শীতের দেশগুলো প্রকৃতির অনেক সৌন্দর্য থেকে বঞ্চিত। ওখানে আমাদের দেশের মতো দিগন্তজোড়া সবুজ নেই। বছরজুড়ে ছয় ঋতুতে তেরো পার্বণের বান ডাকে না সেসব দেশে। কিন্তু ভৌগোলিক অবস্থানের এই সীমাবদ্ধতা তারা কাজে লাগায় অন্যভাবে। তুষারঝরা মৌসুমে যখন পথঘাট সব সাদা হয়ে যায়, তখন তারা বাইরে বের হয়ে মেতে ওঠে উৎসবে। খেলাধুলার পাশাপাশি বরফ দিয়েই তৈরি করে নানা রকম ভাস্কর্য। কোথাও কোথাও বরফের মূর্তি বানানোর প্রতিযোগিতাও হয়। তেমনই বড় চারটি প্রতিযোগিতার কথা জানাচ্ছেন জুবায়ের হোসেন
বিশাল রাজপ্রাসাদটার সামনের চত্বরে দাঁড়িয়ে আছে একটি এক্কাগাড়ি। সামনে দুটি তেজি সাদা ঘোড়া জুড়ে দেওয়া। মনে হচ্ছে শপাৎ করে চাবুক পড়ামাত্র চিহি ডেকে ঘোড়া দুটি দৌড়াতে আরম্ভ করবে। ভালো করে তাকালে বোঝা যায়, ওগুলো আসল নয়। কোনো শিল্পী পরম যতেœ তৈরি করেছেন অপূর্ব এক ভাস্কর্য। তবে এই ভাস্কর্যের গায়ে হাত রাখলে জমে যাওয়ার ভয় আছে। কারণ সেগুলো যে বরফে তৈরি! এমনই একটি ভাস্কর্য স্থান পেয়েছিল এ বছরের হারবিন আন্তর্জাতিক øো স্কাল্পচার ফেস্টিভ্যালে। চীনের হারবিন শহরে ১৯৬৩ সাল থেকে পালিত হচ্ছে এই উৎসবটি। উত্তরপূর্ব চীনে শীতকালে সাইবেরিয়া থেকে বয়ে আসা হিমশীতল হাওয়ায় তাপমাত্রা কখনো মাইনাস ৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসেও নেমে যায়। হাড়কাঁপানো শীতে জমে যাওয়া শংগুয়া নদীর বরফ কেটে ভাস্কর্য গড়তে বসে যান শিল্পীরা। অনুষ্ঠানের সময়কাল ৫ জানুয়ারি থেকে শুরু করে এক মাস। তবে আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে আরো কিছুদিন বাড়ানো হয়। নয়নাভিরাম এক দৃশ্য তৈরি হয় রাতে, যখন স্ফটিকের মতো স্বচ্ছ বরফে আলোর খেলায় পুরো এলাকাটি ঝলমলিয়ে ওঠে। সবচেয়ে বড় বরফ ভাস্কর্যের গিনেস রেকর্ডের মালিকও এই হারবিন ফেস্টিভ্যাল। তেরো হাজার ঘনমিটার বরফ ব্যবহার করে ২৫০ মিটার লম্বা ওই ভাস্কর্য বানানো হয়েছিল ২০০৭ সালে।
কানাডার কুইবেক উইন্টার কার্নিভ্যালের ইতিহাস বহু পুরনো। ক্যাথলিক উৎসব মাগদি গ্রাসের অংশ হিসেবে কুইবেক শহরের লোকজন এখানে-সেখানে বরফ নিয়ে নানা রকম খেলা করত। ১৮৯৪ সালে একটি বরফ প্রাসাদ বানিয়ে প্রথমবারের মতো এটাকে নগরের কেন্দ্রীয় উৎসবে পরিণত করে। তারপর অর্ধশতাব্দী অনিয়মিতভাবে পালন করার পর ১৯৫৫ সাল থেকে এটি প্রতিবছর পালিত হয়ে আসছে। ১৮৯৪ সালের সেই আদি উদ্যাপনের সঙ্গে সংগতি রেখে একটি দুর্গ তৈরি করা এখন রীতিতে পরিণত হয়েছে। দুর্গটি কার্নিভ্যালের সম্মানিত অতিথির জন্য তৈরি করা হয়। আলোকসজ্জিত প্রাসাদের কোণে আবার একটি ছোট জেলখানাও থাকে। উৎসবে আগতরা যারা অতিথিকে যথাযোগ্য সম্মান জানাতে ব্যর্থ হয়, তাদের মজা করে সেই হাজতে পোরা হয়। পঞ্চাশের দশকে দুর্গের পাশাপাশি অন্যান্য ভাস্কর্য তৈরির কথা মাথায় আসে কুইবেকবাসীর। অবশ্য একেক বছর ভাস্কর্য প্রতিযোগিতার রীতিনীতিতে বদল করা হয়। যেমন ১৯৭৩ সালে প্রথমবারের মতো আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি দেওয়ার পর শিল্পীরা চারটি দলে ভাগ হয়ে প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেছিল।
১৯৫০ সালে ছয়জন জাপানি ছাত্র খেলাচ্ছলে ছয়টি বরফ ভাস্কর্য তৈরি করেছিল সাপ্পোরোর ওডোরি পার্কে। জাপানের আÍরা বাহিনীর ঘাঁটি ছিল পার্কের খুব কাছেই। ১৯৫৫ সাল থেকে সৈন্যরাও ছাত্রদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিল। সবার উদোগে সে বছর তৈরি হয়েছিল বিশাল সব ভাস্কর্য। পরে এটাই সাপ্পোরো øো ফেস্টিভ্যাল নামের নিয়মিত উৎসবে পরিণত হয়। সেনাবাহিনী যোগ দেওয়ায় একটি বড় লাভ হলো আয়োজকদের। বরফ দিয়ে হিম ঠাণ্ডায় ভাস্কর্য তৈরি তাদের প্রশিণের অংশ হিসেবে বিবেচিত হতো। তাই যে বছরগুলো তুষারপাত প্রয়োজনের তুলনায় কম হতো, সাপ্পোরো বাইরে থেকে বরফ বয়ে আনার দায়িত্ব ঘাড়ে চাপত সৈন্যদের। ফলে বরফের অভাবে উৎসব বন্ধ রাখার কথা কখনো ভাবতে হয় না সাপ্পোরোর অধিবাসীদের। ১৯৬৫ সাল থেকে শিশুদের জন্য একটি খেলার জায়গা আলাদা করে রাখার চল আরম্ভ হয়। জাপানের সাম্প্রতিক কোনো ঘটনা কিংবা বিখ্যাত কোনো মানুষের প্রতিকৃতি বেশ গুরুত্বের সঙ্গে ভাস্কর্যে রূপ দেওয়া হয়। ১৯৮৩ সাল থেকে আবার যুক্ত হয়েছে সুসুকিনো কুইন অব আইস নামের সুন্দরী প্রতিযোগিতা।
নভেম্বর থেকে মার্চের মাঝামাঝি পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের আলাস্কায় নদী আর হ্রদে যে বরফ জমে সেগুলো প্রাকৃতিক কারণে অস্বাভাবিক রকমের স্বচ্ছ হয়। একসময় বলা হতো আলাস্কার বরফের এমনই গুণ যে চাইলে সাড়ে তিন ফুট পুরু বরফের চাঁইয়ের ভেতর দিয়ে খবরের কাগজও অনায়াসে পড়া যাবে। লোকমুখে এর নামই রটে গিয়েছিল আর্কটিক ডায়মন্ড। অসাধারণ এই বৈশিষ্ট্য বরফশিল্পীদের বরাবরই টেনে নিয়ে গেছে আলাস্কার ফেয়ারব্যাংকসে। ওয়ার্ল্ড আইস আর্ট চ্যাম্পিয়নশিপ নামের আসরে প্রতিবছর ৩০টি দেশ থেকে শতাধিক ভাস্কর যোগ দেন। অন্তত ১০ হাজার পর্যটকের ভিড়ে তখন গমগম করে আলাস্কা। দুই ভাগে প্রতিযোগিতা হয়। সিঙ্গেল ব্লক ক্যাসিকে একটি পাঁচ বাই আট বাই তিন ফুটের বরফখণ্ড ভাস্কর্যে রূপ দিতে দুইজন শিল্পীর দল দুদিন সময় পান। আর মাল্টি ব্লক ক্যাসিকে সময় থাকে পাঁচ দিন। এতে ১২টি খণ্ড দেওয়া হয় চারজনের দলকে। যারা একেবারেই নতুন তাঁরাও আনন্দ থেকে বাদ পড়েন না। প্রতিযোগিতার বাইরে সবার জন্য উš§ুক্ত একটি মঞ্চ হলো ফেয়ারব্যাংকস ওপেন।