class="post-template-default single single-post postid-48700 single-format-standard wp-custom-logo group-blog vl-boxed aa-prefix-matin-">
Shadow

গল্প : ড্রাইভার

গল্প : ড্রাইভার : লিখেছেন ধ্রুব নীল

গল্প ড্রাইভার

কারওয়ান বাজারের মুন্সি টি স্টলে চিনি কম চায়ে চুমুক দিতে দিতে হঠাৎ সলিম ড্রাইভারের মাথায় এলো ‘সে সলিম ড্রাইভার হইলো কেন?’ মানে সলিম ড্রাইভারই কেন গাবতলী রুটের সলিম ড্রাইভার হলো। রাস্তা দিয়ে একটু আগে যে বড়লোকের মেয়েটা দমাদম চলে গেল, সলিম মিয়া তো তার ভেতরেও থাকতে পারতো। যার শরীরের দিকে চোখ ড্যাবড্যাব করে চায়ের কাপ হাতে তাকিয়ে থাকত অন্য আরেক সলিম ড্রাইভার। কিন্তু তা হয় নাই।
এ নিয়ে অবশ্য সলিম ড্রাইভারের আফসোস নাই। সে ভাবছে, ‘সে হইল সলিমের ড্রাইভার। ওই মাইয়াটা তো আর সলিম ড্রাইভার হওনের মজা বুঝতাসে না।’
‘বাড়ি গেসিলা?’
মুন্সির প্রশ্নের উত্তরে কোণাকুনি মাথা ঝাঁকালো সলিম। যেন সে গেছে আবার যায়নি। এটা নিয়েও সলিমের চিন্তার শেষ নাই। একসঙ্গে দুটো জিনিস বিশ্বাস করারও মজা আছে। সে যে দুটো জিনিস বিশ্বাস করে তা হচ্ছে, ‘সলিম ড্রাইভার দুই কিসিমের আদমি। এক সলিম ড্রাইভার গাড়ি চালায়, সংসার চালায়, পেসেঞ্জারের গালি শোনে, বউয়ের গালি শোনে, পোলারাও মনে মনে গাল পাড়ে; আর আরেক সলিম ড্রাইভার শরীরটারে চালায় আর কানাগলির গালি শোনে।’
‘আরেকটা সিগারেট লও।’
‘ট্রিপ নাই?’
‘আছে, এহন না, রাইতে। নিশি রাইতে।’
‘মারফতি কতা রাহ। বাড়িত যাওগিন। আর আমার নাতিটারে লইয়া আইবা।’
মুন্সির ভেতরেও মাঝে মাঝে সলিম ড্রাইভার ঢুকে পড়ে। কিন্তু সুবিধে করতে পারে না। লোকটাকে তার পাগল টাইপের মনে হয়। পাগলের মধ্যে ভাল। সলিম ড্রাইভার নিজেকে এই টাইপ ভাল মনে করে না। সে অনেকটা তার মতো করে ভাল হতে চায়।
আয়েশা বেগমের ভেতর নিজেকে চিন্তা করলে সলিমের নিজেকে বেকুব মনে হয়। বেকুব না হলে কেউ তার মতো মানুষের জন্য রাত দুইটা বাজে গরম ভাত নিয়া বসে থাকবে না। যে মানুষ রাত বারোটার পর থেকে নেড়ি কুত্তার মতো ঘোঁৎ ঘোঁৎ করে শরীর খুঁজে বেড়ায়।

