামান্য পানি। গলা পর্যন্ত গিলে বেহুঁশ পাঁচজন।
ভেতরে ঢুকলো পিপিই পরা কয়েকজন লোক। অজ্ঞান পড়ে থাকা প্রত্যেকের রক্তে ভেজা কাপড় বদলে পরিয়ে দিল নতুন জামা। এরপর ঘরের ভেতরটা পরিষ্কারের জন্য কেউ একজন নির্দেশনা দিল। কয়েকজন মিলে অজ্ঞান সদস্যদের ধরে তুলে নিল একটি গাড়িতে।
দুদিন পর। স্ত্রী-কন্যাকে নিয়ে দামি রেস্তোরাঁয় খেতে গেছে রশিদ। তারা জানে সে গ্রামে গিয়েছিল জরুরি ডাকে। মোবাইল নেটওয়ার্কের বাইরে ছিল। গ্রামের সর্বশেষ একটা জমি বিক্রির নিজের অংশের টাকাটা বুঝে পেয়েছে। নগদ পাঁচ লাখ।
আগের দিন রাত এগারটা। নিপু নিজেকে আবিষ্কার করে রমনা পার্কের একটা বেঞ্চিতে। নতুন জামা কাপড়ের সঙ্গে পকেটে নিজের ফোনটাও পায়। আর পায় টাকাভর্তি দুটো খাম। উবারে করে ফিরে আসে ধানমণ্ডিতে নিজের ভাড়া করা রুমটায়। পকেটে একটা কার্ডও পেয়েছে। একপাশে লেখা ‘সাপলুডু : ১০ লাখ টাকা’। আরেক পাশে একটা নম্বর। বাসায় ঢুকে সে রাতেই অনলাইুেন ভিঞ্চি গ্রুপ লিখে সার্চ করে দেখল কোনো খবর আছে কিনা। না, ব্যবসায়ী দীপঙ্করের কোনো খবর কোথাও নেই। চোখ আটকে গেল একটা ছবিতে। শিরোনামে লেখা ‘গুলশানে ছাদ থেকে লাফিয়ে বৃদ্ধার আত্মহত্যা’।
রাত সাড়ে বারোটা। নুসরাত নিজেকে আবিষ্কার করল একটা দামি বারের সামনে থাকা যাত্রী ছাউনিতে। পরনের আঁটসাট পোশাকটাকে বেশ অস্বস্তিকর লাগছে। তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে কয়েকটা কিশোর। পাশে এক মধ্যবয়সী নারীকে দেখে হাঁফ ছাড়ল।
‘আফা কই যাইবেন? রিকশা ডাইকা দিমু?’
‘হ্যাঁ.. প্লিজ।’
পার্স হাতড়ে দেখল ভেতরে অনেক টাকা। ঘোর লাগা চোখে সেখান থেকে একতাড়া নোট এগিয়ে দিল অপেক্ষমান দর্শকদের দিকে।
রিকশায় নিজের ফ্ল্যাটে ফিরতে কোনো সমস্যাই হলো না। চাবি ছিল পার্সে। নিশ্চিন্তেই ঘরে ঢুকল নুসরাত। কারণ কেউ তার অপেক্ষায় ছিল না। পার্সে গোছানো টাকাগুলো দেখে চকিতে বুঝে নিল আগামী ছ-সাত মাস আর খদ্দেরের দরকার হবে না তার। টাকার বান্ডিলের পাশে থাকা কার্ডটা নিয়ে ভাবল না আপাতত।
কাওরানবাজারে মধ্যরাতের চেঁচামেচিতে ঘুম ভাঙে মন্টুর। এবারও কোমরে হাত গেল। অস্ত্রটা না থাকায় স্বস্তিই পেল। রাস্তায় যেভাবে পড়েছিল তাতে করে সাথে অস্ত্র থাকলে বিপদেই পড়তে হতো। গা থেকে ময়লা চটের বস্তা সরাতে গিয়েও সরাল না। তাতে পথচারী আর আড়তের লোকজনের চোখে টাকার বান্ডিলগুলো ধরা পড়ে যাবে। বস্তাটা আবার গায়ে চাপিয়ে ঘুমের ভান করে পড়ে রইল মন্টু। কার্ডটা হাতে নিয়ে নম্বরটা দেখে যথারীতি হেসে উঠল আপন ভঙ্গিতে।