‘ওস্তাদ, কমলা বেগম আইসে। হেহে।’
‘ধুর হালা, তর কাসে হ¹লে কমলা। এহন কি কমলার সিজন?’
‘না ওস্তাদ, বিশ্বাস না নিলে চলেন।’
‘অহন না, আইজকা আমুবস্যা। দেরি কইরা যাই। নইলে চান্দে টান দিব।’
‘ইয়েস স্যার। হেহে। চান্দে টান দিলে টেস নষ্ট হইয়া যাইব।’
সলিম ড্রাইভার মন্টুর দিকে তাকালেন। হুট হাট করে তার কাছে মনে হয় মন্টুর নাম মন্টু না, অন্য কিছু। ‘মাগার ওর নাম ত মন্টুই, যাউকগা, ওর নাম যাই হোক, ও পোলা বালা। ছয় নাম্বার বস্তিতে নয়া মাল আইলে খবর দেয় হ¹লের আগে।’
ছয় নম্বর বস্তির কথা খুব বেশি লোকে জানে না বলেই মনে করে সলিম ড্রাইভার। এমনটা ভেবে মনে মনে বেশ শিহরিত হয় সে। কম লোকে জানে মানেই ব্যাপারটা গোপন। ‘যত বেশি গোপন, তত বেশি সোন্দর, তত রস।’
সলিম ড্রাইভার নিজে নিজে পুলকিত হয় বেশি। অমাবস্যার রাতে আরো বেশি পুলকিত হয়। কারণে অকারণে শিহরিত হতে থাকে। হুট হাট নিজেকে কমলার জায়গায় ভাবে। তাতেও পূলক। গা শিরশির করে। সে যদি কমলা হইতো!
ব্যাপারটা কেমন হতো? অমাবস্যার ঘন অন্ধকারে ছয় নম্বর বস্তির নড়বড়ে একটা দরজার আড়ালে জ্বলতে থাকা কূপি বাতির তেল ফুরিয়ে আসছে। যেকোনও মুহূর্তে কাস্টমারের পা টিপে টিপে আসার আওয়াজ। দ্রুত কয়েকবার পোশাকের যত্রতত্র টানাটানি আর ঘন ঘন ট্যালকম পাউডার…।
‘ওস্তাদ, উডেন। টেহা দেন।’
মন্টুর ধাক্কায় সলিম ড্রাইভার তার নিজের দেহে ফিরে আসে।
‘নে ধর।’
‘দুইশয় হইবো না।’
সলিম ড্রাইভার আরো এক শ বাড়িয়ে ধরে। ও জানে এখান থেকে পঞ্চাশ নেবে মন্টু। সলিম ড্রাইভারের ওপর বাটপারি। কিন্তু মুখে আজ থুথু জমে না তার।
সলিম ড্রাইভারের মতে, ‘এইডারে কয় শিরায় চান্নি।’ হয়তো যার মানে শিরার ভেতর পূর্ণিমা অথবা যার কোনো মানে নেই।

সলিম এগোচ্ছে। সে জানে, ‘যেদিকেই যাই না ক্যান, জায়গামতো আমারে আমার ড্রাইভার লইয়া যাইব।’ সলিম ব্রেক কষলো। গাড়ি এখন ঘড়ঘড় আওয়াজ দিচ্ছে। পেটের ভেতর অদ্ভুত তালগোল পাকানো ধড়পাকড়। কমলার ঘর দেখা যাচ্ছে।
ওটা আসলে কমলার ঘর নয়। কমলা এসেছে বেড়াতে। ক’দিন থাকবে। তারপর অন্য কোথাও যাবে। সলিম ড্রাইভারের আক্ষেপ হয়। তার কমলা হওয়ার সাধ জাগে।

মন্টুর দেখা নেই। দরকারও নেই। সলিম ড্রাইভারের গাড়ি আবার স্টার্ট নিয়েছে। লো গিয়ার। ধীরে ধীরে নিঃশব্দে এগিয়ে যাচ্ছে। দরজায় টোকা দিল। কিন্তু খট খট শব্দ শুনতে পেল না।
দরজার ফাঁক দিয়ে তাকে আগেই দেখেছে কমলা বেগম। দরজা খুলেই হাসলো। সলিম ড্রাইভার বিভ্রান্ত হলো। ভাবলো, ‘এইডা তো আগের সেই হাসি না। সবাই যেমনে হাসে, সেইরম না। এই হাসি আলাদা।’
‘আসো। পান খাইবা?’
‘হ খামু।’
‘ল..।’
‘গাড়ি চালাইছ আইজ?’
‘হ..।’
‘তাইলে আইলা ক্যান.. হিহিহি।’
‘তোমার জন্যে আইসি। তুমি হইলা আমার মাসিডিজ।’
‘লন, পান লন।’
সলিম ড্রাইভার পান নিয়েছে কি নেয়নি বুঝতে পারছে না। ‘বুইঝা কাম নাই। আগে কমলার কাছে গিয়া বইতে অইবো।’
‘আসো এদিক আসো।’

‘ওস্তাদ বইসা বইসা ভাবলে চলবো? বাড়িত যাইবা না?’
মন্টুর দিকে হা করে তাকিয়ে থাকে সলিম। সে ভাবছে কমলা কি সত্যি সত্যি দরজা খুলে পান সাধবে? সলিম ড্রাইভার যদি কমলা হতো তাহলে কী করতো?
কমলার কথা জিজ্ঞেস করতে গিয়েও করলো না। কারণ মন্টু কমলার কথা বলেনি। সে অনেক্ষণ ধরে ঘ্যান ঘ্যান করছে ‘বাড়িত চলো বাড়িত চলো।’
‘তুই যা। রিন্টুর মারে কইস আমি ফিরুম না। খাইয়া দাইয়া ঘুমাই পড়িস।’
‘কই যাইবা?’
সলিম ড্রাইভার কোথায় যাবে জানে না। ছয় নম্বর বস্তি বলেও কিছু নেই। তাই মন্টুর সঙ্গে সেও বাড়ির পথ ধরলো। বাড়িতে অপেক্ষায় আছে আয়শা।
‘গেলবার যে জ্বরের মইদ্যে পড়ছিলাম।’ সলিমের কল্পনা আবার ফার্স্ট গিয়ারে শুরু হয়। গত বছর জ্বরে পড়েছিল একবার। জ্বরের সঙ্গে কাশি। ‘একেক কাশিতে বুকের কইলজা বাইর হয়া পড়তো। আয়েশা তো আর ঘুমাইতে পারে না। আমার ঘুম হারাম, বউটারও। মাতায় পানি ঢালল। পানি চুইয়া পড়ল গলায়। আয়েশা বেগম মুইছা দিল। তহন দেখলাম, বউয়ের আঁচল ছিঁড়া। জ্বরের ঘোরে ছিলাম। আমার মতো ড্রাইভারের বউয়ের আঁচল ছিঁড়া থাকনের কতা না। কিন্তু তাও আমার মেজাজ গরম হয় নাই। কারণ আমি ছিলাম ঘোরের তালে। আমার বারবার মনে হইতাছিল, কোনো কোনো বউয়ের আঁচল এট্টু ছিঁড়া থাকতে পারে।’

 

ধ্রুব নীলের গল্প : তৈয়ব আখন্দের মা

 

সলিম ড্রাইভার উঠে দাঁড়ায়। চারদিক সুনসান। বৃষ্টি বৃষ্টি ভাব। রাত একটায় স্ট্যান্ডে কুকুর বিড়াল ছাড়া কেউ বের হয় না। হাফ হাতার শার্ট ফুঁড়ে শীতও ঢুকছে খুব।
‘আয়েশা কী করতাসে কে জানে।’ সলিম ড্রাইভার এলমেলো ভাবনায় সুখ পায়। কমলার চেহারা মনে করার চেষ্টা করলো না। এখন সে নিজেকে খানিক্ষণের জন্য অন্যরকম ভাবছে। ‘আমি হইলাম ড্রাইভার মানুষ। যহন যেমন গাড়ি, হেইভাবে চালাই।’ এটা সলিম ড্রাইভারের পুরনো দর্শন। এখন সে এমন কিছু ভাবছে না। এখন ভাবছে আয়েশার সঙ্গে বিশেষ কিছু মুহূর্তের কথা। শারীরিক স্মৃতি নয়। ভাবনাগুলো মোহবিষ্ট হয়ে আছে বিয়ের পর প্রথম বর্ষার স্মৃতিতে। রাত্রিযাপন করছিলেন দু’জন। কিন্তু শুয়ে নয়, এদিক ওদিক ছোটাছুটি করে।
আচমকা শিলাবৃষ্টি শুরু হলো। চালে একের পর এক ফুটো হচ্ছে। বিছানা ভিজে চুপচুপা। নিচেও পানি। ঘরের কোনো বালতি খালি নাই। এক কোণে দুজন গুটিসুটি বসে আছে।
সলিম ড্রাইভারের মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে কেউ একজন। সমিতির কেউ হবে। চেহারাটা চেনারও চেষ্টা করছে না। আগন্তুকের হাতে একটা চকচকে ছুরি।

‘সামনে তো কোরবানির ঈদ নাই, তাইলে হাতে ছুরি ক্যান।’ সলিমের ভাবনার উত্তর দিচ্ছে না লোকটা। ঘোর কিছুটা কাটতেই লোকটাকে চিনতে পারল সলিম। সমিতির ক্যাশিয়ার ছিল। চুরি করে ধরাও খেয়েছিল। সে তার কাছে কী চায়। লোকটা রাগি রাগি চোখে হাসছে। এ হাসির কারণে লোকটাকে এখন গরু গরু লাগছে। সলিম ড্রাইভারের খিদে লেগেছে। গরম ভাতের সঙ্গে ঝাল গরুর মাংসের ছবি মোচড় দিচ্ছে পেটে।

…এরপর খাটের কিনারায় আয়েশার পাশে গিয়ে বসে সলিম। এখনও ড্রাইভার হয়নি সে। তাই নিজেকে নয়, আয়েশাকেই ড্রাইভার মনে হয়। বৃষ্টি কমে না। দুজনই ভিজে চুপসে। সলিমের সকাতর দৃষ্টির সঙ্গে আয়েশার প্রেমময় দৃষ্টি বিনিময়ের ফাঁকে পুরনো টিনের চালে আরো একটা ফুটো বেড়ে যায়। আয়েশার কপাল বেয়ে ফোঁটায় ফোঁটায় গড়াচ্ছে পানি। সলিম ড্রাইভার নড়তে চড়তে পারে না। আয়েশা হাসে। একটা হাত সলিম ড্রাইভারের হাতে রাখে। ভরসা দিতে চায়। ‘বউ আমারে মাফ কইরা দিও।’ কথাটা মনে মনে বলে সলিম। মুখে বলার সাহস হয় না। আয়েশা বোধহয় মনে মনে বলা কথাটা শুনতে পায়নি। সলিমের হাত ধরে তাকে কাছে টেনে নেয়। সলিম নড়ে চড়ে না।
ছুরি ধরা লোকটা সলিম ড্রাইভারের খুব কাছে। তার ব্যাপারে সলিম ড্রাইভার ভাবার চেষ্টা করছে না। তার নামটাও মনে করার চেষ্টা করলো না সলিম। ‘নাম জানার দরকার নাই, আগে আয়েশা বিবির কাছে যাওন দরকার।’ ছুরিটা তলপেটের খানিকটা ওপরে ঢুকতেই ভাবনামুক্তি ঘটে সলিমের।

 

রম্য গল্প: হাবুডাস্টিং

 

সামনে হাসপাতালের চুপসে আসা বাতি। সলিম জানে, পেটে ছুরি ঢুকলে হাসপাতালে যেতে হয়। কিন্তু সলিমের ভেতরের ড্রাইভার বারবার ডানে সিগনাল দেখাচ্ছে। ডানে সলিম ড্রাইভারের বাসা। আগের সেই টিনের ছাদ নেই। এখন ইট-সুরকির বাসা। তবু সলিমের মনে হয়, মাঝে মাঝে বাসায় মধ্যরাতে ছাদ ফুটো হয়ে পানি পড়ে। ভাত নিয়ে নিশ্চয়ই অপেক্ষায় আছে আয়েশা। আঁচলটা যথারীতি ছেঁড়া। সলিম নিজেকে বোঝায়, হাসপাতালে গেলে কী হবে তা সে জানে না। জানার জন্য তাকে আগে আয়েশার কাছে যেতে হবে। দূরে হাসপাতালের বাতি আরো চুপসে এসেছে। কিন্তু সলিমের ভেতরের ড্রাইভার তাকে নিয়ে যেতে থাকে ডানের রাস্তা ধরে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Please disable your adblocker or whitelist this site!